বিজয়কুমার দাস
থিয়েটারের নতুন প্রজন্ম : পর্ব ২৫
উত্তরবঙ্গের মেয়ে তিথি মজুমদার জলপাইগুড়ি মুক্তাঙ্গন নাট্যগোষ্ঠীতে অভিনয় করতে করতেই কলকাতায় থিয়েটারে যুক্ত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল। সেই স্বপ্ন তার সত্যি হয়েছে। তাই মন প্রাণ দিয়ে অভিনয় করছে কলকাতার দলে। লেখাপড়াতেও পিছিয়ে নেই ত্রিদীপ মজুমদার ও বনশ্রী মজুমদারের মেয়ে তিথি। স্নাতক উত্তীর্ণ তিথি থিয়েটারের টানেই জলপাইগুড়ির মুক্তাঙ্গন থেকে এখন কলকাতা ক্রিয়েটিভ আর্ট পারফরমার্স দলের অভিনেত্রী। তার থিয়েটার চর্চায় তার মা বাবার সবুজ সঙ্কেত আছে বলেই সে কলকাতার দলে কাজ করতে পারছে। জলপাইগুড়ি মুক্তাঙ্গনে “জাতক” নাটকে তার প্রথম অভিনয়। মুক্তাঙ্গনের নির্দেশক রীণা ভারতী তাঁর প্রথম নাট্য নির্দেশক। মুক্তাঙ্গনে বছর দুয়েক যুক্ত থাকার সূত্রে জাতক, দ্রোহ, আলো, আচ্ছে সে রেহেনা, খুশবু বীণা ফুল, সমাদ্রিতা, পথ কতদূর ইত্যাদি নাটকে অভিনয়ের সূত্রে উত্তরবঙ্গের থিয়েটারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে অভিনেত্রী হিসাবে। আর তখন থেকেই কলকাতার থিয়েটারে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছেটা তাকে পেয়ে বসে।
সেই ইচ্ছেকে সম্বল করে এক বন্ধুর সূত্রে তার যোগাযোগ ঘটে কলকাতার ক্রিয়েটিভ আর্ট পারফরমার্স দলের সাথে যোগাযোগ ঘটে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত থিয়েটারে বছর তিনেকের একটু বেশি দিন তার যোগ। তার মধ্যেই তিথি বলতে পারে, থিয়েটারে সে নিজেকে খুঁজে পায়,প্রতি মুহূর্তে নিজেকে আবিষ্কার করে তাই সে থিয়েটার করে। কলকাতায় থিয়েটার করতে আসা নিয়েও মা বাবার সবুজ সঙ্কেত পেয়েছে তিথি। এ পর্যন্ত অভিনীত চরিত্রের মধ্যে “জাতক” নাটকের “ময়না” চরিত্রটি তার প্রিয় চরিত্র। ময়না এমন এক নি:স্বার্থ চরিত্র, যা তাকে আকর্ষণ করে। ময়না এক দৃঢ়চেতা, সাহসী, অগ্নিসম তেজি, আবার প্রয়োজনে কোমলহৃদয়া। আবেগ, মমতা মাখানো এক চরিত্র। যে নিজের কথা ভাবে না – ময়না নামের এই চরিত্রে অভিনয়ের সূত্রেই অভিনয়ে থেকে যাওয়ার ইচ্ছেটা তাকে পেয়ে বসে। এমন চ্যালেঞ্জিং চরিত্রের জন্যই তার থিয়েটারে থেকে যাওয়া। জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় চলে আসা।

থিয়েটার করতে করতে থিয়েটার জগৎ নিয়ে তিথির একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে তিথি জানিয়েছে,থিয়েটার করে বা থিয়েটার নিয়ে সারাজীবন বেঁচে থাকা খুব একটা সহজ কাজ নয়। তার জন্য লড়াই করতে হয়। আর সেই লড়াইটাই সে করে চলেছে। থিয়েটার নিয়েই বাঁচার লড়াই লড়তে কলকাতার থিয়েটারের ময়দানে এসে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য তার বাড়ির মানুষজনের পূর্ণ সমর্থন তাকে সেই লড়াইএর রসদ জুগিয়ে চলেছে। তাই সে লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারছে।কলকাতার ক্রিয়েটিভ আর্ট পারফর্মারস দলে অবশ্য এ পর্যন্ত “দ্রৌহিক” ও “কলিকালের সঙ” নামে দুটি নাটকে অভিনয় করেছে এই দলের নির্দেশক কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায়।
তিথিরা দুই বোন, এক ভাই। জলপাইগুড়ির সেন্ট্রাল উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় এবং জলপাইগুড়ি আনন্দচন্দ্র কলেজে তার পড়াশুনো। এখন তার জীবন জুড়ে শুধু থিয়েটার। থিয়েটার করতে করতে নিজেকে আবিষ্কারের একটা আনন্দ অর্জন করেছে তিথি। সাক্ষাৎকারে জানিয়েছে, এক বান্ধবীর সূত্রে জলপাইগুড়ি মুক্তাঙ্গনে এসেছিল। শুদ্ধ মাটির সন্ধানে ও টিট ফর ট্যাট সহ কয়েকটি নাটক করে ব্যক্তিগত কিছু কারণে দল ছেড়ে দিয়েছিল। ২০২২ এর নভেম্বরে দলে ফিরে মনে হচ্ছিল,কিছুই ঠিকঠাক করতে পারছে না। গলা দিয়ে স্বর বেরচ্ছে না। অন্যরা বলেছে, হবে না তিথিকে দিয়ে। বাদ দাও ওকে।অন্য কাউকে দিয়ে করাও। কিন্তু নির্দেশক রীণা ভারতী হাল ছাড়েননি। মুক্তাঙ্গনের অভিনেত্রী মৌসুমী এ সময় তাকে সাহস জুগিয়েছে। রীণা ভারতী বাড়িতে ডেকে এনে আলাদা করে রিহারসাল দেওয়া করিয়েছেন। তাতেও “জাতক” নাটকে ময়না চরিত্র প্রথম শো, দ্বিতীয় শো তাকে তুষ্ট করেনি। কিন্তু অদম্য চেষ্টায় তৃতীয় শো তে বাজি মাত করে দিয়েছিল তিথি। সে বুঝেছিল “হয় না” বলে কিছু হয় না। মুক্তাঙ্গনে আবৃত্তি, নাচ, সমবেত সঙ্গীতেও নিয়মিত শিল্পী তিথি।
সেন্ট্রাল উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় ও জলপাইগুড়ি আনন্দচন্দ্র কলেজ তার প্রধান শিক্ষাক্ষেত্র। স্কুল এবং কলেজে “আলো” নামে একটা নাটকে অভিনয় করেছিল। মা- বাবা সমর্থন করে বলেই সে জলপাইগুড়ির মুক্তাঙ্গন থেকে কলকাতা ক্রিয়েটিভে যুক্ত হতে পেরেছে। অভিনেত্রী হয়ে ওঠার লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারছে। সুন্দরবন নাট্য উৎসব কমিটির একটা নাট্য কর্মশালায় যোগ দিয়ে মেন্টর হিসাবে পেয়েছিল অভিনেতা নির্দেশক সুজন মুখোপাধ্যায়, অভিনেত্রী, নির্দেশক সীমা মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা রাজু বেরা, অভিনেত্রী মেরী আচার্য, তাপস চ্যাটার্জীদের। এরপর পশ্চিমবঙ্গ নাট্য একাদেমির ওয়ার্কশপ ও মিনার্ভা ওয়ার্কশপে সুযোগ পেয়ে প্রশিক্ষণ নিতে নিতে মনে হয়েছিল, কত কিছু শিখতে বাকি ছিল! কিন্তু এখন আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। এখন মনে হয়, একদিন যারা বলেছিল, ওকে দিয়ে অভিনয় হবে না, তাদের উদ্দেশে বলতে ইচ্ছে করে: পারি পারি, আমিও পারি। এখন মনে হয় থিয়েটার ও তিথি মিলেমিশে একাকার। সেই তিথির এখন জীবনের সবটা জুড়ে শুধু থিয়েটার আর থিয়েটার।