কিছু সমৃদ্ধ নাট্য সম্ভারে চুঁয়াপুর সুহৃদ নাট্যদলের জাতীয় নাট্যোৎসব

- Advertisement -

দুলাল চক্রবর্ত্তী

বহরমপুর শহরের চুঁয়াপুর অঞ্চলের, সুহৃদ নাট্যদল ৪৮ বছরে পা দিয়েছে। বহু ভাল উপস্থাপনা সারা দেশে নাটক মঞ্চায়ন করেছে। সেই গৌরব সংবাদেই, সম্প্রতি বহরমপুর রবীন্দ্র সদনে, মহার্ঘ্য জাতীয় নাট্যোৎসবের আয়োজন হয়েছিল। ব্রতীন হালদাদের শিল্প কর্মের পট মুখোশ সহ বিভিন্ন প্রযোজনার আলোকচিত্র ইত্যাদি দিয়ে সদন চত্বরকে নাট্য মনস্ক করতে সাজানো হয়েছিল। এবারের এই উৎসবে সর্বমোট ৮টি চমৎকার নাটকের মঞ্চায়ন মুগ্ধ করেছিল।

দীর্ঘকাল ধরে গুটিকয়েক নাট্য উৎসাহী মানুষকে একত্রিত করে সংস্থার নির্দেশক হরপ্রসাদ দাস কাজ করে চলেছেন। সংস্থার সকলকে নিয়ে প্রযোজনার দায়িত্বে যত্নশীল আছেন। নাটকের লক্ষ্যে অবিচল আছেন। নিজেদের নির্মাণে এবং উৎসবের নাট্য নির্বাচন বা চয়নে শৈল্পিক চিন্তা থাকে। আর সাথে থাকে দায়বদ্ধ নাটকের সম্প্রসারণ চিন্তা। তাই সংস্থার চলে আসা পরম্পরায় অনবদ্য কিছু নাটকের নির্বাচনে এবারের এই উৎসবের চয়ন হয়েছিল। শীত সন্ধ্যার কটা দিন বিচিত্র ভাবনা দর্শকদের মাতিয়েছিল। মানবিক বিষয়ে এবারের নাটকগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দেশের বিভিন্ন প্রদেশ সহ নিউ জার্সি থেকে আসা ৭টি নাটকের বিষয়, অভিনয় এবং নাটক অনুসারে যথার্থ আঙ্গিক রূপায়ণ রীতিমতো চমকে দিতে পেরেছিল।

আয়োজনের শুরুর দিন এই উৎসবের উদ্বোধন করেছিলেন রাজ্যের বিশিষ্ট নাট্য গবেষক,  প্রাবন্ধিক, আশিস গোস্বামী। মঞ্চে তাঁর সাথে উপস্থিত ছিলাম আমি। আশিষ গোস্বামী তাঁর নিজের কথায় সময়ের অভিঘাতে তাল মিলিয়ে সামাজিক মানবিক অবক্ষয়ে বিচলন এবং নিমিত্তবোধক রাজনৈতিক প্রতিবাদ শানিত করতেই যে সুহৃদ অতুলনীয় নাট্য ভাবনায় ও কাজে সত্তরের দশক থেকে এই ৪৮ বছরে এসে পৌঁছেছে। আজও একইভাবে অবিচল আছে।  নিজের বক্তব্য-কথায় তা উল্লেখ করে সংস্থাকে সম্মান জানান। বাস্তবিক খুবই দীন সামর্থেও যে ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, সুহৃদ দলের তৎপর কুশীলবেরা তা প্রমাণিত করে চলেছেন। বহরমপুর বাসীদের সমর্থনে ফি বছর তাই এই উৎসব চালাতে পারছে। বহরমপুরের বিভিন্ন দলের কৃতি শিল্পী কুশীলবেরা সুহৃদ দলের সাথী হয়ে বিভিন্ন নাটকে অভিনয়ে যুক্ত আছেন। এই শৈল্পিক সৌহার্দ্য সম্পর্ক শহরের নাট্য সমন্বয়ে এক প্রাপ্তি। আর্থিক নানা প্রতিকূলতায়, অত্যন্ত বিপন্নতার মধ্যেও সুহৃদের দায়বদ্ধ নাটকের  ভাবনা গর্বের বিষয়।

বাস্তবিক অর্থেই সুহৃদের সব নাটকে মানবিক, সামাজিক ও পারিবারিক বিপর্যয়ের কথা থাকে। রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া সমস্যা কাতরতায় বিরোধী মানুষের জোটবদ্ধতাকে উল্লেখিত করা হয়। ভেঙ্গে পড়া মানুষের কান্না নিয়েও উঠে দাঁড়াবার দিশা-কথা থাকে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের নিরিখে সার্বিক লড়াই আন্দোলনের চিন্তা সূত্রও জড়িত থাকে। তাই মানুষের কল্যাণের পক্ষেই সুহৃদ আয়োজিত এই জাতীয় নাটকের উৎসবের আলাদা মর্যাদা থাকে। এবারের অধিকাংশ নাটকেই তাই মনুষ্যত্বের জাগরণে মানুষ হয়ে ওঠার সংকল্পের অঙ্গীভূত শব্দধ্বনির শৈল্পিক রূপারোপ উল্লেখযোগ্য হয়েছিল। উপভোগ্য হয়েছিল চয়ন প্রকৃয়া।

প্রথম দিন মঞ্চস্থ হয়েছিল সুহৃদ দলের নিজস্ব নাটক প্রযোজনা ‘আজও নুপিলান’। নুপিলান শব্দের অর্থ– নারীদের সম্মিলিত বিদ্রোহ। ব্রিটিশ উপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে মণিপুরের নারীদের ১৯০৪ ও ১৯৩৯ সালের রাষ্ট্রীয় বিদ্রোহ যে আজও একইভাবে আত্মদানের অনির্বাণ আলোকে প্রজ্জ্বলিত আছে। এই নাটক তা দেখাতেই চেষ্টা করেছে। মূল নাটকটি কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের লেখা। সম্পাদনা করেছিলেন প্রয়াত গৌতম রায়চৌধুরী ও ব্রীহি নির্দেশক দীপক বিশ্বাস। আলোক ভাবনায় ছিলেন শ্যামা প্রসাদ বন্দোপাধ্যায়। অপুর্ব মঞ্চ অলঙ্করণে ব্রতীন হালদার। আবহ দেবাশিস সান্যাল এবং রূপ সজ্জায় চিন্টু রাউত। নাটকের নির্দেশনা হর প্রসাদ দাস।  

সুন্দর মঞ্চ ভাবনায় ও ছেঁড়া আলো অন্ধকারে মণিপুরের অরণ্য অধ্যুষিত অঞ্চলের রাষ্ট্রীয় হানার মোকাবিলা পথ খোঁজার উত্তেজনা নিয়ে নাটক শুরু হয়েছিল। কেন্দ্রীয় চরিত্র এসে দাঁড়ায় মনোরমা। সে রাষ্ট্রীয় চক্রান্তের ফাঁস জালে আটকে পড়ে বিদ্রোহের উপায় ভাবছে। কেননা ইতিমধ্যেই নির্দোষ যুবক পবনের উপর নেমে আসছে রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন। অন্যায় জুলুম। সব শেষে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। পরিশেষে নির্যাতিত গ্রেপ্তারি দশা। অত্যাচারিত হয় সে। তাই মনোরমার চিত্ত অভিক্ষেপে যুবক পবনের উপর নেমে আসা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস-বিরোধিতায় রুখে দাঁড়ানো অভিপ্রায় ছিল। তাকে এবং মণিপুরের সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে, করণীয় শক্তি খোঁজাতেই চলেছে সারা নাটকের মূল চলন। চলেছে মনোরমার মনে ভাবনার এক তরঙ্গ। যে তরঙ্গে উপেক্ষিতা চিত্রাঙ্গদা আর দ্রৌপদী এসে মনোরমাকে মানসিক ক্ষমতায় বলীয়ান করতে ইতিহাস-কথা বলে যায়। এভাবেই একদিকে যেমন চলছে অত্যচার, অন্যদিকে সংঘটিত হচ্ছে জোটবদ্ধ প্রতিবাদ করার সংকল্প। বোঝা যায়, কোন সুদূর অতীত থেকেই উত্তর পূর্বাঞ্চলে চলমান আছে অনার্য অবজ্ঞা। এই প্রসঙ্গেই বলিষ্ঠতা পেয়েছে নাটকের প্রতিপাদ্যেটি। কেননা রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনে আজ যা হচ্ছে, তা নতুন নয় বলেই নারী বিদ্রোহের উৎসে মণিপুরের মায়েদের সম্মিলিত শক্তিকে আজও নুপিলান বলে আলোকিত হয়েছে এই নাটক।

ভারতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অনুভুত শোষণ ও বঞ্চনায় মণিপুরী জাতি উপজাতিদের মধ্যে থাকা নারীদের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদকে আলেখ্য করে তাই আজও নুপিলান নাটক জন চেতনায় একটি আগাম জাগরণের ডাক দিতে চেয়েছে। চিত্রায়িত হয়েছে রাষ্ট্র দ্রোহিতার কারণে মিলিটারি হামলায় অত্যাচারিত মানুষের দৈনন্দিন বাস্তবতা। যা দেখে মানুষ যাতে আগামী সময়কে চিনতে পারে। কারণ ধর্মীয় মৌলবাদের জয়জয়কারে শঙ্কিত দেশের চিন্তাশীল মানুষেরা ইতিমধ্যেই ভাবতে শুরু করেছেন, আগামীতে দেশে কীভাবে ফ্যাসিস্ট তান্ডব মানুষের কন্ঠরোধ করে মানুষকে রাষ্ট্রের দাস হিসাবে পদানত করবে। তাই এই নাটকের শ্রেষ্ঠ স্বার্থকতা সময়ের নিরিখে মানুষকে উজ্জীবিত করতে চাওয়াতেই নিবদ্ধ আছে।

বাংলা নাটকের প্রায় পনেরো হাজার দল বর্তমান থাকলেও নাট্য আলোকপাতে মণিপুরের রক্তাক্ত বাস্তবতা নিয়ে কথা বলার নাটক কমই আছে। এতো হিংসা প্রকটিত মণিপুরকে দেখেও নাট্য-উচ্চ্যবাচ্চ্যে এই প্রসঙ্গ কমই মঞ্চে আসছে। রূপকথার ভাবাবেগ বা প্রেম কাহিনির কথায় মূল্য খোঁজার নাটক অনেক আছে। তাই কষ্ট হয়। আর কী সময়ের নীল দর্পণ লেখা হবে না? এখন না হলে আর কবে হবে। এসব ভাবায়। সময়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ-কথা কেন নাটকে সোজাসাপটা বলা যাচ্ছে না। যা ভাবাচ্ছে দায়বদ্ধ নাটকের জন্ম প্রসঙ্গে। তথাপি যে কাজ হয়ে উঠছে না, কিছুটা হলেও সুহৃদ তা করেছে। এখানেই ধন্যবাদ পায় দল। তৃপ্তিও মেলে সামান্যতম যা-কিছু। তাই নির্মিত এই প্রযোজনায় কিছু ভুল ত্রুটি থাকলেও সুহৃদ মণিপুরের একটা পরিস্থিতিকে তুলে ধরেছে। যাতে দেখানো হয়েছে রাষ্ট্রীয় অপশাসনে এবং রাষ্ট্র শক্তির মদতে সৃষ্ট ডিভাইড এ্যান্ড রুল কীভাবে একটি জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষকে দ্বিধা বিভক্ত করে দেশের সার্বভৌমত্ব বিলীন  করছে। তাই রাষ্ট্রের ক্রম বিজিত উল্লাসের বিরুদ্ধে, দায়বদ্ধ নাটকের চর্চায় নাটক আজও নুপিলান নির্বাচন সার্থক।

তবে অভিনয়ে আরো যুক্তি গ্রাহ্য অভিক্ষেপে আন্তরিক তাগিদ যুক্ত হওয়া জরুরি। অনুভূতির তরঙ্গের কাল ঘাম ছোটা উত্তাপের অভাব নজরে পড়ে। প্রতিটি আক্রান্ত চরিত্রের আন্তরিক পথ খোঁজা উত্তেজনা ম্লান লাগে। এসেছে বেশ কিছু অঙ্গ সঞ্চারিত অভিনয় রীতি। যা এ নাটকের মানসিক দ্বন্দ্বের বিপ্রতীপে গিয়ে উপলব্ধিকে বিকশিত হতে দিচ্ছে না। এই কারণে ব্যথা প্রকটিত কম হচ্ছে নাকি, কিম্বা নাটকটি মণিপুর বাস্তবতার সমষ্টিগত মানুষের পক্ষে প্রতীক চরিত্রদের মঞ্চে এনে তাদের মর্মান্তিক যন্ত্রণাকে দর্শক অন্তরে উসকে দিয়ে সহানুভূতির আগুন জ্বালাতে পারছে কি না। তা তলিয়ে ভাবা দরকার। এখানে অভিনয় নয়, এমন উদ্বেগে উদ্বেলিত আত্ম অনুরণন যুক্ত হবে নাকি তা নিয়ে কুশীলবদেরও ভাবতে হবে। চরিত্রের বেশি মুভমেন্ট এবং দৈহিক প্রসারতা বাহ্যিক আচরণকে প্রকট করে। এতে অন্তরলোক সঙ্কুচিত হচ্ছে কিনা, তাও তলিয়ে বিচার করতেই হবে। তবে তুলনায় ফ্যাসিস্ট অত্যাচারী চরিত্রগুলি বেশ সাবলীল ও চরিত্র সামর্থ্যে উজ্জ্বল।

বিভিন্ন চরিত্রে পবন- দেবাশিস সান্যাল,  মনোরমা- তাপসী চাকী ইন্দ্র, চিত্রাঙ্গদা- মহুয়া চক্রবর্তী, মীরা- জয়া চ্যাটার্জী, অফিসার- অনুপ চক্রবর্তী, দ্রৌপদী- বৃষ্টি চক্রবর্তী, সামরিক অফিসার প্রথম ও দ্বিতীয়তে যথাক্রমে বুদ্ধদেব গান্ধী ও কাঞ্চন চ্যাটার্জী, সৈনিক- তপন ভাস্কর, বভ্রুবাহন- সৌমেন চক্রবর্তী এবং তৃতীয় অফিসার- সুপ্রিয় মুখার্জী প্রমুখেরা অভিনয় করেছেন। যার মধ্যে মনোরমা চরিত্রে তাপসী চাকী ইন্দ্র নাট্য ব্যক্তিত্বে উজ্জ্বল।

এই উৎসবে মঞ্চস্থ হয়েছিল, হলদিবাড়ি কোলাজের দীপঙ্কর মন্ডল নির্দেশিত “নতুন পুতুল”, ভূমিসূত থিয়েটারের দেবব্রত দাশগুপ্ত রচিত ও স্বপ্নদীপ সেনগুপ্ত নির্দেশিত “যন্ত্রণা”, কোচবিহার স্বপ্ন উড়ান দলের দেবাশিস লিখিত চালিত এবং “নির্জনতা”, কাইট এ্যাক্টিং স্টুডিও দলের প্রয়াত ঋষি দুবে রচিত এবং সাহেব নিতিশ নির্দেশিত “খোয়া হুয়া আদমি”, আসামের বর্ণনা গোষ্ঠীর সুরেন্দ্র ভার্মা লিখিত এবং কুশল ডেকা নির্দেশিত “সূর্যের অন্তিম কিরণপর প্রথম কিরণালয়”, জলপাইগুড়ি অনুভব নাট্যগোষ্ঠীর স্বপন দাস লিখিত এবং সাধন চক্রবর্তী নির্দেশিত “স্বপ্নের সারথী”, এবং আমেরিকা নিউ জার্সি একতা গ্রুপের সুদীপ্ত ভৌমিক রচিত ও নির্দেশিত “জন্মান্তর” এই নাটকগুলি। প্রত্যেকটি নাটকের বিষয় ছিল অভিনব। অভিনয়ে ছিল চমৎকার কিছু আত্ম আলোকপাত। যা স্বতন্ত্র ভাবে আলোচনা করার দাবি রাখে। মোট কথা মানুষের সার্বিক অস্তিত্বের জানানে সবগুলি নাটকের কেন্দ্রেই পাওয়া গেছে জীবনের জন্যই জ্যান্ত জয়গান। বহরমপুর সুহৃদ শহরের মানুষের আশীর্বাদে এভাবেই এগিয়ে চলুক, সেই শুভকামনা জানাচ্ছি।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -