অতিমারির ওপারে

- Advertisement -

দেবা রায়

অন্ধকার / দূর থেকে এই গান ভেসে আসছে।

একোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার। একি সূর্য নাকি স্বপনের চিতা একি পাখির কুজন নাকি হাহাকার। এ কোন সকাল…

গানের গতিতে আলোর ফেড ইন

কোলাজ
রণক্লান্ত সময়ের এক বিষণ্ণ সকাল। যেখানে চারপাশে উত্তাপ আর আর মৃত্যুমিছিলের অবিশ্রান্ত চলাফেরা। আবহে কান্নার সুর, শেয়ালের দীর্ঘ ডাক। সভ্যতার সাইরেন সগর্বে ছুটে চলেছে এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। সাদা পোষাকের অপার্থব দানবীয় পোষাকে ওরা শব বয়ে নিয়ে চলেছে।

কাট টু

একটি মহিলা রাজপথ দিয়ে উদাভ্রান্তের মতো কান্না সাথে নিয়ে পিছু নিয়েছে শবযানের দিকে।

সকাল আরও অন্ধকার। সূর্য ক্রমে কালো হয়ে ফুটে উঠছে। তার আলোর স্পর্শ পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করেনা। চিতা জ্বলছে। চিতায় পুরে খাক হচ্ছে সারি সারি শবদেহ। পাখিদের ডাকে হাহাকারের সুর।

ক্যামেরা জুম ইন করে একটি পোড়া গাছের নীচে এসে স্থির হয়।   

এক যুবক। উর্দ্ধপানে আকাশের দিকে মুখ করে বসে আছে।

আবহ মিশ্রণ + দৃশ্যের কোলাজ

পাশ থেকে ভেসে আসে শেয়ালের কান্না। চলমান পৃথিবীর চারপাশের শব্দ তরঙ্গে কান্না ভেসে চলেছে। স্বজন হারার কান্না।
সেই কান্নার গহবর থেকে কারা যেন চিৎকার করে বলছে।

জনতার কোরাস

মাহামারী। অতিমারি। প্যান্ডামিক। ভ্যাকসিন। বুস্টার…

কাট টু যুবকের নির্লিপ্ত মুখ।

সেই শব্দ যুবকের কানে প্রবেশ করে না। সে ভাবে।
যুবকের দিক থেকে ঘুরে ক্যামেরা পথের দিকে অনুসরণ করে।

পাশ দিয়ে যাবার পথে এক তরুন তাকে দেখে ঘুরে দাঁড়ায়।

তরুনের বিগ ক্লোজ/ কৌতুহল মিশ্রিত দৃষ্টি।


তরুণ

কে হে তুমি। আকাশের দিকে তাকিয়ে কেন?


যুবক

( কিছুক্ষণ সময় নিয়ে) ঢেউ গুনছি।


তরুণ

ঢেউ গোনা শেষ হবে না যুবক। এ ঢেউ নাগরিক সভ্যাতার জঠরে। তরঙ্গের মতো আসতেই থাকবে। যখন তারা মনে করবেন ঠিক তখনই। ( প্রস্থান)

যুবক

(সেই তরুণের চলে যাওয়া দেখে। হঠাত পেছন থেকে এক তরুণী এসে দাঁড়ায়।)

তরুণী

যুবক এই পথে এক তরুণ গিয়েছে, তুমি জানো?

যুবক

গিয়েছে। একটু তাড়াতাড়ি হাঁটলেই পেয়ে যাবে।

তরুণী

বেশ।। তা তুমি এখানে কেন? যাবে না তিলক নিতে।

যুবক

কালক্ষয় কোরো না।

তরুণী

হ্যা যাই। (দ্রুত প্রস্থান)

যুবক তাকিয়ে দেখে।
হঠাত অন্য প্রান্ত থেকে এক প্রৌঢ় চাষী।


চাষী

টেরেন কি চালু হয়েছে বাপ?

যুবক

হয়নি এখনও। কেন ট্রেনে করে কোথায় যাবে?

চাষী

শহরে। কাজ না করলি খাব কি? পরিবার খাবে কি?

যুবক

কেন সরকার তো চাল দিচ্ছে।

চাষী

বাল দিচ্ছে। চাষ করি খাবার দিন ছেনায় নে, চাল দেয়া হচ্ছে।

যুবক

তা চাষ ছেড়ে করো কি?

চাষী

ঐ শহরের বাবুদের পুরোনো জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে এসে এখানকার হাটে বিক্কিরি করি।

যুবক

আমি একবার মারিয়া রিলকের কবিতার বই তোমাদের হাটে পেয়েছিলাম। পাঁচটাকায়।

চাষী

সে হতি পারে। কতকিছুই তো পাওয়া যায়। কি হবে বল দিনি। টেরেন কি চালু হবে নে?

যুবক

সেটা নিয়ে চিন্তা করার সময় কারো নেই। এই যে তুমি, ট্রেন চালু হলে যদি শহরে গিয়ে জীবানু ছড়িয়ে আসো! তখন শহরের বাবুদের কী দশা হবে একবার ভেবে ভেবেছো?
 
