আড়ালের রাজনীতি ও সত্যজিৎ রায়

- Advertisement -

সুব্রত রায়

ইতিহাসের অপার কৌতুক যে সত্যজিৎ রায়ের “জনঅরণ্য”র নায়ক সোমনাথ ইতিহাসের ছাত্র ছিল। সত্তরের দশকের প্রখ্যাত লোডশেডিং তার ডিগ্রিটাকে যে অবান্তর করে দেয় তা আমার মনে হয় সত্যজিৎ রায়ের কাছে এক চূড়ান্ত রাজনৈতিক বক্তব্য। যে অপু ষাট দশকের শুরুতে অধ্যক্ষের ঘরের বাইরে ছাত্র আন্দোলনের শ্লোগান শুনেছিল সে আজ দেখতে পায় দেওয়াল-লেখায় মাও সে-তুঙ এর স্টেনসিল কিভাবে এশিয়ার মুক্তিসূর্য ইন্দিরা গান্ধিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এরকম স্মৃতি মনে আসলে সত্যিই অনুতাপ হয়, কেন যে সাবেকি ঘরানার চিন্তার দাপটে আমরা সুকুমার তনয়কে অরাজনৈতিক ভেবে বসলাম। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি তিনি এক মহান মানবতাবাদী,রোজকার রাজনীতির রোজনামচায় যাঁর দেখা মেলে না। যেন যুধিষ্ঠিরের রথ ভূমি স্পর্শ করে না।অথচ খবরের কাগজের পাতায় বামপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁর নাম উৎকীর্ণদেখেছি প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার আগে। আর আজ স্পস্টই দেখতে পায় কলকাতা শহরে পা দিয়ে কিশোর অপু অথবা রাজমুকুট ত্যাগের পরমুহূর্তে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ একধরনের রাজনৈতিক মন্তব্য হিসাবেই কাজ করে যেতে পারেন।

আমাদের প্রশ্ন সুতরাং—- সত্যজিৎ রায় কে? তিনি কি শুধুই এমন একজন শিল্পী যিনি বাস্তবের আকার বদলে দেওয়ার পক্ষপাতী নন আর শব্দকে ইমেজে ভাষান্তরিত করাই যাঁর একমাত্র লক্ষ্য।আমার মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে একধরনের রাজনৈতিক দোলাচল ধারন করে আছে, যাঁর সূচনা বিখ্যাত উনিশ-শতকীয় আলোকপ্রাপ্তির মধ্যেই নিহিত। “চারুলতা” ছবিতে ভূপতি স্ত্রীকে একদিন সুরেন বাঁড়ুজ্যের বক্তৃতা বুঝিয়ে দেবে বলে। “চারুলতা”সেসব না বুঝেও “স্বর্ণলতা” পড়ে বা শৈশবস্মৃতি লিপিবদ্ধ করে। যে ঔপনিবেশিক বুদ্ধিজীবী তার মুখপত্রে “সত্য একদিন জয়ী হবেই “সে বুঝতে পারে না অন্দরমহলে জলবায়ু অন্যরকম।সদর ও অন্দরে ইংরেজি ও ভার্নাকুলারের দ্বন্দ্ব যে শেষ পর্যন্ত আমাদের আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় একটি প্রাথমিক স্তর সেই সত্য এখানে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করা যাচ্ছে। কিন্তু ষাটের দশকে আমরা তা খেয়াল করিনি। বদলে ভেবেছি “নষ্টনীড়”থেকে “চারুলতা”কতটা আলাদা,সত্যজিৎ কতটা রবীন্দ্রানুগত, এইসব গৌণ প্রসঙ্গ।যে গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার ৬২ বছর পরে সত্যজিৎ রায় কাহিনীটিকে অবলম্বন করে ইতিহাসের পুনরায় আলোচনা চাইছেন।

এই একই ভাবে প্রশ্ন করা যায়, যে অপূর্ব কুমার রায় গ্লোব হাতে ও বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রতি প্রবল শ্রদ্ধা বহন করে পটুয়াটোলার মুদ্রণালয়ে “গুটেনবার্গ” ছায়াপথ আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি মাত্র ১২ বছর বাদে কেন সিদ্ধার্থ হিসাবে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সন্দেহ নেই সত্যজিতের “নাগরিক” তখনও ভিয়েতনাম যুদ্ধকে মানুষের চন্দ্রাবতরণের তুলনায় বেশি দাম দেয়। কিন্তু অপূর্বকুমার রায়ের মধ্যে যে ধার্মিক, নাগরিকতাবোধ ছিল, যা উনিশ শতকে আমাদের মনে করিয়েছিল যে শহরের নবনির্মাণ, জ্ঞানের বিস্তার-এ পথেই আমাদের ক্রমমুক্তি হবে তা সিদ্ধার্থ চৌধুরীর মধ্যে কিছুটা সন্দিগ্ধ রূপ নিয়েছে। সে নারীর স্তন থেকে সামাজিক ত্রাণ পর্যন্ত সব কিছুতেই সন্দেহের ছায়াপাত টেনে আনে। সিদ্ধার্থ বেশ অসহায়। একইরকম দ্বিধাপীড়িত শ্যামলেন্দুকে আমরা আবিষ্কার করেছি দামি এপার্টমেন্টে সকালবেলায়। আর “জনঅরণ্য”তে সোমনাথ মেয়েমানুষের খোঁজে নৈশ অভিযান শুরু করলে আমরা সকলেই বুঝি, “নগরীর মহৎ রাত্রি’’কে তাঁর মনে হয় লিবিয়ার জঙ্গলের মতো। “জরুরি’’ অবস্থায়, শ্বাসরোধকারী আবহাওয়ায় সত্যজিৎ রায় একটু তিক্ত “না” উচ্চারণ করে জাতিকে কৃতজ্ঞ রাখলেন।

তাঁকে একটি শিশুর চোখ দিয়ে ইতিহাসকে দেখতে হয়, যেভাবে “পথের পাঁচালী”-তে অপু আখ্যানের পক্ষে এক নিরপেক্ষ অবস্থান, যেভাবে দাবাড়ুর অন্তিম ব্যক্তিও বাইরে থেকে ইতিহাসকে বিচার করে। পিকু যেমন নির্জ্ঞান থেকে যৌনতার সংকটকে দেখতে পায়, সত্যজিৎ রায় নিজের সীমানার বাইরে থেকে উনিশ-শতকীয় উত্থান ও শেষে বিশ শতকের ডানাভাঙা জটায়ু কে দেখতে পান; উল্লাস ও তিক্ততা  যুগপৎ তাকে ঘিরে ধরে। আমার বিবেচনায় তিনি মোটেও উদাসীন নন বরং অতিরিক্ত সংরক্ত। অপু কেন নিশ্চিন্দিপুরে ফিরলো না-প্রবল শ্রদ্ধা সত্বেও সত্যজিৎ রায়ের নির্মাণের প্রতি ঋত্বিক ঘটকের এই জিজ্ঞাসা ছিল। কেননা ঋত্বিক বারে বারেই নির্দেশের ভুল হয়ে গেছে ভেবে তাঁর ছবিতে ইতিহাসকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছেন স্থিরতর উৎসবিন্দুতে। অপরদিকে, আমাদের তথাকথিত নবজাগরণ সত্যজিতের মধ্যে ছড়িয়ে ছিল রৈখিক প্রগতি ভাবনার বীজ। যতক্ষণ পর্যন্ত সত্যজিৎ রায় এই দ্বন্দ্ব এবং দোলাচলের প্রতি বিশ্বস্ত, ততক্ষণ পর্যন্ত উত্তরকালকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধানম্র থাকতেই হবে কেননা কোনোরকম দার্শনিক আনুগত্য ছাড়াই তিনি সামাজিক দায় মেনে নিয়েছিলেন আর নিজের যন্ত্রনা ও উল্লাস গোপন রাখেননি সত্যজিৎ রায়ের রাজনৈতিক দর্শনের যদি ব্যর্থতা থেকেও থাকে তা উনিশ-শতকীয় মানবতাবাদের একদেশদর্শীতারই পরিণাম। সমস্যা তৈরি হলো তাঁর শেষ তিনটি ছবিতে। যখন তিনি ভাবতে শুরু করলেন আপ্তবাক্য বিতরণ শিল্পীর কাজ যিনি “অপরাজিত”, “প্রতিদ্বন্দ্বী”র জনয়িতা তিনি “গণশত্রু” বা “শাখাপ্রশাখা”র মতো সরল পাটিগণিত কষতে বসলে বাজার চালু রাজনীতি খুশি হয়। কিন্তু শিল্পের সত্যি ক্রমশই ম্লান হয়ে পরে। এক জানা অবস্থান থেকেই সত্যজিতের “আগন্তুক” যাবতীয় মন্তব্য করে। তাঁর রাজনীতিতে এত অনায়াস সমাধান প্রত্যাশিত ছিল না তবু তাঁর সৃষ্টি আজ উন্মুক্ত। আমরা সেখানে একটি দেখার চোখ খুঁজে পাই যাকে রাজনৈতিক না হল বলা সত্যের অপলাপ।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -