দুলাল চক্রবর্ত্তী ফরাক্কা
সম্প্রতি কোচবিহার রবীন্দ্র ভবনে হয়ে গেল, স্থানীয় কম্পাস নাট্যদলের ৩২তম বর্ষ পূর্তিতে জাতীয় নাটকের উৎসব। মঞ্চস্থ হয়েছে অনেকগুলি বিখ্যাত নাট্য প্রযোজনা। এই উৎসব মঞ্চে সম্মানিত করা হয়েছে, প্রখ্যাত আলোক শিল্পী দীপঙ্কর দে’কে।
নিজের ছোটবেলায় স্কুলের নাট্যচর্চায় এবং পাড়ার ক্লাবের সৌখিন নাট্যচর্চায় ওনার হাতেখড়ি হয়েছিল। মাত্র ৭ বছর বয়সে শিশু শিল্পী হিসাবে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। সেই সুবাদেই গড়ে উঠেছিল শেখার মন। নাট্য বিষয়ের সম্যক জ্ঞানের পাঠ নিতেই ভর্তি হয়েছিলেন ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়ান থিয়েটারের আর্টস বিষয়ক ছাত্র হয়ে। পরবর্তীতে আবার নাটকের ডিগ্রি পান রবীন্দ্র ভারতী ইউনিভার্সিটি থেকে। দু
এভাবেই শিক্ষাক্রম তরঙ্গে নাটকের সার্বিক ধারণা স্পষ্ট করে নিজেকে পোক্ত করে গড়ে নিয়েছিলেন মঞ্চ আলোর খেলায়। কিন্তু এক সময় পারিবারিক কারণে, অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু কিছুতেই নাটক ব্যতীত জীবনে চলে যেতে পারেন নি। কারণ আলো নিয়ে খেলা করার মোহ তাঁর মনের ভিতরে মহম্মদ বাদশা বনে মনোবাসনা-প্রাসাদে হাজারটা ঝাড়বাতি জ্বেলে দিয়েছিল। তাই চলে গেছিলেন সোজা আলোর যাদুকর তাপস সেনের কাছে।
দীর্ঘদিন শিশৃক্ষু ছাত্র হয়ে গাঁটছড়া বেঁধে সাথে সাথে ন্যাওটা পাগল হয়েছিলেন। তাঁর জীবনের হাতে কলমে কাজ শেখা ওই মহান শিল্পী তাপস সেনের কাছেই। সেখানেই হয়তো আকাশে ওড়ার সাহস পেয়েছিলেন দীপঙ্কর দে। বাদ বাকি অনেকটা আবার দীপক মুখোপাধ্যায় জয় সেন প্রমুখদের সান্নিধ্যে বুঝে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। এই বোঝাবুঝিতে খাদ না থাকায় তিনি নিজের পরিচয় উন্মুক্ত করেছিলেন স্বপ্নসন্ধানী দলের আন্তিগোনে, দ্রোহকাল, পাইকপাড়া আখরের দেওয়াল লিখন, নিভা আর্টসের গ্যালিলিও, চন্দ্রগুপ্ত, বেলঘরিয়া অভিমুখের কোজাগরী, রঙ্গিলা দলের মা এক নির্ভিক সৈনিক ইত্যাদি নামি দামী নাটকের নির্মাণে।
শুধুমাত্র থিয়েটারের গন্ডিতেই আবদ্ধ থাকেনি ওনার আলোক ভাবনা। মঞ্চানুষ্ঠানে আলোতে বাঙ্ময় ছবিতে উদ্ভাসিত করেছেন, পন্ডিত বিরজু মহারাজ,উস্তাদ জাকির হোসেন, পন্ডিত অনিন্দ চট্টোপাধ্যায়, বিক্রম ঘোষ, হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, উস্তাদ রসিদ খান প্রমুখ বিশ্ববন্দিত শিল্পীদের রাগাশ্রীত নৃত্য ও সঙ্গীত এর মেহেফিলের দরবারটিকে।
দীপঙ্কর দে, শুধু এমন একজন গুণী মানুষ হ’য়েই থেমে থাকেন নি। তাপস সেনের শেষ জীবনের কাছের বন্ধু হয়ে পারিবারিক জটিলতা সঙ্কটে হাত বাড়িয়েও দিয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন আত্মার আত্মীয়। সমাজ সেবকের এক ভূমিকায় রাতের পর রাত নিজের বিশ্রাম বিপন্ন করে রোগ সজ্জায় মরণাপন্ন জয় সেনের পাশে জেগে বসে থেকেছেন।
উদ্বিগ্ন সে সব দিন মনে রেখেই, সেন পরিবারের একের এক মৃত্যু-শোকের নদীতে ডুবে থেকেই তুলে এনেছিলেন আলোক শিল্পী হবার মনীষা। তা-ই হয়তো এখন প্রতি বছর তাপস সেন ও জয় সেনের স্মারক সম্মান, গুণী কিন্তু বর্তমানে হতকুৎসিত, ভগ্ন হৃদয়, শিল্পীদের হাতে তুলে দিয়ে তাঁদের বাঁচবার সর্বশেষ শক্তিটুকু দিয়ে থাকেন।
কোচবিহার কম্পাস নাট্যদল পরিবার নিজেদের নাটকের উৎসবে শ্রী দীপঙ্কর দে’কে সম্মান জানিয়ে, রাজ্যের ব্যাক স্টেজ কর্মীদেরও সম্মানিত করলো। যা নাট্য জগতে একটি জরুরী কাজ বলেই বিবেচিত হবে।