Tuesday, March 18, 2025
Tuesday, March 18, 2025
Homeনাটকসরকারি অনুদানের আড়াল আবডাল থেকে

সরকারি অনুদানের আড়াল আবডাল থেকে

দেবা রায়

অনুদান কিছু নাট্যকর্মীকে আর কিছু দলকে টিকিয়ে রাখছে। অপরদিকে বাংলা নাট্যচর্চায় একটি বৃহত্তম অংশ অনুদান ছাড়াই নাটক করে থাকেন। যাঁরা অনুদান পান, দল হিসেবে তাদের কৌলিন্য বেড়ে যায়। তাঁরা ভাবতে শুরু করেন, তাঁরাই একমাত্র যোগ্য নাট্য বিশেষজ্ঞ। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায় কোনও কোনও নাট্যদল যোগ্যতা ছাড়াই কোনো এক অদৃশ্য শক্তিবলে এই অনুদানের সুবিধা ভোগ করে চলেছেন।  

অনুদানের সাতকাহন


অনুদান যদি শিল্পকে বাঁচাতে পারতো তাহলে শিল্পকে বার বার অতীতের নাট্য বয়ানে ফিরে যেতে হত না। তাহলে কি নতুন নাটক লেখা হচ্ছে না? সেটা কখনই নয়। দলগুলি হয়তো নাট্যকারের কাছে পৌঁছোতে পারছেন না। আবার কখনও সখনও পৌঁছলেও তাঁদের নাটক করে উদ্ধার করে দিচ্ছেন – এরকম ভাবসাব প্রকাশ করছেন। অনেক সময় নাট্যকারের নাম না নেওয়াও ব্যক্তিগত চর্চার অধীন করে রেখেছেন। এমনি তাঁদের অভ্যাস যে তাঁরা নাট্যকারের নামটা তাঁদের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করেন না।

এই ব্যাপারে আর কি বলি সরকারিভাবে এবারের নাট্যমেলার প্রচার পত্রেও নাট্যকারের কোনও নাম ব্যবহার করা হয়নি। এছাড়া একসময় আমরা দেখেছি এক মহান নাট্যকারের নাটক কপি পেস্ট করে অন্যনামে একটা নাটক লিখে বেশ হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ঐ কেউ কোথাও থেকে যায়, যারা একটু হলেও পড়াশুনা করেন। তিনি রণেভঙ্গ দেওয়ার পরও কোনও সদর্থক ফলাফল মেলেনি। উপরন্তু নাট্য অঙ্গনে তাঁর মহানত্ব আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু একটি নাট্যকারের নাটক হুবহু কপি করে অন্য নামে প্রযোজনা করে তাঁর নাম না উল্লেখ করার ইতিহাসটা কেউ মুছে দিতে পারবেন না।

এরকম ভুরি ভুরি অন্যায় অভ্যাস আমরা প্রতিদিন প্রসব করছি। এবং অদ্ভুতভাবে নিজেদের জাস্টিফাই করছি। আজ ভুলটা সেটাই যেখানে সুবিধাবাদী ভোগকে না মেনে নিতে বলা হয়। একজন সুবিধাভোগীর একটি বিশেষ চরিত্র আছে, সে কখনই প্রাপ্ত সুবিধা হাতছাড়া করতে চায় না। যে সুবিধা পেয়ে সে কাজটা করে, সেই সুবিধা তাকে নিশ্চিন্ত যাপনে অভ্যস্ত করে তোলে। এবং সেই সুবিধা ছেড়ে থাকার অর্থ তার টিকে না থাকা।

কর্মীদের জন্য বরাদ্দ টাকা বন্টনের অভিপ্রায়

আজ এই নাট্য অঙ্গনে সরকার যখন কর্মীদের জন্য টাকা বরাদ্দ করে, তখন দলগুলি কোনও এক স্ব-চিন্তিত অদ্ভুত নিয়মাবলী খাড়া করে সেই সব কর্মীদের থেকে টাকা কেটে নেয় নিজের দলের অন্যান্য খরচ মেটাতে। এখানে তাদের যুক্তি থাকে ‘দল চালানো’। অথচ সরকারের কাছে যখন তাঁরা ইউটিলাইজেশন দেখান, সেখানে নিশ্চই এই যুক্তি থাকে না। থাকতে পারে না। অর্থাৎ সরকার এখানে অন্ধকারেই থাকে বলে মনে হয়। যদি দল পরিচালনার জন্য সরকার টাকা দেয় তাহলে কথা আলাদা। আসলে সরকার কখনও একটি রেজিস্টার্ড দলকে টাকা দিতে পারে কি না, সে প্রশ্নটা থেকেই যায়।  

সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন এক্ট-এ এই দলগুলি সাধারণত সামাজিক কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই দলের গঠনতন্ত্রে সরকার সেটিকে সাহায্য দিতে পারে কি না সেই প্রশ্নের মীমাংসা কবে হবে? তবে দলগুলির প্রযোজনা ব্যয় বাবদ টাকা দেওয়া হয়। শোনা যায় সেখানেও প্রাপ্ত অর্থের সঠিক ব্যবহার হয় না। সেখানে তাদের প্রার্থণা পত্রে যে হিসেব থাকে তা বাস্তবে নিজের মতো করে নেওয়া হয়। সবটাই ঘটে দলের স্বার্থে।

প্রাথমিকভাবে তারা নিজেদেরকে অসহায় করে রেখে, দল চালানো অসম্ভব হয়ে ওঠার সু-অভিনয়ের ফন্দি-ফিকির, সবসময় চলতেই থাকে। একদিকে প্রযোজনা ব্যয় গ্রান্ট, অন্যদিকে কর্মীদের স্যালারি গ্রান্ট, আবার দলের আয়োজনে উৎসব আয়োজনের জন্যও সরকার টাকা দেন। অর্থাৎ সরকারি এই সুবিধাদানের পশ্চাতে উদ্দেশ্য পরিস্কার, বিভিন্ন খাতে টাকা দেওয়া হয়, যাতে এই দলগুলি সেই কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারে। আর যারা অক্লান্ত শ্রমের বিনিময়ে দলে কাজ করেন তাঁদেরকে হোলটাইমার করার লক্ষ্যে সরকার তাঁকে স্যালারি গ্রান্ট দেয়।

কি কারণে সরকারের অর্থ সাহায্য?

একসময় অগ্রজ নাট্যজনেরা কর্মীদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভেবেছিলেন আর সেই মর্মে সরকারের নজরে তা এনেছিলেন কর্মীদেরই সহায়তা করতে। আর সেই সহায়তা আজও বজায় আছে। সরকারি নিয়মেই তার পরিমাণ একটু একটু করে বেড়ে চলেছে। কিন্তু কর্মীরা রয়ে গেছেন সেই অতল গহ্বরেই। এমনকি সরকার ‘গুরু’র খাতেও অর্থ সাহায্য করে থাকে। অর্থাৎ দলের অধিপতির প্রতিও সরকারের দৃষ্টি আছে। এই সব নিয়ম চালু আছে কিন্তু তবু দলগুলি তাদের ইচ্ছামতো প্রাপ্ত অনুদান বন্টন করে থাকে। এবং ঘোষণা করে থাকে যে সেটি না কি তাদের দলের অভ্যন্তরীণ ব্যপার। এখন যারা মনে করেন এই অনুদান ন্যয্য পাওনা, এই তহবিল জনগনেরই ট্যাক্সের অর্থে প্রদত্ত, তাহলে কি প্রশ্ন ওঠে না যে দল কিভাবে সরকারি সিদ্ধান্তের ওপর দলগত সিদ্ধান্ত আরোপের কারণ দর্শায়?

এরপর, দেখা যায় সরকারি অর্থে নির্মিত প্রযোজনায় টিকিট বিক্রি করতে। এই অর্থমূল্য নির্ভর করে সেই দলের কোন অভিনেতার বক্স আছে তার ওপর। এই বক্স অভিনেতার মূল্য বা সান্মানিক কোথা থেকে আসে? যাঁরা পেশাদার বলে নিজের গ্ল্যামার কাজে লাগিয়ে অন্যান্য দলে তাঁদের দক্ষতাকে বিক্রি করেন, তাঁরা কখনও এই প্রশ্ন তুলেছেন? তাঁরা মনে করেন তাঁরই কৌলিন্যে দর্শক প্রেক্ষাগৃহ ভর্তি করে।


অন্যায় করার প্রবণতা বা অভ্যাস

এইসব নিয়ে কথা বলার কারণ যদি কেউ খোঁজেন তাহলে তাঁরা নিশ্চিত তল খুঁজে পাবেন না। যিনি বা যাঁরা উচ্চবর্ণের নাট্যচর্চায় নিয়োজিত প্রাণ তাঁরা কখনই অপেক্ষাকৃত দুর্বল নাট্যজন সম্পর্কে ভীষণ উদাসীন থাকেন। অথবা অনুকম্পা নিয়ে হৃদয় খুলে রাখেন।

এই পরিস্থিতে আমরা যদি অনুদান নেওয়া-দেওয়া, পাওয়া বা না-পাওয়া এই তর্কে লিপ্ত হই – তাহলে হবে না। আঙুল তুলতে হবে আমাদের চারিত্রিক অসততার দিকে। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, তাঁরা যে মিথ্যাচারের অমরবাজারে নিজেদের যুক্ত রাখছেন, তাতে সমাজের কতটা ক্ষতি তাঁরা করেন। যে যুবক অনেক প্রত্যাশা নিয়ে থিয়েটারে আসছেন, তাঁকে প্রতারণা করার অধিকার কি তাঁর আছে? যাঁর নামটা সরকারের কাছে যোগ্য বিবেচিত করে পাঠিয়েছেন, তিনি যদি সত্যি যোগ্য থাকেন, তাহলে তো তাঁর হাতে তাঁর প্রাপ্য টাকা সম্মন-সহ তুলে দেওয়া উচিত। তাহলে সেই ছেলেটি বা মেয়েটি আরও মন দিয়ে নাটকটা করতে পারে।

কথাগুলো হয়তো একঘেয়ে শোনাচ্ছে। কিন্তু একটা বড় সংখ্যার কর্মীর মধ্যে ক্ষোভ কিন্তু দানা বাঁধছে। সেই ক্ষোভ কবে ফাটবে আমরা কেউই জানি না। দর্শকের কাছে বহু নাট্যব্যক্তিত্ব ‘ভগবানের আসনে’ আছেন। কিন্তু তাঁরা যে কত কর্মীর অর্থ মেরে বেঁচে থাকেন, সংসারে সর্বনাশ করেন, তাঁদের মুখোশ যদি কোনও এক সকালে খুলে পড়ে! ক্ষমতা যতক্ষণ আছে ততক্ষণ তাকে ব্যবহার করার প্রক্রিয়াও রাষ্ট্রযন্ত্রের একপ্রকার তরিকা। সরকার যখন এই অনুদানের হাত নিয়ে এগিয়ে আসে তখন তার মধ্যেও তার মুখবন্ধ করে রাখার অলিখিত এক শর্ত থাকেই। নাট্যচর্চার নামে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করো। গুণকীর্তণ না করুক, কেউ অনুদান পেলে কিছু যে বলবে না, এটা কিন্তু সরকার নিশ্চিতভাবে বুঝে যায়।


দল চালাবার নামে, যে ভাবে কর্মীদের বঞ্চিত করা হয় তা একটা রাজনৈতিক পার্টির থেকে কম কিছু নয় বলেই মনে হয়। মানুষকে প্রলোভন দিয়ে তাদের ভোট তারা নেন। কিন্তু ভোট পরবর্তী সময়ে কোনোভাবেই জনগণের সার্বিক সুবিধার লক্ষ্যে কোনো কাজ করে না। আর দলগুলির মুখ্যপাত্র নিজেকে গুরুর আসনে বসান, আর তিনিই সিদ্ধান্ত দেন। বলেন, ‘‘সদস্যদের শুধু মন দিয়ে নাটকটা করে যেতে হবে- এটা একটা কমিটমেন্ট- তুমি যদি তোমার স্যালারিটা থেকে কিছুটা টাকা দলকে দাও তাহলে আমরা নিয়মিত মঞ্চে অভিনয় করতে পারি‘‘ ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ এই ইমোশানাল ব্ল্যাক মেইলিং চলতেই থাকছে। 

সরকারের কাছে কাগজের কোনো ত্রুটি না রেখে, নিয়মিত নিখুঁতভাবে সাজিয়ে হিসাব দিয়ে যান। যাদের দিল্লিতে সরকার ডাকে, তাদের দিল্লি যেতে হয় বলেও নানা যুক্তি তারা দেন, তারা বলেন, এই যে যাওয়া সেই টাকা সরকার তো দেয় না, তারা তাদেরই দেওয়া অর্থ থেকে বাঁচিয়ে দিল্লি যান আর খুশির নানা ডিজিটাল মুহুর্তের কার্যকলাপ সোস্যাল সাইটে চিপকিয়ে যারপরনাই বুক চিতিয়ে চলাফেরা করতে থাকেন আর নাট্যের গর্বিত নায়কের দখলদার হিসেবে নিজেকে মনে করেন। কেউ যদিবা দু-চারটে কথা এসবের বিরুদ্ধে বলেন, তখন দাঁত-নখ বের করে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে বক্তা বা সমালোচককে আক্রমণ করতেও পিছ পা হন না।  

নাট্যের অন্তঃসলিলে

এতক্ষণ যা বললাম সবই অনেক অনিয়মের কথা। কিন্তু অন্তঃসলিলে নাট্যের প্রতি যে নিষ্ঠার চোরাস্রোত বয়ে চলে তা এই সামগ্র বাংলা থিয়েটারের প্রাণকেন্দ্র। যার ব্যাটনটা কিন্তু সেই হাজার হাজার নাট্যশ্রমিকদের হাতেই রয়েছে। যারা মাথা উঁচু করে নিভৃতে নাট্যচর্চা করে চলেন। এবং তারজন্য তাঁরা চাকরির প্রফিন্ডেন্ট ফান্ড, সদস্যদের মূল্যবান জিনিস এবং আরও নানান ধরনের সহায়তার হাত থাকে। তাঁদের কাজ দেখলে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। মনে রাখতে হবে, সেই অসীম ক্ষেত্রের কাছে কিন্তু এই সুবিধাভোগী বা অন্যায়কারীরা সংখ্যায় অতি নগন্য। এই কৌলিন্য তখনই টিকসই হবে, যখন মানুষ এগিয়ে আসবে তার কাজের অংশগ্রহণে। 

   
একটি সরল আবেদন

সরকারের কাছে সেই মহাস্রোতের হয়ে একটি আবেদন রাখা যেতে পারে। যে সুবিধার ব্যবস্থা সরকার করেছেন, তা সঠিক বিচারের সহায়তায় বন্টন হোক। বন্টনের জন্য যোগ্যতার সীমানা ঠিক থাকুক। সেখানে কোনও শৈথিল্য বরদাস্ত করবে না সরকার। সরকারি প্রেক্ষাগৃহের ভাড়া কমালে, সেই টাকা ভর্তুকি হিসেবে সরকার দিলে – সেই প্রদেয় সুবিধা সকল কর্মীর কাছে পৌঁছে যাবার সম্ভাবনা থাকে। নাট্য প্রযোজনায় হলের ভাড়া কমে যাওয়া মানে সেই দলটার কাজ করার ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যাওয়া অর্থাৎ তার কাজে সহায়তা। তাই সরকারি সুবিধা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ভাবনা চালু করার সময় এসে গেছে।

এখন সরকার যদি অনুদান বন্ধ করে দেয়, তাহলে কিন্তু এই কৌলিন্যবাতিক অনুদানপ্রাপ্ত দলগুলিকে বাকি যে দলগুলি অপরিসীম কষ্ট করে নাট্যচর্চায় নিয়োজিত থাকে – তাদের সাথে এক বেঞ্চে বসতে হবে। সেই বেঞ্চে বসে অনুভব করতে হবে, আসলে তাঁরা নাট্যচর্চার নামে যা করছেন তা আদতে শৌখিন নাট্যচর্চা। যেখানে মুষ্ঠিমেয় কিছু মানুষের পকেট ভরে আর চরিত্র নষ্ট হয়। গলা উচু করে কারা কথা বলে তাও আমাদের অজানা নয়। তাই বাংলার নাট্যচর্চার সার্বিক উন্নতি করতে হলে, সবার আগে নাট্যকর্মীদের মধ্যে বৈমাত্রেয় সুলভ ভাবনা চিন্তা থেকে বিরত থাকতে হবে।

একটি কোনোরকম সুবিধা না পাওয়া দল, তারা নিজের মতো করে দল চালাবার পদ্ধতি তৈরি করে। এমন বহু দল আছে, যারা পেশাদার নাট্যকর্মীদের টাকা দিয়েই নাট্য নির্মাণ করে। তাহলে তাঁরা সেই দল কিভাবে চালান? তাই নাট্যকর্মীদের মধ্যেকার যন্ত্রণা অনুভব করতে হবে। নিজেদেরকে আয়নার সামনে দাঁড় করাতে হবে। আর ব্যক্তি মানুষ হিসেবে নিজেকে সুন্দর করা চেষ্টা করতে হবে। দেখবেন, মানুষ আমাদের থিয়েটারকে ভালোবেসে হল ভরিয়ে দেবে। সাম্প্রতিক অনেক কাজ তারই প্রমাণ রেখে চলেছে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular