Tuesday, March 18, 2025
Tuesday, March 18, 2025
Homeগল্পসল্পসারাটা জীবন নাটকই করলাম, নাটক আর দেখা হল কৈ

সারাটা জীবন নাটকই করলাম, নাটক আর দেখা হল কৈ

তথাগত সিংহ

বয়স যত বাড়ছে, গিন্নির মুখে একটা কথা ততই ঘুরে-ফিরে আসছে – ‘আর নাটক করতে হবে না।’ এই কথাটা শুনে ভাববেন না যে আমি একজন নাট্যকর্মী। অভিনেতা। কিংবা নিদেনপক্ষে এক্সট্রা। আমি আসলে এক্কেবারে ‘শান্ত-শিষ্ঠ-পত্নিনিষ্ঠ ভদ্রলোক’ বলতে যা বোঝায়, একদম তাই। কিন্তু আমার গিন্নির কাছে আমি একজন দারুণ অভিনেতা! মাঝে মধ্যে এটাও শুনতে হয়, আমার না কি অস্কার পাওয়া উচিত ছিল। গত আড়াই দশক ধরে না কি শুধু নাটকই করে গিয়েছি।

সংসারে বেঁচে থাকতে হলে তা সবাইকেই এক-আধটু অভিনয় করতে হয়। একটু নাটক করতে হয়। তাছাড়া, মানব জীবন একটা হলে কী হবে? চরিত্র তো আর কম নয়! প্রত্যেকটা পুরুষকেই একই সঙ্গে বাবা, ছেলে, ভাই, স্বামী, বন্ধু, কলিগ, অফিসকর্মী, নাগর – আরও কত না চরিত্রে হররোজ অভিনয় করতে হয়। মেয়েদেরও তেমনই। তাঁদের চরিত্রগুলো হয়তো পুরুষদের থেকেও কঠিন। কিন্তু আমার গিন্নির ওপর অভিমানটা হয় এই কারণে যে আমি তো কখনও বলিনি – তুমিও কম নাটক কর না। অভিনয়ে আমার যদি অস্কার পাওয়ার যোগ্যতা থেকে থাকে তাহলে তোমারও গ্র্যামি বা ওই জাতীয় একটা কিছু একটা পাওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।

না এটা কখনও আমি বলিনি। বলতেও চাই না। কেন বলব? প্রত্যেককেই নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই নাটক কিংবা অভিনয়টা জীবনে প্রতিক্ষণে করে চলেছেন। এই নাটকে কেউ কাউকে বাহবা দেয় না। হাততালি দিয়ে মঞ্চে উঠে গলায় ফুলে মালা পরিয়ে দেয়না। কে যে কখন কোন চরিত্রে অভিনয় করছে – সেটা হয়তো নিজেই জানেনা। কিন্তু তারপরেও দিনের পর দিন যতদিন বেঁচে থাকা প্রত্যেকদিনের নাটকটা সংসার নামের মঞ্চে করে যেতে হয়। এটাই চরম বাস্তব।

তাহলে কি এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ অভিনেতা? নাট্যকর্মী? নাটকের লোক? গিন্নিকে এই প্রশ্নগুলো করার কোনও মানে হয় না। কেননা আমি জানি, এই প্রশ্নগুলির সোজা উত্তর সে দেবে না। ফলে প্রশ্নটা নিজেকে নিজেই করতে হয়। কখনও তো জীবনে নাটকের মঞ্চে উঠলাম না। মঞ্চে উঠে কোনও চরিত্র সেজে হাততালি কুড়োনো হল না। তাহলে কি আমি অভিনেতা? নাট্যকর্মী?

সংসার নামক রঙ্গমঞ্চে যেদিন চোখ ফুটতে শুরু করেছিল (অভিনেতা তখনও হয়ত হয়নি) সে দিনের একটি মঞ্চের কথা এখনও আবছা মনে পড়ে। সাল তারিখ কিছুই বলতে পারব না। শুধু স্মৃতির অতলে এখনও মণি-মুক্তোর মতো যেটা জ্বল জ্বল সেটা একটা দৃশ্য। একটি কিশোরি মেয়ে। খিদের জ্বালায় বাবুদের ফেলে দেওয়া জিলিপির রস ভেজানো খবরের কাগজের ঠোঙাটা চেটে-পুটে খাচ্ছে। রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলোর সঙ্গে লড়াই করে একটু আগে সে ঠোঙাটা কব্জা করেছে। আর তারপর গোগ্রাসে কাগজটা চাটছে। জিলিপির রস ফোঁটা ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে কঙ্কালসার হাতটার সরু কালো আঙুলগুলোর ফাঁক দিয়ে। সেটাও ওই কিশোরি মেয়েটা জ্বিভ বার করে চাটছে।

অন্যদিকে, তার সেই হাতচাটা দেখে দাঁড়িয়ে থাকা পেটমোটা বাবুদের চোখও জ্বলজ্বল করছে। তারাও চাটছে। জ্বিভ নয়, চোখ দিয়ে চাটছে। ওই কিশোরি মেয়েটার শতচ্ছিন্ন ব্লাউজের পিছনে থাকা দড়ির মতো শুকিয়ে যাওয়া বুক আর শরীরটাকে। মাটির ওপর দাগ কেটে চার কোনে চারটি বাঁশ পুতে দিয়ে তৈরি হয়েছে মঞ্চ।  সেই মঞ্চের এক কোনে সাদা আলোর রোশনাই ছড়াচ্ছে একটা হ্যাজাক। সেই হ্যাজাকের আলোয় ঘটে চলেছে কান্ডটা। অজ পাড়াগাঁয়ে এক রাতের জন্য ঘটে যাওয়া সেই নাটকটা পুরোটা মনে পড়ে না। কিন্তু আজও সেই দৃশ্যটা বার বার আমার মস্তিকের কোনও একটি ভাগে মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে।

সেই প্রথম সেই শেষ। কলেজে পড়ার সময় সেই কিশোরি মেয়েটির খোঁজ পেতে হন্যে হয়ে এদিক ওদিক ছুটেছি। কিন্তু খুঁজে পায়নি। যেখানেই নাটক হতো ছুটে যেতাম। কিন্তু নাটক দেখতাম না। খুঁজতাম ওই কিশোরি মেয়েটিকে। হয়তো যৌবনের সন্ধিক্ষণে রাজপুত্তুর হয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দুখিনী রাজকন্যাকে উদ্ধারের স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু সেই রাজকন্যার খোঁজ আমি পাইনি। যখন বয়স বাড়ল – সন্দেহ হল, আদৌ ওই কিশোরি বাস্তবে ছিল তো? না কি সবটাই আমার কল্পনা? নিজে নিজেই আমি একটা গল্প ফেঁদে, সেই গল্পের হিরোর চরিত্রে আমি অভিনয় করে চলেছি?

তখনই বুঝেছিলাম, আমি মঞ্চে উঠে পড়েছি। জীবন আমাকে কখন যে অভিনয় করতে নামিয়ে দিয়েছি – টেরও পাইনি। সেই শুরু। তারপর ঘর-সংসার-চাকরি-বউ-বাবা-মা-শ্বশুর-শাশুড়ি-ছেলে- মেয়ে। সামনে যা এসেছে নির্দ্বিধায় অভিনয় করে গিয়েছি। বিয়ে করে প্রথম রাতেই খাটে উঠে গিন্নিকে বলেছি, ‘তুমিই আমার প্রথম প্রেম।’ সেদিনই গিন্নি বলেছিল, ‘মরণ, আর নাটক করতে হবে না।’ সত্যিই তো, নাটকই তো করেছি। মঞ্চের সেই কিশোরিকে সত্যিই কি আমি ভুলতে পেরেছি? পারিনি। সেই কিশোরিকে আজও কলকাতার বুকে কোনও এক গলির মিস্টির দোকানের আশে-পাশে দলা-মাটি মেখে পড়ে থাকতে দেখি। সেই রকমই তার শতচ্ছিন্ন বুকের কাপড়। কঙ্কালসার দড়ির মতো চেহেরা। কিন্তু পাশে গিয়ে কখনও জিজ্ঞেস করিনি – তুমিই কি সেই কিশোরি?

বরং সেদিনের সেই মিস্টির দোকানের বাবুদের মতো করেই আমিও পথে আধা বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকা মেয়েটার ছেঁড়া ব্লাউজের বুকের ফোঁকরের দিকে তাকিয়ে লোলুপ চোখে তাকিয়ে থাকি। কারণ আমি জীবনে বেঁচে থাকতে বাবুর চরিত্রে অভিনয় করে চলেছি। 

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular