গ্রামথিয়েটার-কেন থিয়েটার-কোন থিয়েটার-কোথায় থিয়েটার

- Advertisement -

অনুপ চক্রবর্তী

অনেক ঘাম ঝরিয়ে নাটক হয়। অনেক গতিশীল দুরন্ত স্বপ্নকে মনের মধ্যে লালন করে নাটক হয়। প্রসবোন্মুখ শিশুর মতো যা বেরিয়ে এসে মঞ্চকে আলোড়িত করার জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠে। থিয়েটার গড়ে ওঠে এভাবেই। তা নাগরিক সমাজের মহার্ঘ প্রেক্ষাগৃহে হোক কিংবা গ্রামের মাচা বাঁধা মঞ্চে হোক। উলুবেড়িয়া মহকুমার নাট্যচর্চা সম্পর্কে সীমিত অথচ দীর্ঘকাল ব্যাপী কিছু অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এটুকু না বলে উপায় নেই যে নাট্যপিপাসু মানুষদের এখানে সাধ আছে কিন্তু সাধ্য নেই। এই সাধ্য কিন্তু ব্যক্তিগত প্রতিভা, দক্ষতা বা কর্মকুশলতার ব্যাপার নয়। কেননা ছাই চাপা রতনের মত প্রতিভা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামের অন্ধকারেও ছড়িয়ে আছে। আর দক্ষতা বা কুশলতার জন্ম ও বিকাশ প্রাপ্ত সুযোগ বা সুযোগহীনতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

যে প্রতিভাময়ী মেয়েরা শশাটি বা বহিরা বা বানীবন থেকে সপ্তাহে তিন দিন ফুলেশ্বরে এসে রিহার্সাল দেয়, তারা যদি তাদের প্রস্ফূটিত হতে থাকা প্রতিভার বিকাশের বিশেষ সুযোগই  না পায় শুধুই সুযোগের অভাবে, তাহলে ক্ষতিটা হবে বাংলা থিয়েটারেরই। যে সুযোগ সরাসরি অর্থের সঙ্গে যুক্ত। যে অর্থের ভয়ানক অভাবের জন্য সংশ্লিষ্ট কপর্দকশূন্য অথচ সিরিয়াস কোন গ্রুপথিয়েটার তাদের অভিনয় করার প্রতুল সুযোগ করে দিতে পারে না। তারপর হয়ত কেউ কেউ বিবাহোত্তর সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করে  থিয়েটার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হ্যাঁ। এভাবেই হয়ে যায় বহু প্রতিভার অপমৃত্যু। ফুল হয়ে ফুটে ওঠার আগেই যা ঝরে পড়ে।

বিশাল উলুবেড়িয়া মহকুমায় আছে কেবলমাত্র একটি প্রেক্ষাগৃহ। এবং তা উলুবেড়িয়া শহরে। যার এক দিনের ভাড়া দশ হাজার টাকা। খারাপ acoustics এর কারণে নাটক করার জন্য বাইরে থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে মাইক্রোফোন ভাড়া করতে হয়। আর নাটক চলাকালীন হঠাৎ বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে নাটক বন্ধ হওয়ার থেকে বাঁচার জন্য চার হাজার টাকা খরচ করতে হয় জেনারেটর ও তেলের জন্যে। এছাড়া ন্যূনতম প্রয়োজনে বাইরে থেকে সামান্য আলোর ইকুইপেন্ট ভাড়া করতে হয় কয়েক হাজার টাকার। কারণ তা প্রেক্ষাগৃহে লভ্য নয় ৷

