Tuesday, February 18, 2025
Tuesday, February 18, 2025
Homeআলোচনাকান্দী ঝড় নাট্যদল ও গ্রহণ নাটক এই ঘুমন্ত সময়ের ঝড়-কথা

কান্দী ঝড় নাট্যদল ও গ্রহণ নাটক এই ঘুমন্ত সময়ের ঝড়-কথা

দুলাল চক্রবর্ত্তী

কান্দী ঝড় নাট্যগোষ্ঠীর নাটকের জন্যে শ্রদ্ধাশীল সংস্থা। এই দলের নাটকের উৎসব বিষয়ক কিছু কথা, সারা বাংলার নাট্য সমাজই অবগত আছেন। এখানে এসেছেন বহু বিদগ্ধ মানুষ। রেল যোগাযোগ বিহীন একটি মফস্বলি অঞ্চল। ২৬ বছর ধরে চলছে ঐতিহ্যশালী গ্রাম বাংলার একটি মহার্ঘ্য নাটকের উৎসব। এই উৎসবে এসেছে বহু দল। প্রায় সব জেলারই বহু ভাল প্রযোজনা আমন্ত্রিত মর্মে অভিনীত হয়েছে। গ্রাম গঞ্জের ব্যবস্থায়, এই আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোতে এমন নাটকের আসরের ফী বছর পরিচালনা করা যে কি লড়াই। তা সহজেই অনুমেয়। কলকাতা থেকে কেবল মাত্র বাস রুটে দল আনা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। তথাপি তা চলছে,২৬ বছর এক নাগাড়ে। কান্দীর মতো মফস্বল বাংলায় বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই মানের উৎসব উদ্যোগ নেই বললেই চলে। এখানে আরো দুটি এই জাতীয় উৎসব হচ্ছে। সেই সব কথা নিয়েই এই প্রতিবেদন।

আলোচ্য বিষয়টি খোলামেলা হওয়া দরকার। ১৯৯৮ সাল থেকে শুরু হওয়া এই উৎসব পরিণত হয় ২০০১ সালে। কলকাতার অজিতেশ একাডেমির তিন পয়সার পালা, বহরমপুর ঋত্বিক দলের ৩০শে জানুয়ারী দিয়ে শুরু হয়েছিল বহিরাগত নাটক নিয়ে আসা এবং কান্দীতে দর্শকদের, আধুনিক নাটকে সমাহিত করার উদ্যমী চেষ্টা। এরপর থেকেই চলছে প্রদর্শনী নাটকের রমরমা আয়োজন। এখানে নাটকের শো করতে এসেছে কলকাতার রঙ্গবিন্দু, ক্যানভাস, প্রেক্ষাপট, গান্ধার(বাটানগর), সমলয়, অঙ্কুর(বাটানগর), রঙ্গলোক, যাত্রী( বাটানগর), শৌভিক সাংস্কৃতিক চক্র, ইউটোপিয়ান, কুশীলব, বিভাব নাট্য একাডেমি, স্ববাক( বরানগর), সন্দর্ভ, থিয়েটার প্রসেনিয়াম(ভদ্রকালী), শোহন, রঙরূপ, রিদম(বাটানগর), রঙ্গিলা, নান্দীপট, বহুরূপী, বালিগঞ্জ ব্রাত্যজন, পূর্বরঙ্গ, নিভা আর্টস, ভূমিসুত থিয়েটার, পি. এল.টি, মুখোমুখি, নান্দীমুখ, সংলাপ, থিয়েটার ওয়ার্কশপ, প্রভৃতি নাটকের উল্লেখযোগ্য সংস্থা এখানে নাটক করতে এসেছে। এছাড়া শান্তিপুর, গোবরডাঙ্গা, ব্যান্ডেল, নৈহাটি, চাকদহ, ফরাক্কা, মালদহ, শিলিগুড়ি, বহরমপুর, সিউড়ী, বেলঘরিয়া, কৃষ্ণনগর, হলদিয়া, বর্ধমান, বোলপুর, হালিশহর, মধ্যমগ্রাম, অশোকনগর, খামারগাছি, বারাসাত, চন্দননগর, কাঁচরাপাড়া, মেদিনীপুর, রায়গঞ্জ, রঘুনাথগঞ্জ, আগরপাড়া ইত্যাদি অঞ্চলের সেরা নাটকের দলও তাদের নাটকের সম্ভার এনে মঞ্চায়ন করেছে। এসেছে বাংলাদেশের নাট্যদল, আরণ্যক,  থিয়েটারওয়ালা,শব্দ দল, নাট্যলোক, বাংলাদেশ থিয়েটার এই রকম কিছু সংস্থা। প্রাসঙ্গিক কিছু উল্লেখযোগ্য নাটকের নাম হলো…চোপ আদালত চলছে, আবৃত্ত, লন্ঠন সাহেবের বাংলা, জনতার আফিম, সীতায়ন, অটো, চন্দ্রগুপ্ত, বিয়ে গাউনি কাঁদন-চাঁপা, পাঁচফোড়ন, অর্ধাঙ্গিনী, হলুদ রঙের টি সার্ট, নীরো, এক টুকরো ম্যাকবেত, জাগরণ পালা, নাগমন্ডলা, মুদ্রারাক্ষস, মাই নেম ইজ গওহরজান, কমলা, ব্রেনড্রেন, আরোগ্য নিকেতন, স্বদেশী নক্সা, টাইপিষ্ট, গুলি, কন্যাদান, নীল রঙের ঘোড়া, রাড়াঙ, মালাডাক, কঙ্কাল ইত্যাদি। এই তালিকা অনেক লম্বা। বলে শেষ করা যাবে না। তথাপি অনালোচিত এবং অনালোকিত হয়ে আছে ঝড় সংস্থার যাবতীয় কর্মকাণ্ড। তাই প্র‍য়োজন ভিত্তিক এই তথ্যগুলো অবগত করা। যার থেকে কান্দীর ঝড় নাট্যগোষ্ঠীর তৎপরতা বিষয়ে কিছুটা নিশ্চিত ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

সবচেয়ে দুঃখের কথা, এ হেন বিস্তৃত উদাহরণ, উদ্দেশ্যপূর্ণ উদ্দীপনা, উদ্যোগ ইত্যাদিতে ভরা, বিগত ২৫ বছরের নাটকের উৎসব-ইতিহাস থাকা স্বত্বেও, এই সংস্থা উৎসব চালনার জন্যে কোন রকমের আর্থিক অনুদান পায় নি, আজও পায় না। এই দলটি, বহু নাট্যদলের সাথে সম্পর্কিত হওয়া স্বত্বেও জেলার বাইরে অন্যত্রে নিজেদের নাটক মঞ্চায়িত করার ডাক পায় না। ঝড় নাট্যগোষ্ঠী কান্দীতেই নাটকের নিজস্ব দর্শক তৈরি করতে পেরেছে। বহু দলের এগিয়ে চলায় সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা করছে। নিজেদের উৎসবের আর্থিক জোগান চাঁদা তুলে বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সাহায্য সহায়তায় মিটিয়ে চলেছে। বিগত সময়ে প্রচুর নাট্যদল এবং অজস্র বিদগ্ধ ও সম্মানিত বড় নাট্যজন এখানে এসে নিজেদের দলের নাটক আমন্ত্রিত অভিনয়ে মঞ্চস্থ করতে পীড়াপীড়ি ফোনালাপ চালিয়েছেন। পরে ঘুরেফিরে নিশ্চিত ডাক পেয়ে এসেছেন। নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। অভিনয় শেষে সবাই নিজের গন্তব্যে ফিরেও গিয়েছেন। নাটক মঞ্চায়নের সাথেই সম্পর্ক শেষ হয়েছে। প্রায় সকলেই ঝড়ের অস্তিত্ব ভুলে গেছেন। ভুলে যাচ্ছেন, এবং ভুলেই যাবেন চিরদিন। আমরা যতই শুদ্ধস্বরের কথা বলি না কেন, কার্যত তা কথার কথা হয়েই থেকে যায়। এই উৎসব চালনা সংক্রান্ত গর্ভ যন্ত্রণা নিয়ে কোথাও কেউ-ই কিছু বলেন নি, বা কিছু করে দেখান নি। এটাই বাস্তবতা, যদিও মর্মান্তিক সহমর্মিতা প্রসঙ্গে।

সকলেই জানেন ঝড় সংস্থা প্রতি বছর নিজস্ব নাটক নির্মাণ করে আসছে। এখানে অনেকেই আসেন, কিন্তু এই দল তেমন বিশেষ কোথাও যেতে পারে না। কোথাও তেমন মঞ্চায়ন সুযোগও পায় না। কেউ ডেকে বলে না আমাদের এখানে এসো, মঞ্চ দিচ্ছি, দেখাও তোমাদের কাজ। বলতে কষ্ট হলেও সত্যি। তাই বাধ্য হয়ে স্বেচ্ছায় এই প্রতিবেদন লিখছি। এবং উল্লেখ করতে চাইছি  ঝড় গোষ্ঠীর সাম্প্রতিক নির্মাণ মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের লেখা গ্রহণ নাটকের কথা। আলো আবহ ও মঞ্চের সুনির্দিষ্ট ভাবনায় দলের নির্দেশক চিরঞ্জীৎ চ্যাটার্জী। তিনি বেশ ভাল পরিচালনা করেছেন। বহরমপুর রবীন্দ্র সদনে নবীন দলের নাটকের উৎসবে গ্রহণ নাটকের মঞ্চায়ন দেখেছি।

এই নাটকটি মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের অসুস্থ হবার সময়ে লেখা। ২০০৯ সালে শারদীয়া গ্রুপ থিয়েটার পত্রিকায় প্রকাশিত। সে সময় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে, সামাজিক উল্লাসের মধ্যেই বাহুবলের তীব্রতা দিয়ে মানুষের স্বাভাবিকতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল। গুন্ডারাজ, মস্তানি বেড়ে গিয়ে মানুষ পথে ঘাটে বিব্রত, বিভ্রান্ত হচ্ছিল। যা এখন চরম আকার নিয়েছে। মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের তার বিরুদ্ধেই একটি বাস্তব দেখানো চেষ্টা এবং রাজনৈতিক দিশাহারা অবস্থার মোকাবিলা করার সাহস দেখিয়েছিলেন। তথাপি প্রায় ১৫ বছর এই নাটকের তেমন মঞ্চায়ন কথা জানা যায় নি। যে নাটকে দেখানো হয়েছিল দুর্বৃত্তায়ন দিয়ে রাজনীতিকে আয়ত্তাধীন করতে চেষ্টা চলছে। আর তথাকথিত সমাজ কল্যাণের পক্ষে শুভ চেতনার রাজনৈতিক দল পিছু হটছে। প্রতিবাদহীন, আর হীনমন্যতায় আক্রান্ত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ভীত হয়ে কোণঠাসা অবস্থায় চলে যাচ্ছে। নাটকের নন্তু চরিত্রটি আগে বিভিন্ন বিষয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংঘটিত করতে সবার আগে থাকত। এখন সে চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে। এবং এমন নাক ডাকছে যে তার বউ রীতা অতিষ্ঠ হয়েপরিস্থিতি সামাল দিতে সেলুটেপ দিয়ে তার নাক মুখ আটকে দিয়ে ফোনে ডাক্তার খ্যাপাদাকে বিস্তারিত জানাচ্ছে। এই খ্যাপাদা প্রাচীন প্রবীণ এক গণমুখী সমাজতান্ত্রিক দলেত সমর্থক। যিনি মনে প্রাণে চান মানুষ সাহসের সাথে অন্যায়ের বিরুদ্ধে পথে নেমে প্রতিবাদ করুক। এই মর্মেই তিনিই সাহস জুগিয়ে নন্তুর ঘুম ভাঙ্গিয়ে তাকে বন্ধু দুলালের সাথে প্রতিবাদের মিছিলে সামিল হবার শক্তি দান চিকিৎসা করেছেন। ঝড় নাট্যগোষ্ঠীর এই সাম্প্রতিক নাটকটি দেখতে যেমন মজার, ভাবলেই বিরাট বক্তব্যের। সময়ের সুবিধাবাদী চেতনা আপোষ করতেই ঘুমন্ত। সামগ্রিক দেশের পরিস্থিতিতে মানুষকে সজাগ হতেই হবে। অন্যথায় শুধুই ভোট দিয়ে জিতিয়ে আনা দূর্নীতিবাজ জন প্রতিনিধিদের হাতে নিজেদের অস্তিত্ব বিকিয়ে অনিবার্য ভাবেই তলিয়ে যেতে হবে।

নির্দেশক চিরঞ্জিৎ চ্যাটার্জী যথেষ্ট ভাল নাট্য নির্মাণ করেছেন। সুন্দর সাজিয়েছেন তিনি বিষয়কে আলো মঞ্চ আবহে। তিনি নিজেনন্তু চরিত্রে বেশ ভাল অভিনয় করেছেন। পাশাপাশি বন্ধু দুলাল চরিত্রে সৌরভ সাহাও যথাযথ। লালু ওরফে লাল মোহন মুখোটি চরিত্র অরিজিৎ হাটি ভয়ের মুহুর্তগুলি সুন্দর গড়েছেন। তবে তার উপর চোটপাট করা মস্তান সোনা নস্করের চেয়ে বয়স বেশি হওয়ায়, কিছুটা বেমানান লেগেছে। সোনা নস্করের মস্তানিতে প্রকৃত দাপটের চেয়ে বহু দেখা ক্লিশে অবাস্তব চেহারা উঠে এসেছে। অনুপলব্ধ অভিনয় প্রতাপ চরিত্রকে তরল করছে। যা গাম্ভীর্য কমিয়ে প্রযোজনার ক্ষতি করছে। কারণ এটাতে বিশ্বায়ন বাস্তবতা আছে। মোবাইলে মানুষ এখন চরমতম শক্তি পেয়েছে। সবাই এমন বিশ্বাসী স্বভাব বাদী হয়েছে যে, টেকনোলজির যুগে দাঁড়িয়ে সবাই যেন আস্বস্ত। বিহেভিয়ার ক্রমে উগ্রতা থেকে নেমে স্বাভাবিক ছন্দেই ক্রাইমে নিযুক্ত। ভাবা যায় না, এমনই ক্রিমিনাল সংযত ভাবে কিছু ঘটিয়ে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। পার্টি আছে পাশে। তাই আশ্রিত ক্ষমতা আকস্মিকতায় হকচকিয়ে দিচ্ছে। কে যে কি কান্ড ঘটাবে তার আঁচ পাওয়াই কঠিন এখন। সোনা নস্কর এভাবে এলেই নাটকে সুপ্রযুক্ত হবে। তাছাড়া এই চরিত্রে সৌম্য দাসের অভিনয়কে ব্যক্তিত্বের বলিষ্ঠতায় ভয় ব্যাঞ্জক করতেই হবে। ডাক্তার খ্যাপাদা চরিত্রে নারায়ণ সাহা চরিত্রটিতে ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। এখন অভিনয় রীতি চরমভাবেই ন্যাচারাল উপলব্ধিতে পৌঁছেছে। তাই পাগলের মতো কেন তিনি? তিনিই তো এ নাটকের কেন্দ্রীয় শক্তি। একইভাবে দুলালের স্ত্রী / অনামিকা চ্যাটার্জী ও রীতা চরিত্রে সঙ্গীতা দাস, দুজনকেই ভয়াবহ সিচুয়েশনের উপলব্ধিতে ভীত সন্ত্রস্ত হতে হবে। আমরা বর্তমানে ভিসুভিয়াসের উপর দিয়ে হেঁটে চলে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করছি। এ নাটক সেই কথাই বলতে চেয়েছে। যেকারণে এটি একটি অসম্ভব শক্তিশালী নাট্য টেক্সট। তাই এসব সামান্য ত্রুটির মধ্যেও, নাটকীয়তা আর ঘটনায় চরিত্রের মুখের সংলাপ দিয়েই ঝড়ের গ্রহণ অনেকই কাঙ্ক্ষিত নাট্যায়ন হতে পেরেছে। নাট্য সম্পাদনায় সংযোজনে আসা প্রাসঙ্গিক পর্বে দুই শিশু শব্দ রায় ও অহনা চ্যাটার্জীও মন্দ নয়। বিশ্বজিৎ দাসের আবহ ও মানস চক্রবর্তীর আলো এবং সুচিন্তিত মঞ্চটির বিন্যাস নাটকের জন্যে উপযুক্ত বলেই মনে হয়েছে। এটি একটি বিষয়বস্তুতে জ্যান্ত নাটক। সাজানো আরোপিত নাটকের ক্রম চর্চায় ক্লান্ত দদর্শকদের ভাবতে বলেই মজাও দেবে ষোলো আনা।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular