কৃষ্টি’র নাটক চৈতি রাতের প্রিয়

- Advertisement -

দুলাল চক্রবর্ত্তী

এবারের শীত মরশুমের ভাল একটি নাটক। অনেক উৎসবেই অভিনীত হয়েছে। হ্যাঁ, কাঁচরাপাড়া কৃষ্টি নাট্য সংস্থার ‘চৈতি রাতের প্রিয়’ নাটকটির কথা বলছি। সাম্প্রতিক নির্মিত সফল কিছু ছোট নাটকের মধ্যে এটি অন্যতম। গয়েশপুর সংলাপ দলের নির্দেশক, অভিনেতা, সুদীপ্ত দত্ত নাটকটি লিখেছেন। তাঁরই মঞ্চ ভাবনায় তিনিই শিল্পীদের চালনা করেছেন। নাটকের সামগ্রিক রূপায়ণে যুক্ত আছেন মনোজ প্রসাদ এবং গৌতম ঘোষ। কয়েকটি ভাল নাটকের নির্মাণ প্রসঙ্গেই  ইতিমধ্যেই সুদীপ্ত দত্ত আলোচিত হয়েছেন। গয়েশপুর সংলাপ দলের চৈতন্য এবং তাজমহল নাটক দুটির কীর্তির মধ্যেই তিনি নিজের নাট্য বীক্ষণকে চূড়ান্ত ভাবে মেলে ধরেছেন। এই নাটকটি যদিও ভিন্ন। কারণ এখানে কোন ভাবাবেগ নেই। আছে দুরন্ত গতি আর বাস্তব ঘটনার পরিক্রমা। যা সময়ের চলনের অভিজ্ঞতা থেকেই প্রাপ্ত।

এই চৈতি রাতের প্রিয় নাটকটির কেন্দ্রীয় শক্তি হলো সব চরিত্রের সুসামঞ্জস্যপূর্ণ অভিনয়। সাথে আছে মনোজ প্রসাদের নানা মাত্রার উন্নত আলোক চিন্তন। সারা রাজ্যের বাংলা নাটকের অন্যতম কৃতি আলোক শিল্পী। অতএব, নিজের দলে, নিজের বেস্টটুকু তিনি দেবেনই। সাথে ছিল সামান্য সাজেশনের মঞ্চ উপকরণের সমাহার। চমৎকার আলো আর আবহে এবং অভিনয়ের দ্যুতিতে মঞ্চ ভরাট হয়ে যায়। এই সময়ের পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক পটভূমিতে নাটকের গল্পটা ঘুরেছে, সময়ের অবসাদের বৃত্তে। মন্টু নামের নিচুতলার এক যুবকের, কোন মতে কপাল ঠুকে বেঁচে বর্তে থাকার যন্ত্রণা কথাই সারা নাটকে লেপ্টে রয়েছে। যার মধ্যেই অনেক বড় ভাবে যুব সমাজের চেহারা ধরা পড়েছে।

বেকার তরুণদের টাকার প্রয়োজন আছে। তাদের জীবন গড়ার সাধও আছে। কিন্তু তারা বেকার বলে অথর্ব জীবন নিয়েই পথ হাতড়াচ্ছে। মন্টুও তাই। স্বপ্ন পূরণ করতে পারছে না। যেহেতু রাজ্যে চাকরির সুযোগ নেই। তাই মুখ থুবড়ে পড়েছে তরুণদের ভবিষ্যৎ। নিরুপায় ভাবে এরা ছুটে চলেছে রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে। যদি সেখান থেকে কাজের আশ্বাস মেলে। তাই প্রতিদিন অন্ধ হয়ে এরা অন্ধকারকেই চিনে নিচ্ছে। প্রতিশ্রুতি দেওয়া ক্লাব জনক রাজনৈতিক দাদাদের হাতের কাছেই পাচ্ছে। সেখানেই অনৈতিক, অমানবিক কাজে তারা লিপ্ত হচ্ছে। যদিও সবাই নেই এই অলিন্দে। অসংখ্য যুবক টোটো অটো চালিয়ে, হকার হয়ে, লটারির টিকিট বিক্রি করে, না-হয় অন্য কিছু করে বেঁচে থাকার চেষ্টাও করছে। যারা বাবা মা’র সম্বল নিংড়ে কিছুটা উচ্চ শিক্ষা নিতে পেরেছে। পড়াশোনা করেছে। তারাও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। পরিযায়ী কর্মী বা এখানে ওখানে ক্যাজুয়াল উপার্জনে কাজ করছে। তাতে শুধু নিজের আর্থিক প্রয়োজনটুকুই মেটাতে পারছে। চৈতি রাতের প্রিয় নাটকের মূল পরিপ্রেক্ষিত এখানেই আছে। যেখানে বলতে চাওয়া হয়েছে, মানুষের নিদেনপক্ষে জীবন ধারণের সামর্থ্য নেই। মধ্যবিত্তদের ঘরের ছেলেরা স্বপ্ন কিনতে গিয়ে দুষ্ট চক্রের সংসর্গে নিচে নামতে বাধ্য হচ্ছে। অল্প শিক্ষিত যুবক সমাজ খিস্তিখেউড় করে, এলেবেলে চলে, পরশ্রীকাতর হয়ে, আত্ম-অবিশ্বাসের হীনমন্যতা আক্রান্ত হয়ে, ঈর্ষা কাতরতায় তরুণদের নিজস্ব আত্ম সামর্থ্য শক্তি ক্ষয় হচ্ছে। তারা মদ্যপ হচ্ছে। অবসাদের তীব্র আগুন বুকে নিয়েই অসত প্রবৃত্তিতে চালিত হয়ে ক্রমে অপরাধ কেন্দ্রের দিকেই তারা ধাবিত হচ্ছে। যার সূত্রে আছে উন্নয়নের গাল ভরা কথ্য কথায় উপহাস্যকর গলাবাজির রাজনীতি। এই নাটকের মন্টু, পানু, কটা, বটু, চানু, এরা সবাই-ই  বেকারত্বের জ্বালায় মরে থেকে সামান্য কাজের সুযোগ চেয়ে ডাল ভাতের প্রত্যাশি হয়েই পা পিছলে পড়েছে। অন্ধগলির এইসব বাসিন্দারা শুধু স্বপ্ন পূরণ উন্মাদনার কারণে প্রকারান্তরে রাজনৈতিক চামচা বনতে বাধ্য হয়েছে। অঞ্চল দখলে কায়েম গুন্ডা লাগেই। সেই কায়েমি চক্রান্তে সামিল হচ্ছে তরুণ সমাজ। করুণার পাত্র হয়ে নেতাদের ক্ষমতার দাপটে অপকর্মে লিপ্ত হয়েই, গুলিয়ে ফেলছে লক্ষ্য এবং বিধেয়। এরা জানে না সমাজ বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা। রাজনীতির আদর্শিক তোয়াক্কা না করা এই অধপাতের চাল চিত্রেই বলি হয়ে যাওয়া যুব মানসের অক্ষম দশাকে, নির্মম সত্যে তুলে ধরেছে এই চৈতি রাতের প্রিয় নাটকের বিষয়, অভিনয়, আলো, আবহ মঞ্চ ইত্যাদির সবটুকুই। প্রতিবাদ বিহীন আত্ম স্বার্থ ভিত্তিক এক অনুগমন। অন্ধকারে তলিয়ে গিয়ে পুনরায় স্বপ্ন উদ্ধার কর্মে সামিল হবার অপচেষ্টা। আসলে রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা-করুণা বৃত্তে কাজ পাবার আশায় ধন্না দেওয়াতে, ক্লাব বাজিতে মজে ক্রমে কিভাবে ধান্দা বাজিতে একজন যুবক গিয়ে পৌঁছায়। তার পরিনাম চাক্ষুষ করাতে, মানুষের নামে মানুষ ঠকাবার রাজনৈতিক দৌরাত্ম-স্বার্থের চেহারা চেনাতে, যুবকদের অনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যবহৃত হওয়াতে, এই নাটকের ঘটনাগুলি বড্ড বাস্তব এবং চেনা। 

চানুকে ভালবেসে বিয়ে করা নিয়ে স্বপ্ন মগ্ন যুবক মন্টুর গড়ে তোলা উদ্দীপনা নাটকের চমৎকার এক আবেশ। চানুকে বিয়ে করে মন্টুর সংসার গড়ার উত্তপ্ত সাধই মন্টুকে বিবিধার্থ আত্ম প্রতিষ্ঠা সংগ্রামে টেনে নিয়ে গেছে। ঘটনা থেকে ঘটনা ক্রমে সে ছুটে বেড়িয়েছে। তারপর একদিন বিয়ে হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাশিত চাওয়ার অনটন মেটেনি। তাই চানুর শখ পূরণে বার্থ হয়েছে মন্টু। এই সুযোগে চানুর আহ্লাদিত বিলাসী মনকে শিকার করেছে রাজনৈতিক ক্ষমতা পুষ্ট পাড়ার প্রমোটার দিলুদা। ভাগ্য ফেরাতে বিলাপ বকেছে মন্টু। সাথে মিশেছে পানু। এতোটা বোঝে না ভাবে না কটা, বটুরাও। তারা মস্তানি করেছে। এর মধ্যেই শ্যামদা লটারির টিকিট বিক্রি করেছে, এদের সাথে মিশেছে, মদ খেয়েছে। কিন্তু নীতিগত পরিবর্তনের শিক্ষা দিতে পারেনি সে। দাঁত নেই শ্যামদার। সে কাউকে কামড়াতে পারে না। না পারুক কিন্তু সমাজ বদলের পথ তো সেই বলতে পারতো? এখানেই এক আদর্শের পাঠমালা নাটক পেতে পারে কিনা, তা ভাবা দরকার। এদিকে শ্যামদার চোখের সামনেই পানুর বিরোধী হয়ে ওঠা। দিলুদার পুলিশ লেলিয়ে ধরিয়ে দেওয়া। আগ্নেয় অস্ত্র রাখার অপরাধে জেলে পাঠানো। তবে শ্যামদা কী করলেন এই নাটকের প্রতিপাদ্যের প্রতিষ্ঠায়? তা ভাবতে হচ্ছে, এই চরিত্রটি নাটকের কাজে কীভাবে লাগতে পেরেছে, তাই। মদ, জুয়া, ক্যারামের মধ্যেই বীতশ্রদ্ধ এই তরুণ পথ দেখাবার কিছুটা ঈঙ্গিত আসা দরকার ছিল। শ্যামদা ছিল যথার্থ সুযোগ। এই নাটকে শুধু চলমান তরুণদের অবরুদ্ধ জীবনের গল্পই বলেছেন সুদীপ্ত দত্ত। ঘটনায় মোচড় ছিল। কিন্তু কোথাও কিছু খোয়ানোর সম্ভাবনা অলক্ষ্যে থেকে গেছে কিনা, খুঁজে দেখার অনুরোধ করছি। পথের শেষ কোথায়, তাও তো ভাবতে হবে, নাকি?  তবে নিজের লেখা নাটকটির, ঘটনার দ্রুত এবং চমৎকার সঞ্চালনা ও অভিনয় প্রকৃয়ায়, তার নির্দেশনার মাপা আনুপাতিক বিশ্লেষণে এই নাটক দেখতে বসে মুগ্ধ হতে হয়।

যেহেতু এই গল্পটা, একেবারে ভাগ্য ভিত্তিতে সরল ব্যাখ্যায় গড়া। কর্মের দিকে তৎপর নয়। আবেগে ভেসেছে মন্টুর অসজাগ মনন। তাই উত্তরণের উপায় পায় না গল্পের পরিণাম। নিরুপায় এক হনন মেরুতে আটকে থাকে মন্টুর অশিক্ষিত চেতনা। বিশেষত মন্টুই তো চাক্ষুষ করেছে, তার স্ত্রীর লোভী স্খলনকে। প্রতিবিধায়ক রাজনৈতিক দাপটের কাছে তার নতি স্বীকার যুব মানসের অক্ষমতাকে চিহ্নিত করে। সেই দৃশ্য, যে দৃশ্যে তাদের স্বামী স্ত্রী’র দাম্পত্য বিছানায় চানুর সাথে প্রেমে মত্ত দিলুদার শুয়ে থাকা আংশিক ঘনিষ্ঠতার দৃশ্য দেখেও যথার্থ উদীপ্ত হতে পারে নি সে। তার এই মেনে নেওয়া তো আংশিক পঙ্গু যুব সমাজের চেহারা দেখানো। যদিও বাস্তব। অজানা নিরাপত্তা হীনতায় প্রচন্ড ভয়েই হয়েছে নাটকের এই অনিবার্য পরিণতি। এখানে প্রশ্ন আছে। দাসত্বের জীবনে এমনটা হতেই পারে, বহু কাহিনী আছে এমন। কিন্তু এখন তো অন্য পৃথিবী। সেখানে চালিত শক্তির যাবতীয় সম্ভাবনায় মন্টুর শঙ্কিত হওয়া উচিত ছিল। তাছাড়া মন্টুকে সজাগ করতে শ্যামদাই তো যথেষ্ট বড় উপস্থিতি ছিল। তিনি কেন এসেছেন নাটকে, তার প্রশ্ন ওঠে। নাটকের বিষাদে ভরে যাওয়া স্ফুলিঙ্গ-উচ্ছ্বাস, যেভাবে হতাশা জনক হয়ে ওঠে। নিশ্চিতই প্রতিকার নেই, এ কথা মেনেও বলছি, একটা শুদ্ধ মন কী একেবারেই শক্তিহীন হয়ে পড়ে পড়ে মার খাবে? পুরুষ শাসিত সমাজে পৌরুষ অঙ্গীভূত প্রাথমিক শর্তে, যে কোন মনই নিজের স্ত্রী, নিজের পরিবার সম্বন্ধে সচকিত থাকারই কথা। তাই অবলীলায় এই ঘর ভাঙ্গার মর্মান্তিক গল্প, মনে ভয়ঙ্কর চাপ দেয়। উপায় কী, তা খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু এতসব আলোচনার পরেও বলতে হয়, এই নাটকের সহজ সরল চলা সময়ের আয়নায় জ্বলন্ত ও নির্মম অন্ধ বাস্তবতা। যা নাটকে সামর্থ্যের পরিপূর্ণতায় সুন্দর করে ধরতে পেরেছে। তাই এটি দর্শক ধন্য হয় অনায়াসে। শুধু চাওয়া….গল্পের অন্তিমদশা আমাদের কিছু ভাবনায় ভাবাক।

নাট্য গল্পে বলা চরিত্রে, কোন কারোর অভিনয়ই বিফলে যায় নি। তবুও মনে হয়েছে, শ্রেষ্ঠ উপস্থিতি শ্যামদার ভূমিকায় নব কুমার চৌধুরীর অনবদ্য চরিত্র জ্ঞান। জীবন যুদ্ধে এমন পরাজিত নায়কের  দেহের নানা বিভঙ্গ ও দাঁত হীন মুখের সংলাপ প্রক্ষেপণ চমৎকার ব্যঞ্জনা দিয়েছে। অসম্ভব ভয়ের প্রতীক হয়েছে সমরেশ সাহার দিলুদা’র চরিত্রটি। একজন দক্ষ অভিনেতা উনি। চানু’র ভূমিকায় পারমিতা সিংহ রায়ের প্রতিটি অভিব্যক্তি এতো নিখুঁত, বডি লাংগুয়েজ এতটাই মানানসই। যা এই নাটকের বিশিষ্ট শক্তি। তবে সবার উপরে দেবাশীস মুখার্জীর মন্টু এক ঝর্না ঝুঁকি নদীর চলা। কবিতার মতো সরল এই চরিত্র দেখেই অভিনেতার জাত চেনা গেল। আকাশ প্রসাদের কটা, আকাশ ভৌমিকের বটু চরিত্র দু’টিও ভীষণ তাৎপর্যময়। পানু চরিত্রে অনির্বাণ সেনগুপ্ত এবং কুনাল চক্রবর্তীও যথাযথ। প্রত্যেকের অভিনয় এবং আলো ও সঙ্গীতের দ্যোতনা চৈতি রাতের প্রিয় নাটকের একটি সমন্বিত শিল্প চেহারা দিয়েছে। এমন নাটকের কাছেই দর্শক অবনত থাকতে চায়।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -