ইউনিটি মালঞ্চের নাটক ‘সেই একই ঘ্যান ঘ্যান’ যেন এক অদৃষ্টের অদৃশ্য পরিহাস

- Advertisement -

দুলাল চক্রবর্ত্তী, ফরাক্কা 

দেখলাম একটি সাম্প্রতিক নাটক। তাও একেবারে প্রথম মঞ্চায়ন। নৈহাটি ঐকতান মঞ্চে। কাঁচরাপাড়া নাট্য কল্লোলের ৫০তম বর্ষ পূর্তি নাটকের উৎসবে অভিনীত হলো সেই নাটক। নাটকের নাম “সেই একই ঘ্যান ঘ্যান”। প্রযোজনা ইউনিটি মালঞ্চ। সম্পাদনা, সামগ্রিক পরিকল্পনা এবং নির্দেশনা দেবাশিস সরকার। বিষয় ভেবেছেন, রাণীগঞ্জ অঞ্চলের নাট্যকার দেবাংশু দাস। প্রযোজনা উপযুক্ত করে চলনের চেহারায় রূপ দিয়েছেন দেবাশিস সরকার। এদিন অনেকগুলি বাধা টপকে হঠাৎই হাজির হয়েছিলাম। বলা যেতে পারে, নাট্য কল্লোলের অর্ধ শতাব্দী পথ চলার ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা আর এই নাটকের নামের চমক টেনে নিয়ে গেছিল। ……সেই একই ঘ্যান ঘ্যান– অদ্ভুত নাম।  

প্রথা বিরুদ্ধ চলনের বাইরে বেড়িয়ে এসেছে হালিশহর ইউনিটি মালঞ্চ দল। এ নাটকে অনেকটা ঝকঝকে চেহারায় ইউনিটি মালঞ্চ। নিজেদের নাটকের ভাবনা চিন্তার পরিচিত চেহারার পোশাক পাল্টে ফেলেছে। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা, কাঠ পুতলি, অলীক, দেশবন্ধু, ঘুম ভাঙ্গানোর গান এসব নয়। আগের থেকে কিছুটা আলাদা অন্য চলনে, ইউনিটি মালঞ্চের নাটক সেই একই ঘ্যান ঘ্যান। বাস্তবতার গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে একটা আ্যবসার্ডিটির বিমূর্ততায়, কিছু টুকরো কোলাজে হেরে যাওয়া চাওয়ার পোস্টমর্টেম। ঘটনার মধ্যেই পার্ক পাহারাদারি, কারা আছে কারা নেই, কি কেন কোথা থেকে এলো… গুলিয়ে তালগোল। মেলে আবার মেলেও না। সঙ্গতিহীন গল্প তাল কাটা বেতালা। ব্যকরণ বহির্ভূত নাটুকে পাগলামি। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ পার্কের আবছায়ায় এক খ্যাপাটে বুড়োর একক আলাপ। মন খারাপের কান্না। হতে পারে এই শতাব্দীর এই আছি বেশ আছি, খুব ভাল আছি। আরো ভাল থাকবো। থাকবোই বলে প্রত্যয়ের লড়াইয়ে নেমে, জীবন ভর পরিচর্চায় পাওয়া এক বনস্পতি, সেই লাগানো গাছের ফল মুখে দিয়ে “আহ্ কি তেতো” বলে ছিটকে আসা।…. কিম্বা সময়ের কুরুক্ষেত্রের সেই ব্যুহ, যেখানে ঢোকা যায়, কিন্তু বেরুনোর রাস্তা নেই….সেইখানে অভিমন্যুর মত বাস্তব সপ্তরথীর আক্রমণে রক্তাক্ত হওয়া। অথবা মুঠোয় “আচ্ছে দিনের” আশীর্বাদ পাবার জন্যে দুর্মূল্য বাজারে গিয়ে সুখে শান্তিতে ভাল থাকা খুঁজে ফেরা এক বাবার হাত ফসকে পড়ে ভেঙে যাওয়া শান্তির সেই পাঞ্চজন্য শঙ্খের দিকে তাকিয়ে এই ২০২৩ র ১০ সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যায়, একবার অঝোর বৃষ্টির মত… ঝরঝর করে কেঁদে ফেলা। সন্তানের উপেক্ষায়, সন্তানকে বুকে জড়িয়ে না পাবার অভিমানে, সন্তান ভুলে নিঃসন্তান ভাবার জন্যে মরিয়া এক বৃদ্ধের একাকীত্বের হাহাকার কথার অদৃশ্য অপলাপে। যে বিলাপের নির্ধারিত কাল নেই। রাত নেই। দিন নেই। নেই নেই সে-ই পাখি, বনে যদি ফুটলো কুসুম, নেই কেন সেই পাখি? কী আছে তবে? অভিমান। আছে কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর হানা দারি আগ্রাসন। আছে সন্তানের অনিবার্য শিক্ষায় এন আর আই হয়ে বিত্তশালী হবার কামনায় বিদেশ যাপন। আছে একা বসে এই পরবাসে রবে কে বলে একান্তের চোখ চাওয়া। দূরে কোথায়, দূরে দূরে, মন চলে ভেসে উড়ে-

সেই একই ঘ্যান ঘ্যান করা বিরক্তিকর আচরণ থেকেই এক সুরেলা নন্দিনী, সে কাঁঠালী। সে কী সময়ের প্রশ্ন? মিমাংসা কে তবে? অন্ধকার কই? আলো কত দূরের মরিচীকা? এসব…এসবের খোঁজ চলছে মনে। হয়তো আমিও বৃদ্ধ বলে। একা একাই একাধিক হবার তারুণ্য আমার কষ্টার্জিত জীবন ধারণ করি। কিছু চেয়ে না পেয়ে এখনো পথিক। হ্যাঁ তাই, বেদনার ধারণা আছে তাই,…সেই একই ঘ্যান ঘ্যান এসবের যুক্তি জালে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা এক অদৃষ্টের অদৃশ্য পরিহাস। এখানে লুকিয়ে রয়েছে যুগ যন্ত্রণার যন্ত্রপাতির খামচে ধরা থাবা। আছে রাজনৈতিক অস্থিরতায় দ্বিধা গ্রস্থ ছুটে চলা, যেন গায়ে আগুন লাগিয়ে ছুটে বাতাসকে বলা, পোড়াও, আমাকে ছাই করে দাও। আছে মরে পচে হেজে যাবারই অব্যক্ত ব্যথার পাহাড়। আছে ভীড়ের প্রশ্নে জর্জরিত শূণ্যতার প্রচ্ছায়া। এমনটা তো নয় দৃশ্যমান এই নাটক?  তাহলে এও কি পাগলের প্রলাপ।

হ্যাঁ। এসব নাটক থেকেই পাওয়া ভাবনা। সবটা নাটকে নেই। থাক উচিত কি অনুচিত… সে আলোচনা এখানে নয়। এখানে আনন্দ আহ্লাদ কিম্বা নাটুকে বিলাস উলম্ব প্রচ্ছায়া ঘিরে প্রসাধনী পসরা সাজিয়েছে, নাকি জীবনানন্দের অন্য আবেগে ধান সিঁড়ি নদীটার ওপারে জমা মেঘের স্তুপে রবীন্দ্র মূর্তির আনন্দ এসেছে। জানি না। জানতে চাইও না। কারণ আমি যে শুধু এস্রাজের কান্নাই শুনলাম যেন। ছিল কী এমন সুর? ছিল কী এমন এক আ্যালিনিয়েশন যা অদৃষ্টের উপরে হাতুড়ির ঘা মেরে জিজ্ঞাসা করে, রাত কত হলো? এই এক জ্বালা। আমার নাটক দেখার ওয়েবসাইট দিয়ে বহু বাতাস বয়ে যায়। এখানে সেই নিঃশ্বাস, কিছুটা দীর্ঘশ্বাস হোক। সবারই কত ভাবনা আসে। জন্মেই মরে যায়। আমি তা শেয়ার করে দিলাম ইউনিটি মালঞ্চের কাছে। হ্যাঁ,  মানি, তাই কি ভুল কি ঠিক তা নিয়ে কচকচ করলাম না। নাটুকে বাতিক দিয়ে উপায় বাৎলে মহৎ শিল্প করিয়ে নেওয়া অসম্ভব। সম্ভব শুধু অন্তর অনুভূতি দিয়ে, পার্কে বসা রতন বাবুকে আপন করে, কাছে টেনে টোকা দিয়ে বলা” তুমি কাঁদছো কেন?” বা ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো’?

হবে হবে। সবটা হয় নি। সময়ের আয়নায় চোখ দিলে আরও মুখ দেখা যাবে। যার আদলে চমক নেই। ছলকানো জলছবি শুকনো পাতায় ভাসবে। এ নাটক যখন বাদল রবীন্দ্রনাথ ছুঁয়েছে, তবেই তো ভাবনার পোকা মাথায় ঢোকে? সময়ের নিত্য ঘষায় আরো মজবে। আরো চকচকে হবে।

ইউনিটি মালঞ্চ বলিষ্ঠ দল। প্রতি বৃহস্পতিবার নাট্য মুখপত্রে প্রায় ত্রিশ বছরের আগে পরে, সায়কের দায়বদ্ধ বাসভূমি আর হনুয়া কা বেটা, চরিত্র, দানো, উজান গাঙে (আর নাম মনে পড়ছে না) এ-সব নাটকের মাস ব্যাপি মঞ্চায়ন তালিকা প্রকাশিত হতো। তাই এঁরা, বাবলু চৌধুরী, সুপ্রিয় ভট্টাচার্য,  মৌমিতা মন্ডল, সাগ্নিক সরকার, পার্থ দাস, অঞ্জন নাথ, সুদীপ্ত দাম, নিত্যানন্দ পাল, অরূপ পাল, মনোরঞ্জন চক্রবর্ত্তী, প্রবীর মজুমদার, পিঙ্কু চৌধুরী, দেবাশিস সরকার প্রমুখেরা অনেক কথা বার্তা গানে এই ভাবনা গুলিকে অন্তরে দিতে পেরেছেন। তবে বেশি ভিন্ন কথা আছে। বিষয়ে তাড়নায় সম্মান সমীহের চেয়ে এই নাটক বড় সমীক্ষার মুখোমুখি আছে। সরল সমীকরণের সমাধানের চেয়ে সেই একই ঘ্যান ঘ্যান… এর ভিতরে নাটকের এক ব্যাধি গ্রস্ত আর্থ-সামাজিক যন্ত্রণা আছে, এই বাজারে নাটকের মধ্যেই ডাল ভাত তরকারির গল্পে যে  কষ্টের তাগিদে এগিয়ে চলার মোচড় আছে? তাতে নাটক কেন আহ্লাদিত হবে? আমিও আমোদিত হবো কী করে? আচ্ছা, রতন বাবু কি মঞ্চে কাঁদতে পারেন? গনেশের বাবা রিক্সা চালায়, গনেশ মরে গেছে, স্ট্যাটাসের চাপে বিক্রম সেখানে যেতে পারে নি বলে, সেও কি গুনগুনে আগুনে ঝলসে ডুকরে কেঁদে ওঠে নি? আধোঘুমের তন্দ্রায় গানের সুরের পাশে হাৎড়ে কী স্বজনের সন্ধান মিলেছে?

প্রশ্নেরাও আজ প্রশ্ন করে। কারণ উত্তর আছে অনেক অতলে। মজা আছে এক হাঙরের পেটে। সে একই ঘ্যান ঘ্যান তাই হাঙরের দাঁত দেখুক। To be or not to be-এর যুদ্ধ আট দিনেই শেষ হয়তো হবে না। কুরুক্ষেত্র তো জীবনের তরঙ্গে আছেই। থাকবেও।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -