জলপাইগুড়ি মুক্তাঙ্গন নাট্যগোষ্ঠীর নাটক “দ্রোহ”ধর্ম বনাম মানবতার একটি আখ্যান

- Advertisement -

দুলাল চক্রবর্ত্তী

উত্তরবঙ্গের লোকজ আঙ্গিকে নির্মিত দ্রোহ নাটকটি শহর কলকাতায় অভিনীত হলো। রাজবংশী ভাষার এই নাটকের উপজীব্য বিষয় ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিষয় ধরেই গ্রামীণ সরলতায় নির্মিত অন্যতম লোকাচারের সাংস্কৃতিক দোলায় মজেছিল শহর মননের সুপ্ত আকাঙ্খা। এই নাটকে সম্মিলিত মেয়েদের অভিনয়ে, চরিত্র অনুযায়ী মানানসই পোশাক ও চারিত্রিক দক্ষতায় ভারসাম্যপূর্ণ ছিল। এই নাটকের গল্পে, সংস্কার আর কৃষি নির্ভরতায় ঈশ্বরকে জড়িয়ে নেওয়া গ্রাম্য মানুষের অসহায়ত্বকেই চিহ্নিত করলো। যেখানে মানুষ আর মানবিক প্রতিক্রিয়া আছে সাধারণ মানুষের নিজের দ্বায়িত্বে।

কলকাতা তপন থিয়েটারে মিউনাস আয়োজিত সারা রাত্রি ও দিন ব্যাপী টানা চব্বিশ ঘন্টা মহিলা পরিচালিত নাটকের উৎসবে, গত ২৭ জানুয়ারি রাত্রি নটায় নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। এটি ছিল উৎসবের তৃতীয় ক্রমিক নাট্যায়ন। প্রযোজনা জলপাইগুড়ি মুক্তাঙ্গন নাট্যগোষ্ঠী। কোচবিহারের নাট্যকার অর্ণব মুখোপাধ্যায় নাটকটি লিখেছেন। জলপাইগুড়ির বিশিষ্ট মহিলা অভিনেত্রী, রীনা ভারতী এই দ্রোহ নাটকের সম্পাদনা সহ নির্দেশনার কাজে সফল। যে নাটকের আলোক ভাবনায় আছেন জলপাইগুড়ির সুজিত সাহা। মঞ্চে আলোক প্রক্ষেপক ছিলেন রণাঙ্গন পালিত (বাবুদা)। একইভাবে রূপসজ্জায় মহম্মদ সাবির আলী এবং নাটকের আবহ, চরিত্র অনুযায়ী পোশাক ও মঞ্চ ভাবনার কৃতিত্বে রীনা ভারতী স্বয়ং। এদিন আবহ প্রক্ষ্যেপন  করেন মৌসুমী কুন্ডু এবং সুমন্ত রায়।

নাটকের গল্পটি রচিত হয়েছে উত্তরবঙ্গের মাটির ভাষায়। এটি রাজবংশী সম্প্রদায়ের গ্রাম্য ধর্মীয় লোকাচারের পুজো ভিত্তিক জীবন বোধ ও সংগ্রামের কাহিনী। প্রচন্ড খরায় কৃষি কাজ বিপন্ন হলে, তখন বৃষ্টিকে আহবান জানাতে হয়। এই পার্বণের উৎসকথায় বিজড়িত আছেন বরুণ দেবতা স্বয়ং। লোক কথায় যাকে হুতোম দেবতা বলা হয়। তাই পুজোকে হুতোম পুজো বলা হয়ে থাকে। যে পুজো শুধুমাত্র করে তরুণী সুন্দরী যুবতী মেয়েরা। তারা গাছতলায় একত্রিত ভাবে বিবস্ত্রা হয়ে গভীর রাত্রে অরণ্যের অন্ধকারে এই দেবতার উদ্দেশ্যে লোকাচারের নৈবেদ্য সমর্পণ করেই পুজো সুসম্পন্ন করে থাকে। আর সেখানে মেয়েরা নগ্ন অবস্থায় থাকে বলেই এই পূজার জায়গায় পুরুষের প্রবেশ কঠিন ভাবেই নিষিদ্ধ। সকলেই জানি দেবতা বা ঈশ্বর আশ্রিত কল্পনায় ত্রান পেতেই, গ্রাম্য মহিলা লোকাচার ধর্মের সাথেই খিদেকে সংযুক্ত করে রাখে। যাতে সুখ সমৃদ্ধিতে সংসার ভরে ওঠে, মানুষ পেট পুরে দুটো খেতে পায়, এবং সেই মর্মেই হুতোম দেব মান্যতা পায়। কিন্তু হুতোম দেবতায় নারীর নগ্নতা সমর্পণ এখানে বড়ো মর্মান্তিক একটা বাস্তবতা।

এই গল্পে এসেছে দারিদ্র্য পীড়িত বৃদ্ধ বাবা(সুমিত দে), তার বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে উর্মিমালা (সংহিতা চন্দ) কে পাত্রস্থ করতে পারছে না। এদিকে উর্মি’র সাথে প্রেমিক কাচুয়ার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক আছে। আবার এই সম্পর্কের পেছনে সামাজিক জটিলতাও চরমভাবে রয়েছে। ওদিকে উর্মিমালার রূপ সৌন্দর্যের আকর্ষণে রায়চাঁদ বাণিয়া (নারায়ণ মন্ডল)  প্রতি রাতেই প্রায় দারিদ্রে লোভ দেখাতে হানা দেয় এই প্রান্তিক পরিবারের নির্জন অঞ্চলে, উর্মি’র সান্নিধ্য কামনায়। বৃদ্ধ বাবা অন্ধকারে কেশে মরে আর এইসব পুরুষের উৎপাতে জর্জরিত থাকে। প্রেম পীড়িত এই এলাকার মানুষের জীবন যন্ত্রণায় কাঙ্ক্ষিত নয়। এখানে শুধুই পেট যে একমাত্র। তাই লহুব বড় হয়ে উঠে এসেছে। অতএব উর্মি’র সাথে কাচুয়া স্বাভাবিক প্রণয়ের দেখা সাক্ষাৎ করতে পারে না। চলে টানা পোড়েন। তথাপি এক অপ্রতিরোধ্য প্রেমাবেগে কাচুয়া এবং ধনী রায়চাঁদ বাণিয়া রাতের অন্ধকারে পর্যায়ক্রমে ঘুরঘুর করে বেড়ায়। এরকম সময়েই আসে হুতোম পুজোর প্রাক্কাল। গ্রাম্যজীবনের কৃষি ভিত্তিক চেতনায় মুখে অন্ন জোগানের মুখ্যত এই পুজোতে সব কুমারী মেয়েকেই যোগ দিতেই হবে। এমন ধর্মীয় সংস্কারের বিধান দিয়েছে বিধুয়া ( রীণা ভারতী)। তার ডাকে সাড়া দিয়ে লক্ষ্মী (তিথি মজুমদার), চন্ডী (অদিতি ভৌমিক), মেনকা (সহেলী মল্লিক), সরস্বতী (মৌসুমী কুন্ডু) প্রমুখ  যুবতীরা জোর করে উর্মিমালাকেও সামিল করেছে। পুজো চলছে, এমন সময় সেখানে কাচুয়া এসে হাজির হতেই বাঁধে বিপত্তি। এবার উর্মিমালার সামনে হত্যা করা হবে নাকি কাচুয়াকে? একটা টানটান উত্তেজনার মধ্যে এসে দাঁড়ায় দ্রোহ নাটক। দেবতার না মানবতার জয় হবে সেখানেই পড়ে নজর। অর্ণব মুখোপাধ্যায়ের লেখার তারিফ অজান্তেই স্বীকার হয়ে এসে যায়

এই নাটকের তরুণ তরুণী শিল্পী কুশীলবদের নিয়ে রীনা ভারতী চমৎকার প্রযোজনা নির্মাণ করেছেন। নজর কাড়া অভিনয়ে উর্মিমালা, কাচুয়া, রায়চাঁদ বাণিয়া, লক্ষ্মী, সরস্বতী, মেনকা, চন্ডীরা সবাই উজ্জ্বল। তথাপি প্রায় সংলাপ বিহীন, স্বাভাবিক ও সংযত চরিত্রায়নে রীণা ভারতী এবং সুমিত দে’কে প্রশংসা করতেই হয়। মঞ্চের আলো অন্ধকার অনুপম পরিবেশ রচনা করেছিল। আবহ সুপ্রযুক্ত। লোকাচারের প্রদীপ হাতে অর্ধ নগ্নভাবে শিল্পীদের আত্মঘন উচ্চারণে  আঞ্চলিক ব্রতগান অপুর্ব লাগে কলকাতার ব্যস্ততায় উপস্থাপিত গ্রামীণ সরলতায়। তবে রাজবংশী ভাষার উচ্চারণে কিছু অস্পষ্টতা, অবোধ্যতা বা অক্ষমতা আছে কি না, তার অন্বেষণ জরুরি। কিছু দর্শকের এই মর্মের অভিমত কানে এসেছিল। তবে আমার দেখা মিউনাসের এই উৎসবের ১৫ টি নাটকের মধ্যে বক্তব্যে ও বিশেষ লোকায়ত চর্চার নমুনা হিসাবে জলপাইগুড়ি মুক্তাঙ্গন নাট্যগোষ্ঠীর দ্রোহ ভিন্ন স্বাদের অন্যন্য বোধের একটি স্বতন্ত্র উপস্থাপনা। হয়তো সকলেই স্বীকার করবেন এমন নাটকেই আমরা সত্যিকারের গ্রামকে দেখেছিলাম। যেখানে স্বাভাবিক হবার প্রাণপণ চেষ্টা ছিল।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -