বিজয়কুমার দাস
থিয়েটারের নতুন প্রজন্ম: পর্ব ২০
রূপনারায়ণপুরের শুভদীপ চৌধুরী থিয়েটারকে ভালবেসে যুক্ত হয়েছিল থিয়েটারে। আসানসোল চর্যাপদ রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য নাট্যদল। রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে এই নাট্যদল নানা কুশলী নির্দেশনার স্বাক্ষর রেখে বেশ কিছু আকর্ষণীয় প্রযোজনা নির্মাণ করেছে। শুভদীপ সেই চর্যাপদের একজন দায়িত্বশীল নাট্যপ্রাণ অভিনেতা। অথচ ভারতীয় ডাক ও তার বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মী শুভদীপের থিয়েটার না করলে হয়তো কিছুই ক্ষতি হত না। কিন্তু থিয়েটার করার ইচ্ছাটা তাকে তাড়া দিয়েছে। সেই থিয়েটারপ্রীতির ফলেই২০১২ সালে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে নান্দীকার নাট্যদলের ছয় মাসের কর্মশালায় যোগ দিয়েছিল শুভদীপ। তখন সে যথারীতি চাকরীতে যুক্ত। তবু শনিবার ৩ টে থেকে রাত ৮ টা ও সোমবার বিকেল ৫ টা থেকে রাত ৮ টার ক্লাস করতে ছুটত। কিন্তু বাদ সাধল চাকরীর দায়িত্ব। সপ্তাহে দুদিন অফিস কামাই করে কলকাতায় গিয়ে থিয়েটার করা সম্ভব হচ্ছিল না। সমস্যা হচ্ছিল অফিসে। সেটা অনুভব করেই গোটা ছয়েক ক্লাস করে নান্দীকারের কর্মশালা তাকে ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু থিয়েটারটা ছাড়েনি শুভদীপ।
২০১২ সালে নান্দীকার কর্মশালায় যুক্ত হয়ে গোটা কতক ক্লাস করে সম্ভবত তার থিয়েটারের ক্ষিদেটা বেড়ে গিয়েছিল। থিয়েটারচর্চা চালিয়ে যাওয়ার মত একটা নাট্যদল খুঁজছিল মনে মনে। ২০১৪ সালে আসানসোল বাসস্ট্যান্ডে নাট্য উৎসবের একটা ছেঁড়া পোস্টার তার চোখে পড়ে। আসানসোল চর্যাপদের নাট্য উৎসবের পোস্টার সেটা। যোগাযোগের ঠিকানায় রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তীর নাম দেখে শুভদীপ একদিন রুদ্রর সাথে দেখা করে। তারপর থেকেই সে চর্যাপদের শুভদীপ হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা, শুভদীপ থিয়েটারটাই শিখতে চেয়েছিল ভাল করে। চলচ্চিত্রে বা দূরদর্শন ধারাবাহিকে অভিনয়ের মোহে সে থিয়েটার করতে আসেনি। থিয়েটারের অভিনয়টা রপ্ত করতেই তার থিয়েটারের প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল।সেই আগ্রহেই একদা আসানসোল থেকে কলকাতার নান্দীকারের কর্মশালায় নাম লিখিয়েছিল। সেটা ছেড়ে দেওয়ার আক্ষেপটা তার মিটেছিল চর্যাপদে যুক্ত হয়ে।

বাড়ির অভিভাবকরা স্পষ্ট করেই শুভদীপকে জানিয়েছিলেন, অভিনয় বা অন্যান্য কিছু করতে হলে আগে গ্রাজুয়েশন করতে হবে। কিন্তু তার আগেই ২০০৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে পড়াশুনো করতে করতেই সরকারী চাকরীর পরীক্ষায় বসতে শুরু করেছিল শুভদীপ। ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে চাকরীও জুটে যায় তার ভাগ্যে। পড়াশুনোয় ইতি চাকরীর কারণেই। তাই চাকরীটা পেয়েই তার খোঁজ শুরু হয় থিয়েটার প্রশিক্ষণ নিয়ে। সেই খোঁজের সূত্রেই নান্দীকারে থিয়েটার শিখতে গিয়েছিল বলে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছে শুভদীপ। তারপর চর্যাপদে আসা। অভিনয়ের টানে চর্যাপদে যুক্ত হলেও এই দলের অভিনয় সংক্রান্ত সব রকম কাজেই সে নিজেকে যুক্ত করেছে। নিজেকে একজন থিয়েটারকর্মী বলতেই সে পছন্দ করে। ভারতীয় ডাক বিভাগে চাকরী করার পাশাপাশি থিয়েটারে নিবেদিত প্রাণ শুভদীপ।
আসানসোল চর্যাপদের “বিষছায়া” নাটকে তার প্রথম অভিনয়। বিশিষ্ট নাট্য নির্দেশক অভি চক্রবর্তী নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তবে পরে শান্তিনিকেতনের একটি শো উপলক্ষে নাটকটিতে কিছু অংশ সংযোজন করে দলের প্রধান মুখ রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী। সেই সংযোজিত অংশেই শুভদীপ প্রথম অভিনয় করে চর্যাপদে। এখনও পর্যন্ত শুভদীপ শুধুমাত্র চর্যাপদ দলেই অভিনয় করেছে। অন্য কোন দলে অভিনয় করেনি।
তার অভিনীত চরিত্রগুলির মধ্যে দুটি চরিত্র তার প্রিয় চরিত্রের তালিকায় বলে সে জানিয়েছে। সেগুলি হল : লজ্জা নাটকে সুবিমল এবং ঘোড়ার ডিম নাটকে এক পাখাওয়ালা চরিত্রে। পাখাওয়ালা চরিত্রটিতে রাজার আদেশ পালন করা ছাড়া তেমন কোন সংলাপ নেই। এক ক্যাবলাকান্ত রাজার সহযোগী হিসাবে অভিনয় করা তার কাছে বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল বলেই চরিত্রটি তার প্রিয়। লজ্জা নাটকে সুবিমল চরিত্র হয়ে মঞ্চে নেমে বেশ কিছু নিজস্বতা, নিজস্ব ভাবনা আরোপ করতে পেরেছিল বলে সুবিমল তার আর একটি প্রিয় চরিত্র। তার এই নিজস্বতার আরোপে নির্দেশক রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী তাকে স্বাধীনতা দিয়েছিল বলে শুভদীপ জানিয়েছে।
একটা সময় থিয়েটারে অভিনয় নিয়ে বাড়ির মানুষজনের মৃদু অসূয়া থাকলেও ১০ বছরের বেশি সময় থিয়েটারে যুক্ত থেকে বাড়ির মানুষদের কাছে সহনীয়ই হয়ে উঠেছে। বলা যায়, বাড়ির সকলকে সে বোঝাতে পেরেছে যে, থিয়েটারে থাকলে সে ভাল থাকে। বেঁচে থাকার একটা অন্য আনন্দ খুঁজে পায়।
শুভদীপের অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল : বিষছায়া, লজ্জা, এমনও হয়, ঘোড়ার ডিম, অমল তোতা ও আমরা, আমসত্ত্ব, বন্ধ ডায়েরী, dont get me wrong, দেবতার গ্রাস, অন্যরকম। এছাড়া দলের বেশ কিছু নাটকে আলোক প্রক্ষেপণের দায়িত্ব সামলেছে সে। সেই নাটকগুলি হল : আমি শুধু ফোন করতে এসেছিলাম, মদন কাণ্ড, আন্তিগোণে, এমনও হয়, লজ্জা, দেবতার গ্রাস,আমসত্ত্ব। মদন কাণ্ড এবং আন্তিগোণে নাটকে আলোক পরিকল্পনার দায়িত্বও ছিল তার।
থিয়েটার জগৎ সম্পর্কে যে ধারণা তার ছিল সেটা এখন বদলে গেছে থিয়েটার করতে করতে। অনেক ভাল অভিজ্ঞতা যেমন হয়েছে, তেমনি ভাল লাগেনি এমন অনেক কিছুও আছে। তবে থিয়েটারে কোন শিল্পীকে অন্য কোন শিল্পীর ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতাটা তার অপছন্দ বলে সে জানিয়েছে।
বর্তমানের থিয়েটার মানেই কলকাতাকেন্দ্রিক থিয়েটার নয়। তার মনে হয়েছে, কলকাতার থিয়েটার বেশ কিছু ক্ষেত্রে স্টারকেন্দ্রিক।কিন্তু শহরে মফস্বলে বিভিন্ন নাট্যদলেও অনেক দক্ষ অভিনেতা অভিনেত্রী আছেন। শুভদীপ মনে করে, থিয়েটার দেখতে আসা মানে স্টার দেখতে আসা নয়। একটা টোটাল থিয়েটার দেখতে আসাই প্রধান।
শুভদীপ তার অভিজ্ঞতা থেকে মনে করে, থিয়েটার করে বাঁচা যায় না। যারা কোন একটি মাত্র দলে অভিনয় করছে, থিয়েটার করে বাঁচাটা তাদের পক্ষে সহজ নয়। বিশেষত যারা জেলার নাট্যদলে যুক্ত। স্যালারি গ্রান্ট নির্ভর হয়েও বাঁচা যায় না বলে সে মনে করে।
শুভদীপ থিয়েটারকে ভালবেসেই থিয়েটার করে যেতে চায়। তাই চাকরীর পাশাপাশি থিয়েটারের দলের জন্য সে সময় বের করে নেয়। অভিনেতা শুধু নয়, একজন নাট্যকর্মী হয়ে থিয়েটারের সেবা করে যেতে চায় শুভদীপ।