দুলাল চক্রবর্ত্তী, ফরাক্কা
নাটিক- কোনি
নাট্যরূপ- উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের
নির্দেশনা- শান্তনু নাথ
প্রযোজনা- পানিহাটি অভিযাত্রী
ইতিমধ্যেই পানিহাটি অভিযাত্রী দলের সদ্য নির্মিত কোনি নাটকের দুটি অভিনয় একাডেমি মঞ্চে হয়ে গেছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি আর ২২ মার্চে সন্ধ্যায়। অনেক গুণী শিল্পীদের একত্রিত করে নাট্য চালনায় কল্পনা মিশিয়েছেন তরুণ উদ্ভাবক শান্তনু নাথ। চমকে উঠেছে নাট্য মহল।
এ কি কান্ড! মতি নন্দীর “কোনি ” মঞ্চে!
জল ছেড়ে স্থলে? অবাক হবারই বিষয়। কদিন আগেই অভিযাত্রী দলের ‘কি খবর বল’ নাটকের একজন কুশীলব ছিলাম। শান্তনু নাথ জানিয়ে ছিলেন, এটা এবার করবেনই। পাঁচ বছর ধরে সে ভাবনার চূড়ায় এবার এসে গেছে। পাত্র পাত্রীও ঠিক হয়ে গেছে। ছোটাছুটি দৌড়াদৌড়ি চলছে। এই কাজের গভীরতায় সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে গেল সংস্থার বছর না ঘোরা নির্মিত দু’টি সমৃদ্ধ ছোট নাটক, “অস্তিত্ব” আর “কি খবর বল” উপস্থাপনার মঞ্চায়ন। সারা শীতের ঠান্ডা ছিল আগুনের মতো গরম। তারপর এলো প্রথম মঞ্চায়নের শুভ দিন।
মুর্শিদাবাদ থেকে গেলাম ছুটে। দেখলাম। কিছু ত্রুটি বিচ্যুতির মধ্যেও এক অন্য অভিজ্ঞতা।
সঙ্গীতা সেন মৎসকন্যা। ক্ষিতদার মনের ভেতরে জন্মে সুইমিংপুলের কাছে ক্ষিতদাকে দেখলেই জল বেয়ে কিনারায় আসে।
জলের তলায় এই মানবীর পা যায় না দেখা। সে সত্যিই মাছ যেন। কিন্তু কি করে সম্ভব? শরীর সে কিনা ডাঙ্গায় ভাসমান! মৎস্য কন্যা সে। আসে ভাসে নির্বাক তাকায়। ক্ষিতদা বলে, কি বলে না বলা না হওয়া সংবাদ। তাতেই মুহুর্মুহু হাত তালি। চলছে নাটক।
অনেক ছবি কিন্তু সামান্যই সংলাপ। বাহাদুরি দেখাবার অভিনয়ও তেমন নয়। শুধুই অবস্থা। অনুভূতি যখন যেমন তেমন। নাটকে প্রায় ১৫/১৬ টা টুকরো দৃশ্য। গড়ে আর ভাঙ্গে। মানুষের এগিয়ে চলা উচ্ছ্বাস ক্রমেই দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে গিয়ে আছড়ে পড়ছে। মনে হচ্ছিল না একাডেমি মঞ্চে বসে নাটক দেখছি। এ যেন ফুটবল মাঠে বসে গোলের পর গোল দেওয়ার তাপমাত্রা মাপছি।
তাই বলে নাটকে গ্রীক স্থাপত্যে ভরা থাম খিলানের মধ্যে প্রাচীন এক ট্র্যাজেডি নাটকের প্রচলিত চেহারায় কোন গভীর গম্ভীর সংবাদ ছিল না। ছিল না রোমহষর্ক খুনের বর্ণনা। রোমাঞ্চ লেনদেনও চলছিল না। অথবা উঁচু রস্টার্ম এর উপর এক দানবীয় হত্যা লীলাও চলছিল না। আধুনিক রিয়েলিস্টিক মঞ্চের মতো প্রাসাদোপম দেউলও নয়। এ নাটকে বিরাট দেওয়াল ঘেরা কিম্বা অসম্ভব দৃষ্টি নন্দন সৃষ্টি কিছুই ছিল না। বলা যেতে পারে কিছুই নেই চোখের জন্যে তৃপ্তিদায়ক। ছিল রঙ আলো আর ভালবাসা দিয়ে মুড়ে নেওয়া এক অসহায়ের ঘুরে দাঁড়াবার খন্ড গল্পের ভেতরের মোচড় আর যদির নদীতে ভেসে যাবে নাকি আমাদের রোজকার ধুলো মাখা পৃথিবীর রাজনীতি।
ক্ষমতায় অর্থে প্রতিপত্তিতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সত্যকে প্রতিপন্ন করার একটা খোঁজ ছিল। আসছিল ঘুরিয়ে পাল্টিয়ে রাস্তা থেকে জুপিটার কিম্বা অ্যাপোলো ক্লাবের অফিস ঘর, ক্ষিতীশ সিংহের বাড়ি, না তো ঘিঞ্জি বস্তির ওইসব টিবি রোগের আবাস, কিম্বা বাজারের দিকে মোড় নেওয়া ভীড় গ্যাঞ্জাম পথ। এরই আভাস। ছিল উঁচু দুটো স্টেপ বেয়েই সুইমিংপুলের কিনারা। তারপর জল, একেবারে ডিপ ও ব্যাক স্টেজে। আর দর্শকদের মাথার উপ দিয়ে বয়ে চলেছে জল। জলের তলায় মানুষের কিলবিলে কৌতুহলে প্রায় স্থবির নিশ্চুপ মন আর উদগ্রীব চোখ। এই, এ–ই, ব্যস…আর কিচ্ছুটি নেই, এখানে নাটক নাটক খেলার নাটুকে উপাদান একটাও নেই।
হ্যাঁ, ছিল। এইমাত্র মনে পড়লো। একরাশ জিজ্ঞাসা। জানতে চাওয়া। বুঝে নেওয়া। ইঞ্চি মেপে হিসাব….মতি নন্দীর কোনি তাঁর নিজের পূর্ণ পূর্ণিমার পূর্ণতায় পরিপূর্ণ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পর আর দেখাবার বাকি আছে কি? কেন এই স্বপ্ন? একি অবান্তর “খুব পারি বেশ শক্তি, অসাধারণ” এই শোনার আর বাজারের কমোডিটি হয়ে পণ্যের পশরায় দক্ষতা দেখাবার লোভ?? তবে? মঞ্চে কেন ক্ষিতদা আবার? আমাদের সেই একদিন প্রতিদিনের স্মৃতি গুলির ভেতরের মিথ্যে হয়ে বেঁচে থেকে সত্যি হওয়ার দারিদ্র্য কথাসব মিথ্যে নাকি। ধুর… মঞ্চে কোনি। ছেড়ে সেলুলয়েড সাদা কালোর আলো অন্ধকারের বাইরে? কোনি? ভাগ.. পালা…বললেই হলো? চ্যালেঞ্জ… impossible ভাই, বেট ধরবি? আয় তবে….
মঞ্চের উপর কোনি নাটক? কি করে সম্ভব ভাই? কেমন এবার ক্ষিত্ দা? আর বস্তির সেই মরে বেঁচে থাকা কোনি? সাঁতারুদের লাইন ধরে নিজের ট্র্যাকের ফাইট হবে কি আদৌ? কিন্তু সাঁতার দেবে কি ভাবে? এই এই শুধুই এইসব নিয়ে অনেক সত্তর দশকের মস্তিষ্ক তাল গোল পাকিয়ে ছিল। কবি সাহিত্যিক চিত্রকর ভাস্কর প্রাবন্ধিক চলচ্চিত্রকার ভাবনায় সবাই ছিলেন, মনে মুখে আনমনে অধরামৃত বা অর্ধমৃত চিন্তা সমুদ্রে।….
শেষমেষ এসেছিল ২৪ ফেব্রুয়ারী। যারাই বেশি বেশি ভেবে, বিষয় আর উপস্থাপন প্রক্রিয়ায় নানা কূটকচাল বিরোধের মধ্যে নান্দনিকতা এবং দারিদ্রতার মিল খুঁজে কুল পাচ্ছিলেন না। জল স্থল সাঁতার গুলিয়ে ফেলেছিলেন। তারাই এলেন। অনেক স্বজন বন্ধু আনলেন। মিলে মিশে নাটক দেখলেন। মজলেন। হাত তালি দিয়ে বাড়ি ফিরেও গেলেন। তৃপ্ত অতৃপ্তির মধ্যে যে অনির্দেশিত দিক থেকে দরিদ্রদের দারিদ্র্য নিয়ে ক্ষতার রাজনীতি চলছে। তাতে নির্বাক-ধূসর বনলেন। আর নির্দেশক শান্তনু নাথ, মঞ্চে কেশে হেজে মজে, কোনির দাদা সেজে, স্বপ্নের বীজের ভেতরে লেগে থাকার অঙ্কুরকে তীব্র অপমান অবমাননায় ধুয়ে নিয়ে জলের জালে শরীর-পোশাক করে কোনির শরীর-অস্তিত্বের উলঙ্গ সংগ্রামকে জারি করে দিলেন।
উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের সুদক্ষ নাট্যরূপারোপের মধ্যে অরূপ মিশিয়ে অপরূপ কোনি প্রতিমা গড়লেন। শান্তনুর ৫ বছরের স্বপ্ন কল্পনায় ছিল কোনিকে মঞ্চে আনার ইচ্ছা। সেই আকাশে প্রিয়া সাহা রায় আরেক জল স্থল তোলপাড় করা উভচর জীব হয়ে একেবারেই সরীসৃপ বস্তিবাসী জীবনের লক্ষ কোটি সংখার আত্মসম্মানে সুন্দর অবদানে নিজেই মঞ্চ-সুন্দরী কোনি হয়ে গেলেন। খুব ভাল ধীরেন/ জুপিটার ক্লাব কোচ কমল ব্রহ্মের আধিপত্য বিস্তার। হেরেও জিতে নেওয়ায় লেগে থাকা। দুরন্ত পার্সোনালিটি এম এল এ বিনোদ, এতেই মাত করলেন কৈলাশ নাথ পাল। নীরজ মন্ডল পাজল্ড ব’লে অতটা নয় জগাই, যতটা দরকার। লীলাবতী না খেতে পাওয়া লড়াকু পরিবারের প্রতীক চরিত্রে সিনেমার মতো স্মার্ট, আসা যাওয়া কথা বলা কিম্বা না বলা উচ্চারণে। শর্মিষ্ঠা দাস অনবদ্য ভূমিকা। কিন্তু ক্ষিতদার শারীরিক লালিত্য লাবণ্য এবং পরনের পাতি বুর্জোয়া পোশাক মেনে নিতে কষ্ট হয়। রোদে জলে ঘোরা, সূর্যের তাপে পোড়া, তালায় ভাত শুকিয়ে চাল বা স্যাঁকা গরম রুটির বাসি হওয়া কড়কড়ে ভাবের আমাদের সেই নকশাল বাড়ি আন্দোলনের ভিজে পোশাকের ক্ষিতদা এমন নয়। কিছুতেই ছিল না। সময় ছিল ইমার্জেন্সি অমার্জনীয় বাস্তব।
তবে অসাধারণ অভিনয় দিয়ে, আপ্রাণ সামর্থ্য সম্ভারে উজ্জ্বল দেবদূত ঘোষ, মঞ্চের উপর দুরন্ত ছিলেনই। কিন্তু শরীর ছিল দুধে ভাতে। মরা পেটের সেই ক্ষিতদার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ চোয়াল-চাপড় পেলাম না তো। কোনি ফাইট…ফাইট…ফাইট অনেকের মুখে চলে ঘুরে তরল হলো। হুইস্কির মধ্যে বেশি সোডা। নেশা নীল, শূন্য হয়ে উবে গেছে উত্তেজনার সেই ফাইট। ক্ষিতদার কথা, ক্ষিতদার লীলাবতী প্রবঞ্চনায় কোনি অন্য এক ইল্কেট্রা, নাকি বুদ্ধদেব বসুর কলকাতার ইলেক্ট্রা বুঝে নিয়েও কুলে থই মেলে না। কোনির মা সুলতা রায়, কোনির নেগেটিভ প্রতিদ্বন্দ্বী অমিয়া/ রিনিকা দাস, বেলা/ সৃজনী রায়, ভালবাসার ফুটন্ত গোলাপ মিষ্টি মেয়ে হিয়া, আহা কি চোখ চাওয়ায় শ্রেয়া সাহা চমৎকার দ্বান্দ্বিক কিন্তু বাস্তব।
শান্তনু নাথের কোনির দাদা সত্তরের দশকের বন্দুকের নলই যেন ক্ষমতার উৎস হলো। সেই বিপ্লব মরে গেছিল সাদা কাপড়ে ঢাকা খাড়াখাড়ি দাঁড়িয়েই। বাম, অতি বাম, এরা খুব রাম খেয়ে রামায়ণের রাম রাজ্যের মধ্যেই বাংলা মদে আসুক। সিদ্ধার্থ শঙ্করের সে উগ্র সিদ্ধান্তের পথে খই বৃষ্টির মধ্যেই এই ২০২৩ সালের মরা সভ্যতা মোবাইলে প্রমোদভ্রমণ করে চলেছে নাকি? টেকনোলজির সাম্রাজ্যবাদ বাঘ বন ছেড়ে ঘরে ঘরে এলো,…. পায়ে পায়ে। কেউকেটা হবেই বলে, ভোটে জিতে গদি পাবে বলে, বিষ্টুচরন সুন্দর চরিত্রায়নে মোটা বপু সৌমদীপ দাস। বাঁশিওয়ালা, তার অনুচর অনুচ্চারিত হিটলার কমিটমেন্ট হয়ে খাটের নিচের ছাড়পোকা সে। সে জানে বাজারের ব্যবসায় আজ কথা না বলেই নেটওয়ার্ক বেশি শব্দকেই বহ্ম প্রমাণে লেগেছে।
পুরুষোত্তম শিশু সুলভ কিন্তু ব্ল্যাক ক্যাট,…পুরুষোচিত। দু লাখ টাকা পাবে অ্যাপোলো ক্লাব… সৌভাগ্য তাই..দুরন্ত স্মার্ট প্রাণ গোবিন্দ সাহার সত্তর বছরের শরীর নকুলের মধ্যেই। কি টার্ন টানটান শিরদাঁড়ায়, চমৎকার একটা চরিত্র। সত্যের শক্তিতে সুব্রত সেনগুপ্ত এর প্রণবেন্দু ভাল। বস্তুত সবাই ভাল, অনেক ভাল কাজের সমাহার কোনির মঞ্চ পরিক্রমা পরিকল্পনা। কোমাচ্ছন্ন ছিল বহুদিন পানিহাটি অভিযাত্রী। দলের নাট্য-কৃতকর্ম নিত্য সেবা না-পেয়ে আই সি ইউ তে ছিল। এখন সেই মহীনের ঘোড়া অক্সিজেন নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তাহার নামটি রঞ্জনা, কি খবর বল, অস্তিত্ব আর কোনির সোনা রোদের গানেই হয়তো নতুন ভাবে আমাদের যাত্রা হলো শুরু।