‘অলীক কুনাট্য রঙ্গে, মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে’!

- Advertisement -

ড. শুভ জোয়ারদার

‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়’। মিথ হয়ে যাওয়া নাট্যগীতের এটি একটি প্রথম চরণ। এটিও সত্যি যে, আমাদের থিয়েটার আর আগের মতো নেই। তার উদ্দেশ্য বিধেয় প্রেক্ষাপট আভ্যন্তরীণ অভিঘাতগুলি বিলকুল বদলিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও সেটা শুধু লক্ষ্যচ্যুতই নয়, বিপ্রতীপ কোণে পাকাপাকিভাবে থিতু। কেন এমন হলো?

আমার মনে হয়ঃ আজকের এই পরিবর্তিত থিয়েটার যতটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা গ্রুপকেন্দ্রিক, তার পাঁচ শতাংশও সমাজকেন্দ্রিক নয়। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সমাজ-আন্দোলন আর থিয়েটার-আন্দোলনের যুগলবন্দীতে আমরা শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের যাপনচর্চাকে সম্মান জানিয়ে পথচলা শুরু করলেও, আজ প্রশ্ন উঠেছেঃ স্থিরিকৃত সেই লক্ষ্যবিন্দুর নিরিখে আমরা ঠিক কতটা বিশ্বাসযোগ্য এবং নিবেদিতপ্রাণ? আমাদের থিয়োরি আর প্র্যাকটিশের মধ্যে থাকা যোজন যোজন ফাঁক ও ফাঁকির পঙ্কে নিমজ্জিত আমরা। সমকালের শহুরে বাতানুকূল থিয়েটার আর গ্রামীণ আটপৌরে নাট্যচর্চার মধ্যেও বোধে বিশ্বাসে বিস্তর তফাৎ। যার অর্থ হলোঃ অতীতের শৃংখলাকে তাকে তুলে রেখে, বর্তমানে আমরা লক্ষ্যহীন, শতধাবিভক্ত, পরস্পর পরস্পরের প্রতিযোগী হয়েছি, নানা বিচিত্র-বৈপরীত্যে। সব মিলিয়ে আমাদের আজকের থিয়েটারের প্রামাণ্য ছবিটি যথেষ্ট জগাখিচুড়িময় ও স্ববিরোধিতার টেনশনে টইটম্বুর !

আমার মনে হয়, নাট্যকর্মীদের পারস্পরিক মতবিনিময়, আন্তরিক যুক্তি তর্ক আর আলোচনার মধ্যেই নিহিত আছে আমাদের যাবতীয় আগামী থিয়েটার চর্চার বিজ্ঞানময় দিশা। এই বিষয়ে নিশ্চয় অনেকের মনে নানা প্রশ্ন আছে। সেটিই সঙ্গত। আমারও মনে আছে কিছু জিজ্ঞাসা। সেগুলি এখানে রাখলাম। আপনারাও আপনাদের প্রশ্নগুলিকে রাখুন। নীরস পান্ডিত্য আর তাত্ত্বিক কচকচিকে একপাশে সরিয়ে রেখে আসুন আমাদের খোলামনের আলোচনায় আমাদের থিয়েটারের পালে আবার লাগুক দক্ষিণা

হাওয়া। আমরা সচেতন মনে দোষত্রুটি শুধরে নিয়ে শুরু করি ফের মানুষের থিয়েটার !

থিয়েটারকর্মিদের কাছে মতবিনিময়ের জন্য কিছু জরুরি প্রশ্ন—

১) আমাদের বর্তমান থিয়েটারচর্চার আঙ্গিকটি মাত্র ২০০ বছরের, ইংরাজি শিক্ষিত ‘বাবু-কালচার’এর অনুকরণ করে। যদিও আমাদের আছে একটি কমবেশি ৩০০০ বছরের ঐতিহ্যময় নাট্যইতিহাস। থিয়েটারকে বর্তমান দশা থেকে মুক্ত করতে আমাদের আরো একটু নিজস্ব দেশজ ইতিহাসের দিকে নজর দেওয়া জরুরি নয় কি ?

২) বাবুদের থিয়েটার- সখের থিয়েটার- পেশাদারী থিয়েটারের পর আমাদের থিয়েটারে প্রথম রদবদল ঘটে গত শতকে ৪০এর দশকের মাঝামাঝি গণনাট্য কালে। সামন্তবাদী জমিদার-সংস্কৃতির বাগানবাড়ি বাতিল করে সেই প্রথম বাংলা-থিয়েটারের শিকড়ের কাছে আসা। ‘গণনাট্য’ধর্মী সেই থিয়েটার আন্দোলনের নেপথ্যে ছিল তৎকালীন বাম রাজনৈতিক দলগুলির প্রকাশ্য সমর্থন। পরবর্তীকালে দলগুলির নিজেদের মধ্যে যতো দূরত্ব বেড়েছে, আমাদের থিয়েটারও ততো গণনাট্য, গ্রুপথিয়েটার, নবনাট্য, প্রসেনিয়াম,ওয়ানওয়াল,থার্ড থিয়েটার ইত্যাদি নানান তত্ত্ব আর প্রয়োগের পরীক্ষানিরীক্ষার পর অবশেষে আজ করপোরেট পুঁজি এবং সরকারি অনুদান লিপ্সায় নিছক বিনোদনচর্চায় রূপান্তরিত। প্রকৃত আইডেনটিটি ক্রাইসিসের তাবৎ চিহ্নাদি প্রকট তার সারা গায়ে। প্রশ্ন হলোঃ থিয়েটার যদি সমসময়ের প্রতিবাদের দলিল হয়,তাহলে আজকের রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিপন্নতা ও সার্বিক সামাজিক মূল্যবোধহীনতা বা পণ্যসর্বস্যতার প্রতিফলন কই সমকালীন নাট্যচর্চাতে ? এই আদর্শহীন, উদ্দ্যেশ্যহীন থিয়েটারচর্চায় আর কতোদিন নিয়োজিত থাকবো আমরা ?

৩) ভারতীয় নাটক গ্রিক নাটকেরও আগে। যাযাবর আর্যরা এদেশে ভাগ্যান্বেষণে আসে ৫০০০ বছর আগে। তার আগে এদেশে,বিশেষ করে পূর্বভারতের ‘গঙ্গারিড’ অঞ্চলে সুসংহত দ্রাবিড়/অস্ট্রোমোঙ্গলীয় জাতির আপন সংস্কৃতির ধারাতে নাট্যচর্চা ছিল। তবে তা ছিল মূলত লোকনাটক। নাট্যগবেষকদের অনুমান, এই লোকনাটকই গঙ্গারিডের অধিবাসী বণিক ও নাবিকদের মাধ্যমে পূর্বভারতের তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে, অন্যান্য বিকিকিনি দ্রব্য—রেশম, তামাধাতু, গন্ধদ্রব্য, মশলাপাতি, কারুশিল্প ইত্যাদির সঙ্গে গুজরাটের লোথাল হয়ে প্রথমে মিশর, পরে রোমে পাড়ি দিয়েছিল, পালতোলা জাহাজে চড়ে। মনে করা হয়, গ্রিক নাটকের শুরুয়াৎ হয়েছিলো আজ থেকে ৫০০০ বছর আগে গঙ্গারিডের লোকনাটকের হাত ধরে। যার অর্থ,সারা পৃথিবীর থিয়েটারের উৎস– গ্রিকথিয়েটারই ঋণী ভারতীয় লোকনাটকের কাছে। আমরা যতটা বিদেশীদের থিয়েটার নিয়ে আগ্রহী, ততটাই উৎসুক কী আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক শিকড় – লোকনাটক নিয়ে ? শোনা যায় আন্তর্জাতিক নাট্যব্যক্তিত্ব ব্রেটোর্ল্ড ব্রেক্ষট্ তাঁর বিখ্যাত ‘এলিনিয়েশন’ তত্ত্বের বীজটি পেয়েছিলেন আমাদের লোকনাট্য থেকেই। আমাদের নাটকের ‘প্রস্তরীভূত’দশা কাটাতে আমরা কি অতঃপর একটু শিকড়মুখী হতে পারি না?

৪) নাট্যশাস্ত্র মতে জনশিক্ষার সমাজবোধ আর নান্দনিক বিনোদন— বিমূর্তএই দুটি বস্তুর তৃতীয় রূপান্তরই হলোঃ নাটক। পৃথিবীখ্যাত দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ মাওৎ সেতুং সম্ভবত নাট্যশাস্ত্রের খবর জানতেন না। যদিও তিনিও সমউচ্চারণে বলেন ‘শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি প্রসঙ্গে ইয়েনান ফোরামে’র ভাষণে, সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা ও নান্দনিক মেলবন্ধনের কথা। আমরা থিয়েটারের কর্মিরা ব্রেক্ষট্ পড়ি, স্তানিশ্লাভস্কি পড়ি খুব ভালো কথা, কিন্তু আজ থেকে ৩০০০ বছর আগে লেখা, আমাদের দেশজ উপাদানসমৃদ্ধ গ্রন্থ ‘নাট্যশাস্ত্র’ পড়ি না কেন ? আমাদের থিয়েটারের রাহুমুক্তির জন্য আমাদের আপন তত্ত্ব ও প্রয়োগের সূত্রগুলিকে আত্মস্থ করা কি জরুরি নয় ? মনে রাখা দরকার, তিলোত্তমাশিল্প নাটকের নানা বিভাগ নিয়ে সারা দুনিয়ায় নানা ভাষায় অগণিত বই লেখা হলেও ‘নাট্যশাস্ত্র’ই অদ্যাবধি একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রন্থ। তাই তাহা ‘পঞ্চমবেদ’ !

আসুন খোঁজাখুঁজি করি। স্থাপন করি একটি আন্তরিক আলোচনার পরিবেশ। নিজেদের বোধবুদ্ধি মতো চেষ্টাকরি একটি প্রয়োজনীয় ঐক্যমতে পৌঁছোবার। তাতে আমাদের কি হবে তা জানিনা, তবে ঠিকঠিক বিষয়গুলি ধরতে পারলে, আপাত বদ্ধজলার মতো আমাদের থিয়েটার ক্ষেত্রটি যে পুনরায় গতিমতী হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা সবাইকে ।

লেখক ড. শুভ জোয়ারদার, ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার প্রবীণ স্নাতক/ পরিচালকঃ বঙ্গপুতুল পাপেট প্যাশন। খুব শীঘ্র তাঁর কলমে নিয়মিত লেখা পাবেন আমাদের এই বাংলা নাটক ডট ইন।  

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -