Wednesday, June 11, 2025
Wednesday, June 11, 2025
Homeসিনেমাআভিজাত্যের রূপকথা: দেবকী কুমার বসু

আভিজাত্যের রূপকথা: দেবকী কুমার বসু

সুব্রত রায়  

সে একটা সময় ছিল যখন ভারত তথা বাংলা চলচ্চিত্র পৌরাণিক বৃত্ত থেকে সরে এসে আস্তে আস্তে সামাজিক গল্প উপন্যাস নিয়ে ছবি তৈরি শুরু করলো, প্রকৃত শিল্পমনস্ক বীরেন্দ্র নাথ সরকারের “নিউ থিয়েটার্স” নামক প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায়। সিনেমা তখন থেকেই বাঙালির কাছে বই বলে পরিচিত হল। সময়টা মনে রাখতে হবে ৩০-এর দশক, যখন নিউ থিয়েটার্স তাঁর  সৃষ্টিশীলতার চরম শিখরে উন্নীত হয়েছিল। তৈরি হলো “চণ্ডীদাস” (১৯৩২) সালে। এ কথা একজন বাঙালি হিসাবে আমার বলতে অত্যন্ত গর্ব হচ্ছে যে, ভারতীয় চলচিত্রকারদের মধ্যে তিনিই চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক প্রথম জ্যোতিষ্ক। যাঁর পরিচালিত “সীতা” ১৯৩৫ সালেই ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়ে “সার্টিফিকেট অফ মেরিট” পায়। যিনি ভারতীয় পরিচালকদের মধ্যে প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তিনি আর কেউ নন একমেদ্বিতীয়ম দেবকী কুমার বসু।

কুড়ির দশকের শেষের দিকে কলকাতা শহরে সে যুগের একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় দেখলেন একটি ভদ্রঘরের ছেলে গামছা বিক্রি করছে। ধীরেন্দ্রনাথের অবাক বিস্ময়ের উত্তরে ছেলেটি তাঁকে জানালো যে, গান্ধীজীর মতাদর্শে দীক্ষিত হয়েই তিনি স্বদেশী গামছা বিক্রির সামান্য জীবন বেছে নিয়েছেন। আসলে তিনি এক সম্পন্ন ভূস্বামীর ছেলে। ধীরেন্দ্রনাথ তাকে নবগঠিত ব্রিটিশ ডমিনিয়ন ফিল্ম কোম্পানিতে সুযোগ দিলেন। “ফ্লেম অফ ফ্লেশ” বা কামনার আগুন এই যুবকেরই চিত্রনাট্য। এরপর দেবকীবাবু “পঞ্চশ্বর” ছবিটি পরিচালনা করলেন ইনিই বাংলায় নিজস্বতায় ভাস্বর চলচ্চিত্রকার দেবকী কুমার বসু।

দেবকী বসু বাংলা চলচ্চিত্রে আগমনের ফলে বাংলা ছবির ইতিহাসে নতুনভাবে দিকবদলের সূচনা হল। আমরা ক্রমেই দেখতে পেলাম বাঙালি ভদ্রলোকের সাংস্কৃতিক আইকন হয়ে উঠলেন দেবকী কুমার বসু। শনিবারের চিঠিতে সজনীকান্ত দাসের মন্তব্য আমাদের কাছে অতিশয় উক্তি বলে মনে হয় না। তিনি বলেন,” সেই সময় বাংলার ঘরে ঘরে উচ্চারিত হত তিনটি নাম নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, মোহনবাগান আর দেবকী কুমার বসু। “তিনিই প্রথম মঞ্চানুগ চিত্রকর্ম কে চলচিত্র উপযোগী রূপ দান করেন। প্রমথেস বড়ুয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রথম নির্বাক ছবি “অপরাধী”র কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক ছিলেন দেবকী কুমার বসু। এই ছবিতেও প্রথম অন্তরদৃশ্য কৃত্রিম আলোর সাহায্যে চিত্রগ্রহণ করা হয়। সদ্য প্রতিষ্ঠিত নিউ থিয়েটার্স-এর “চণ্ডীদাস” (১৯৩২) ছবিটি পরিচালনা করার সঙ্গে সঙ্গেই ঐতিহাসিক অবদান এই যে তিনি সময় ও সামাজিক দায় সম্বন্ধে অবহিত প্রথম চলচ্চিত্রকার। তিনি নিজের পত্রিকায় নিম্নবর্গীয় জনসমাজকে “হরিজন” আখ্যা দিয়ে এটুকু বোঝান যে, তথাকথিত অস্পৃশ্য মানুষও দেবতার আত্মীয়। এই ভূমিকাটি মনে রাখলে বোঝা যাবে যে, দেবকী বসুর উমাশশী রানী ধোপানির চরিত্রে এক উজ্জ্বল দৃঢ়তায় রাখেননি, প্রায় পাশাপাশি গুরুত্ব পেয়েছেন চণ্ডীদাস রুপি দুর্গদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো। তাই “রজকিনী প্রেম  নিকষিত হেম কামগন্ধ নাহি তায়”। চন্ডীদাসের এই রচনা এক আলাদা মাত্রা পায় দেবকী বসুর চলচ্চিত্রে। জাতপাতের তুচ্ছ সীমা পার হয়ে দেবকী কুমার বসু চন্ডীদাসের মূল সুর—“সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”—তা মর্মে গেঁথে নিয়েছিলেন সেজন্য তাঁর কাছে আমরা চিরঋণী।

সে যুগের মর্মকথা ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলেন বলেই “চণ্ডীদাস” অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়। এই ছবিটিই ভারতবর্ষের প্রথম ছবি যার সিলভার জুবিলি হয়। এই ছবিতে আবহসঙ্গীতের সুচারু প্রয়োগ আমাদের চলচ্চিত্রে এক বিরল সাফল্য এনে দেয়। এখানে তিনি অপর যে ছবিগুলি নির্মাণ করেন তা হলো “পুরণভগত” (হিন্দি)। শোনা যায় এই ছবিতেই এই ছবির নায়িকাকে এরকম অপাপবিদ্ধ শুদ্ধতা দেওয়া দেবকী বাবুর পক্ষেই সম্ভব। পরে তিনি স্বাধীন ভাবে “আপনা ঘর” (হিন্দি), “মেঘদূত”, “কৃষ্ণলীলা”, “কবি”, “রত্নদ্বীপ”,”, “পথিক”, “চিরকুমার সভা” প্রভৃতি ছবি করেন। শেষ ছবি রবীন্দ্রনাথের চারটি কবিতা অবলম্বনে রচিত ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রযোজিত “অর্ঘ্য”। শুধু বাংলা বা হিন্দি নয়, দেবকী কুমার বসুর অবাধ যাতায়াত ছিল তামিল, মারাঠি, ও উর্দু ভাষায় ছবি নির্মানেও। তিনি ১৯২৮ সালে সাগরসঙ্গমে ছবির জন্য রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক পান। তিনি ১৯৬৫ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন।

আমাদের চলচ্চিত্রের আদিযুগ দেবকী বসুর কাছে ঋণী। গুণমুগ্ধ নজরুল ইসলাম তাই দেবকী বাবুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছিলেন।— “ছিল পর্দার অন্তরালে যে রূপ বাণীর দল তাহাদের দল হে শিল্পী ফুটাইলে শতদল লিখিল চিত্ত ‘রমা হলো রামী’ যাদুকর তবে বরে। ভুলে যাওয়া কবি চন্ডীদাসের গান শুনি ঘরে ঘরে।“

দেবকী কুমার বসুর আজ আমাদের কাছে glorified past, কিন্তু এদের মনে রাখার দায় আমাদের নেই। এখনকার ছোটবড় পরিচালকরা যখন ভালো গল্প না পেয়ে চটুল বিনোদনে মগ্ন থাকেন—যেখানে পর্দা জুড়ে শুধু নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নারী শরীরের বিজ্ঞাপন, হাড় হিম করা ভায়োলেন্সের কারনে অকারণে ছবির প্লটের জন্য অল্প পয়সায় বিদেশে ঘোরা। তখন দেবকী কুমার বসু ছিলেন অভিজাত, রুচিশীল বাঙালি পরিচালকদের একটি প্রতিশব্দ। যিনি স্বয়ং উত্তম কুমার সংলাপ মুখস্ত করে না আসায় “চিরকুমার সভার” শুটিং বন্ধ করে দেন। সুচিত্রা সেনকেও নাকি তিরস্কার ও চড় খেতে হয়েছিল “ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য” অভিনয় চলাকালীন। আসলে যে নিষ্ঠা আর তাঁকে পরিচালক ও মানুষ হিসাবে অনেক উন্নত স্তরে নিয়ে গিয়েছিল তার এখন বড়ই অভাব। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে আভিজাত্যের রূপকথা।  

রূপকথাই তো কেননা দেবকী বসুরা আজ লুপ্ত প্রজন্ম—তাদের ছবি দেখলে বা কথা শুনলে দুঃখের মধ্যে সুখের অনুভূতি ও সুখের মধ্যে দুঃখের অনুরণন।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular