গুরুকুলে আমার মুহুর্তরা

- Advertisement -

সুচরিতা বড়ুয়া চট্টোপাধ্যায়

আসলে কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে, যে মুহূর্তগুলোয় মনে হয় আমরা আছি, বেঁচে আছি নরম ভাবে বেঁচে আছি। সেই মুহূর্তগুলোকে চিরস্থায়ী করার এক তীব্র ইচ্ছায় আমার কিছু কথা আমতা পরিচয় গুরুকুলকে নিয়ে। 

ঋতুপর্ণা আমার আদরের বোন, আমাদের বি-থিয়েটারের এক কান্ডারী… ও যখন একদিন হঠাৎ ফোন করে বলল, ‘দিদি এই তারিখটায় তুমি অবশ্যই আসবে। আমাদের গুরুকুলে-  বিশেষ একজন মানুষ আসছেন বাংলাদেশ থেকে তাকে আমরা সম্মাননা দেব তোমার হাত দিয়ে’- এছাড়া তাঁরই লেখা একটা নাটক অভিনীত হবে।

মনে আনন্দের সুর বেজে উঠলো। বহুদিনের ইচ্ছে ছিল বোনের এই সাধের গুরুকুল দেখার- কিছু ভিড়ের অলিগলি পেরিয়ে যখন দুপাশে সরষে ফুলের বিছানো হলুদের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলাম- মনের ভিতর একটাই ভাবনা ছিল প্রকৃতির এত কাছে বলেই আমার বোন এত সুন্দর এত স্বচ্ছ। অভিনয়ের আনাচ কানাচ এতো সহজে স্পর্শ করতে পারে। 

পৌঁছে গেলাম আমতা পরিচয় গুরুকুলের আঙিনায়। চারিদিকের সাদা কাশ ফুলের মধ্যে জমির একটু পথ পেরিয়ে গুরুকুলকে ছোঁয়া যায়। পথের দুপাশে এমনভাবে সাজিয়ে তোলা, যা দেখে মনে হচ্ছিল এই তো এমনই তো হওয়ার কথা ছিল থিয়েটারের মন্দির। যেখানে মন খুলে প্রাণ খুলে জীবনের কথা বলতে পারব। ঋতু তখন দেবযানীর রূপসজ্জায় ব্যস্ত।

আমাকে দেখে ওর চোখ ভরা হাসির স্পর্শে মন স্নাত হয়ে গেল। এগোলাম- শুভেন্দু এগিয়ে এসে আপ্যায়ন করল, মেয়েরা কপালে চন্দনের টিপ দিয়ে বরণ করল। আহা, এ যেন এক সত্যিকারের আশ্রমে প্রবেশ করলাম। আমার আগেই আমার কিছু পরিচিত থিয়েটারের মানুষ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বিশিষ্ট গবেষক আশীষদা, আশীষ গোস্বামী উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিক নাটককার মাহফুজা হিলালি এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন, বাংলাদেশের মানুষগুলো এত মিষ্টি হয়, এত তাড়াতাড়ি আপন করে নেন।

আমরা বসলাম ওই গুরুকুলের একধারে বানিয়ে তোলা এক বৈঠকখানায়, খোলা আকাশের নিচে। কি যে ভালো লাগছিল। সকলে মিলে পারস্পরিক জানা-অজানা কথায় বুনে চললাম কিছু অসাধারণ মুহূর্ত। নাটকের ফার্স্ট বেলের মত শুভেন্দু এসে জানান দিল- নাটক শুরু হতে চলেছে, আমরা যেন ওদের অন্তরঙ্গ মঞ্চের ঘরে প্রবেশ করি। করলাম।

সত্যিকারের আশ্রম সত্যিই কোনদিন দেখিনি। কিন্তু সেদিন মনে হচ্ছিল গুরুকুল  নামটি সার্থক। মঞ্চটি সেদিনের নাটকের বিষয়বস্তু নির্ভর করে নানা স্তরে সাজানো হয়েছে। অ্যাক্টরস লেফটে চারজন বসে আছে গেরুয়া বসন পড়ে।

মনটা কেমন স্নিগ্ধ হয়ে গেল ওদের দেখে- শুরু হলো মাহফুজা হিলালীর লেখা নাটক ‘দেবযানী’। নাটকটির নির্দেশক শুভেন্দু ভান্ডারী, সেট মানে মঞ্চসজ্জা করেছে রাজু খান। নাটকের সুর  বুনেছেন প্রভাত বাউল ও কৌস্তব রায়। কৌস্তবের সাথে ছিল রূপ সাঁতরা, রবি পুরকাইত।

নাটকটির অভিনয় করেছে বোন ঋতুপর্ণা একা।  বাঁশি করতাল ঢোলের সুরে সুরে কন্ঠের মাদকতায় শুরু হল ‘দেবযানী’ নাটক। এই নাটকটির এত মায়া আর বোন ঋতু  ভিতরে ভিতরে অভিনয়ের সূক্ষ্ম তারগুলিকে বাজিয়ে অন্তরস্পর্শ করেছে, মনের ভিতরটা কেমন বৃষ্টিধারায় ভিজে যাচ্ছিল। দেবযানি-কচের ঘটনার স্পর্শে রচিত এই নাটকটি এক বাউল ঘরের কথা।

এত মায়ায়  মায়ায় নাটকের সংলাপগুলি জড়িয়ে ধরেছিল, সেখান থেকে বের হতে পরে অনেক সময় লেগেছে। বিষয়বস্তু নিয়ে কথা পরে না হয় কোন এক সময় বলা যাবে। শুধু বলি, নির্দেশনায় মঞ্চসজ্জায় সুরের মায়ায় ঋতুর অভিনয়ের তীব্রতায় আমরা ডুবে গিয়েছিলাম। নাটক শেষে মাহফুজা হিলালিকে সম্মাননা দেওয়া হলো।‌ ঋতুর কাছের কিছু মানুষকে সম্মান জানানো হলো।

গুরুকুল আমাকে জানান দিল থিয়েটার আসলে এখানেই… দর্শকদের স্পর্শ করার দূরত্বেই সে বাস করে। এ‌ হেন গুরুকুল সম্পর্কে কিছু জানব না ? জানি…

ঋতুপর্ণা ছোট্ট থেকে থিয়েটারের জীবনে জড়িয়ে ছিল। থিয়েটার পরিবারে থাকা, একান্নবর্তী পরিবারের যত্নে বড় হওয়া ঋতু চেয়েছিল সারা জীবন সকলকে নিয়ে বেঁধে বেঁধে থাকতে। আর শুভেন্দুর স্বপ্ন ছিল এমন একটি থিয়েটারের আঙিনা তৈরি করা যেখানে ২৪ ঘন্টা শুধুমাত্র থিয়েটারের জীবন-যাপন হবে।

দুজনের স্বপ্ন মিলেমিশে এক হয়ে জন্ম দিয়েছিল এই গুরুকুলের- ওদের মনে এই স্বপ্নের প্রথম বীজ বুনে দিয়েছিলেন স্যার শ্রী রতন থিয়াম, যিনি রবীন্দ্রভারতীতে এক কর্মশালায় এসেছিলেন, সেইসময়। এরপর ২০০২ সালে ‘কাঠ’ নাটকটা দেখতে গিয়ে উড়িষ্যায় সুবোধ স্যারের নাট্যগ্রাম দেখে তাদের মনের বীজ একটু একটু করে ডানা মেলছিল। ২০১৩ সালে তাদের সেই বীজ অঙ্কুরিত  হল।

ইতিমধ্যে তাদের নাট্যচর্চা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির জন্য বারবার বাধা প্রাপ্ত হচ্ছিল। তারা যে রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাস করে সেই বিশ্বাসের সঙ্গে ওখানকার মানুষের বিরোধ বাঁধছিল বারবার। ফলে তারা যাযাবরের মতো কখনো সরপোতা গ্রামে দু কামরার ঘর ভাড়া নিয়ে রিহার্সাল শুরু করে, ৮/৮ মাপের ঘরে প্রায় ১৫-১৬ জন দিনরাত এক করে রিহার্সাল দিত।

সেখানে গরমে এক রকমের কষ্টে, শীতে আরেক রকমের কষ্টে তাদের থিয়েটার চর্চা চলতো নিরবিচ্ছিন্নভাবে। কিন্তু বর্ষাকাল আসলেই তাদের রিহার্সাল বন্ধ হয়ে যেত। এই রকম বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হতে মনের স্বপ্ন বাস্তবের পথে এগিয়ে আসলো।

ওদেরই  জমিতে যেখানে আগে চাষ হতো কিন্তু বেশ কিছুদিন চাষ বন্ধ ছিল, সেখানে মাটি উঁচু করে আটচালা বাঁধা হল।  বাঁশ দিয়ে ঘেরা হলো চারদিক, উপরে খড়ের চাল। এর চেয়ে বেশি ভাবার ক্ষমতা ছিল না সেইসময় ঋতুপর্ণা আর শুভেন্দুর- আর্থিক পরিস্থিতি তাদের ভীষণভাবে ধাক্কা দিচ্ছিল। ওই সময় কিছু অসামাজিক ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল ওদের।

পাশে পেয়েছিল সেইসময় অর্পিতাদিকে এবং সেখানকার বিধায়ককে- তাদের আশ্বাসে ঋতু আর শুভেন্দুর স্বপ্ন ডানা মেললো আকাশে- এই গুরুকুলের শিলান্যাস হয়নি।

কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৭ সালে উদ্বোধন করেছিলেন বিধায়ক শ্রী সমীর কুমার পাঁজা। তাদের স্বপ্ন আশ্রমিক ভাবনা এই গুরুকুলে রূপ পাক। আর অবশ্যই ২৪ ঘন্টার থিয়েটার চর্চার কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠুক, এই ভাবনাকে প্রশ্রয় দিয়ে ড. আশিস গোস্বামী নাম দিলেন গুরুকুল পরিচয়।

আমতা স্টেশন থেকে ৮ কিমি, বাসস্ট্যান্ড থেকে ৭ কিমি ভেতরে প্রেমরোডের ধারে ঋতু আর শুভেন্দুর এই গুরুকুল। এই গুরুকুল চারকাঠা জায়গা নিয়ে তৈরি। এখানে ২০×২৫ বর্গফুট রিহার্সালের স্পেস আছে, সঙ্গে বাথরুম। ১৩/১২ একটা মেকআপ রুম সঙ্গে ৮/৮- এর বাথরুম, ১২/১২-এর একটা ক্যান্টিন (যেখানে গুরুকুলের মেয়েরাই অতি যত্নে সবার জন্য খাবার তৈরি করে), ১২/১০-এর একটি কম্পিউটার রুম, ১০/৮-এর একটি লাইব্রেরী, এছাড়াও আছে ২ কাঠা জায়গার একটি মুক্তমঞ্চ, ১ কাঠার একটা ছোট্ট পুকুর, ১টা ওপেন এয়ার মেডিটেশন স্পেস, ৬ কাঠার জায়গায় জৈব পদ্ধতিতে চাষের জায়গা। এসব ছাড়াও বাইরে দুটো পাকা বাথরুম ৫০০ বর্গফুট স্পেসটিতে ৫০ জন দর্শক বসতে পারে। এই সময় পাঁচটি ৫০০ ওয়াট হ্যালোজেন ছাড়া কিছু নেই। কারণ ২০১৫ সালের বন্যায় সবটা নষ্ট হয়েছে। সাউন্ড সিস্টেমে ১২ চ্যানেলের মিক্সার মেশিন একটি কর্ডলেস মাইক্রোফোন পাঁচটি ল্যাপেল ইত্যাদি রয়েছে।

কালো পর্দা দিয়ে চারিদিক ঘিরে দেওয়া যায়। আলাদা করে কোন কার্টেন বা উইংস-এর ব্যবস্থা নেই। আসলে ওরা গ্রাম্য পরিবেশে যতটুকু গ্রামের প্রয়োজনে করা যায় সেটুকুনই করার চেষ্টাই ঋতুরা করেছিল। খাবার ব্যবস্থা আগেই বলেছি মেয়েরাই করে, চা ছাড়া অন্য কোন নেশার দ্রব্য এখানে বর্জনীয়।

ফিরে আসবার সময় ভাবছিলাম, থিয়েটার জীবনযাপনের এই দুঃসময়ে যেখানে মানুষ একে অপরের হাত ধরে না, এক অদ্ভুত কুপমন্ডুকের জীবন কাটায়, সেখানে আমতা পরিচয়-এর এই গুরকুল যেন এক পশলা বৃষ্টি।

থেকে যেতে ইচ্ছে করছিল ভীষণভাবে বারবার ঋতু আর নতুন বান্ধবী মাহফুজা হিলালী অনুরোধ  করেছিল। কিন্তু সেই হৃদয়ের স্পর্শ মাখা মায়ার বাঁধন কাটিয়ে আমার এই চাকুরে জীবনে ফিরতে হয়েছিল। ভালো থাকিস বোন ঋতু। তোদের স্বপ্নমাখা এই গুরুকুল থিয়েটারের আকাশে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করুক।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -