কৃষক বিদ্রোহের কথা বলে নাটক ‘এক মুঠো রোদ’

- Advertisement -

নারায়ণ দেব, ত্রিপুরা

নাটক বরাবরই মানুষের কথা বলে। সময়ের কথা বলে। প্রায়ই দেশের কৃষকেরা রাস্তায় নেমেছে তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষে। কৃষকদের আন্দোলন নতুন নয়। যখনই জোতদার জমিদারের অত্যাচার সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে তখনই কৃষকরা নিজেদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নেমেছে। এমন অসংখ্য উদাহরন রয়েছে। আর সেই ন্যায্য লড়াই দমনের জন্য জমিদার-জোতদারেরা রাষ্ট্র শক্তির আশ্রয় নিয়েছে।  আমাদের রাজ্যের গোলাঘাটির কৃষক বিদ্রোহ তার প্রকৃষ্ট উদাহরন। সাময়িক ভাবে হয়তো আন্দোলন দমানো গেছে।  কিন্তু একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। কৃষক যতদিন শোষিত হবে ততদিন এই আন্দোলন জারি থাকবে। তেমনি এক কৃষক বিদ্রোহের কথা বলে নাটক ‘এক মুঠো রোদ’।  

ত্রিপুরা সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর আয়োজিত নাট্যোৎসব, ২০২৩ এর তৃতীয় সন্ধ্যায় রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবনের ২ নং প্রেক্ষাগৃহে  রাঙামাটি নাট্য ক্ষেত্র উপস্থাপন করল  তাদের নাটক ‘এক মুঠো রোদ’। মূল গল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। নাটক ও নির্দেশনাঃ উত্তম দাস। ১৯৪৬-৪৭ সালে তেভাগা কৃষক আন্দোলনের উপর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করেন গল্প – ‘হারাণের নাত জামাই’। এই গল্পটিকে সামনে রেখেই রচিত হয়েছে নাটকটি।  গল্পের চরিত্রগুলির নাম ঠিক  রেখেই  নাটককার তার নিজের মতন করে রচনা করেছেন নাটকটি।

মূল গল্পটি এই রকম – বিপ্লবী ভুবন মণ্ডল। চাষীদের নেতা। জোতদারদের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই। জ্বলে ওঠে বিদ্রোহের আগুন। তাপ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে গ্রামে। চাষিরা জোট বাঁধেন। গর্জে ওঠেন সমবেত ভাবে। ভুবনকে আদর্শ মানেন। প্রত্যেকেই বুঝে নিতে চান তাদের নিজেদের অধিকার। তাঁরা যে  বঞ্চিত, শোষিত উপলব্ধি করেন। সমস্যায় পড়েন ধূর্ত জোতদাররা। বুঝতে পারেন, এবার চাষীদের ঠকানো প্রায় অসম্ভব। অসৎ উপায়ে পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশ করেন। ভুবন মণ্ডলের নামে বের হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ভুবন ঘুরে বেড়ান এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। মিটিং করেন চাষীদের সঙ্গে। একদিন রাতে গ্রামে মিটিং সেরে হারান দাসের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। পুত্রবধূ নিস্তারিণী, নাতি নিতাই ও নাতনি ময়নাকে নিয়ে তাঁর দরিদ্র চাষী পরিবার। বিয়ের পর থেকে শ্বশুরবাড়ির মুখ দেখেনি ময়না। পণের দাবি মেটানো যায়নি বলে। ভুবন মণ্ডলের নাম মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লেও পুলিশ তাঁকে দেখেনি। হারানের ঘরে ভুবন রাত কাটাচ্ছেন, গোপনসূত্রে খবর যায় পুলিশের কাছে। দলবল নিয়ে ছুটে আসে খাকি উর্দিধারীরা। কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন ময়নার মা। উপস্থিত বুদ্ধির জোরে। ভুবনকে নিজের জামাই পরিচয় দিয়ে মেয়ের সঙ্গে ঘরে ঢুকিয়ে দেন। হতচকিত হয়ে যায় পুলিশ। এইভাবে ময়নার মা গ্রেফতারির হাত থেকে বাঁচান চাষীদের নেতা ভুবন মণ্ডলকে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যায় জমিদার ও পুলিশ। হারানের সমস্ত পরিবারকে ধরে নিয়ে যেতে চায়। দারোগা মন্মথ হাত দেয় ময়নার চিবুকে, অশ্লীল মন্তব্য করে। রুখে উঠে ময়নার জামাই জগমোহন। গ্রামের জনতাও প্রতিরোধ গড়ে তুলে।এখানেই গল্পটি শেষ।

কিন্তু এই নাটকের শেষদৃশ্যে জমিদার চন্ডী ঘোষ পুলিশের বন্দুক কেড়ে নিয়ে ভুবন মন্ডলকে গুলি করে হত্যা করে। হয়তোবা সময়ের প্রেক্ষিতে নাট্যকার এই দৃশ্যটি রচনা করেছেন। তবে ভুবন মন্ডলের মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে যখন একটি ছোট্ট শিশু দু’হাত বাড়িয়ে দেয় উর্ধাকাশে। মনে হয় যেন আগামির প্রত্যাশা। বড় ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠে দৃশ্যটি। গল্পটি ছোট্ট। সেটা নিয়ে নির্মিত হয়েছে এক ঘন্টার নাটক। কাজটি খুব সহজ ছিল না। দৈর্ঘ্য বাড়াতে অতিরিক্ত কিছু মুহূর্ত সংযোজিত করা হয়েছে। বেড়েছে দৃশ্য। তাই কোনও কোনও সময় নাটক সরে গেছে মূল গল্প থেকে। আমুল পরিবর্তন এসেছে কিছু চরিত্রেও। তা সত্ত্বেও নাটকটি দর্শকদের টেনে রাখতে সক্ষম। কোনও সময় চোখ ফেরানো যায় না। প্রতিটি দৃশ্য টানটান। দৃশ্যান্তরের মুহূর্তে জন্ম নেয় কৌতূহল। কিছু কিছু সংলাপ মনে দাগ কেটে যায়। গানের প্রয়োগ এবং কোরিওগ্রাফি সুন্দর। পুরো নাটকটিকেই অত্যন্ত সুদক্ষ নাবিকের মত পথ দেখিয়েছেন নির্দেশক উত্তম দাস। তবে শেষ দৃশ্যে নব্বই বছর বয়স্ক হারানকে দুম করে মাটিতে ফেলে দেওয়ায় নাটকের গাম্ভীর্য খানিকটা টোল খায়। বারবার জগমোহনের কন্ঠে ‘পরপুরুষের লগে শুইছে বা ঘুমাইছে’ সংলাপটি শুনতে মনোটোনাস লাগে। 

অভিনয়ে সকলেই নিজ নিজ চরিত্র রূপায়নে ছিলেন যত্নবান। বিশেষ ভাবে বলতে হয় রিমি দেবের কথা। নাটকের সেন্টার ক্যারেক্টার ময়নার মা নিস্তারিণীর চরিত্রে তাঁর অভিনয় মন ছুঁয়ে গেছে। কখনও স্নেহশীলা জননী, কখনও ভেঙে পড়া অসহায় নারী, কখনও তেজস্বিনী, বুদ্ধিমতী, প্রতিবাদী— প্রতিটি সত্তা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তবে মাঝে মাঝে অতি অভিনয় সামগ্রিক উপস্থাপনাকে কিছুটা ব্যহত করে। 

জগমোহন চরিত্রটিকে সানি সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করেছেন তার বিশেষ টাইপে হাটাচলা এবং কন্ঠস্বর প্রয়োগের মাধ্যমে। চণ্ডী ঘোষে খলচরিত্রে নিজেকে দারুণভাবে মেলে ধরেছেন বিশ্বজিৎ রায়। ভুবন মন্ডলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন নাটককার নির্দেশক উত্তম দাস নিজেই। স্বল্প পরিসরের এই চরিত্রটিকে তিনি প্রস্ফুটিত করেছেন তার নিজস্ব স্টাইলে। তবে এই চরিত্রটিকে আর একটু পরিসর দিলে ভাল হত। দারোগা মন্মথর চরিত্রে যথাযথ অভিনয় করেছেন মনোজিৎ দেব রায়। হাবিলদার চরিত্রে স্বল্প পরিসরে গৌতম দাস দুর্দান্ত। 

অন্যান্য চরিত্রে রূপ দিয়েছেন এষা দেবনাথ (ময়না), বিদ্যুৎ হোসেন ( হারান দাস), প্রজ্ঞা পারমিতা পাল (গ্রামবাসী),  সমৃদ্ধি ধর ( গ্রামবাসী), মিঠুন ধর (গফুর আলী), সুজন পাল (কানাই),উদয় দেবনাথ (উসমান), রুমাশ্রী নম (মর্জিনা), শ্রেয়সী দেবনাথ (গ্রামবাসী), সায়নী সুত্রধর (গ্রামবাসী), বুদ্ধদেব সাহা ( বলাই), রমন নট্ট (হাবলা), বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী (রাখাল) এবং শিশু শিল্পী অরিদ্রিতা দাস।

আবহে মনোজিৎ দেবরায় ও  পঙ্কজ ভৌমিক।  মঞ্চসজ্জায় রাজেশ কান্তি সাহা। আলোক সম্পাতে রিন্টন রায়। রূপসজ্জা এবং পোষাক রূপা নন্দী। কোরিওগ্রাফি শিববগিড়ি ডান্স একাডেমী। অভিনয়, কোরিওগ্রাফি, মঞ্চ, রূপসজ্জা, আলো সবগুলি বিভাগের সু-সম্পাদনায় পুরো নাটকটি উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। 

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -