দেবা রায়
অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত এই নাটক। রজত ঘোষের ‘হেলমেট’ নাটকের অনুপ্রেরনায় লিখিত ‘গর্ভগৃহ’র রচনাকার সুজন সাহা। যারই নির্দেশনায় নাটকটি নির্মিত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে নাটকটি মঞ্চসফল বললে অত্যুক্তি হবে না। সমাজেরই অন্দরের পচন যখন বাইরে বেরিয়ে এসে দুর্গন্ধ ছড়ায় তখন দর্শক ও শোতৃমন্ডলীর থেকে বাহবার প্রকাশ স্বতস্ফুর্ত থাকে।
গতকাল তপন থিয়েটারে অঙ্গন নাট্য সংস্থার আয়োজনে ‘বেঁধে বেঁধে থাকি, ২০২৪’ শীর্ষক একদিনের নাট্য সন্ধ্যা দ্বিতীয় দর্শন ছিল গর্ভগৃহ নাট্য মঞ্চায়ন। নাট্য উপস্থাপনায় অ্যাক্টরস মিড রাইটে একটি ব্যানার উজ্জ্বল হয়ে গল্পের গতি ও দিক নির্দেশ করে। ব্যানারে লেখা ‘মাতৃ গর্ভে সুস্থ শিশু ও বাস্তুহারাদের পুনঃবাসন (পুনর্বাসন- শুদ্ধ)’। এই শব্দবন্ধে বুঝতে অসুবিধা হয় না, যে সামাজিকভাবে এই ঘোষণা কতটা প্রহসনের বার্তা বহন করে। ব্যানারের সামনে স্টেজ করা হয়েছে, এই মর্মে একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে এই প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়েছে। একটি এনজিও সংস্থার প্রোগ্রাম যেখানে গৃহহীনকে গৃহ দেওয়া হবে, আর গর্ভবতীর গর্ভের শিশুকে সুস্থ রাখতে পরিসেবা দেওয়া হবে। অর্থাৎ মাতৃত্বকালীন পুষ্টির নিশ্চয়তা দান। ঠিক তার বিপরীত পাশেই দেখা যায় একটি বস্তির খণ্ডাংশ যা সজ্জিত মণ্ডপের উদ্দ্যেশ্য ও উপস্থাপনাকে সরাসরি এন্টি থিসিসের ভাষা প্রকাশ করে। এবং নাট্যের অব্যবহিত পরেই তা স্পষ্ট হয়। শোষন যন্ত্রের মুখ এখানে সরাসরি সেই বস্তির ওপর আক্রমণ চালায় না, যেখানে একটি সামাজিক সংস্থাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যার ঘর নেই তাকে ঘর দেওয়া এই সামাজিক সংস্থার কাজ। কিন্তু তাদের তালিকায় যাদের নাম আছে, সেটা তাদের পূর্ব নির্ধারিত বা পূর্ব পরিকল্পিত। অর্থাৎ দেওয়ার ছলে কোনো গোপন অভিসন্ধি থাকলেও থাকতে পারে। আর তা স্পষ্ট হয় যখন তারা দেখেন তাদেরই মঞ্চের অদূরেই একটি বস্তি, যা তাদের লিস্টে নেই। কিন্তু উচ্চস্থায়ীয় নেতৃবর্গ যখন এই প্রজেক্ট উদ্বোধণ করতে আসবেন তখন এসে যদি এরকম একটি পরিবেশ দেখেন, তাহলে তাদের সম্মান বা প্রজেক্টের গুরুত্ব ধুলায় মিলিয়ে যাবে, অতএব সংস্থার মূখ্য পরিচালিকা, তাদেরই আয়োজিত অবস্থানের উল্টোদিকে দাঁড়ান। বস্তি সরিয়ে দেওয়ার হুকুম ও বরাত দেন স্থানীয় রতন নামের এক গুন্ডাকে। এদিকে সেই বস্তিতেই থাকে জীবন ও জীবনের বউ সন্ধ্যা। সম্প্রতি তাদের একমাত্র মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বাবার কাছে এসে থাকছেন। গল্পের আর একটি দিক প্রকাশ পায়। যে সংস্থা গর্ভস্থ শিশুকে সুস্থ রাখার অঙ্গীকার করে, তাদের ত্থেকেই সেই অন্তঃসত্ত্বা মা সহ তার মা ও বাবাকে বস্তি থেকে উচ্ছেদের ফরমান জারি হয়।
বস্তিবাসী জীবন রুখে দাঁড়ায়। ভয়ানক শক্তি রতন রূপী রত্নাকরকে রুখে দেয় জীবন। থানকা মেরে তাকে মাথা ফাটিয়ে দিতে পারে এমন জায়গায় দৃশ্য উপস্থাপীত হয়। পরাস্ত রতন নাট্য আবর্তে নিজেকে পরিবর্তন করে। বস্তি উচ্ছেদের ভয়াবহতা, জীবনের পোয়াতি মেয়ের অসহনীয় করুণ অবস্থা অনুধাবন করতে পেরে রতন সেই এনজিও প্রধানের কাছে এই ঘটনার নৈতিকতার ইঙ্গিত দর্শায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রতনের সেই আবেদনেও কাজ হয় না। বস্তি ভেঙ্গে সরিয়ে দেয়া হয়। সেই ভয়াবহ রাতেই জীবনের মেয়ে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়।
নাটকের দৃশ্য বিভাজন ও ট্রাঞ্জিশনে চলতি মিউজিক প্রয়োগে নানাবিধ নাট্য মুহুর্তের জন্ম হয়েছে। আবেগতারিত মানুষের অসহায়তার কাব্য লেখা হয়েছে মঞ্চে। জীবনের সোজা হয়ে শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহসকে ভর করে তার মেয়ে ও মা তাকে সাথ দিতে এগিয়ে এসেছে।
আজ এই নাটকের সমসাময়িকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না। তবে সরাসরি সরকারের হস্তক্ষেপকে এখানে স্থাপন করা হয় নি। সামাজিকভাবে যখন আমরা দেখি কত বাস্তুহারা পথে ঘাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেঁচে থাকে, অথচ ঘর বানানোর জন্য সরকার টাকা বরাদ্দ করে, টাকা অনেক সময় তার কাছে যা পৌঁছায় তাতে বাসা বানানো আর হয় না। এই সামাজিক অনিয়ম বা অন্যায়ের মূল কারিগর সমাজেরই অন্দরে থাকা বেশ কিছু সাধারণ মানুষ, যারা উন্নয়নের লক্ষ্যে, সমাজ সেবার ভণ্ডামিতে নিজের পকেটের স্বাস্থ্য বৃদ্ধি করে।
এই নাটকের মূল অভিনেতা রতন চরিত্রে প্রশান্ত দত্ত। এককথায় আঙ্গিক ও বাচিক অভিনয়ে খাপে খাপ। সাথে পাল্লা দিয়ে দক্ষতার সাথে চরিত্রায়ন করেছেন নির্দেশক সুজন সাহা। মঞ্চে যতক্ষণ এই দুই চরিত্র উপস্থিত থেকেছেন, ঠিক সেই সময়েই নাট্য মুহুর্ত তৈরি হবার প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। জীবনের স্ত্রীর ভুমিকায় স্বাগতা সেনগুপ্তর চরিত্রাভিনয়ের চেষ্টা ভালো। চোখে পড়ার মতো অভিনয় করেছেন জীবনের মেয়ে চরিত্রে রিমি গাঙ্গুলি। সংস্থার মাথা শ্রীতমা চরিত্রে কস্তুরি গাঙ্গুলির স্বরগ্রাম ও সংলাপ উচ্চারণ নিয়ে আরও যত্নশীল হওয়া দরকার। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে সুপ্রভাত, সুস্মিতা নস্কর, সনৎ মণ্ডল প্রত্যেকেই তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা নাটককে বাঁধতে সাহায্য করেছে।
বাবলু সরকারের আলো নাটকের ছন্দকে অসাধারণত্বে উত্তরণ ঘটিয়েছে। অভিজিৎ নস্করের মঞ্চ সজ্জায় রিয়ালিস্টিক ভাবনা ও কাহিনীর সাথে তাল মিলিয়ে দৃশ্যপট রচনা চোখে পড়ার মতো। মঞ্চের মাঝে আবাসনের স্বাপত্য যেন সরাসরি শোষণের ধারালো অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
নাটকের চিন্তা ও দৃশ্য বিভাজনের সুচিন্তিত। সুনিপুণ দক্ষতার বুননে নির্মিত এই নাটক অবশ্যই ভালো প্রচেষ্টার সফল ফলাফল।