সুতরাং মোট খরচ কুড়ি হাজার টাকা ছাপিয়ে যায়। অথচ কলকাতার সরকারী শিশির মঞ্চের ভাড়া মাত্র দুহাজার টাকা। এছাড়াও কখনো কখনো অজানা যান্ত্রিক কারণে এমনই শব্দ সমস্যা হয়, যে দর্শক নাটকের কোন কথাই শুনতে পায় না।। সর্বোপরি শীতকাল ছাড়া এই প্রেক্ষাগৃহে নাটক করা যায় না। কেননা এটা শীততাপনিয়ন্ত্রিত নয়। আর গরমকালে পাখা চললে নাটকের কোন সংলাপ শোনা যায় না। এই হলো উলুবেড়িয়ার একমাত্র প্রেক্ষাগৃহ। বিশাল এই মহকুমায় অসংখ্য গ্রামে অসংখ্য তরুণ তরুণী তাহলে কিভাবে তাদের লালিত স্বপ্নের রূপায়ন করতে পারবে? কিভাবে তারা নাটক করবে? যদি মঞ্চায়নের সুযোগ না পায়, তাহলে কিভাবে তাদের নাট্য প্রতিভার বিকাশ ঘটবে? রাষ্ট্রযন্ত্র এই বিকাশের জন্য কতটুকু করে তার ইঙ্গিত তো দিলাম। তাহলে তারা পাড়ায় পাড়ায় মাচা বেঁধে নাটক করবে? তাও অনেক অর্থের ব্যাপার। শরীরের সমস্ত রক্ত যদি মাথায় গিয়ে পৌঁছতে থাকে, তাহলে শরীর বাঁচে না।

নাটক করার সুযোগ যদি শুধু কলকাতা ও মফস্বলের কিছু প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে গ্রামীণ লোকসমাজে নাটক বাঁচবে কি করে? তার বিকাশ হবে কী করে? হবে না। তাই খুব নেতিবাচক শুনতে লাগলেও এটা সত্যি যে গ্রামে গ্রামে থিয়েটারের বদলে রমরমা অর্কেস্ট্রা জলসার। গ্রামের মানুষের বিনোদনের জন্য । শুধু উলুবেড়িয়া মহকুমা নয়, সব গ্রামেতেই একই অবস্থা। এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে দোষারোপ করা অন্যায়। কেননা উৎপাদন পদ্ধতি ও জীবিকার ব্যাপক পরিবর্তনের জন্য ভেঙে গেছে লোক সমাজের কাঠামো। অবক্ষয়িত হতে হতে প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে যাবতীয় লোকসংস্কৃতি। যা নিয়ে বেঁচে থাকতো গ্রামের সরল সাধারণ মানুষ। যেসব ছিল তাদের একমাত্র বিনোদন। পেটের খিদে মেটার পর যা মনের খিদে মেটাতো।

এর ফলে গ্রাম জীবনের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে এক ব্যাপক ও গভীর শূন্যতা। সেই শূন্যস্থান পূরণ করছে ব্যাপকভাবে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়া অপসাংস্কৃতিক ভালগার ড্যান্স সহ অর্কেস্ট্রার মতো প্রতিক্রিয়াশীল অপসংস্কৃতি। কেননা তা জীবনবিচ্ছিন্ন, আরোপিত, অনুকৃত, অপসাংস্কৃতিক এবং ভালগার। তাহলে গ্রামে গ্রামে অসংখ্য ছেলেমেয়ে,যারা পুঁথিগত শিক্ষার মুখ দেখছে, তাদের সংস্কৃতির বিকাশ কীভাবে হবে? শুধুই অনিয়মিতভাবে কিছু আবৃত্তি, ছবি আঁকা, রবীন্দ্র নৃত্য আর লিটল ম্যাগাজিনে একটু আধটু লেখার অতি সীমিত সুযোগের মাধ্যমে? কিশোর কিশোরী বা তরুণ তরুণীর যৌন প্রবৃত্তির সবচেয়ে সার্থক ও সুন্দর উদগমন হয় প্রধানত থিয়েটারের মাধ্যমে। এটাই আধুনিক সময়ের দাবী। বিকাশমান সমাজে কালের নিয়মে ব্যাপকভাবে আধুনিকীকরণ হয়ে চলেছে শহর ছাড়িয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে। এবং টেকনোলজির কুব্যবহার সত্ত্বেও এই আধুনিকীকরণ প্রগতির সহায়ক। চিন্তার সংকীর্ণতাকে তা ভেঙে ফেলে দেয়। মুক্তচিন্তার বিকাশের যা সহায়ক।

কিন্তু এই আধুনিকীকরণ যদি কেবলই স্মার্ট ফোন, facebook, ইউটিউব, whatsapp, ওয়েব সিরিজ, ওটিটির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে যা বিকাশ হয়ে দাঁড়াবে তা শরীর ও মনের পক্ষে উপযুক্ত সুস্থ সংস্কৃতি নয়। এক কিম্ভূতকিমাকার বিকৃত অসংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতি। যেখানে মনন ও মননের বিকাশ নেই। কল্পনা ও কল্পনার বিকাশ নেই। সহজ আবেগ ও সহজ আবেগের বিকাশ নেই। যা প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন ও আনরোমান্টিক বা অ্যান্টিরোমান্টিক। যা শুধুই নিছক যৌনতাকেন্দ্রিক বা কখনো কখনো রিরংসার ব্যাপার। বর্তমানে সর্বাত্মক এই অপসংস্কৃতি বা অসংস্কৃতি। মানুষ এখন গান শুনতে পায় না। প্রতিদিন ছুতোয় নাতায় অহরহ তাকে শুনতে বাধ্য করা হয় বিকৃত আপাত নিষিদ্ধ ডিজের বাজনা ও তারস্বরে বাজানো কদর্য নানা মিউজিক। এতে তার শরীর ও মনের ভয়ানক ক্ষতি হয়। মানুষের সাংস্কৃতিক সত্তার ওপর এই ভয়ানক ও নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণ চলতে থাকে প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনগুলোর সক্রিয় উদ্যোগে। এবং অবশ্যই প্রশাসনের প্রশ্রয়ে।

কেননা সবাই জানে এই প্রশ্রয়ের সঙ্গে জড়িত থাকে রাজনৈতিক স্বার্থ। সাধারণ অসহায় মানুষ চুপ করে থাকে। সহ্য করতে বাধ্য হয়। কেননা তারা জানে প্রতিবাদ হবে নিষ্ফল। বরং প্রতিবাদ করলে সে হবে আক্রান্ত ও শব্দশহীদ। তাহলে কোথায় থিয়েটার? গ্রামের মানুষদের, গ্রামের ছেলে মেয়েদের, তরুণ তরুণীদের কি সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশের সুযোগ পাওয়ার অধিকার নেই? তারা কি শুধু সারা বছর ডিজের বাজনা শুনবে আর মোবাইলের মধ্যে তাদের চিন্তা ভাবনা কল্পনা অনুভূতি আবেগ সবকিছু বিসর্জন দিয়ে সংস্কৃতিহীন, মননহীন, অনুভূতিহীন, আবেগহীন, প্রেমহীন, আনরোমান্টিক শুধুই যৌনতাকেন্দ্রিক অদ্‌ভুত সত্তায় পরিণত হবে? ব্যতিক্রম বাদ দিলে গ্রামাঞ্চলে নাটক হয় না। কেননা গ্রামের ছেলে মেয়েরা নাটক করার সুযোগ পায় না। তারা জানেই না নাটক জিনিসটা কী। কলকাতায় গিয়ে নাটক দেখার পয়সা তাদের নেই। তাই তাদের সে ব্যাপারে উৎসাহ নেই। গ্রামের স্কুলে স্কুলে নিয়মিত নাট্য চর্চা হয় কি? যেখান থেকে তারা নাটক জিনিসটা কী সেটা শিখবে বা অনুপ্রাণিত হবে ভবিষ্যতে নাটক করতে?

না। ব্যতিক্রম বাদ দিলে গ্রামের স্কুলগুলোতে নিয়মিত শুধু নয় অনিয়মিতভাবেও বা অনেক ক্ষেত্রে কোনদিনই ছেলে মেয়েদের নিয়ে নাটক করানো হয় না। অথচ নাটক অন্যতম কোকারিকুলার বা সহপাঠ্যক্রমিক কাজের মধ্যে পড়ে। শুনতে তিক্ত শোনালেও ব্যতিক্রমবাদ দিলে এই দায়িত্ব পালন করা হয় না স্কুলগুলোতে। এবং তাই ছেলে মেয়েদের সাংস্কৃতিচেতনার বিকাশ হয় না। তারা জানতেই পারে না থিয়েটার জিনিসটা কী। জানলে তো তবে তারা উত্তরজীবনে থিয়েটার করবে। শুধু স্কুল নয়, ব্যতিক্রমবাদ দিলে কলেজেও এই সুযোগ পায় না ছেলেমেয়েরা। তাহলে তারা কী সুযোগ পায় না? তারা শিক্ষায়তনে সুযোগ পায় না নাটক করার বা নাটক জিনিসটা কি তা জানার। পয়সা না থাকায় তারা সুযোগ পায় না কলকাতায় গিয়ে নাটক দেখার। কুড়ি হাজার টাকা খরচ করে মহকুমার একমাত্র প্রেক্ষাগৃহে নাটক করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাদের পক্ষে এটাও সম্ভব হয় না অনেক খরচ করে পাড়ায় মাচায় বেঁধে নাটক করার।

তাইতো তারা আটকে গেছে এই দায়িত্ববোধহীন নির্মম সামাজিক কাঠামোয় ও অনভিপ্রেত অসুস্থ পরিবেশে স্মার্টফোনের স্ক্রীনে আর অর্কেস্ট্রায়। আর বিপুল গতিতে এই সমাজ ক্রমশ পরিণত হচ্ছে এক বিকৃত দানবে যা তাদেরই গ্রাস করে চলেছে। এইসব হলো তিক্ত ও আশাহীন নেতিবাচক কথা। কিন্তু এইসব মর্মান্তিক বিষ উদগীরণই এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্যটা ইতিবাচক। ব্যাধিকে চিহ্নিত করলে তবেই তার নিরাময় সম্ভব। তাহলে এক্ষেত্রে কিভাবে নিরাময় হবে? আবহমানকাল ধরে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে রাষ্ট্রযন্ত্র সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশের স্বার্থে বিশেষ কিছু করেনি। করেছে অভিজাত শ্রেণীর সংস্কৃতির চর্চার জন্য। Downward filtration এর মতো চুঁইয়ে পড়ে সেই সংস্কৃতির কিছু কিছু জিনিস সাধারণ মানুষ যে পেয়েছে সে কথা সত্য।

কিন্তু গ্রামের লোকসমাজ বেঁচে ছিল মূলত গ্রামের লোকসংস্কৃতি নিয়ে। শুনতে ভালো না লাগলেও কালের নিয়মে সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের সঙ্গে যা প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। সেই বিলীয়মান লোকসংস্কৃতিকে পরিবর্তিত সমাজ কাঠামোতে ফিরিয়ে আনার কৃত্রিম চেষ্টা করা প্রগতির সহায়ক নয়। কেননা যা প্রাচীন তাকে আঁকড়ে থাকলে সামনে এগোনো যায় না। সেটাও আরোপিত হয়ে যায়। তাই গ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্য, গ্রামের মানুষদের জন্য প্রয়োজন গ্রামের থিয়েটার। এই থিয়েটার তারা করবে অত্যন্ত স্বল্প খরচে বা বিনা খরচে। মাঠে ঘাটে হাটে বাজারে স্কুলে পুজোমণ্ডপে। তারা করবে ইন্টিমেট থিয়েটার বা বাদল সরকারকে অনুসরণ করে থার্ড থিয়েটার। প্রসেনিয়াম থিয়েটার নয়। কেননা তার সুযোগ নেই। সেসব করার পয়সা নেই। দূর অতীতে লোকনাট্য হতো পয়সা খরচ না করে। গ্রামের মানুষরা করত। গ্রামের মানুষরাই উপভোগ করত। তাদের নিজস্ব আবেগ দিয়ে। রাষ্ট্রযন্ত্র বা অভিজাত শ্রেণী সেসবের পৃষ্ঠপোষকতা করত না।

সেই আবেগ ফিরিয়ে আনতে হবে। গ্রামের জীবনের বাস্তবতা নিয়ে গ্রামের ছেলেমেয়েদেরই নাটক লিখতে হবে। এমনভাবে এমন নাটক লিখতে হবে যা তাদের জীবনকে, সময়কে প্রতিফলিত করে, যা তাদের সংগ্রাম আবেগ প্রেম স্বপ্ন বিক্ষোভ রোমান্সকে নাটকের মধ্যে জীবন্ত করে তোলে, তাদের অনুপ্রাণিত করে, তাদেরকে বাঁচার অক্সিজেন দেয়। এই অক্সিজেন রাষ্ট্র তাদের দেবে না। এই অক্সিজেন গ্রামীণ অভিজাত শ্রেণী তাদের দেবে না। এই অক্সিজেন গ্রামের সুবিধাভোগী শ্রেণী তাদের দেবে না। এই অক্সিজেন তাদেরকেই সৃষ্টি করতে হবে। তার মধ্যেই তাদের প্রশ্বাস নিতে হবে। বেঁচে থাকতে হবে। সৃষ্টির আনন্দে উদ্বেলিত হতে হবে। তাদেরই জীবন নিয়ে, তাদেরই লেখা, তাদেরই তৈরি করা এই নাটক হবে তাদের নিজস্ব সুস্থ থিয়েটার সংস্কৃতি ।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -