উত্তপ্ত অনুভূতিতে ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’ ‘সবার পথ’ নাট্যদলের জ্বলন্ত-যন্ত্রণা সময় কথা

- Advertisement -

দুলাল চক্রবর্ত্তী 

মনের মধ্যেই প্রাণের সাড়া ছিল তার। বাস্তব থেকে ভারসাম্য হরিয়ে খসে পড়া বকুলের গন্ধ ছিল যার বুকে। সে একটা নারী। তার আছে কমনীয় রমণী দেহ। আছে পৃথিবীর সাথে মিশে যাবার অনন্তে ধাবিত এক মন। সেই দেহমনের কোণেই লুকোনো ছিল কিছুটা আকাশ। সূর্যমুখী সেই আকাশী-নীল কল্পনার ভিতরে পুষে রাখা গেছিল একটি বেড়াল আদর পাগলা খেয়াল। চারদিকে ঘিরে রাখা দেওয়াল তার অ সহ্য। সেসব ভাঙতে চাওয়া এই বদ খেয়ালেই পড়ে শকুনের নজর। তাই মায়ের চোখের আড়ালে কিছুটা খেয়ালি বাতাসে যে নিজেই হয়েছিল যখন মন পবনের সেই নাও। সেই মেঘলা বাতাসে পাল তুলে আবেগে আবেশে ভেসে যেতেই যে মন সঙ্কল্প করেছিল। বাস্পীয় অস্তিত্বের চূড়ান্ত চূড়ায় তার ছিল গন্তব্য।

কেননা বৃষ্টি হতে চেয়েছিল সে। কিন্তু মুহুর্তের খেয়ালে, সে ভুলে গেছিল যে সে একটা মেয়ে। অবরুদ্ধ তার গতি ও গন্তব্য। সব চাওয়া তার মানায় না। কারণ তাড়া করে ফেরা শাসনের দমকে তার পায়ে আছে অদৃশ্য শৃঙ্খল। তাই কোন অলুক্ষণে সে কোন মতিভ্রমে যে বলেছিল আয় বৃষ্টি ঝেঁপে। কেন যে গায়ে বৃষ্টি মেখে সে ধুয়ে নিতে চেয়েছিল অপবিত্র সব অপবাদ। কিন্তু সে বোঝেনি, ভাবতেই পারেনি… উল্টে কিছু ঘটতে পারে। তবুও ঘটনা দুর্ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছিল। কারণ ওই বৃষ্টি মুখী আকাঙ্খাই তাকে করেছিল অপবিত্র। পাড়ার উঠতি মস্তানদের লোভ লালসার শিকার হলো সেই চড়ুই পাখি প্রাণ। নির্মলতা মুছে গেল। আবেগের গলা টিপে ধরা হলো। তাকে দুই পুরুষের বেষ্টনীতে, ধর্ষিতা হতে বাধ্য করা হলো। নির্জন ছাতের কার্নিশ ঘেরা চৌহদ্দিতে।

এই মেয়েটির কথা বলতে এলো ওরা। ওর মতোই ওরা অনেকেই। সবার পথ দলে ওরা জীবন খুঁজে বেড়ায়। তাই ২৮শে জানুয়ারির শিশির ভেজা ভোর-সকালে, তপন থিয়েটারের সামান্য চত্বরে জ্যান্ত নাটক কাকে বলে। স্বপ্নের মরণ কীভাবে হয়। তা ওঁরা চিৎকারে, হাহাকারে, করে দেখালো। ওরা পথচারী সবার নজরও কাড়তে চেয়েছিল। জানান দিতে মরিয়া ছিল, মেয়েদের রক্ষা কামনায়। তাই এই একরাশ তরুণ তরুণীদের প্রাণ-কাড়া কান্না আর্তনাদের নাটক “আয় বৃষ্টি ঝেঁপে”– শীতের হীম শীতল ঠান্ডাকেও রীতিমতো গরম হল্কা হাওয়ায় চাগিয়ে দিল। বুকের ঢিপঢিপকে দিল বাড়িয়ে। প্রতিদিনের সংবাদে উঠে আসা অজস্র মেয়েদের উপর হয়ে চলা ধর্ষণ হত্যার নেপথ্য কথায়। প্রতিবাদ ও অভিযোগের আগুন ছটায়। দেশের সর্বত্র নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে এই সব তরুণ তরুণীদের পথে নেমে আসা যদি সবার পথেই সবার আপন হতে পারে, তবে মেয়েরা নিরাপদে থাকতে পারবে। সংসারে সমাজে, আনন্দে শান্তিতে বৃষ্টি কিম্বা জোৎস্নায় ভিজে, ভেসে,… আকাশ খুঁজে কোন অদৃষ্ট লক্ষ্যে সহযে উড়ে যেতে পারবে। নাটকের উদ্দেশ্য বিধেয় এমন অভীষ্ট দিকেই সৃজিত ছিল।

তাই সবার পথ দলের, এই আয় বৃষ্টি ঝেঁপে অঙ্গন মঞ্চের সার্থক এবং সাহসী উপস্থাপনা। নিছকই নাটক নাটক খেলা নয়। কেবলই নাটুকে বাহাদুর বাসনাও নয়। সাজানো বানানো মঞ্চ মায়া একেবারেই নয়। নাটকের প্রাণে প্রতিপাদ্যের প্রতি পদে, কথা আর কহতব্যের প্রতি ছত্রে, উল্লসিত হুল্লোড়ও নয়। নেই কোন স্তুতি শংসা পাবার প্রত্যাশা। তাই তো রাস্তার কাঁকরে শরীর ঘষটে, ধুলো মাটিকে বুকে নিয়ে, মেয়েদের জীবনে নেমে আসা অকস্মাৎ অত্যাচারের আখ্যান-কথা দিয়ে বুনে নেওয়া একরাশ অনুভূতির সহমর্মিতা আর প্রতিবাদ এই নাটক। 

এখানে জাত ধর্ম কোনো বিষয় নয়। যদি তুমি মেয়ে। তবেই শুরু হলো তোমার শঙ্কিত এই মরুতীর্থ যাত্রা। তুমি জন্ম থেকেই জন্ম দেবার মেশিন আর কলকব্জা। রাস্তা থেকে শুরু করে সমাজে সংসারে…..স্কুলে, কলেজে, অফিসে,  বাজারে ট্রেনে বাসে সব জায়গায় তুমি হবে ভোগ্যপণ্য বস্তু। প্রাণ থাকতেও জড়ত্ব জড়িয়ে যাবে তোমার পায়ে, তোমার চলার পথে। অদেখা জালে আটকে যাবে পা। না বলা কথায় ভরে যাবে বুক। তোমার স্বপ্ন-গতির মতি চুরি যাবে অলক্ষ্যে।  বাজারে নারীর বিপননের বিপন্নতায় তুমিও চক্রান্তের একটা সামান্য উৎপাদিত উৎপন্ন বস্তু মাত্র।

এই পৃথিবীর সর্বত্র, চোখের সামনে আসা সমস্ত যায়গায়, যা মানুষের চোখে পড়ে, এমন কি বাড়ির বিছানাতেও। তুমি বউ মেয়ে মা, যেই হও। যেহেতু মেয়ে তুমি। তাই ধর্ষণ করা হবে তোমার দেহ-মনের সবটুকু পরিসরকেই। ১ থেকে ৮০ যে কোনো বয়সেই যা প্রযোজ্য। পরিচিত বন্ধু, অপরিচিত, কিম্বা আত্মীয় মহলে।

এই, সেই সমস্ত মেয়েদের যন্ত্রণার কথা, যা আজ খুব বেশি বেশি বলা দরকার, তা-ই, সবটুকুই পরিণত অভিনয়ে আন্তরিকতায়, সবার পথের ওঁরা চিৎকার করে বলে। অভিনয় করেন না কেউ। ভান নেই, কুণ্ঠাবোধ নেই। শব্দ আসুক, শব্দেরা জাগুক। যত দূর অবধি সেই শব্দ ছুটে যায়। যেতে পারে, দেশে বিদেশে, প্রদেশের গ্রামে গঞ্জে, শুধু কিছু নোংরা পিশাচ জন্তু সমান মানুষ গুলোর অস্তিত্বের কাছে যেতেই একটা চলনে চলা পথকে মঞ্চ সমান করে নেওয়া। সবার পথ এভাবেই একটা নারী পুরুষের সম্মিলিত পথেই এবার নামতে চায়। শপথের, শঙ্খচিলের ডানায় ভর দিয়ে সমস্ত নারী পুরুষ একসাথে হাতে হাত রেখে লড়াই করে, মেয়েদের মর্যাদার কামনায়, ওরা পথের ধুলো মেখেই পথেই অনাবিলভাবে এগিয়ে চলে। যথেষ্ট খিদে, যথেষ্ট কষ্ট, যথেষ্ট সাংসারিক ব্যস্ততায় জর্জরিত হয়েই। সময় নিশ্চিত ওদের আশীর্বাদ করবে। ওরা তো জীবনমুখী জন সমুদ্র হবেই।

এই নাটকের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হলেন ঝিল। অভিনয়ে যুক্ত ছিলেন সিমি, উর্নিশা, পৌলমী, স্বাগতা, মধুরিমা, রূপসা, সৌপর্না, সঞ্জিতা, কৌশিক, অয়ন আর সুচয়ন। আর সঙ্গীতে একাই সৌগত। এই নিয়েই সবার পথ।

থিয়েটার জেগে থাক ২৪ ঘণ্টা। মিউনাস আয়োজিত মহিলা পরিচালিত ২৫টি নাটকের সম্ভারে ১৩তম ক্রমিক মঞ্চায়নে অভিনীত এটি একটি প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে দেবার নাটক। সকলেই দাঁড়িয়ে দেখেছেন। নির্বাক-ধূসর হয়ে গেছিল সবার মন। নাটককার সঞ্জিতা। নির্দেশিকা সঞ্জিতা। সঞ্জীবনী শক্তির আকারে আঁধারের বিরুদ্ধে আলোর অন্য প্রজ্ঞা।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -