সুব্রত রায়
বাঙালির গত শতাব্দীর আসলে বাংলা চলচ্চিত্রেরও প্রথম শতাব্দি। কবে যে চলচ্চিত্র প্রথমে ঠিক বাঙালির কাছে এসেছিল সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নথিপত্র হাতের কাছে নেই।বলতে লজ্জা লাগে সবচেয়ে জনপ্রিয় এই গনমাধ্যমের জন্মতিথি কারোরই জানা নেই। চলচ্চিত্রকে তো আমাদের কাছে বিনোদন এর অন্য নাম। তার আবার ইতিহাস। এ রকমই ছিল নাক উঁচু বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের মনোভাব। যদি সিনেমা নিয়ে কথা বলতেই হয় তবে এক ও অদ্বিতীয় সত্যজিৎ রায়,বড়জোর ঋত্বিক কুমার ঘটক বা মৃণাল সেন। উত্তম সুচিত্রার ছবি দেখা যায় কিন্তু লেখা?এ তো আমাদের অধ্যাপক মুখরিত বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের নৈব নৈব চ। কিন্তু সুখের বিষয় হালে মনোভাব পাল্টেছে। গণসংস্কৃতির ইতিহাসে যে ধরা পড়ে জনজীবনের চলচ্ছবি একথা জানার পর কেউ কেউ ভাবছেন প্রখ্যাত কালিস মুখোপাধ্যায়ের কাজটা আবার শুরু করা যাক না।
স্টেটসম্যান পত্রিকায় বিজ্ঞাপন সমীক্ষা করে মনে হয় হাজার 1917 সালের 20 শে জানুয়ারি প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হয় চৌরঙ্গীর অধুনালুপ্ত রয়াল থিয়েটারে। প্রায় একই সময়ে জানুয়ারি মাসের শেষে বিডন স্ট্রিট এর মিনার্ভা থিয়েটারে অ্যানিমেট গ্রাফ প্রদর্শনী চলে। এর অল্প পরে এমারেল্ড রঙ্গমঞ্চে নিত্য নব রঙ্গে দর্শকদের প্রীতি উৎপাদনের জন্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের তৃতীয় রঙ্গভূমি স্টার থিয়েটার। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ক্ষেত্রে স্টার হয়তো অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারেনি,কিন্তু এই মঞ্চের বনেদিয়ানা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তায় অন্য একটি মাত্রা যুক্ত করে। স্টারে প্রদর্শন যন্ত্রটির নাম ছিল বায়স্কোপ। এই বাইস্কোপ ই দীর্ঘদিন ধরে আমাদের স্মৃতিতে চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রতিশব্দ। বাঙালি জীবনের মায়াবন বিহারিনী হরিণী। এই বায়োস্কোপ’ দেখার সুখস্মৃতি পাওয়া যায়
এই বায়োস্কোপ’ দেখার সুখস্মৃতি পাওয়া যাচ্ছে সাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় এর কলমে। সে রাত্রে গ্রাম্য বিভাব নাটকের অভিনয় হয়েছিল এবং তারপর স্টিফেনসন সাহেবের বায়স্কোপ দেখানো হয়। বায়োস্কোপের পর হয়েছিল মিস নের্লি ও মাউন্ট কেসনের সর্প রামধনু নৃত্য। এইসব অলীক কুনাট্য রঙ্গে অমৃতলাল বসু ও তার পৃষ্ঠপোষক বাবু বিবিদের পক্ষে কতদূর উপাদেয় হয়েছিল তা আপাতত আলোচ্য বিষয় নয়। কিন্তু তখনও সিনেমাকে সিনেমা হবার সময় আসেনি। চলচ্ছবি কে ভাবা হচ্ছিল আমাদের নাট্যশালার হারানো স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের একটি লঘু বিনোদন সূত্র। কখনো কখনো বা ফাদার লা মতো কোনো অধ্যাপক সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বিজ্ঞানের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র দেখাচ্ছেন। আর আমরা দেখছি জনপ্রিয় আঙ্গিকের জনপরিসরে বাংলা সিনেমার ভূমিকা নির্ণয় করতে অবতীর্ণ হয়েছেন এক ও অদ্বিতীয় হীরালাল সেন আঠারোশো 66 থেকে 1917।, সেই কিংবদন্তির অধিক ভাগ্যাহত প্রথম পথিক।
বাঙালির ইতিহাস নেই এজাতীয় আক্ষেপ ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের। মনে হয় কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। আমাদের ইতিহাস আছে। তবে তা অনাথ বালকের মত। মাঝে মাঝে নতুন জামা কাপড় দিয়ে সাজানো হয় তাকে। কারোর ইচ্ছে হলো তো স্টেশনের নাম পাল্টে গেল। কারোর ইচ্ছে হলো তো বাংলা চলচ্চিত্রে শতবর্ষ পালন করা গেল 2018 সালে। সকলি তোমারি ইচ্ছা। আসলে যে হীরালাল সেন এই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক বলে আমরা দীর্ঘদিন চায়ের পেয়ালায়, মতান্তরে সুরাপাত্রে তুফান তুলেছি,আমাদের চলচ্চিত্র রসিকরা অনেকেই তাকে দাদাসাহেব ফালকের পূর্বসূরী বলে দাবি করে গেলেন এমনকি চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চ থেকেই বছর পাঁচেক আগে শ্রীযুক্ত অমিতাভ বচ্চন স্বয়ং তাকে প্রবর্তকের মর্যাদা দিয়েছিলেন। সেই ইতিহাস চৈতনা হঠাৎ হীরালাল এর শতবর্ষের পরের বছরই মুছে দিতে হলো কেন? হীরালাল এর তো কোন রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না ।
সত্যি বলতে কি ভারতীয় উপমহাদেশে চলচ্চিত্রের জন্ম খন নিয়ে সংশয় এর অবসান হয়নি। মহারাষ্ট্র ও এই বিষয়ে দ্বিধা আছে। রাজা হরিশচন্দ্র মুক্তি পাওয়ার এক বছর আগে 1912 সালের 18 ই মেয়ে মুক্তি পেয়েছিল শ্রীরামচন্দ্র গোপাল তরুণের তত্ত্বাবধানে তৈরি 22 মিনিটের ছবি শ্রী পুণ্ডলিক ।অনেকে মনে করেন সেটি ভারতের প্রথম কাহিনীচিত্র। যেমন কলকাতার প্রায় সকলেই দাবি করেন হীরালাল সেনের আলিবাবা মুক্তি পায় 1903 সালে। যদিও এর খন্ডাংশ দফায় দফায় শুরু হয়েছিল 1900 থেকেই। অর্থাৎ শ্রুতকীর্তি অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেনের এই মামাতো ভাই যে আমাদের মন্থর গ্রামীণ সমাজের শিল্পের দিক থেকে আধুনিকতার বকলমে এক ধরনের সক্রিয় কারিগরি হস্তক্ষেপ,তা স্পষ্ট স্বরে বলতে আমাদের সামর্থের অভাব আরো স্পষ্ট। বরং তাঁর যে সুবিখ্যাত গতির চিত্র গুলি রয়েছে যেমন 1903 সালের করোনেশন দরবারের চিত্র বা হাজার 1 905 সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের চিত্র অথবা নানা সামাজিক দৃশ্যাবলী ।যেমন চিৎপুর রোড এর চলমান চিত্র,রাজেন মল্লিকের বাড়ির বিয়ের সমারোহ এসব উপেক্ষিতই থেকে গেছে। এমনকি এই উপমহাদেশের বিজ্ঞাপনচিত্রের তিনিই পথিকৃৎ। দমদম আগরপাড়ার বাগানবাড়িতে মিস্টার সেন এর জবাকুসুম তেল এর প্রচার চিত্র তুলেছেন তিনিই ।তবু আমরা আলোকচিত্রী, দলিল ,বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা হীরালাল সেন বিষয়ে উৎসাহ দেখায় নি। আমাদের যাবতীয় মনোযোগ তিনি বঙ্কিমবাবুর ভ্রমর অথবা ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ এর আলিবাবা গতি চিত্রায়িত করেছিলেন কিনা তা জানার জন্য। সেখানেও 1900 এক সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অমৃতবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে series of super fine pictures for our world renowned play like Ali Baba Buddha Sitaram etc will be produced to the extreme astonishment of awaare patrons. ওই একই বছরে দোসরা ফেব্রুয়ারি দা বেঙ্গলি নামের সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন আমাদের জানায় ,ও অমরেন্দ্র দত্তের পূর্বোক্ত ক্লাসিক থিয়েটার তার নাট্য প্র�
নাট্য প্রদর্শনীর মধ্যে ভ্রমর, আলিবাবা, দোল লীলা, সরলা ইত্যাদি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে। চিত্র নির্মাতা বলাবাহুল্য ছিলেন হীরালাল সেন।
দুঃখের বিষয় হীরালাল সেনের কারিগরি কুশলতা থাকলেও ব্যবসাবুদ্ধি ছিল না। তার বঙ্গ বিরোধী ছবিটি মুহূর্তের অমনোযোগ চলে যায় ম্যাডামদের এলফিনস্টোন বায়োস্কোপের হাতে।একদিন বাধ্য হয়ে নিজের স্বপ্নের ক্যামেরা বিক্রি করেছিলেন বিখ্যাত সুদখোর আংটি মল্লিকের কাছে। তিনি দুহাতে দশটি আংটি পর তেন বলেই এমন সুনাম অর্জন করেছিলেন। অবশেষে ক্যান্সার রোগে এক নিঃসঙ্গ মৃত্যু।তার মাত্র দু’দিন আগে হাতিবাগানে বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে গিয়েছে তার যাবতীয় নির্মাণ। আজ সকলেই বুঝতে পারেন যা পু ড়েছিল তা বাংলা সিনেমার কপাল,তা শুধু হীরালাল সেন এর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এইসময় দিপালী, নাচঘর বা বায়োস কোপ প্রভৃতি পত্রিকা থেকে আমরা জানতে পারি হীরালাল সেন এর কর্মকান্ড।
একথা অনস্বীকার্য যে এই এলফিনস্টোন বায়োস কোপ কম্পানি অর্থাৎ ম্যাডাম থিয়েটার্স 1917 সালে সত্যবাদী রাজা হরিশচন্দ্র দু বছর বাদে 1919 সালে বিল্বমঙ্গল নামে দুটি কাহিনী চিত্র বানায়। শেষোক্ত ছবিটি পুনরুদ্ধার করা গেছে। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্ম ক্ষণে ম্যাডাম কোম্পানি ছিল ধাত্রীদেবতা। আন্তর্জাতিকভাবে ইউনেস্কো যখন সিনেমার শতবর্ষ পালন করেছিল তখন কোন দৃষ্টান্ত দেখানো হয়েছিল কি? নাকি ফরাসি দেশের লোমের ভাতৃদ্বয় 1895 সালের 28 শে ডিসেম্বর প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনী করে। সেই তথ্যটি কিন্তু সারা পৃথিবীতে সম্মানিত হয়। আমাদের দেশেও
1 995 সালে সাড়ম্বরে চলচ্চিত্রে শতবর্ষ উদযাপন হয়েছিল। লুমিয়ের নির্মিত the train arrival of a station বা workers leaving from the Lumiere factory এসবই হীরালাল এর মতই বাস্তব জীবনের নির্বাক ,অসম্পাদিত ও টুকরো টুকরো চলমান দৃশ্য। তাহলে বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ হীরালাল সেনের কার্যক্রমের সূত্রে 2001 সালে হয়ে গেছে ।অলৌকিক সমাপতন যে হীরালাল এর মৃত্যুর 100 বছর কেটে গেল ঠিক 5 বছর আগে। জীবনানন্দ থাকলে বলতেন জীবনের মরণের হেমন্তের এরকম আশ্চর্য নিয়ম। খাওয়া হয়ে গেছে বলে এমন অসম্ভব।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য ও ও সংস্কৃতির প্রথম প্রতিভূ হলেন হীরালাল সেন। আমাদের চলচ্চিত্র সংস্কৃতি তার কাছে নত হয়ে আছে ।