‘অনুদান নাটকের যেমন কিছু উপকার করেছে তেমনই ক্ষতিও করেছে’- অরুণ মুখোপাধ্যায়

- Advertisement -

কিছুদিন আগেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি হয়েছিলেন কিংবদন্তি নাট্যকার অরুণ মুখোপাধ্যায়। তিনি এখন বেশ সুস্থ। এবং খুব শিগগিরই কলকাতায় ‘চেতনা নাট্যগোষ্ঠী’ নিয়ে ‘হারানের নাতজামাই’ নাটকটি মঞ্চস্থ করতে চলেছেন। এরই মধ্যে রিহেয়ার্শাল প্রায় শেষ। এতদিন পর কেন কলকাতার জন্য ‘হারানের নাতজামাই’ নাটকটিকেই অরুণ মুখোপাধ্যায় বেছে নিলেন, তারকাদের নিয়ে এই নাটক মঞ্চস্থ করতে গিয়ে অভিজ্ঞতা কেমন, কেন্দ্রের অনুদান বিতর্ক নিয়েই বা তিনি কী মনে করেন – এমনই নানান প্রশ্নের খোলা-মেলা উত্তর দিলেন সংবাদ মাধ্যমের ক্যামেরায়। সেই সাক্ষাতকারেরই কিছুটা অংশ বাংলা নাটক ডট ইনের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল –

প্রশ্ন – এতদিন পর ‘হারানের নাতজামাই’ নাটকটি বেছে নিলেন কেন?

অরুণ মুখোপাধ্যায় – এই হারানের নাতজামাই আমার খুব প্রিয় নাটক। এটা আমরা চেতনা থেকে করেছিলাম মুম্বইয়ের একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে। কিন্তু কলকাতায় আমরা এই নাটক করিনি। কারণ, গণনাট্য সঙ্ঘের বেশ কয়েকটি শাখা এবং আরও যেসব নাটকের দল ছিল – তারা নিয়মিত এই নাটকটি কলকাতায় নিয়মিত অভিনয় করত। সেখানে এসে চেতনায় আবার নতুন করে এই নাটকি কলকাতায় করা – সেটা আমার কাছে ঠিক মনে হয়নি। এরপর মুকেশ যখন প্রস্তাবটা নিয়ে এল তখন আমার প্রথমেই মনে হল – আমি নিজে যখন কলকাতায় করিনি তখন করা যেতেই পারে।

আর আরেকটা কারণ হচ্ছে, দিল্লিতে তখন কৃষক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে, সেটা একটা বড় কারণ ছিল। বড় কারণ। যদিও স্পষ্ট করে তেভাগা আন্দোলনের কথা ওই ভাবে বলা নেই কিন্তু তেভাগা আন্দোলনের পটভূমি তো রয়েছে। সেটা ভেবেই নাটকটা করা। এবং এঁরা যেভাবে ব্যবস্থাপনা করেছে তাতে এখানে বিভিন্ন দলের অভিনেতারা এসে অংশ নিয়েছে। ঠিক স্টার আর্টিস্ট বলে এঁদের আমি গ্রহণ করেছি তা নয়, মুকেশের মনে কী মতলব ছিল আমি জানি না – কিন্তু এঁরা নাটকটা গুছিয়ে তুলেছেন। এটা একটা কৃতিত্বের ব্যাপার। এখানেই বোধহয় দু’তিন মাস ধরে রিহেয়ার্শাল হয়েছে। কলকাতায় রিহেয়ার্শালের ঘর পাওয়া তো মুশকিল! কিন্তু তারপরেও ওঁরা করেছে।

প্রশ্ন – পর্দার তারকারা কি মঞ্চেও তারকাসুলভ আচরণ করেন?

অরুণ মুখোপাধ্যায় – না। আমার অভিজ্ঞতায় নেই এটা। কারণ এঁরা বেসিক্যালি থিয়েটারের লোক। যাঁরা করছে তাঁরা টিভির কল্যাণে স্টার হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু স্টার মানে হচ্ছে একটু পরিচিতি বেশি, ব্যক্তির আকর্ষণ, বাজারে একটা দর থাকে, সেটা তাঁদের আছে। সেটা সঙ্গে সঙ্গে যায় তো। সেটা তো আর কিছু করার নেই।

প্রশ্ন – মঞ্চে ধীর লয়ে হাঁটা, সংলাপহীন অথচ সুর রয়েছে। আপনার এই স্বকীয় নাটকরে ধারা বর্তমানে সময়ে কতটা প্রাসঙ্গিক?

অরুণ মুখোপাধ্যায় – খুবই প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে যাঁরা অভিনেতা তাঁরা যখন একটা চরিত্রকে কনসিভ করেন, এবং আমার নাটকে যে গানের প্রাধান্য , সংলাপ দিয়ে বলার ওপরেও আরেকটা মাত্রা পেয়ে যায়। দর্শকের মনোযোগটা আরও ঘণীভূত হয়। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে ‘মেরিবাবা’। মেরিবাবার গান যে অত জনপ্রিয় হয়েছে বা এখনও এত জনপ্রিয় তার প্রধান কারণ হচ্ছে ওটা গানের মাধ্যমে এসেছে। ওই কথাগুলিই যদি সংলাপের মাধ্যমে আসত তাহলে আমার ধারনা ওই ইমপ্যাক্ট হতো না।

হারানের নাতজামাই এত জনপ্রিয় হল তার প্রধান কারণ গান একটা এবং আমাদের গ্রামীণ যে একটা কালচার পাশাপাশি চলেছে তো থিয়েটারের পাশাপাশি যাত্রার যেটা অপেরা পার্টির, তারা একটা ধারা তৈরি করেছে। সেই কারণেই একটু মফস্বল কিংবা জেলার দিকে গিয়ে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছে। সেখানকার মানুষ এনজয় করছে, রিলেট করছে যে হ্যাঁ এটা আমাদেরই কথা।

প্রশ্ন – এই ধারার নাটক শুরু করার ভাবনা এল কী ভাবে?

অরুণ মুখোপাধ্যায় – এটা আমি বলব যে ছোটবেলায় যেভাবে আমার কেটেছে ওই পরিবেশের মধ্যে পালাগানের দু’তিনটে দল আমার বাড়ির আশ-পাশেই ছিল। তাদের সঙ্গে থেকে থেকে সেটা আমার রক্তের ভিতরে ঢুকে গেছে একদম। সেই জন্য কোনও কিছু বলতে যখন অস্বস্তি হয়, সংলাপের মাধ্যমে বলতে গিয়ে কেমন যেন শুকনো লাগছে বা প্রচার বলে মনে হচ্ছে – তখন সেটা যখন গানে এল নতুন মাত্রা পেল। এবং এই মাত্রা যে বার্তাটা আমি দিতে চাইছি সেটা সংলাপে বললে আর গানে বললে তফাৎ হয়ে যাচ্ছে। এই তফাৎ তো পুরো এনজয় করে থিয়েটার যদি ঠিক জায়গায় ঠিক মতো গান ব্যবহার করা হয়।

প্রশ্ন – আপনার গোটা জীবনই তো নাটক …

অরুণ মুখোপাধ্যায় – (হেসে) তা অবশ্য বলাই যায়। নাটকটাই সব। মানে বাড়িতে যখন থাকি তখনই নাটকের সঙ্গে আছি। রিহেয়ার্শাল রুমে যখন তখনও নাটকের সঙ্গে আছি। শো হলে তো কথাই নেই।

প্রশ্ন – অসুস্থতার সময় হাসপাতালকেও না কি শিশির মঞ্চের সাজঘর মনে হয় আপনার?

অরুণ মুখোপাধ্যায় – (হো হো করে হেসে) হ্যাঁ, মাঝে ভুল বকার একটা ফেজ গেছে আমার। তখন এসব নিয়েই বেশি কথা বলেছি। মানে গ্রিনরুম এটা সেটা। নাটকের সঙ্গে জীবনটা এমনভাবে মিশে গেছে যে সুস্থতা এবং অসুস্থতা – দু’ক্ষেত্রেই নাটক আমার সঙ্গে আছে।

প্রশ্ন – অনুদান দেওয়ার বিনিময়ে কোন নাটক মঞ্চস্থ হবে, তার কি নির্দেশ দিচ্ছে কেন্দ্র?

অরুণ মুখোপাধ্যায় – ফান্ডের ব্যাপারটা খুবই জটিল এবং ইয়ে … কেননা গ্রান্ট এসে আমাদের থিয়েটারের অনেকে যেমন অনেকভাবে উপকৃত হয়েছে তেমনই ক্ষতিও করেছে। কেননা, দেখা গেছে থিয়েটারের একটা অংশ গ্রান্টমুখী হয়ে গেছে। মানে গ্রান্ট পাবে বলে তারা থিয়েটার করে – এরকম দলও আছে। ঠিক নাটককে বিচার করে গ্রান্ট দেওয়া হয় – এমন তো কোনও কথা নয়। সেখানে অনেক রকমের কারসাজি আছে। বিদেশে যেমন গ্রান্টের ব্যাপার আছে – তারা থিয়েটারকে এমন একটা উঁচু জায়গায় রেখেছে সে ব্রিটেনে বলুন কিংবা জার্মানিতে বলুন। গ্রান্ট যারা দিচ্ছে তারাই মনে করে এটা আমার কর্তব্যের মধ্যে পরে, এটা আমার কাজের মধ্যে পরে। ঠিক লোককে বেছে গ্রান্ট দাও যাতে থিয়েটার উন্নত হয় এবং তার সংস্কৃতির চেহারাটা অন্যরকম হয়।

এখানে কিন্তু তা হয়নি। গ্রান্ট যারা দেয় তাদের সবসময় ওই দিকে নজর যে গ্রান্ট তোমায় দিচ্ছি দেখো আমার স্বার্থটা যেন থাকে। গ্রান্টের ভিষণ দরকার কারণ থিয়েটারটা তো কস্টলি। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থিয়েটার করা মুশকিল আছে। কিন্তু সেই মুশকিলের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে অন্তত আমি বলব থিয়েটারে যতই গ্রান্টের প্রভাব পড়ুক থিয়েটার এখনও তার নিজের শক্তিতে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রশ্ন – রাজনৈতিক পালাবদলকে কী ভাবে গ্রহণ করেছেন?

অরুণ মুখোপাধ্যায় – এটা কী ভাবে গ্রহণ করলাম এটা খুব বলা মুশকিল। কেননা এটা তো আমার ইচ্ছেয় হয়নি। আমাকে জিজ্ঞেস করেও কেউ করেনি। কিন্তু যেটা দাঁড়িয়েছে আমি বলব খানিকটা ক্ষতি তো করেইছে। বেশ খানিকটা ক্ষতি করেছে। বেশকিছু দুর্বল যারা দল তারা এর ভিকটিম হয়েছে। এটা ঘটনা। গ্রান্ট তার সঙ্গে জড়িত। গ্রান্টের পলিসি তার সঙ্গে জড়িত। গ্রান্ট যখন তৈরি করে একটা দল তার টোটাল যে তার রাজনৈতিক এবং সবমিলিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি এবং অবস্থান – সেখানে তারা ওটাকে কাজে লাগাবেই। কাজে লাগাবার চেষ্টা করবেই।

প্রশ্ন – শুধু নাটকের ওপর ভরসা করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে নয়া প্রজন্ম?

অরুণ মুখোপাধ্যায় – (বিরস মুখে)  নাহ। না। মুশকিল আছে। মুশকিল আছে এখনও নাটককে জীবিকা করে বেঁচে থাকা খুবই মুশকিল। কিন্তু এত মুশকিল সত্ত্বেও যাঁরা নাটককে ভালোবাসে তাঁরা শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও নাটক করবেই। আটকানো যাবে না।

প্রশ্ন – আপনার মতে অভিনয় শেখা যায়?

অরুণ মুখোপাধ্যায় – আমার বেসিক্যালি মনে হয়, কাউকে কিছু শেখানো যায় না। কিন্তু শেখা যায়। শেখাটা নির্ভর করে যে শিখছে তার ওপর। যিনি শেখাচ্ছেন তাঁর কৃতিত্ব হয় ওরে বাপরে উনি বড়ো ডিরেক্টর ওমুক-তমুক। ওসব ধোপে টেকে না। অভিনয় তো করে দেখানোর প্রশ্নই নেই। কারণ করে দেখালে তাঁর ভিতরে কী আছে, সেটা সুযোগ পেলে, স্ফূরণ ঘটলে সেটা কতখানি বৃদ্ধি পায়, সেটা কতখানি সমৃদ্ধ হয় – সেই সুযোগ তো পাবো না। আমি যদি গোড়াতেই শেখাতে যায় – এভাবে নয় এভাবে বল – এটা আমার ধাতেই নেই।

প্রথমত যে অভিনেতা সে যদি স্টারও হয় – তার মনে খোঁচা থাকবে যে এটা আমি কি নিজে করছি? না ডিরেক্টর যেটা বলে দিয়েছে সেটা করছি? ডিরেক্টর যেটা শিখেয়েছে সেটা করছি? ডিরেক্টর ওই ভাবে বা শেখাবেই কেন – আমার মাথায় আসে না। কেননা, অভিনেতা তো রয়েইছে – কার ভিতরে কি আছে সেটা দেখে বের করে আনার চেষ্টা কর। তাহলে সে মনে করবে যে আমি করেছি। এই আমি করেছিটা ভিষণ দরকার। এবং এটা আমাদের অনেক ডিরেক্টরের মধ্যে ল্যাক করে।   

আমার এমন অভজ্ঞতা হয়েছে, মারিচ যখন খুব পপুলার হল, পর পর শো হচ্ছে – আমি যাদের যাদের একটু দেখিয়ে দিয়েছি এভাবে নয় এভাবে কর – তারা করেছে, চেষ্টা করে একটা পর্যায় অব্দি অনেকটাই করেছে। করল। কিন্তু ১০টা, ১৫টা, ২০টা শো’য়ের পর তার পুরনো যে দোষত্রুটিগুলো সেগুলো আবার বেরিয়ে আসছে। কারণ তার যে শিল্পচিন্তা, তার যে মেকানিজম – সেটা তো ওইভাবেই তৈরি। শম্ভু মিত্র বহু জায়গায় এটা বারবার জোর দিয়ে বলে গেছে যে পরিচালকের কাজই নয় অভিনয় দেখানো। অভিনয় করার জন্য অভিনেতারা রয়েছে। ডিরেক্টরের আরও অনেক কাজ আছে।

যার সত্যিকারের শিখতে চায় আমি দেখেছি, তারা রিহেয়ার্শাল রুমে একদল আছে নিজে রিহেয়ার্শালটা দিল – দিয়ে ব্যাস! কিন্তু আরেক দল আছে যারা সবটা সময় রিহেয়র্শালে বসে থাকে এবং কাকে কি বলছে, কাকে কি চেঞ্জ হচ্ছে বদল হচ্ছে, পরিচালক কতখানি অবদান রাখছে রাখছে না সেটা বোঝার চেষ্টা করে। যে শিখতে চায়। শুধু তার অভিনয় নিয়ে মাথা ঘামায় না। সে গোটা নাটকটা বুঝতে চায় এবং বুঝে করতে চায়। কিন্তু সবার তো ক্ষমতা সমান থাকে না। এটা কিছু করার নেই তো।

প্রশ্ন – তাহলে যে সিনেমার আগে অভিনেতাদের নিয়ে ওয়ার্কশপ হয়?

অরুণ মুখোপাধ্যায় – সেখানে বেসিকস কতগুলো শেখানো হয়। সেগুলো কাজে লাগে। কিন্তু বেশিদূর পর্যন্ত এগোনো যাবে না। সৃষ্টি হবে না। ক্রিয়েশন যাকে বলে। বেসিকস যে গুলো হাঁটা-চলা অমুক-তমুক, কী করে গলার জোর বাড়াবে – এগুলো শেখা যায়। এগুলো খুবই কাজে লাগে। যেমন অনেক অভিনেতা মঞ্চ থেকে যাওয়ার সময় দর্শকদের দিকে না চেয়ে যেতে পারে না। এমন অভিনেতাও আছে। অভিনয় হচ্ছে। এবার তার বেরোনোর কথা এদিক দিয়ে। সে ঘাড় অন্যদিকে করে রেখেছে। মানে শরীর একদিকে – ঘাড় আরেক দিকে। মানে বেরোবার সময় নিশ্চিত করতে চাইছে – দর্শক আমাকে দেখছে তো? সে ভাবে আমি না তাকালে বোধয় দর্শক আমার দিকে তাকাবে না। এরকম কিছু মজার ব্যাপারও ঘটে।

কিন্তু সত্যিকথা আমি বলছি, অ্যাক্টিংটা ভিতরে কিছু থাকে। সবাইকে দিয়ে অ্যাক্টিং হওয়ার কথা নয়। কিছুটা হয়তো হবে। কিন্তু সবাই অ্যাক্টর হওয়ার জন্য জন্মায় নি।

কৃতজ্ঞতা – আনন্দবাজার ইউটিউব

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -