নাট্যকর্মী সঞ্জিতার মুখোমুখি  

- Advertisement -

দেবা রায় 

বছর ছ’য়েক আগে নেওয়া সাক্ষাৎকার যা আজকের নতুন প্রজন্মের নাট্যকর্মীদের জানা উচিত। এই সময়ে দাঁড়িয়ে সঞ্জিতা নাটক ও সিনেমা জগতে দক্ষতা সাথে নিয়মিত অভিনয় করে চলেছেন। সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি পড়লে বুঝতে পারবেন তার লড়াই আর একাগ্রতা কথা। আজ এ সাক্ষাৎকার একজন অভিনেত্রীর জীবন সংগ্রামের নিয়ত জীবনের এক টুকরো দলিল মাত্র। যাকে দেখাটা জরুরী।

আপনার থিয়েটারে আসার গল্পটা যদি বলেন  

গল্প করে বললে সেটা শুনতে বেশ ভালোই লাগবে। আমার পরিবার কালচারালি এনরিচড একটি পরিবার। আমার বাবা সুনীল ব্যানার্জী ছিলেন শিক্ষক। মা বন্দনা ব্যানার্জী অন্যন্ত  সেন্সেটিভ একজন আধুনিকা। এরকম একটা পরিবারের মধ্যে আমি বড় হয়েছি। ছোটবেলায় পড়াশুনায় ফাঁকি দেওয়া বলতে ছিল, মা একটু গানে বসবো? রেওয়াজ করবো? বাবা, আমার গ্রামে নাটকের  ডিরেকশন  দিতেন। অভিনয় করতেন। অসম্ভব ভালো অভিনেতা  ছিলেন উনি। অসাধারণ কণ্ঠ। আমার গ্রামের নাম দেশমুখা, অঞ্চল শিয়াখালা, হুগলী জেলায়। বাবা নিয়মিত অভিনয় চর্চা করেছেন  সেখানে। আমার গঠনটা ওখান থেকেই। আমি বাবার সাথে দু-একটা নাটকে করেছি, মজার নাটকে করেছি। বেশীরভাগ আমার দাদা দিদিরা করেছে। আমার দাদা আমার নাটকের শিক্ষক। ছোট ছিলাম বলে ওরাই সুযোগ পেয়েছে বেশী। তবে আমার  বাবা  যখন রেডিওতে যাত্রার ডিরেকশন দিতো তখন দেখতাম যে, আমার দিদি সঙ্গে যেত, আমার দাদাও অভিনয় করতো, এমনকি আমার ছোড়দি ও যেত। আমি এসব দেখতাম। তবে ছোটবেলা  থেকে আমি গান করতাম, আবৃত্তি করতাম। অভিনয় করার বিশেষ  কোন ইচ্ছে আমার ছিল  না। এরকম যে একটা জগত আছে আমি জানতামই না। আমি এই গ্রামেই এইচএস(HS) অবধি  পড়েছি, বেলুড় কলেজে ইংরিজি নিয়ে পড়াশুনো। বিয়ের পরে আমি মাস্টার্স করি। আমার বাবা একজন  সক্রিয় কমিউনিস্ট মতাদর্শের মানুষ ছিলেন। প্রচুর স্ট্রাগল  করেছেন। আমি ভীষণ কষ্ট দেখেছি।  আমি এক বেলা না খেতে পাওয়া দেখেছি। তবে এগুলো আমি কিছুই জানছি না। বুঝতে দেয়া হয়নি, বাপির মাইনে তো সেভাবে হত না, অনেকদিন পরে হয়তো কিছু পেলেন।  তারমধ্যেও কিন্তু বাপি সন্ধ্যেবেলায় জীবনানদ পড়বেন, আমরা গোল হয়ে বসে শুনবো। রবীন্দ্রচর্চার একটা পিলার ছিল আমাদের  বাড়িটা। আমার দাদা এইসব গিলে নিয়েছিল। তার ফলে বাপির চেয়ে ওর প্রভাব আমার ওপর বেশী। বাপি আমার বন্ধু ছিল। আমাকে নির্মান করার দায়িত্বটা নিয়েছিল আমার দাদা, মনসিজ বন্দ্যোপাধ্যায়। আলোমুখের নির্দেশক আমার দাদা, হাওড়ার গ্রুপ। ওর কাজটা কিছুটা আপনার মত। আমার দাদা আমাকে নিয়ে গেল  ‘একটি দলে’। চিন্ময় চট্যোপাধ্যের দলে। ওথেলো প্রোডাকশনে। আমার দাদা ওথেলো প্রক্সি দিয়ে করত। এমিলিয়া চরিত্রে আমি। আমাকে ধরে বেধে নিয়ে যেত। আমি ভীষন রেগে যেতাম, ও করতে পারবে না আর আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, আমার তখন থিয়েটার করতে ভালো লাগত না।

সেটা কি ভয় থেকে?

না না। ভয় কেন? শুনুন তাহলে- পাড়ায় একটা বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। সেখানে কলকাতা থেকে বড় বড় শিল্পীরা আসতেন, সারারাত বাংলাগানের অনুষ্ঠান। সেবার শুরুতে যে  শিল্পীর আসার কথা ছিল সে কোন কারনে আসতে পারেনি। বাপি আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলছে, বাবু ওঠো তো তোমাকে একটু গান   গাইতে যেতে হবে। আমি শুধু জানি আমাকে হারমোনিয়ামটা দিলে আমি গেয়ে দেব। এটুকি আমার স্মৃতিতে আছে, সেই প্রথমে আমাকে কোলে করে গান গাইতে নিয়ে যাওয়া হল। সুতরাং মঞ্চকে ভয় পেতে হয় সেটা আমি জানিনা। বরং এখন আমার মঞ্চ থেকে নামলে ভয় করে। মঞ্চে উঠে গেলে মনে হয় আমি সিকিওর। গ্রামের থিয়েটারে- আমি একটা নাটক করেছিলাম, যেমন ফাঁস। তার আগে আমি বিসর্জনে একটা সংলাপ বলতে উঠে ছিলাম। ‘মহারাজ ডেকেছে আমারে’ বলার জন্য। সেটাও না বুঝে  করা। তারপর দীর্ঘদিন আমি নাটকের সঙ্গে ছিলাম না। স্কুলে আমি জীবনে নাটক করিনি। গান করেছি প্রচুর। নৃত্যনাট্য করতাম। আবৃত্তি করতাম। স্কুলে এইগুলোর জন্যে পপুলার ছিলাম। সেই প্রথম থেকেই আমার মধ্যে একটা ব্যাপার কাজ করতো, যদিও সেটা খুব নন থিয়েট্রিক্যাল সাউন্ড করবে, আমি খুব গুরুত্ব পেতে চাইতাম। আমি যেটা করতে চাইছি, সেটা এটা নয়, আরো বেশি কিছু। ফলে যেটা হল শুরুতেই আমার একটা  অনীহা তৈরী হয়ে গেল। কারন আমি অত্যন্ত সাধারণ দেখতে, আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতাম না তখন, অদ্ভুতভাবে বেঁকে দাঁড়াতাম। আমার বাবা বলতো, তুমি ভেব না, তুমি না থাকলে পৃঠিবীটা বন্ধ হয়ে যাবে ঘোড়া। বাবার কাছে  আতিশয্য দেখাবার জন্যে কিছু নেই, সে আমাকে খেলনা দিতে পারে না কথায় কথায়, ভালো জামা কিনে দিতে পারে না, শুধু ভালোবাসা ছাড়া, সে শুধু ভালোবেশে আমাদের বুঝিয়ে দিত সব। তারপর আমি সেই  ওথেলোতে যখন অভিনয় করেছি এমিলিয়া চরিত্রে, তখন আমার গ্রাম থেকে গাড়ি ভাড়া করে সবাই একাডেমীতে নাটকে দেখতে এসেছিল। আমার অংকের টিচার আমাকে এখনও ফোন করে বলেন, ‘আজকে  কাগজে এটা দেখলাম, এটা  কি তোমার ছবি, সকালটা আমার ভালো হয়ে গেল।’ এই সবটাই আমার মঞ্চে টিকে থাকার   কারণ। ভিত। পরবর্তীকালে আমি বার বার ভাবছি, আমি ঠিক পাঠ পাচ্ছি না। সেটা অবশ্য খানিকটা অজ্ঞতা থেকে। পরে আমি আমার দাদার সাথে আরেকটা গ্রুপে কাজ শুরু করলাম, সেটা হচ্ছে অন্যকথা। সেটা আমার ক্রমশ ভালো  লাগতে  শুরু করে। অন্যকথায় আমি  দাদার লেখা ‘চাঁদিপুরের চাঁদ কুমার’ নাটকে গৌরী  চরিত্রে অভিনয় করতাম। তারপর ‘পাকেচক্রে’ বলে একটা নাটক হল, সেই নাটকটায় আমি অভিনয় করতাম। তারপর আমার বিয়ে হয়ে যায়। থিয়েটার করাও ছেড়ে  দিলাম। আমার লক্ষ্ণৌতে বিয়ে হয়, যার ফলে আমাকে এসব ছেড়ে চলে যেতে হয়। ওদের পুরো পরিবারটাই লক্ষ্ণৌতেই জন্ম-কম্ম সব। এখন আমরা সবাই এখানে। তারপর আমি চাকরী নিয়ে ব্যাঙ্গালোর গেলাম, আমার বরও সেখানে গেল। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা আমাকে খুব ভালোবাসে। এরপর আমি কনসিভ করলাম। মেয়ে হল এখানে। আমার হাসব্যান্ড বলল যে আমাদের কলকাতায় সেটল করা উচিত, কারণ সে  যেভাবে ছোটবেলা থেকে একা বড় হয়েছে, সেটা সে চায় না তার সন্তানও হোক। কারণ সে বলে, না আমি লক্ষ্ণৌ-এর হয়ে থাকতে পারি, না আমি বাঙালি হয়ে, একটা অদ্ভুত ক্রাইসিস, লক্ষ্ণৌয়ের লোকেরা ওকে বাঙালি বলে, অথচ ও বাঙালি না, অসম্ভব ভালো হিন্দি বলে। বাংলা কথায় ওর টান। ফলে ওর যে মানসিক একটা কষ্ট সেইটা ও আমার সাথে শেয়ার করল। আমার শ্বাশুরি মা ওখানে কলেজে পড়াতেন, আমার শ্বশুর মশাই এয়ার ফোর্সে ছিলেন, অসম্ভব ডিগ্নিফায়েড একটা ফ্যামিলি। আমার ভাশুর আর্মির একজন ব্রিগেডিয়ার। বর্ধিষ্ণু পরিবার। সাংঘাতিক রেসপেক্ট। তারপর আমরা কলকাতায়  সেটেল্ড করে গেলাম। এই আমার পোকাটা আবার নড়তে শুরু করলো।  কিন্তু আমি তখন চাকরি করি, দাদাকেও সময় দিতে পারছিনা। মাঝে মাঝে যেতাম। আমাকে দিয়ে প্র্যাক্টিস করাত, কিন্তু মঞ্চে আমি উঠতে পারছি না। একদিন  রেডি হয়ে অফিস যাব,  সেই সময় আমার দিদির ছেলের বন্ধু প্রিয়জিত, ওর কাছে জানতে পারি ওয়ার্কশপের কথা, নাটকের ওয়ার্কশপ, রঙ্গকর্মী, উষা গাঙ্গুলির, যা আমি এতদিন কাগজে পড়েছি। আমি ওকে জিজ্ঞাসা  করলাম আচ্ছা কি করতে হয় রে, এখানে যেতে হলে? কিছু করতে হয় না, এমনি গেলেই হয়ে যায়। আমি ওকে বললাম, আমি যাব। তুই নাম্বারটা দে। একদিন রঙ্গকর্মীতে গেলাম। এই প্রথম ঐ বিশাল মাপের মানুষের কাছে গেলাম। কিছুক্ষণ আগেই ফোনে কথা হল, উনি এখন কলম্বিয়ায় গেছেন।  তা সেদিন আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, কি কর তুমি? আমি বললাম আমি একটু একটু গান করতে পারি। সে শুনতে চাইলেন, গেয়েছিলাম, ‘খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে…’।  উনি বললেন তুমি কাল থেকে এসো  না ওয়ার্কশপে। আমি তো এটাই চাইছিলাম, যে উনি আমাকে ওয়ার্কশপে আসতে বলুক। তখন আমি বললাম আমি তো চাকরি করি, সময় পাবো না। তা  উনি বললেন, ঠিকাছে তুমি যখন অফিস থেকে ফিরবে, তখন একবার ঘুরে যেও। এই প্রথম একজন আমাকে সুযোগ দিচ্ছেন, তুমি যেটা করছো সেটা করার পরে যতটুকু সময় আছে, ইনস্টিড অফ গোয়িং ব্যাক টু ইওর হোম, সেই সময়টা এখানে দিয়ে যাও। শুধু রাত্রিতে ঘুমোতে যাও। এই উনি আমার সর্বনাশটা ঘটাচ্ছেন। পরদিন অফিস গিয়ে। সেই সময় আমি ট্রেনিং দিচ্ছিলাম। আমি ট্রেনিংটা সকালে শিফট করে নিলাম, সাতটা থেকে। দুপুরের দিকে শেষ হয়ে যেত, ওখান থেকে ছুটতাম। ওয়ার্কশপ করাতে আসতেন, একজন অসাধারণ মানুষ, ভুপাল থেকে, মনোজ নায়ার। তিনিই প্রথম  আমাকে বোঝালেন, যে আমি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, মানে কিছু একটা করতে পারি, যেটা আমি এতদিন থেকে খুঁজছি। উনি আমাকে নানাভাবে কাজ দিতেন,  গানের সুর করতে দিতেন, আমার রেসপেক্ট চিরকাল তার জন্য  থাকবে। সেই আমার রঙ্গকর্মীতে যাওয়া, উষা গাঙ্গুলী আমাকে পছন্দ করতে  শুরু করলেন। একদিন উনি একটা ছবি নিয়ে এসে আমাকে দেখালেন, মুখটা বন্ধ করে দিয়ে আমাকে বললেন, দেখ! আমাদের দুজনের সিমিলারিটি দেখালেন আমাকে। আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। সেদিনটা ছিল ১লা  সেপ্টেম্বর, আমি সব ভুলে যাই এটা ভুলিনি, উনি সোফায় বসে আছেন, আমি নীচে। ওনার মনে নেই, কিন্তু  আমার মনে আছে। উনি আমাকে বললেন যে, হোয়াই শুড আই কুইট মাই জব। তখন কিন্তু আমি এয়ারসেলের কোয়ালিটি এনালিস্ট। হিউজ স্যালারি পাই তখন আমি। আমি একরকম করপোরেট লেডি হয়ে গেছি। কাধে ল্যাপটপ নিয়ে, বাড়িতে গাড়ি আসছে। এরকম একটা পরিস্থিতি। উনি বোঝালেন, জবকে আমায় ছেড়ে দেওয়া উচিত। আমি যে কথাগুলি মনে মনে বলি, উনি  আমাকে ভাবালেন, উনি বললেন, যে দেখ যখন তোর পঞ্চাশ বছর বয়স হবে, সারা পৃথিবীসুদ্ধু সবাইকে তুই কার্স করবি, যে তুই কি করতে পারতিস আর এই  মানুষগুলোর জন্য তুই করতে পারলি না। এযে কী অভিশপ্ত জীবন। আর এইটা তুই বেছে নিস আমার সান্নিধ্যে আসার পরে, এটা আমি চাই না। আমি তাঁর পায়ে মাথা রেখে কেঁদেছি, মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছি, উনি বললেন যে দ্যাখ তুই থিয়েটার করলে, তোর টাকা পয়সা অনেক কম হয়ে যাবে, তোর খুব কষ্ট হবে। এই মেটেরিয়ালিস্টিক জীবনে। আমার কেন জানি মনে হয়ে তোর কাছে এগুলো খুব একটা বড় কষ্ট নয়। চাকরীটা ছেড়ে দে। আমি ২রা সেপ্টেম্বর থেকে আর অফিস যাইনি। কি যে হয়ে গেল   আমার। আমি অদ্ভুত একটা কনফিডেন্স পেলাম, একটা রিসন পেলাম। আমি অফিসেও বস, বাড়িতেও বস, বন্ধু মহলেও বস, আমি যেন ক্রমশ বস হয়ে যাচ্ছি। সেইটা আমি নিজেও ঘৃণা করতাম, কিন্তু ওটা হয়ে যাচ্ছি। আর থিয়েটার আমাকে পুরো উলটো কথা শেখাচ্ছে। তুমি বস হলে তোমাকে কেই মানবে না। তুমি যতক্ষণ একজন মানুষ হয়ে থাকবে, তোমার মাটিতে পা মানে তুমি সবার মধ্যে, সবাই তোমাকে চাইবে। সেদিন থেকে আমার  অনেকদিনের ফোন নং আমি পালটে ফেললাম। আমি সবটাই ইরেজ করে দিলাম। তারপর আমি রঙ্গকর্মীর রেপার্টারিতে জয়েন করি। আমাকে যে টাকাটা দেয়া হত তাতে আমার আসা যাওয়া ঠিকঠাক চলে যেত। খুব  সাপোর্ট করতেন আমাকে ম্যাম। ওই সময়টা আমি খুব এনজয়  করেছি। আমাকে যেমন বকতেন আবার কাছে ডেকে বোঝাতেন, সে যে কি সম্মানের  তা কি বলি, আমি সবসময় বিশ্বাস রেখেছি, যা কিছু এই মানুষটি বলছেন  তা আমার ক্ষতি করার জন্যে নয়। ভালোর জন্য। তারপরে, সৈয়দ জামিল আহমেদ এলেন ‘শ্যামার উড়াল’ নাটকটি  ডিরেকট করার জন্য, বাংলাদেশ, ঢাকা থেকে, উনি একজন এনএসডিয়ান। পরে আমরা এনএসডিতেও করি নাটকটা। সারা পৃথিবী জুড়ে উনি কাজ করেন, কি মাপের মানুষ ওনাকে না দেখলে বলে  বোঝানো যাবে না। উনি আমাকে রাখতে চাইলেন, আমি শুধু গান করবো ঠিক ছিল, উনি বললেন যে আমি তিনজন শ্যামা কথা ভেবেছি, মধুমিতা, অর্পিতা, এবং সঞ্জিতা। আর সেটা যখন স্থির হল সেই সময়টা আমার  ব্যাক্তিগত জীবনে একটা ঝড়। আমার বাবা যিনি আমার সব। সেই মানুষটার শরীরটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, তাই  আমার কাছে এনে রেখেছিলাম। ডাক্তার দেখালাম, ডাক্তার একদিন আমাকে ফোন করে বললেন, সঞ্জিতা আপনার বাবার কিছু টেষ্ট করাতে হবে, আমার ঠিক ভালো লাগছে না, এই প্রথম আমি আমার ব্যক্তিগর জীবনে এইরকম পারিবারিক ঝড় ফেস করলাম। আমি টেস্ট করালাম, করে জানতে পারলাম, যে আমার বাপি খুব বেশী হলে আর কুড়িদিন বাঁচবে। তার এমন একটা লাং ক্যান্সার হয়েছে, যেটায় ব্যাথা হয় না। সে ছুটে এলেও হাপাচ্ছে না। কিন্তু ভেতরে লাংসে পোকা ছড়িয়ে গেছে, সে আর বেশীদিন বাঁচবে না। আমি প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়লাম। পরদিন থেকে শ্যামার রিহার্সাল শুরু হবে। আমি ওদের জানিয়ে দিলাম, আমি নাটকটাতে পার্টিসিপেট করতে পারবো না, কারণটা বললাম, ম্যাম বললেন কোন কথা নয়, এসব নিয়ে ভাবতে হবে না তুমি বাড়ি চলে যাও। আমি চলে এলাম বাড়িতে। পরদিন সকালবেলা জামিল ফোন করলো, সঞ্জিতা আপনি রিহার্সাল কখন আসছেন? আমি তখন বললাম, যে স্যার  আমি তো এখন আসতে পারবো না, আমার একটা পারিবারিক সমষ্যা রয়েছে। আমাকে বললেন, আপনি যদি না আসেন, তাহলে  আমি কিন্তু আপনার ম্যাডামকে বলবো, আমাকে রিটার্ন টিকিট কেটে দিতে আমি বাড়ি চলে যাব। উনি আর কাজটা করবেন না। ভাবুন আমার ক্রাইসিসটা। আমার বাপি আমাকে বলছেন, তুমি রিহার্সাল যাচ্ছো না? বাপি তো জানে না, দাদাও বলল তুমি রিহার্সাল চলে যাও। আমি গেলাম। তখন জামিল বুঝিয়ে বললেন, দেখুন আমাকে কাজটা করতে হবে, আমি প্রোডাকশনটা যেভাবে ভেবেছি সেইভাবনাটাতে আপনি নেই, এটা আমার মাথায় আসছে না, পরবর্তীকালে মাস পাচেক পরে যখন প্রোডাকশনটা করেছি, তারমধ্যে বাপি চলে গেছে, ‘শ্যামার উড়াল’ মঞ্চস্থ করলাম। এখন আরো বেশী করে  বুঝতে পারি যে সেই সময়ে যদি উনি  আমাকে গ্রাস করে না নিতেন আমি  পড়ে যেতাম। আর হয়তো আমার থিয়েটারটা সত্যি করা হোত না। শোকটা  সামলাতে পারতাম না। এটা হয়তো উনি বুঝেছিলেন। মারা যাবার আগে  বাপি বলেছিল, যে আমরা যে রকে বসে তারা খসা দেখতাম মনে আছে তোর?  আমি বললাম  হ্যাঁ। সে বললে, তারাগুলো কোথায় যায়? কোথায় আবার যাবে, মাটিতে কোথাও থাকে, ঠিক  মাটিয়ে  কোথাও থাকে, আমারো না এরকম হবে,  তারমানে কি আমি নেই হয়ে যাব? না, কোথাও হয়তো থাকবো। তুমি যদি খুজে নিতে পার খুব ভালো, আর নাহলে তাও কিন্তু আমি থাকবো, কান্নাকাটি কর না। বাপি মারা যাবার পর জামিল আমাকে ফোন করলেন, আর  কয়দিন ছুটি নেবেন? ছুটি! আমি তার পরের দিনই রিহার্সাল গেলাম। এইভাবে থিয়েটার না  প্রতি পদে পদে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। শো বেশী হল না নাটকটার, খুব এক্সপেন্সিভ ছিল। জামিলের সাথে কাজ করার পর আমার যে সর্বনাশটা হল আমার আর কারোর কাজ ভালো লাগছে না। ঐ যে কী একটা জাদু করে দিয়েছেন, অদ্ভুত প্রসেসে কাজ করতেন, স্ক্রিপ্টটা অবধি ওইখানে বসে বসে লেখা হচ্ছে। আমি রঙ্গকর্মী যাওয়াও ছেড়ে দিলাম। ম্যামের জন্য খুব মন খারাপ করতো। কিন্তু থিয়েটারটা আমার আর করতে ভালো লাগছে না। আবার সেইসময় আমাকে বাঁচিয়ে দিল, আমার দাদারই গাইডেন্স, সে আমাকে বলল সৌমিত্র বসুর কাছে যা। একটা মাত্র মানুষ আছে, যে এই যে তুই আটকে গেছিস, সেখান থেকে তোকে রিলিফ দেবে। আমি ফোন করলাম তাঁকে। উনি বললেন- একে! কে কথা বলছে আমার সাথে? আপনার সাথে কাজ করতে চাই। আপনার সাথে কাজ করলে ভালো লাগলেও লাগতে পারে। উনি বললেন তাহলে আমাকে পরীক্ষা দিতে হবে? খানিকটা আমি বললাম। ঠিকাছে আপনি আমার নাটক দেখতে আসুন। মধুসূদন মঞ্চে নির্বাস নাটকটা ছিল। গেলাম। প্রণাম করতে গেলাম, সে বলল উরে বাবারে আমার বুকে ব্যাথা লাগে। আমি মেনে নিলাম তাকে। হাসিয়ে দিলেন আমায়। এরপর থেকে মানুষটাকে আমার অসাধারণ লাগলো। সেই শুরু তাঁর সাথে কাজ করা। সন্দর্ভে। সে চেয়ারের ওপরে বসে ডিরেকশন দিতেন বলে আমি তাঁর নাম দিয়েছিলান গুরুমশাই। কিছুদিন যাবার পর আমি সেখানেও  যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। আসলে আমি ওই গ্রুপ কন্সেপ্টটার মধ্যে কিছুতেই এডজাস্ট করতে পারছিলাম না। সৌমিত্রবাবুর সাথে দলের একটা ব্রিজ তৈরী হল, আমিও সেই সময় থেকে সেখানে যাওয়া ছেড়ে দিলাম, আর সেই সময় থেকেই আমি আমার ‘পথ’এর কাজ শুরু করি। আমার মনে হয় যে স্ট্রীটে কাজ করা উচিত। বছর তিনেক  আগে। কারন আমাদের জন্য অজস্র মানুষ আছে যারা আমাদের সাথে কথা বলতে চায়, তাদের রাস্তায় গেলে পাওয়া যায়। সেইসময় প্রবীর গুহ খুব সাহায্য করেন। আমার ঘরে এসে উনি রিহার্সাল করাতেন। উনি শেখালেন, যে আমাকে রাস্তায় গিয়ে কী করতে হবে। পথের কাজ করতে করতে শুরু করে দিলাম  অন্তর্মুখে কাজ করা। প্রচুর কাজ করি সেখানে।

আপনি কি এইসব কাজগুলো যে করেছেন সেগুলো কি  পেশাদারভাবে করেছেন নাকি অপেশাদার ভাবে?

পেশাদের বলতে যদি টাকা পয়সা বোঝায় তাহলে সেই অর্থে আমি কোন টাকা পয়সা পেতাম না কিন্তু। খুব কষ্ট হত, আমার এরকমও দিন গেছে, যে সময়টা আমি শ্যামবাজার থেকে হেঁটে  বাড়ি এসেছি। বাড়ি থেকে টাকা চাইতে লজ্জা লাগতো। মনে হোত এতকিছু করছি অথচ টাকা পয়সা কিছু পাচ্ছি না, সেইসময়টা বড় স্ট্রাগল গেছে, শুরুর দিকে, আমার এই থিয়েটার করার সিদ্ধান্তটা তার পছন্দ হয়নি। সে খুব নরম প্রকৃতির মানুষ সে না বলতে জানেনা। তার পছন্দ হয়নি এটাই সে আমাকে বুঝিয়েছে।  বেশীরভাগ দিনই মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম। আমি এমন হয়েছে, ওকে পিঠে রেখে রিহার্সাল করেছি। ঝিল(মেয়ে) যদি অত শান্ত প্রকৃতির না হত তাহলে হয়তো আমাকে আরো একটা বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হত। রেপার্টার ছেড়ে দেবার পর যে সংকট সেটা খুব সাঙ্ঘাতিক ছিল। আজ সেদিন আমাকে একজন বললেন আমি নাকি সবচেয়ে বেশী টাকা নি এখন? তবে  হ্যাঁ আমি এখন একটা ঠিকঠাক টাকা নি। প্রচুর সঙ্কটেও আমি থিয়েটার ছেড়ে দেব এটা আমি ভাবিনি। শেষ অবধি আমি যখন কোথা থেকেও টাকা পয়সা পেতান না, অথচ নাটকটা আমাকে করতেই হবে, আমি তখন কিন্তু সৌমিত্রকে(হাজব্যান্ড) বলেছিলাম- দেখ, তুমি যদি আমাকে একটু ইকোনমিকাল সাপোর্ট না কর,  আমাকে থিয়েটার করা বন্ধ করে দিতে হবে। হুইচ ওয়াস ফর ম অলমোস্ট আ বেগিং। আই নেভার ওয়ান্টেড দিস। (কথা বলতে তাঁর চোখে জল আসে) সে সারা জীবন চেয়ে এসেছে, আমি যেন কিছু চাই তার কাছে। আমি জানিনা যে সোনার গয়না চাইতে হয়, বা কিছু একটা জিনিষ চাইতে হয়, আমার কোনদিন সেসব নিড-ই নেই, তারপর ফ্রিলান্স করতে শুরু করলাম। অন্তর্মুখ যখন কল শো শুরু করলো তখন মাঝে মাঝেই, কিছুটাকা পয়সা পেতাম, প্লাস আমি হঠাত একটা হিন্দি ফিচার ফিল্মে কাজ করলাম, প্রচুর টাকা পেলাম, তারপর টুকটাক মেগার কাজ শুরু করলাম, প্রচুর ডাবিং করতাম তখন, ফলে ঐ চাওয়ার প্রসেসটা বেশিদিন করতে হয়নি।   এরপর আমার অর্থনৈতিক কষ্ট আর থাকল না। ও এখন একটা কর্পোরেটেই আছে। 

একটি অন্য কথা বলি, বাবা মত একজন কমিউনিস্ট পার্টির মানুষের সাথে থেকে কি আপনার ওপর তার কোন প্রভাব পড়েছে?  

প্রচণ্ড ভাবে। সিপিআইএমকে গালাগাল, শুনতে একদম পারি না। আমি কিন্তু কট্টোর একজন  সিপিআইএম, যেটা অবশ্য আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, পলিটিক্যালি আমাদেরকে লিবারেল হওয়া উচিত, কিন্তু আমি এটাও বিশ্বাস করি এই দুর্দিনেও আমি ক্যাম্পপেইন করেছি। অবশ্য ভেতরের মনে আমি নিজেকে খুব পলিটিক্যাল রাখার চেষ্টা করি।   

আজকে মৌলবাদী আগ্রাসন আসছে সে বিষয়ে আপনার ভাবনা কি

দেখুন এই যে আগ্রাসনটা আসছে, এটা যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখবেন, একদম ঘরে ঘরে এইটা পৌছে গেছে, সম্প্রতি একটা পলিটিক্যাল প্লে করছি, পাঁচ তারিখে তার প্রথম শো, ‘দিগন্ত রেখা’, নাটকের নাম। আমার মনের কথা বলা আছে এ নাটকটায়।  

একজন অভিনেত্রী হিসেবে আপনার বার্তা কি?

সবাই যদি আমার পার্টটাইম করে থিয়েটার করবো, তাহলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে, কারণ, আমাদের পলিটিক্যাল অবস্থা যা, আমাকে একজন থিয়েটার পারসন হিসেবে লড়তে হবে, প্রত্যেকটা মানুষ যদি নিজেকে কুৎসিত ভাবতে শুরু করে, সে কিছু করার ক্ষমতা হাড়িয়ে ফেলবে। পলিটিক্যালি আমাদের ব্রেনটাকে ক্যাপ্টিভেট করে নেবার যে রাষ্ট্রীয় চক্রান্ত এটা আমাদের বুঝতে হবে। ফ্রি ডিজিটাল ইন্ডিয়া, সেটা কি আমাদের দেশে সম্ভব, সম্ভব নয় তো? সেদিন আমি নিউজ পেপারে পড়লাম, পাটনাতে ষ্টেশন এলাকায় ফোর জি না থ্রি জি ফ্রি করে দিয়েছে। কি হল, দেখা যাচ্ছে ওই এলাকাতে পর্ণগ্রাফি দেখার চর্চাটা সবচেয়ে বেশী। এটাই তো ওদের  উদ্দেশ্য। ওখান থেকে বেরোবার যে সাহস থাকা দরকার সেটা  কিন্তু  থিয়েটারের  লোকেদের আছে। কারণ তারাই তো শ্রম দিতে জানে।  

তাহলে আপনি পেশাদার হয়েও এইরকম একটা মুভমেন্ট করছেন, সেখানে আপনার কোন  অসুবিধা হচ্ছে না?

দেখুন নিজেকে ক্ষেপ খাটা অভিনেত্রী করে নিয়েছি। আমার কোন

দল নেই এটা সত্য কথা, আমার কিন্তু আক্ষেপে নেই, প্রতিটি দলে

আমি কিন্তু আপ্যায়ন পাই খুব। আমি সকলকে বলে দিয়েছি,

আমার যারা বড়রা আছেন তাদের বলে দিয়েছি, এটা তাদের

দায়িত্ব যে আমি যেন থিয়েটারটা করতে পারি। আমাকে বাঁচিয়ে

রাখতে হবে, এটা আমার দাবী। আর এ ব্যাপারে যাদের সাহায্য

ছাড়া আমি এইটুকু কাজ করতে পারতাম না তাদের  কথা না

বললেই নয়, তাদের একজন প্রকাশ ভট্টাচার্য। নাট্যকার উজ্জ্বল

চট্টোপাধ্যায় সেও আমাকে উৎসাহ দেন। চন্দন দা মানে চন্দন

সেন কে আমি ভুলি কি করে। আমার বাপি চলে যাবার সময়

একজনকে খুঁজে নিতে বলেছিল, সেই নামটা একসময়ের রেডিও  

ও মঞ্চে জনপ্রিয় নাম, প্রবীর দত্ত। কয়েকমাস পরেই আমি তাকে

এই মানুষের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছি।  

আপনি পথের যে কাজ করছেন তা বাংলায় প্রথম বলা যেতে পারে, আপনি তো এটা পেশাগতভাবে করছেন না, আপনি যে এই সংগঠন করলেন

আমি পথ-কে সংগঠন বলি না। পথ হল একটা আলিঙ্গনের নাম।

আমাদের রেজিস্ট্রেশন আছে, সেই অর্থে দেখতে গেলে এটা

একটা সংগঠন। আমার রেজিস্ট্রেশন যদি না থাকে যিনি আমাদের

থেকে লিগ্যাল সাপোর্ট চান, সেটা  আমি দিতে পারবো না। আমি

তো চাই পথ আমায় না করতে হোক। সেই দৌড়টা বন্ধ হয়ে

যাক। পথ কিন্তু আমার আনন্দের   জায়গা নয়। পথ আমার

অসহায়তা। পথ করেতে গিয়ে আমি বুঝতে পারি, যে আমি  মানুষ

হিসেবে কতটা অসহায়। আমার ক্ষমতা কতটুকু? এটা তো খুব

কষ্টের  জায়গা আমার। পথ আমাকে কথা বলতে শিখিয়েছে।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -