Tuesday, February 18, 2025
Tuesday, February 18, 2025
Homeনাটকজয় পরাজয়ের ধাঁধা

জয় পরাজয়ের ধাঁধা

সুব্রত কাঞ্জিলাল

অনেক বছর আগে। সম্ভবত ইংল্যান্ডের সঙ্গে ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল। আম্পেয়ার সুনীল গাভাস্কারকে এলবিডব্লিউ-তে আউট হওয়ার নির্দেশ দিলেন না। তাতে কি হলো? সুনীল গাভাস্কার নিজেই বুঝেছিলেন যে তিনি আউট হয়েছেন। ব্যাট হাতে প্যাভিলিয়নে‌ ফিরে গিয়েছিলেন।

চিড়িয়াখানা ছবির জন্য সেবার সত্যজিৎ রায়-কে ভারত সরকার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। এই সংবাদ শোনার পর সত্যজিৎ বাবু অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘এটা ঠিক হলো না। পুরস্কার পাবার মতো যোগ্য ছবি এটা নয়।’

জর্জ বার্নাড ‘শ নোবেল পুরস্কার দুবার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আকাশবাণী বেতার কেন্দ্রের ঘোষকের চাকরিতে ইন্টারভিউতে পাস করার পরেও অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায় তাঁর অন্যতম বন্ধু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন সৌমিত্র যোগ্য মানুষ।

মহাভারতের যুগে কর্ণ যে প্রকৃত অর্থে বীর। অর্জুনের থেকেও এগিয়ে রয়েছেন। এটা কোনভাবেই প্রমাণ করবার সুযোগ করে দেয়নি কেউ। কারণ ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণদের অনাস্থা। একইভাবে বল প্রয়োগ করে একলব্যের ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল কেটে নেওয়া হয়েছিল।

যেমন ফুটবলের বিশ্বকাপের একটি আসরে ষড়যন্ত্র করে ফুটবলের রাজপুত্র দিয়াগো মারাদোনার পা কেটে নেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ তাকে তার অজান্তে নিষিদ্ধ ড্রাগ খাইয়ে দেওয়া হয়েছিল। মূল কারণ মারাদোনাকে মেলাইন করা। একইসঙ্গে আর্জেন্টিনা দলটাকে বিশ্বকাপ থেকে বার করে দেওয়া।

স্বাধীন ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের অধঃপতন শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যে এক ধরনের স্বৈরাচারী মনোভাবের উলঙ্গ প্রকাশ হয়ে পড়ার পর থেকে। দেশ সেবা নয়। মানুষের মঙ্গল কামনা নয়। দলগুলোর একমাত্র লক্ষ্য ক্ষমতা দখল করা। যেকোনো মূল্যে ভোটে জিততে হবে। বিরোধী শূন্য করে দিতে হবে সংসদ ভবন গুলোতে। পঞ্চায়েত থেকে পৌরসভা সর্বত্র নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চাই।

কয়েক সপ্তাহ আগে ‘স্যস’ পত্রিকার সম্পাদক সত্য ভাদুড়ি মশাই একাঙ্ক নাটক নিয়ে লেখা একটা প্রবন্ধ শোনাচ্ছিলেন। আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন একাঙ্ক নাটকের প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কেন? আমি কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছিলাম। একটা কারণ সেদিন সত্য ভাদুড়ীকে বলা হয়নি। সেটা হলো বিচারকদের ওপর অনেক সময় প্রবল চাপের অসুস্থ কারণগুলো।

এটা যে সর্বত্র হয় তা কিন্তু নয়। শুধুমাত্র এই ক্ষেত্রে হয় তাও নয়। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতেও বিচারকদের চাপের মুখোমুখি হতে হয়। যেমন সত্যজিৎ রায় কে একবার কোন একটি প্রতিযোগিতায় প্রবল চাপের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি সেই চাপের কাছে নত হননি। মৃণাল সেনের কাছেও এই ধরনের চাপ থাকতো। বলে বাহুল্য যে, তিনিও মেরুদন্ড সোজা করে থাকতেন।

নাটকের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেও অনেক বিচারকের মেরুদন্ড সোজা থাকার ঘটনা রয়েছে। প্রধানত হাতেগোনা কয়েকটি দলের কাছ থেকে এই ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। তারা তাদের নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী বিচারককে দেখতে চান। অন্যথায় ওই সব দলের পরিচালকরা কুৎসা করা শুরু করেন। এমনকি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেও অভিনয় করতে এসে অভিনয় না করে ফিরে যাবার দৃষ্টান্তও রয়েছে।

এই প্রসঙ্গে আমি একথা বলতে চাই না যে, অযোগ্য বিচারকরা এই মঞ্চে একেবারেই যে থাকেন না। আমার বলবার কথাটা হচ্ছে এই, বিচারকের দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষাদীক্ষা, রুচি সর্বত্র নিম্নগামী। ৯-এর দশকের মাঝামাঝি বেথুয়াডহরির একটি মঞ্চে একটি প্রতিষ্ঠিত দল প্রয়াত শ্রদ্ধেয় নাট্য ব্যক্তিত্ব বহরমপুরের অঞ্জন বিশ্বাসকে অপদস্ত করতে আমি নিজে দেখেছি।

মেদিনীপুরের তখনকার দিনের একটি নামকরা প্রতিযোগিতার মঞ্চে আয়োজক সংস্থার দুই-একজন বিচারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। তাদের মনোনিত একটি দলকে কেন প্রথম পুরস্কার দেওয়া হবে না এই প্রশ্ন তারা তুলেছিল। এইসব কারণে মান-সম্মান বজায় রাখতে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি পরের দিকে বিচারক হতে অপছন্দ করতেন।

সবিনয় একটি প্রশ্ন তুলতে চাই। প্রতিযোগিতা মঞ্চের নিয়ম কানুন মেনে, বিচারকদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত এটা কিছুতেই কেন পছন্দ হবে না? পুরস্কার না পাওয়ার পর কেন উষ্মা প্রকাশ করা হবে? এটাতো নোংরা রাজনীতির জায়গা নয়!প্রতিযোগিতা মঞ্চকে বর্জন করবার স্বাধীনতা তাদের তো রয়েছে। তাদের প্রযোজনা মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য অনেক রকম মাধ্যমও রয়েছে। কেন বিরুদ্ধ সমালোচনা সহ্য করতে পারবো না? পরম সহিষ্ণুতা সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে যুক্ত থাকা মানুষদের থাকবে না? সর্বত্র আমাকে জয়ী হতে হবে? যে কোন মূল্যে জয় লাভ না করতে পারলে আমি নিজেকে ছোট মনে করব কেন?

ঋত্বিক ঘটক তো অস্কার পাননি। বস্তুত কোন আন্তর্জাতিক পুরস্কার তাঁর কপালে জোটেনি। বাংলার শক্তিশালী লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরকারি বেসরকারি কোন পুরস্কার দেওয়া হয়নি। তাই বলে কি মানিকবাবুরা মূল্যহীন? সমালোচক বা বিচারকদের শিক্ষা দীক্ষা রুচি নৈতিকতা কি রকম, তার ওপর নির্ভর করে তাদের সমালোচনার মান। যে সমালোচক অঞ্জন চৌধুরী মার্কা ফ্যামিলি ড্রামা পছন্দ করেন, তিনি কি শম্ভু মিত্রের অনুগামীদের মূল্য দেবেন? থিয়েটারের বিন্দুমাত্র শিক্ষায় শিক্ষিত সমালোচকরা কখনো হালকা রুচির নাটক গুলোকে পছন্দ করবেন না এটাই তো স্বাভাবিক।

তাছাড়া আমাদের দেশে নাটক বিচারের একটা প্রচলিত মানদন্ড রয়েছে। যেখানে বলা হয় যে, অরাজনৈতিক, কিংবা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ঘরানার নাটক, ধর্মীয় মৌলবাদী প্রবণতার নাটক, ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ ধারার নাটক সাধারণত বর্জন করা হয়। চরিত্রের সঙ্গে চরিত্রের সংঘাত, চরিত্রের সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংঘাত না থাকলে কোন নাটককে মূল্য দেয়া হয় না।

সমাজব্যবস্থার অসংগতি গুলোকে, ত্রুটি গুলোকে, রাজনৈতিক ভন্ডামি গুলোকে, প্রতিষ্ঠান বিরোধী কণ্ঠস্বর গুলোকে চিরকাল এখানে মূল্য দেওয়া হয়েছে। তারপর একইসঙ্গে দেখা হয়েছে শিল্প মূল্যের তীক্ষ্ণতা। সস্তা হাততালি মার্কা নাটকগুলো এইসব মঞ্চে সাধারণত সমালোচকদের কাছে অনুমোদন পায় না। সেই পঞ্চাশের দশক থেকে এইসব মঞ্চে বৃহত্তর সমাজের খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা ইত্যাদি মৌলিক কমন সংকটের প্রতিচ্ছবি বারবার প্রতিফলিত হয়েছে। সমালোচকরা বারবার সন্ধান করে এসেছেন বিষয় এবং শিল্পের গভীর গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো।

বলাবাহুল্য সাধারণত নব্য যুবক-যুবতী শিল্পে অদিক্ষিতদের অপটু নাটক এবং কাজগুলো অনেক ক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যায়। তারা বুঝতেও পারেন না যে স্বীকৃতি পাবার জন্য অনেক বেশি দক্ষ হয়ে উঠতে হয়। প্রত্যেকটি দলের নিজস্ব রুচি শিক্ষা দীক্ষা বিচারবোধ নিয়ে তারা যেসব প্রযোজনা মঞ্চস্থ করতে আসেন তাদের যেমন স্বাধীনতা রয়েছে। একইভাবে তাদের রুচিকে তাদের মতো করে সমর্থন করতে হবে এটা কি অন্যায় আবদার নয়?

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র শিল্পী উৎপলেন্দু চক্রবর্তী এই কারণেই হয়তো একবার বলেছিলেন, অঞ্জন চৌধুরীরা যত বেশি বেশি করে সিনেমা বাণিজ্যে এগিয়ে যায়, ঠিক তত বেশি বেশি করে আমাদের মত জীবন শিল্পীরা পেছনে পড়ে থাকে। মনে রাখতে হবে জনগণের সমর্থন শেষ কথা বলে না।

বিদ্যাসাগরের আন্দোলন জনগণের সমর্থন পায় নি। বরং ওইসব জনগণ রামমোহন বিদ্যাসাগরদের নানাভাবে নিগ্রহ করেছে। এই সরল সিদ্ধান্তে এসে আমরা বলতে পারি না যে বিদ্যাসাগর ভুল ছিলেন। সব পরাজয় যেমন পরাজয় নয়। সব জয়‌ জয় হতে পারে না ।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular