দুলাল চক্রবর্ত্তী
কোচবিহার অনুভব সংস্থা অতি সম্প্রতি নির্মাণ করেছে নাটক “ঝিন্টি একটা ফুলের নাম”। নাটকটি কোচবিহার রবীন্দ্র ভবনে, অনুভবের রজত জয়ন্তী বর্ষ নাটোৎসবে অভিনীত হয়েছিল। নাটকটি, ডা: শ্রীপর্ণা দত্ত ব্রহ্মের রচনা এবং ডা: অশোক ব্রহ্মের নির্দেশনায় একটি এই সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের উত্থাপন করেছে। সবচেয়ে বড় কথা স্কুলিং অফ আ্যক্টিং এর স্বাভাবিকতা প্রসঙ্গ। একেবারেই স্বাভাবিক স্তর থেকে উঠে আসা সংলাপ ও বাচিক উপস্থাপনা নির্মলতা পূর্ণ। অতীত প্রযোজনাতেও সংস্থার অভিনয় প্রকৃয়া উচ্চকিত উচ্চারণ বর্জিত অন্তর জারিত অনুভুতির স্তর থেকে অনুসৃত হয়ে থাকে। এই মর্মেই নাটকের গল্প মফস্বলি স্বভাব বাদেই সম্পৃক্ত।
কলকাতায় গ্রাম বাংলা থেকে কলেজে পড়তে আসা গৌরব রায় ছিল একদিন এক মননশীল যুবক। কিন্তু শুরুতেই তাকে র্যাগিংয়ের শিকার হতে হয়েছিল। এর মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া তার মনে র্যাগিং করার প্রবণতাকে উসকে দিয়েছিল। সে এভাবেই পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীবদ্ধ যুবক ছেলেদের হিংসাত্মক তৎপরতায় সামিল হয়েছিল। যার পরিণতি মারাত্মক হয়েছিল। তাদের সংঘটিত র্যাগিংয়ের শিকারে নবাগত একটি ছেলে মারা যায়। বিচারে সাজা হয় গৌরবের। এই র্যাগার যুবক গৌরব বিচারে সংশোধনাগারে স্থানান্তরিত হয়। পরবর্তীতে সে যখন ফিরে আসে। দেখে যে তার নিজের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন মুছে গেছে। এই কষ্টকে প্রোথিত করার তাগিদেই শ্রীমতি পর্ণা দত্ত ব্রহ্ম, র্যাগিং পরবর্তী পরিস্থিতিতে, যে কোন র্যাগার যুবকদের বাস্তব পরিস্থিতির চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন। সাধারণত বাস্তবে, র্যাগিং এর শিকার হওয়া ছেলেটার কথাই বেশি বলা হয়। কিন্তু ভিক্টিম ক্রিমিনাল র্যাগারদের মন মনস্তাপ, অনুশোচনা এবং মনস্তত্ত্ব কেন্দ্রীক ও সমাজের আভ্যন্তরীণ কাঠামো ইত্যাদিতে তার প্রভাব চমৎকার ভাবে নাটকে উঠে এসেছে। বাস্তবে নেপথ্যে সংযুক্ত থাকা আর্তনাদ কমই আলোচিত হয়। যে র্যাগিং করেছে, সেই পরিবারে চেনা যুবক মননের অকাল মরনে সংসার কোন পীড়ন সহ্য করে? সমাজ এই পরিবারকে কীভাবে ধিকৃত করে? পরিবারের আত্মীয় স্বজনরা কেমন প্রতিক্রিয়ায় ক্রমে শত্রুবৎ হয়ে যায়? গৌরবের একান্তের সান্নিধ্যে, কোলে পীঠে মানুষ হওয়া ভাইঝি পুতুল বা ঝিন্টি কেন বারে বারে কাঁদে? সে-সব নিয়েই এই নাটকের সবকথাই না বলা কথার অন্তিম উচ্চারণ।

নাটক বলতে পারে নি, গৌরব কেন অন্তর ধিক্কারে, আত্ম তিরস্কারে নিখোঁজ হয়ে কোন অতলান্ত পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব মেলায়। কিন্তু এক বিচ্ছিন্নতা বিয়োগে, আত্ম নিয়োগ করে নিজের জবানবন্দিতে সে এই হতে না চাওয়া সিস্টেম আভ্যন্তরীণ কাঠামোর অনুসরণ কোন অভিঘাতী তাড়না বটে। তার কথা আলাপিত সংলাপে, ঘটনার প্রকাশে, এ নাটকে উঠে এসেছে। বস্তুত আমার দেখা সামান্য অভিজ্ঞতায় অনুভব প্রযোজনা ক্রাইসিসকে উচ্চকিত না করে, তার অতলের ধ্বনি প্রতিধ্বনিগুলিকে নির্মল নম্রতায় আলোচিত করে মাত্র। যেহেতু সার্থক চিকিৎসক দম্পতির দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারার কোমল স্তরে থিয়েটার শব্দটা অন্য সব প্রচলিত নাটকের ঘরানা থেকে একেবারেই আলাদা মানে সংজ্ঞায়িত প্রজ্ঞায় ধরা আছে। যার সাথে অন্য নাটকের চলন মেলে না। অবশ্যই এই প্রয়োগ পদ্ধতি দর্শক মননে কার্যকরী অনুরণন। তাই বিষয় নিরিখের গুরুত্বে, সমগ্র উত্তর বঙ্গ জুড়ে এমন নাটকের বহুল মঞ্চায়ন কাম্য।
গৌরবের বাবা, বিপ্লব চরিত্রে মলয় কান্তি ঘোষ, মা, বসুধা চরিত্রে শ্রীপর্ণা দত্ত ব্রহ্ম, ভাইঝি পুতুলের ভূমিকায় স্নেহাশ্রী ভৌমিক, পিসিমা শুক্লা চরিত্রে শ্যামশ্রী চক্রবর্তী এবং র্যাগিংয়ে মারা যাওয়া হতদরিদ্র নিঃস্ব নিঃসঙ্গ বাবা নৃপেন চরিত্রে সজল চন্দ খুব ভাল অভিনয় করেছেন। এছাড়া পুতুল ঘনিষ্ঠ তমোঘ্ন, একটি এই সময়ের এন জি ও যুক্ত সংবেদনশীল যুবকের ভূমিকায় কিছুটা আড়ষ্ট হলেও অনুরাগ সরকার ফ্যান্টাস্টিক সংযোগ। একইভাবে সামান্য উপস্থিতিতে দেবলীনার চরিত্রে অনিন্দিতা ধর সাবলীল। খুবই ভাল লেগেছে গৌরব চরিত্রে দেবায়ন চক্রবর্তীর সার্বিক ভুমিকা। অনবদ্য এই উপস্থিতি। তবে প্রায় সকলেই একটু বেশি হাত নেড়ে অভিনয় করেছেন। এই প্রবণতা নাটকের অন্তর্লীন সংবাদ প্রকাশের অন্তরায় হচ্ছে। এছাড়া বলার কথা, নানা পরিস্থিতিতে, এতো বেশি না কেঁদেও যে যন্ত্রণা, সমবেদনা বা আর্তি আর্তনাদ করা যায়। সে-ই অভিনয় প্রকরণ এই নাটকে অত্যন্ত জরুরী। নিস্তব্ধতার শক্তি এই ধরনের নাটকের অন্যতম বিশেষ প্রয়োগ হলে কেমন হয়,তাও ভাবা যেতে পারে। আবহ কিছুটা বেশি। এক ক্রিমিনাল যদি পরিবারে জন্ম নেয়, সেই শুভ পারিবারিক বাতাবরণে ধিক্কারের জ্বালা পোড়া থাকে বিশেষ বিশিষ্ট আবহের ঝলকে হঠাৎ চিৎকারের মতো। আলো মঞ্চ বেশ কল্পনাকে উসকে মনের আলপনায় বিষাদ কাল রচনা করছে। নাটকের সার্বিক সঞ্চালনা, পরিকল্পনা এবং নির্দেশনায় আছেন ডা: অশোক ব্রহ্ম। নাটকে, তাঁর নিজের বাস্তব চিকিৎসক ভুমিকাটির পুনরাবৃত্তি করেই, তিনি যেন, মমতা, স্নেহ, ভালবাসা, সংযম, সহনশীলতা ইত্যাদির মিষ্টতা,অজান্তেই এই প্রযোজনায় উল্লেখ করে ফেলেছেন। মঞ্চের ভাবনায় দেবায়ন অনুরাগ ও রূপমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আবহে প্রলয় চক্রবর্তী এবং আলোতে পঙ্কজ মৈত্র আরও কিছু করতে পারেন। এমনিতে মন্দ নয়। তবুও উদ্ভাবন জারি থাকুক। রূপসজ্জায় সুব্রত সরকার এবং কারিগরি সহায়তায় ও প্রোজেক্টর সঞ্চালনে বিকাশ চন্দ্র সরকার যথাযথ। সব মিলিয়ে একেবারে ভিন্ন স্বাদের এবং ভিন্ন বিষয়ের এই ঝিন্টি একটা ফুলের নাম মায়া বিস্তার করে দর্শক মননে।