চাষী

দেখো বাপু জীবানু দেখিও নি। সেই ছোট থেকি জীবানুর সাথি বাস, তারে চেটেপুটে খেয়ে ফেলে তেবি এ আস্তায় নেমিছি। বুঝিছ?

যুবক

জীবানু চেটে পুটে খেয়েছো?

চাষী

তা নয়তো কি, এটা জেবন, না আছে দুবেলা ঠিক মতো খাবার, ভিটে মাটি, এমনকি ইলিকটিরও দেকা নেই। অথেচ শহরে আলো দে সাজায়ে দেছে। দিন না আঁধার বুঝতে লারি।

যুবক

হুম। অত বুঝে কাজ নেই। ঘরে যাও, নয়তো তিলক নিয়ে আসো, ঐ পথে।

চাষী

খেপিছ, আমি তিলক নেবো, ঐ ফোটা পোঁদে ফোটালি পড়ে দেখা যাবে নে কালই টেসে গেলাম। মানষের পেটের ভাত আগে না তিলক আগে এটা বল দিনি।

যুবক

ভালো প্রশ্ন। অবশ্যই ভাত আগে।

চাষী

আছা যাই গো। ঘরে ফিরতি সন্ধ্যে গড়ায়ে যাবে নে। (প্রস্থান)

যুবক

যাও। যাও। (বসে ভাবে)

সেই পথ দিয়ে এক ব্যক্তি দ্রুত ছুটে আসছে।

ব্যক্তি

উড়ে বাবারে, এ বয়সে এসব তিলক টিলক সয় বল?

যুবক

কেন কি হয়েছে।

ব্যাক্তি

সহ্য হয়নি। আমার নাকি বডিতে ইমুনিটি নেই।

যুবক

কাজ নেই, ঘর নেই, জল খেতে হয় কিনে, আর সেই দেশের মানুষের ইমিউনিটি চর্চা। গাধা গাধা, মস্ত গাধা আমরা।

ব্যক্তি

গাধা বললে কারে?

যুবক

আপনাকে না। বাড়ী যান। গিয়ে পুষ্টিকর খাবার খান।

ব্যক্তি

পুষ্টি! আমার ছেলেটা ভিন রাজ্য থেকে ফিরে এসেছে। আর কাজে ফিরে যেতে পারেনি। সেই যে ঘরে বসেছে, বসেইছে। জানো আমার ছেলেকে ঐ যে বিশাল পাইপ দিয়ে কীটনাশকে স্নান করিয়েছে। তাই ওকে জীবানু ধার ঘেসতে পারবে না।
আমি যাই। গেরামে একটা ডাক্তার নেই। কোমড়ের ব্যাথাটা খুব বেড়েছে জানো! যাই তাহলে।

যুবক

মেনে নিয়েছি সব। প্রশ্ন করি না।

ফ্রেম ইন

বয়স্ক(প্রবেশ)

কে বললে প্রশ্ন করি না। আমি করি।

যুবক

আপনি কি মধ্য স্বত্বভোগী?

বয়স্ক

না মদ্য ভোগী। এই জঞ্জালে মদ্যপানই একমাত্র সাহারা। শালা মানুষ জন কি সব অশিক্ষিত হয়ে গেল? এই বলছে থালা বাজাও, বাজালাম, এই বলছে শনিবার হাফ বেরোবে, বেরুলাম না, এই বলছে রবিবার ফুল বন্ধ, তাই সই। এখন আবার সময় ধরেছে।  রাত আটটা থেকে সকাল ছটা। আরো রাত দশটার পর তো মানুষ এমনিতেই ঘুমে ঢলে পড়ে। কে আর বাসার বাইরে থাকে শুনি, জীবানু তাদের কানে কানে কয়েছে যে তারা সে সময়ই বার হবে,  মানুষরে জাপ্টে ধরবে। এ যেন জীবানুর সাথি সরকারের ওঠাবসা। যে জীবানু ঠিক কখন আসপি আর কখন আসপি না, ঠিক বুঝি যেতি পারছে।

যুবক

এতো চাবুক !

বয়স্ক

খাবে নাকি এক ঢোক। জীবানু সুর সুর করে পালাবে। আচ্ছা তোমরা শহরের বাবুগুলো কি মাথামোটা?

যুবক

ঠিক। মেদযুক্ত মস্তিস্ক আর কি করতে পারে। তারা মনে করে তারাই পৃথিবীটাতে বেঁচে থাকবে। ঐ টিকে থাকার থিওরি। একদিকে মাছেদের ধরার জন্য চারা ফেলবে, আর অপর দিকে মাছেদের সংরক্ষণ নিয়ে বড় বড় সেমিনার, বক্তিমা, আর্টিকেল।

বয়স্ক

মাছ ভাজা দে মাল খেতি মন্দ লাগে না। তা তুমি তিলক নিতে গেলে না?

যুবক

না।

বয়স্ক

আমিও না। যারা যাচ্ছে তারা যাচ্ছেই। সারা দেশজুড়ে গাঁড় মারামারির মহামারি লেগেছে।

যুবক

মারামারির মহামারি। বেশ তো।

বয়স্ক

তা নয়তো কি। আমাদের মধ্যে একতা আছে? পাশে থাকা?

যুবক

নেই বলছো? কিন্তু মানুষ তো প্যারালাল সোসাইটি বানিয়ে ফেলেছে। সেখানে বন্ধুত্ব, প্রেম, ওঠাবসা সবই চলছে নিয়মিত। তোমাদের এই ফিজিক্যাল সোসাইটির আর অস্তিত্ব থাকবে না।

বয়স্ক

থাকবে না বলছো।

যুবক

না।

বয়স্ক

তা কি করে সম্ভব?

যুবক

স্পার্ম ব্যাঙ্ক বা সারোগেশন কি তোমার অজানা।

বয়স্ক

আচ্ছা সুর্যটাকে দেখেছো?

যুবক

সেই থেকে তো তাকেই দেখে আসছি।

বয়স্ক

সভ্যতার এই আয়োজন কি শেষ পর্যন্ত টিকবে?

ফ্রেম ইন

শিশুকণ্যা( প্রবেশ)

টিকবে না। গ্লোবাল ওয়ার্মিং একটা কথা আছে। আমি সেদিন দেখেছি। আমরা প্রকৃতিকে নষ্ট করে সভ্যতার বড়াই করছি। পৃথিবীতে যত মানুষ আছে তাদের প্রত্যেকের বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত খাবার প্রকৃতি দিয়েছে। অথচ আজও মানুষ খাবার না খেয়ে থাকে। এটা কেনো? তোমরা কেউ জানো?

বয়স্ক

মাথাটার এক অংশে লোভ নামে একটা পোকা বাস করে, সে ভীষন মারাত্মক এক কীট। সমস্ত কিছু গ্রাস করে।

যুবক

আর এইভাবে গ্রাস করতে করতে একসময় সে নিজেকেও খেয়ে ফেলে।

শিশু

নিজেকে খেয়ে ফেলে?

যুবক

হ্যা। নিজেকে। আর তখনই এই পৃথিবীতে ধ্বংস নেমে আসে। বুঝেছো।

শিশু

বুঝেছি। নিজেকে যদি আমরা ধ্বংস করি তাহলে তো আমরাই বাঁচবো না। আর আমরা না বাঁচলে

(হঠাত মেয়েটির শ্বাস কষ্ট শুরু হয়) আহ, আমার কষ্ট হচ্ছে, তোমাদের কাছে ইনহেলার আছে? আমি ইনহেলার ফেলে এসেছি।

বৃদ্ধ ইনহেলার বার করে। মুখটা পরিস্কার করে ওর মুখে দিয়ে গিয়ে দেখে শেষ। করুন চোখে যুবকের দিকে তাকায়।

যুবক অসহায়। ইনহেলার বার করে শিশুকে দেয়। দেবার পর বলে।


যুবক

আমারও শেষ দুটো পাফ ছিল। অপেক্ষা করছিলাম কখন এই শ্বাসের শেষ হবে।

শিশু কিছুটা সুস্থ। সে বলে
শিশু

তোমাদের শেষ তবে আমায় দিলে যে!


যুবক

তোমাকে রক্ষা করা আমাদের দায়। এগিয়ে চলো। ঐ পথ ধরে। ঐ যে সবুজ। ঐ পথেই তুমি কৃত্তিম স্বাস যন্ত্র ছাড়াই চলবে।

শিশু

তোমরাও চলো।

বৃদ্ধ

আমার সময় হয়েছে। খুব বেশী যাবার শক্তি নেই। ঐ পথ পৌছনোর মতো কৃত্তিম শ্বাস ও নেই। তোমাকেই যেতে হবে একা।

যুবক

হ্যাঁ গো কন্যা তুমি ওই পথেই বেরিয়ে পরো। তোমার কৃত্তিম শ্বাসের সময় মাত্র ছ ঘন্টা। এর মধ্যে তুমি পৌঁছে যাবে।

শিশু

তুমিও যাবে না কাকা?

যুবক

আমার কাছেও আর শ্বাস অবশিষ্ট নেই। তুমি একাই যাও। ঐ দেখো সবুজ তোমায় ডাকছে।

শিশু কান্না কান্না মুখে এগিয়ে চলেছে সবুজের দিকে।

ক্যামেরা ফিরে আসে অপর প্রান্তে।

এদিকে বৃদ্ধ ও যুবক একে একে মৃত্যু মুখে ঢলে পড়ে।

বৃদ্ধ ও যুবকের এস পি শটে দেখা যায় শিশু হেঁটে চলে সবুজের দিকে। সেখনাএই সে মিলিয়ে যায়।

ছবি ফেড আউট

@কপিরাইট দেবা রায়।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -