নাটিকা ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’

- Advertisement -

অনুপ চক্রবর্তী

চরিত্র- নজরুল। আরমিনা। মাধবী। বিএসএফ। প্রথম অনাগরিক। দ্বিতীয় অনাগরিক। প্রথম ঘাতক। দ্বিতীয় ঘাতক। মানুষ। লোভ।

মানুষ।। একী গভীর বাণী গহননীল অন্ধ গহ্বর থেকে উত্থিত হয়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে দিকচক্রবালে! এক অজ্ঞাত আশার মূর্ছনা যেন তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে দুঃখিত বিবর্ণ আকাশের দিকে। স্পষ্টতর হয়ে উঠছে যেন স্বপ্নের আশ্বাসবাণী নিরাশার অন্ধকার ছিঁড়ে ফেলে। মানবতার সীমাহীন অপমান লুপ্ত হওয়ার যেন  উজ্জ্বল আশ্বাস এই নেতির সর্বব্যাপী আক্রমণের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও। ধর্ষিতা জননীর রক্তে ভেজা মাটির ক্রন্দন যেন সেই মহাসঙ্গীতে বিলীন হওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।

প্রত্যয়ের ঝংকার তুলে কে যেন বলছে এগিয়ে আসছে সবুজ রাত্রি যার গর্ভ থেকে আবার জন্ম নেবে হারিয়ে যাওয়া সোনালী সকাল। অযুত নিযুত হৃদয়ের কান্নায় কান্নায় মথিত সময়ের তীব্র নীল বেদনার সমুদ্রে এক নবীন তরঙ্গ যেন উঠছে জেগে। অনাগত প্রভাতের সেই তরঙ্গ যেন বলছে বিনাশ বলে কিছু নেই, মৃত্যু বলে কিছু নেই, নেই অপ্রেম। নেই পরাভব।

(লোভের প্রবেশ। লোভ প্রবল হিংস্র হাসিতে মায়াবী অন্ধকার চূর্ণ করে দেয়। মঞ্চ ভরে যায় রক্ত লাল আলোয়।) 

লোভ।। হাঃ হাঃ হাঃ। কে বলে ওসব নেই? ওসবই আছে। আছে বিনাশ, মৃত্যু, অপ্রেম আর চিরায়ত পরাভব। কেননা আমি আছি। আমি আছি, তাই ওরা সবাই আছে।

মানুষ।। কে তুমি?

লোভ।। অবোধ মূর্খ মানুষ! আমাকে চিনতে পারছ না? আমি মূর্তিমান লোভ।

মানুষ।। তুমি লোভ?

লোভ।। হ্যাঁ। আমি সেই চিরন্তন লোভ। আমি সেই ভোগবাদী সর্বগ্রাসী অনাদি অনন্ত লোভ। অহরহ তোমাকে আমার চাই হে মানুষ। চিরকাল আমি তোমাকে খেয়েছি কুরে কুরে। আজো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাব তোমাকে।

মানুষ।। না চিরকাল ছিলে না তুমি। ছিলে না সেই গুহার অন্ধকারে। সেই দল বেঁধে পাথর ছুড়ে বাইসন মেরে তার মাংস পুড়িয়ে সকলে মিলে খাওয়ার দিনে। তারপর কি যে হলো –

লোভ।। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। তারপর বদলে গেল অনেক কিছু। হলো তোমাদের কৃষি বিপ্লব। রাশি রাশি  ফসলে উঠল ভরে তোমাদের সমাজ। তোমাদের ভাঁড়ার পূর্ণ হয়ে তারপর উদ্‌বৃত্ত হল ফসল। সেই উদ্‌বৃত্ত সম্পদ থেকে জন্ম নিলাম আমি দুর্নিবার লোভ। সঞ্চারিত করলাম তোমাদের মধ্যে সংঘাত সেই উদ্‌বৃত্ত সম্পদ দখলের জন্যে। উত্তাল হয়ে গেল তোমাদের সমাজ এই প্রশ্নে – কে নেবে সেটা। আর আমি প্রবেশ করালাম তোমাদের মধ্যে আরো আরো বাসনা আর প্রত্যাশা আর লালসা। আরো আরো ধনলিপ্সা। আরো আরো আরো চাই। আমি তাই তোমাদের নিয়ন্ত্রক। তোমাদের চালক। সর্বশক্তিমান। সবার ওপরে। তোমরা সবাই ভৃত্য আমার।

মানুষ।। তাহলে আমার কি কোন স্বকীয়তা রইলো না? কী ভয়ানক কথা বলছ তুমি!

লোভ।। না। যতদিন আমার অস্তিত্ব আছে ততদিন তোমার কোন স্বকীয়তা নেই। কোন নিজস্বতা নেই।

মানুষ।। আর যদি তোমাকে অস্বীকার করি? দেখো ঐ যে ঈশ্বর দাঁড়িয়ে আছে। ওই তো আমার বল । আমার সহায় ।

লোভ।। ঈশ্বর? হাঃ হাঃ হাঃ। তোমার ঐ ঈশ্বর তোমার কোন উপকার করতে পারবে না। কেন না তুমিতো অন্তরে ঈশ্বরে বিশ্বাস করো না। একটু আগেইতো বললে সেই কথা।

মানুষ।। আর যদি বিশ্বাস করি?

লোভ।। হাঃ হাঃ হাঃ। সেই বিশ্বাস হবে নিজেকে প্রবঞ্চনার নামান্তর। স্বার্থের খাতিরে সেই বিশ্বাস তোমার কোন উপকার করতে পারবে না। কেননা তোমার স্বকীয়তা নেই। তোমার প্রত্যয় নেই। এই দেখো আমি কেমন পীড়ন করব। তোমার ঈশ্বর পারবে না তোমাকে রক্ষা করতে।

(লোভ মানুষটার গলা টিপে ধরে তাকে মাটিতে ফেলে তার ওপর বসে গলায় চাপ দিতে থাকে)

মানুষ।। ওঃ! তুমি আমাকে এত ভীষণভাবে পেষণ করছ!

লোভ।। চিরকালই আমি তোমাকে এভাবেই পিষ্ট করে করে তোমার রক্ত পান করেছি। যেভাবে এখন করছি। তোমার মুখেতে এভাবে মুখ ঠেকিয়ে।

মানুষ।। (যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকে) ওঃ ওঃ আমার ভয়ানক যন্ত্রণা করছে। আমি এই ভয়ংকর অত্যাচার সহ্য করতে পারছি না ঈশ্বর, আমাকে বাঁচাও আমাকে বাঁচাও তুমি

(অন্ধকার)

(আরমিনা আরমিনা বলে ডাকতে ডাকতে একজন মেয়ে মঞ্চের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়ে চলে যায়। আবার তখনই মাধবী মাধবী বলে ডাকতে ডাকতে উল্টো দিক থেকে আর একজন মেয়ে দৌড়ে চলে যায় ওই প্রান্তে। এভাবে চলতে থাকে। তারপর দুজনে মুখোমুখি হয়ে যায়। ওদের কথোপকথন চলতে থাকে।) 

মাধবী।। তুই কোথায় গেছিলিস? তোকে কত খুঁজছিলাম আরমিনা৷

আরমিনা।। আমিও তোকে খুজছিলাম মাধবী। আমার আব্বা আম্মা সব কোথায় গেল। আমি তো ওদের খুঁজে পাচ্ছিনা। তুই তোর বাবা মাকে কি খুঁজে পেয়েছিস?

মাধবী।। নারে।পাইনি রে আরমিনা। ট্রাক থেকে আমাদের নামিয়ে দেবার পর ওরা কি করে যে আলাদা হয়ে গেল!

আরমিনা।। আমার আব্বা আর আম্মাও তো ট্রাক থেকে নেমে যাবার পর হারিয়ে গেল। পুলিশগুলো এত তাড়া লাগাচ্ছিল যে আমরা আলাদা হয়ে গেলাম।

মাধবী।। আমাদেরও তো একই ব্যাপার। আচ্ছা ওই পুলিশগুলো কি ইচ্ছে করে এটা করল? আমার তো সেটাই সন্দেহ হচ্ছে।

আরমিন।। আমরা এটা কোথায় এলাম? দূরে দূরে আরো অনেককে দেখতে পাচ্ছি। এটাতো ভারতের বর্ডার। ওই তো সামনে টহল দিচ্ছে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স।

মাধবী।। আর দূরে দ্যাখ বাংলাদেশের পুলিশ। আমরা তাহলে কোথায় যাব? বাংলাদেশে নাকি?

(একজন বিএসএফ এগিয়ে আসে।) 

বিএসএফ।। তোমরা বাংলাদেশ যেতে পারবেনা। কারণ বাংলাদেশের পুলিশ বলেছে তোমাদের ঢুকতে দেবে না।

মাধবী।। তাহলে আমাদের বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাও। 

বিএসএফ।। না। তোমরা ফিরতে পারবে না। কারন তোমরা ভারতের নাগরিক নও ।

আরমিনা।। তাহলে আমরা কোথাকার নাগরিক?

বিএসএফ।। জানিনা। বাংলাদেশকে আমরা বলেছিলাম। ওরা রাজি নয় তোমাদের নিতে।

মাধবী।। তাহলে আমরা কোনও দেশের নাগরিক নয়?

বিএসএফ।। না। আপাতত এই নোম্যানস জোনে তোমাদের থাকতে হবে। যতদিন না ওপর থেকে অন্য কোন আদেশ আসে।

আরমিনা।। আমরা খাব কি?  

বিএসএফ।। তোমাদের শুকনো খাবার দেওয়া হবে দিনে দুবার।

মাধবী।। রাতের বেলায় শোবো কোথায়?

বিএসএফ।। ওই সামনের মাঠে শোবে। ওখানেই বাথরুম পায়খানা করবে।

আরমিনা।। তোমরা কি মানুষ?

বিএসএফ।। এই শালী গুলি করে মারবো বেশি রঙ দিলে।

(ওরা দুজন হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে।)

আরমিনা।। আমরা কি দোষ করলাম? আমাদের কেন দেশ থেকে তাড়িয়ে দিলে।?

মাধবী।। আমরা তো এ দেশেই জন্মেছি।

আরমিনা।। হ্যাঁ। আমাদের আব্বা পূব পাকিস্তান থেকে এসেছিল। জোয়ান বয়সে। কাজের ধান্দায়। পূব পাকিস্তানে রোজগার পাতি করতে না পেরে। 

মাধবী।। মোর বাপও তো একই কারনে ওপার থেকে চলে এসেছিল শুনেছি আরমিনা। এখন এরা বলছে আমাদের গুলি করে মারবে।

(বিএসএফ টহল দিতে দিতে চলে যায়। দূর থেকে একজন লোক লাফাতে লাফাতে গাইতে গাইতে ঢুকে পড়েঃ কারার ঐ লৌহ কপাট।)

আরমিনা।। এই পাগলা বুড়োটা কে। কে তুমি?

নজরুল।। আমাকে চিনতে পারছ না?

মাধবী।। না। কে তুমি?

নজরুল।। আমি তোমাদের নজরুল গো। তোমাদের কবি নজরুল। নজরুল ইসলাম। চিনতে পারছ না আমাকে?

আরমিনা।। ধ্যাত পাগল। নজরুল তো কবে মারা গেছে।

নজরুল।। আমার তো মৃত্যু নেই। তাই মরে গিয়েও আবার ফিরে এসেছি তোমাদের কষ্ট দেখে৷

মাধবী।। তুমি ভুত নাকি?

নজরুল।। আমি বিদেহী হলেও সেই একই বিদ্রোহী চেতনা। এখন তো রুখে দাঁড়িয়ে তোমাদের লড়তে হবে। শুধু শুধু কাঁদলে হবে?

আরমিনা।। আমাদের বেনাগরিক করে দিয়েছে আমরা মুসলমান বলে।

মাধবী।। আমাদেরও বেনাগরিক করে দিয়েছে আমরা হিন্দু হলেও। বলছে আমাদের কাছে কোন কাগজ নেই। আমাদের নাকি কোন প্রমাণ নেই যে আমরা এ দেশের লোক।

আরমিনা।। আমাদেরও একই কথা বলেছে।

নজরুল।। তোমরা আলবাত এদেশের লোক। সেই কতকাল আগে শয়তানগুলো দেশভাগ করলো। কিন্তু ভাগ হয়নিকো এই নজরুল। এই নজরুল সকলের। ভারতের। বাংলাদেশের। আমি তাই আবার ফিরে এসেছি তোমাদের সাথে লড়াই করব বলে।

(আবার নজরুল লাফিয়ে লাফিয়ে গান গাইতে থাকে।)

নজরুল।। গাও গাও।তোমরাও গাও। মন খারাপ করে থেকো না। সবাই মিলে লড়তে হবে। কেউ তোমাদের তাড়িয়ে দিতে পারবে না। দেশটা দুভাগ করে রাখা এই কাঁটাতার মানুষ একদিন ভেঙে উড়িয়ে দেবে। গাও গাও তোমরা আমার সঙ্গে।

(ওরা সবাই গাইতে থাকে।)

সমবেত সংগীত।। আমার প্রতিবাদের ভাষা……

(অস্ত্র হাতে ঘাতকরা দুজন অনাগরিককে তাড়া করতে করতে ঢোকে)

ঘাতকরা।। (নেপথ্যে) এই। থাম। থাম ব্যাটারা। কোথায় পালাচ্ছিস। দাঁড়া বলছি।

প্রথম অনাগরিক।। না। না। আমাদের মেরো না। মেরো না আমাদের।

দ্বিতীয় অনাগরিক।। হ্যাঁ। হ্যাঁ। মেরো না আমাদের। এই কে আছ? রক্ষা করো আমাদের। প্র

প্রথম অনাগরিক।। হ্যাঁ। রক্ষা করো। রক্ষা করো আমাদের।

নজরুল।। এ কী? কারা তোমরা?

প্রথম অনাগরিক।। আমাদের ওরা হত্যা করতে আসছে। আমাদের রক্ষা করবে তো ?

নজরুল।। আমার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করব। কিন্তু ওরা তোমাদের মারতে আসছে কেন?

প্রথম ও দ্বিতীয় অনাগরিক।। কারণ আমরা অনাগরিক।

নজরুল।। অনাগরিক?

প্রথম অনাগরিক।। হ্যাঁ। আমি এক অনাগরিক। নাগরিকত্বহীন এক মানুষ নাকি আমি। তাই নাকি বাঁচার অধিকারহীন আমি। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি পৃথিবীতে বার বার এসেছিলাম শুধুমাত্র উলঙ্গ শিশু হয়ে। কখনো সঙ্গে করে নিয়ে আসিনি পৃথিবীতে কোন ধর্ম,ভাষা,সংস্কৃতি, জাতীয়তা, নাগরিকত্ব। তবুও বার বার বিপন্ন হয়েছি আমি,লাঞ্ছিত হয়েছি আমি,আহত হয়েছি আমি,নিহত হয়েছি আমি। বার বার শোষণের পাত্র হয়েছি আমি, ভোগের বস্তু হয়েছি আমি, খেলার পুতুল হয়েছি আমি। কখনো আমাকে গোলাম বানিয়ে করা হয়েছে রোমের গ্ল্যাডিয়েটার। তুলে দেওয়া হয়েছে আমার হাতে তরোয়াল আমারই মতো আর এক গোলামকে হত্যা করার জন্যে। কখনো আমাকে আফ্রিকার অরণ্য থেকে গলায় শেকল বেঁধে তুলে নিয়ে গিয়ে করা হয়েছে আমেরিকার তুলোর ক্ষেতের গোলাম শ্রমিক।

কখনো আমাকে বলা হয়েছি আমি হিন্দু, কখনো বলা হয়েছে আমি মুসলমান। কতবার ‘‘হিন্দু আমি’র সঙ্গে ‘’মুসলমান আমি’’র লাগিয়ে দেওয়া লড়াইয়ে আমরা পরস্পরকে হত্যা করেছি। আমার প্রভুরা যুগে যুগে সেসব ঠাণ্ডা মাথায় নিৰ্বিকার ভাবে দেখে গেছে। কখনো জেনেছি আমি ইহুদী। তাই মরতে হয়েছে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে জার্মানীর আউসভিৎসে প্রাণঘাতী গ্যাসে ভরা গ্যাস চেম্বারে আরো অনেক ইহুদীর সঙ্গে। মরতে মরতে একটু বাতাসের জন্যে দেওয়াল খামচে খামচে সেখানে কেটেছি অজস্র আঁচড়।

একলব্য হয়ে কখনো কাটতে হয়েছে আমাকে নিজের আঙুল ধনুর্বিদ্যায় দক্ষ হওয়ার অপরাধে। শম্বুক হয়ে ছিন্নশির হয়েছি বিদ্যাচর্চার অপরাধে। দেশভাগের কারণে ছিন্নমূল উদ্বাস্তু হয়েছি আমি। রক্তাক্ত,দগ্ধ, নিহত হয়েছি আমি। পাঞ্জাবে। বাংলায়। রোহিঙ্গা হয়ে মায়নামারে ছিন্নমূল উদ্বাস্তু হয়েছি আমি। সেখানেও রক্তাক্ত,দগ্ধ, নিহত হয়েছি আমি। আর আজ এখানে আমি হলাম নাগরিকত্বহীন এক মানুষ। কেননা আক্রান্ত, তাড়িত হয়ে প্রাণের দায়ে বা ক্ষুধার্ত ও জীবিকাহীন হয়ে পেটের দায়ে ছিন্নমূল উদ্বাস্তু হয়ে দূর অতীতে একদিন এখানে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি বা আমার পূর্বপুরুষ।

কিন্তু আজ আমি নাগরিকত্বহীন৷  আমাকে নাকি চলে যেতে হবে। নাহলে আমাকে নাকি গুলি করে মারা হবে। কিন্তু কোথায় যাব? আমারতো আ র কোন নাগরিকত্ব নেই। আমাকেতো মৃত্যু ছাড়া আর কেউ নেবে না। তাহলে এই সমগ্র পৃথিবীতে কো থাও আমার আর পা রাখার কোন জায়গা নেই। আমার যাওয়ার জন্যে শুধু রয়েছে কদর্য মৃত্যুর হিমশীতল জগৎ। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি শুধুই উলঙ্গ শিশু হয়ে জন্মেছিলাম। হিন্দু হয়ে নয়। মুসলমান হয়ে নয়। অসমীয়া হয়ে নয়। বাঙালী হয়ে নয়। বাঙলাদেশী হয়ে নয়। ভারতীয় হয়ে নয়। শুধুমাত্র মানুষ হয়ে।

(অস্ত্র হাতে ঘাতকদের প্রবেশ)

ঘাতকরা।। এই কুত্তার বাচ্চারা! এখানে লুকিয়ে আছিস? এখনই চল আমাদের সঙ্গে।

নজরুল।। কেন ওদের নিয়ে যেতে চাইছ?

প্রথম ঘাতক।। ওরা বেনাগরিক বিদেশী মানুষ। এদেশে অনুপ্রবেশকারী।

দ্বিতীয় ঘাতক।। আমরা ওদের ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাব।

প্রথম ঘাতক।। তারপর ওদের সেখানে দিনরাত খাটাবো। না খাটলে গুলি করে মারব।

দ্বিতীয় ঘাতক।। রাষ্ট্রীয় আইনে অনুপ্রবেশের এটাই শাস্তি।

ঘাতকরা।। এই কুত্তারা, চল আমাদের সঙ্গে

অনাগরিকরা।। যাব না। যাব না তোমাদের সঙ্গে। কেন যাব?

প্রথম ঘাতক।। যাবি, কারণ এ দেশ তোদের নয়। এ দেশে তোদের থাকার কোন অধিকার নেই। তোরা বিদেশী অনুপ্রবেশকারী।

দ্বিতীয় অনাগরিক।। এই সারা পৃথিবীর যে কোন কোণে আমার থাকার অধিকার আছে। কারণ আমি এই পৃথিবীর সন্তান। তাই বৃষ্টিভেজা এই যে আদিগন্ত নানা রঙা সবুজ – এসবই আমার। সদ্য ঘুমভাঙা ভোরের আকাশও আমার । খেয়ালী আকাশে লুটোপুটি খাওয়া নরম নরম বাতাসও আমার। সানসেট ইয়োলো রঙের রোদও আ মার। তার চুমু ভরা সীমাহীন এই নীলিমাও আমার। মঞ্চে দৃশ্যান্তরের মতো ঋতুদের বদলে যাওয়াও আমার। আর এ মাটিও আমার আমার। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই এ সারা পৃথিবী আমার। এ পৃথিবীর এক দেশ ভূমি থেকে তাড়িত হয়ে আর এক দেশভূমিতে গেছি। এক দেশভূমি থেকে পেটের জ্বালায় আর এক দেশভূমিতে গেছি। কারণ ঐ। ওটাই। এ পৃথিবী আমারও।

যুগ যুগ ধরে তৈরি করা,যুগের পর যুগ গলে গলে ঝরে পড়া এবং বদলে যাওয়া সীমানা,আইন,জাতীয়তা,নাগরিকত্ব সবই তোমাদের। আমার নয়। আমার হলো গোটা পৃথিবীটাই। এর সমগ্র মাটির প্রতিটি কণাতে আমার জন্মগত অধিকার। যদি বলো ছিনিয়ে নেবে এই অধিকার,যদি বলো সীমান্তে কাঁটাতারে লটকে দেবে আমাকে,যদি বলো অভুক্ত, অসম্মানিত,ঘৃণিত বন্দী করে রাখবে আমাকে বা গুলি করে মারবে আমাকে, তবুও বলেই চলব এ সারা পৃ থিবী আমার। তোমাদের সাজানো সব আইন ছেঁড়া কাগজের মতো উড়িয়ে দিলাম আমি। তোমাদের কাঁটাতার, তোমাদের ঘৃণা, তোমাদের বুলেট ডাস্টবিনের আবর্জনা হয়ে নোংরা করে দিচ্ছে আমার অ ধিকারের এই মনোহর প্রেমের পৃথিবীকে।

যে প্রেম তোমাদের হতভাগ্য চেতনায় নেই। যে প্রেম তোমা দের রক্তের মধ্যে নেই। সম্মার্জনী দিয়ে দূর করে দেব তোমরা সমেত তোমাদের সব আবর্জনাকে আমি ও আমার মতো আমরা। কারণ এই ভালবাসার পৃথিবীতে তোমাদের ঘৃণাভরা সত্তাগুলোর কোন অধিকার নেই। অমৃতস্য পুত্রাঃ আমরা। অমৃতের সন্তান আমরা। তোমরা নও। তোমাদের মরে যাওয়া চেতনা নিয়ে এ পৃথিবীর মৃত সন্তান তোমরা। যাও তোমরা। যাব না আমরা।

ঘাতক।। যাবি না তোরা?

অনাগরিকরা।। না। যাব না।

ঘাতক।। তাহলে মর তোরা।

(ঘাতকরা আক্রমণ করে। নজরুল প্রবলভাবে বাধা দেয়।)

নজরুল।। এই – কী করছ তোমরা – ওদের মেরো না – মেরো না –

(ঘাতকরা নজরুলকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে অনাগরিকদের হত্যা করে চলে যায়। অনাগরিকদের রক্তস্নাত মৃতদেহ পড়ে থাকে।)

নজরুল।। (অশ্রু বিসর্জন করতে থাকে) খুন হয়ে গেল ওরা। পারলাম না ওদের রক্ষা করতে। আশ্রয়হীন সহায়হীন বিপন্ন আর্ত মানুষদের উষ্ণ রক্তে ভিজে গেল মাটি । আমারই মতো দুজন মানুষ। তাদের খুন করে চলে গেল আমারই মতো আর দুজন মানুষ। তাহলে কি আমিই খুন করলাম আমাকে?

আরমিনা।। না। না। তুমি ওদের খুন করোনি নজরুল।

মাধবী।। ওদের খুন করেছে তারাই যারা আমাদের বর্ডারে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।

আরমিনা।। তুমি ভেঙে পোড়ো না নজরুল। এই তো একটু আগেই তুমি আমাদের লড়াই করার কথা বলছিলে।

মাধবী।। ঠিক তাই নজরুল। তুমি আবার বিদ্রোহের গান গাও নজরুল। তোমার বিদ্রোহী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ব নজরুল।

নজরুল।। ঠিক।

‘’মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেইদিন হবো শান্ত

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না

অত্যাচারীর খড়্গকৃপাণ ভীমরণভূমে রণিবে না

বিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেইদিন হবো শান্ত’

সমবেত সংগীত।। জাগো জাগো সর্বহারার দল…………

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -