নাট্য নির্দেশক-সংগঠক আশিস দাসের মুখোমুখি

- Advertisement -

সাক্ষাৎকার- দেবা রায়

(লেখাটি সেই সাত-আট বছর আগে নিয়েছিলাম, একাডেমী অফ ফাইন আর্টসের অফিস ঘরের বাইরের বেঞ্চে বসে। এরকম কর্মময় জীবন আমি খুব কম দেখেছি, আজ এই মানুষটা একটা প্রতিষ্ঠানের রূপ দিয়েছে। গোবরডাঙ্গা সংস্কৃতি কেন্দ্র। নিয়মিত নাট্য চর্চা, প্রদর্শন, সেমিনার, কর্মশালা সব সেখানে সম্ভব, আবাসিক এই কেন্দ্রের নাট্য শিক্ষার কোর্স পর্যন্ত বিদ্যামান। এমনি এক কর্মকান্ডের কারিগর আশিস দাস। সদা হাস্য এক নাট্য জনের সেদিনকার কথাগুলি আজকের মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার দায়বদ্ধতা থেকে এই ইন্টারভিউটি আবার প্রকাশ করলাম আমাদের এই বাংলা নাটক ডট ইন , ওয়েব ম্যাগাজিনে।)

একজন নির্দেশক হিসেবে আপনি নাটক নির্বাচনের ব্যাপারটা কিভাবে করেন?

একটা সময় আমাদের কেউ নাটক দিত না। তখন আমরা ছাপা নাটকই করতাম। তারপরে ৮৯-৯০ সাল এইসময় আমরা পর পর বারটল ব্রেখটের দুটো নাটক করেছি। ‘ককেশিয়ান চক সার্কেল’ এবং ‘থ্রি পেনি অপেরা।’ একটা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রূপান্তর আর একটা হচ্ছে আমার মাস্টারমশাই রুদ্রপ্রসাদ  সেনগুপ্তের রূপান্তর। তার আগে মোহিতদার নাটক কিছু করেছি আমরা। আমার কাছে কে নাটক লিখছে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়।  আমার কাছে নাটকটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। নাটকের পরিচয় তার একটা পরিচয়। প্রথম দিকেই আমাদের নাটক লিখলেন কবি বিভাস রায়চৌধুরী। আমার যেটা মনে হয়েছে নাট্যকার প্রথমে যদি কবি হন তাহলে খুব ভাল হয়, আসলে চারলাইন কথায় অনেক কথা বলে দেয়া যায় তো, রবীন্দ্রনাথ ‘পথ’ বলে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কোন পথ! সেই পথ তোমাকেই খুঁজে নিতে হবে। এইটা  একজন ডিরেক্টরের সার্চিং-এর ক্ষেত্রে খুব ইন্টারেস্টিং বলে মনে হয়। সেখানে আমারও জার্নি করতে খুব সুবিধা হয়। খুব অতিরিক্ত সংলাপ পুরো ব্যপারটাকে ঘেচে দেয় বলে মনে হয়। বিভাসের নাটক বেশ কয়েকটা করেছি আমরা। তারপরে অরিন্দম সেনগুপ্তের নাটক করেছি। এখন মৈনাকই মূলত আমাদের নাটক দেন। তার মানে এমন নয় যে মৈনাকের নাটক ছাড়া কারোর নাটক করা যাবে না। প্রচুর নতুন নতুন ছেলে মেয়েরা বলে, আমি বলি হ্যাঁ করবো।

‘‘আমি কখনও কাউকে পাঠ দেখিয়েও দেই না, করেও দেই না, তারাই সব করে।’’

পছন্দ হলে সে নাটক করি আমরা। আর নাট্যকার নাটক পড়েন, তখন সেটা আমার সঙ্গে একা ওয়ান টু ওয়ান। কারণ সেটা আমি কখনো গ্রুপের  সকলের সামনে পড়াই না। নির্বাচিত হয়ে গেলে তখনও নাটকারকে দিয়ে পড়াই না। কারন নাটকার যখন পড়েন তখন তাঁর যে ভিসুয়ালটা , তার যে ভয়েস মডিলিউশান সম্পর্কে, পিচ সম্পর্কে যা ধারনা থাকে সেইটা একটু সমষ্যা হয়, দীর্ঘদিন ধরে যেহেতু একসাথে কাজ করি তারাও বুঝে যায়, এই চরিত্রটা হয়তো আমার পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তখন অবচেতন মনেই তার একটা ইমিটেশনের বাসনা তৈরি হয়ে যায়। সেকারণেই সেটা করিনা। তাই আমাদের যখন রিডিং হয় তখন আমরা একেবারেই জাস্ট ইনফরমেটিভ ওয়েতে পড়া হয়। এবং আমি কখনও কাউকে পাঠ দেখিয়েও দেই না, করেও দেই না, তারাই সব করে। এই বললাম হয়তো- এই আর একটু অন্যরকমভাবে করা যায় কিনা, বা ইমোশানটা লাগানো যায় কিনা। নাটক নির্বাচনের ক্ষেত্রে ছোট নাটক বড় নাটক নয়, প্রচুর বড় নাট্যকার পৃথিবীতে আছে, শেকসপীয়র করেতে পারিনি, কালিদাসের নাটক, বা আমাদের সংস্কৃত কোন নাটক এখনো করতে পারিনি। এত ভাল নাটক আছে, সব ভালো নাটক তো সবসময় নিজের দলে যা স্ট্রাকচার থাকে তাতে সম্ভব হয়ে ওঠে না, তার হয়ত কিছু কিছু স্বাদ পূরণ হবে বা অধিকাংশই হবে না। কে নাটক লিখেছে সেটা আমার কাছে অত গুরুত্বপূর্ণ নয়। ইটসেলফ নাটকের মধ্যে দিয়ে আমার ভেতরের কিছু কথা যেটা আমি বলতে চাই, সেটা আমি যে নাটকে পেয়ে যাই সে নাটকটাই আমি নির্বাচন করি।

এই নির্বাচনের ক্ষেত্রে বা প্রযোজনার ক্ষেত্রে কি আপনার ইচ্ছেটাই শেষ কথা? নাকি দলের সদস্যদেরও মতামত নিতে হয় বা না নিলে বাঁধা আসে?

না না আমাদের দলে বন্ডিংটা এমন, মানে ভাবনাগত জায়গা থেকে বা ইডিওলজিকাল জায়গা থেকে, দীর্ঘদিন আমার সঙ্গে কাজ করার জন্যে, ওরা আমি হা করলেই বুঝে যায়, আমি হাওড়া বলছি হাবড়া বলছি। সেই জায়গায় ওয়েভ লেংথ কখনও কিছু সমষ্যা হয়নি, যেকোন সিকোয়েন্স নিয়ে আলাপ আলোচনা হয়, কোন চরিত্র নিয়ে, আর সেটা তো খুবই হেলদি। সেটা হওয়া ভাল।

দীর্ঘনাট্যজীবনে আপনার নির্দেশিত কোন প্রযোজনা সৃষ্টি করে আপনি বেশী সুখী হয়েছেন?

আমার খুব ভাল লেগেছিল ককেশিয়ান চক সার্কেল করে। এবং এটা নিয়ে বেস কিছু ছাত্ররা এটি নিয়ে গবেষণাপত্র তৈরি করেছিলেন। আমি নাটকটা করেছিলাম ৮৯ সালে। তার আগে সত্তরের দশকে , আপনি জানেন যে বেশ কয়েকজন বিখ্যাত মানুষ বাদল সরকার, সুব্রত নন্দী, এবং রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। এই তিনজনই তাঁদের নিজের মত করে স্ক্রিপ্ট করে সেই নাটক করেছিলেন, অতএব আমি কিন্তু রুদ্রবাবুর নাটকটাই করেছিলাম। এবং সেটা যারা দেখেছিলেন তৎকালীন সময়ে তারা বলেছেন, রুদ্রবাবুর যে প্রযোজনার স্টাইল সেটা আমার এই প্রযোজনার থেকেই ভিন্ন। কারণ আমি টোটালটাই ফোকে বেঁধেছিলাম। এই কাজটা করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল, যে নাট্যকার কে? এই বিষয়টাও না খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বারটল ব্রেখট প্রথমে কবি তারপরে নাট্যকার। তার যে সংলাপ, এবং তার যে আডাপটেশন স্যার করেছিলেন, সে সাঙ্ঘাতিক একটা ব্যাপার, কথা যেন মুখস্থ করার জন্যে অসুবিধা হয় না কিছু, মনে রাখতে কোন সমস্যাই হয় না। জীবন্ত যদি সংলাপ হয়, জীবনের সাথে যদি মিশে যায়, তাহলে সেটা মনে রাখার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হয়না কিন্তু সংলাপ উচ্চারণ করতে ভেতরের যে ফিলিংস তৈরি হয়, সেইটা আমরা খুব আনন্দ পেয়েছিলাম ‘ককেসিয়ান চক সার্কেল’ করে। এবং ওটাতে আমাদের বেঙ্গল স্রাচির একটা পুরস্কার মিলল।

‘‘জীবন্ত যদি সংলাপ হয়, জীবনের সাথে যদি মিশে যায়, তাহলে সেটা মনে রাখার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হয়না কিন্তু সংলাপ উচ্চারণ করতে ভেতরের যে ফিলিংস তৈরি হয়’’

ওরা দিয়েছিল বিজন ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার। ঐ নাটকটা করে আমি খুব তৃপ্ত হয়েছিলাম। এবং কি হয়েছে এই নাটকটা ২০০০ সালে প্রথম করেছি কলকাতায়। ৮৯ এ প্রথম শো, আর দুহাজারে প্রথম কলকাতায়। আমরা বোধহয় গোটা তিন-চার শো টানা করেছিলাম। তাতে তৎকালীন সময়ে আমাদের ৫০ হাজার টাকা ধার হয়ে গিয়েছিল। থিয়েটার কিন্তু সেই টাকা ফেরত দিয়ে দিয়েছিল। ওই নাটক দুরদর্শনে নির্বাচিত  হয়েছিল, সেখান থেকে পয়সা পেয়েছি, সব মিলিয়ে থিয়েটারের ইনভেস্টমেন্ট জলে যায় নি আমার। সেটা থিয়েটার ফেরত দিয়ে দেয়। আমি ৭০০ টাকার একটা প্রডাকশান করেছি। বিভাসের লেখা নাটক, বিভাস চক্রবর্তীর লেখা আর স্বপ্নময় চক্রবর্তীর গল্প। স্বপ্নময় নিজেও নাটকটা দেখেছেন। শুধু ৭০০ টাকা তার প্রোডাকশান কস্ট। ওই নাটকটা আমরা প্রায় শ চারেক শো করেছি। এটা নব্বইয়ের দশকে। সেই নাটক আমাকে প্রায় সাত লাখ টাকা দিয়েছে। অতএব অনেক খরচ করা, অনেক ইনভেস্ট করা, এখন যে থিয়েটারের এই বহিরঙ্গের ওপর জোর পড়ছে না, এটা হল একটা মানুষ তার হার্ট নেই মনে হচ্ছে।

আসলে আভরণটাই সবসময় বড় নয়, নিরাভরন থিয়েটার

একদম, রবীন্দ্রনাথ যেটা বলছেন, তোমার চিত্রপটে নয় চিত্তপট… কবে বলে গিয়েছে। আমাদের দেশের আমজনতা, সাধারণ মানুষ সে গ্রামের মানুষ, সে যাত্রা দেখে, যাত্রায় কত সিম্বলিজম ব্যবহার হয়। ঐ একটা ব্লক। যার ওপর যিনি বসছেন, তার বসা দেখলেই বোঝা যায় সেটাকে ময়ুর সিংহাসন হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের দেশে সিম্বলিজমের চূড়ান্ত ব্যবহার আছে। একটা পাথরের শিবলিঙ্গ বসিয়ে দিলে সেটা শিবঠাকুর হয়ে গেল। আমরা দেখেছি যে একটা  গাছের তলায় একটা নুরী মত পাথর। এবং সেইটাই কল্পনা করে নেওয়া হয়েছে সেইটাই ওমুক দেবতা। আমি সেই দেবতা বিশ্বাস করি বা না করি সেটা পরের প্রশ্ন, এই যে আমাদের রিচুয়ালস গুলো, আমাদের যে সংস্কৃতি রুটের যে সংস্কৃতি সেইখান থেকে আমরা যদি প্রতিনিয়ত আহরণ করি না, তাহলে আমাদের থিয়েটারে খরচ হবার কথা না।

কলকাতা কেন্দ্রিক থিয়েটারের বাইরে বেড়িয়ে তথাকথিত মফঃস্বলের তকমা নিয়ে সেখানকার থিয়েটারকে থিয়েটারে একটা জায়গা করে নিতে আপনি কতটা অসুবিধায় পড়েছেন বা সুবিধা পেয়েছেন? 

আসলে কোন জায়গা তৈরি করে নিতে পেরেছি কি না এটা হচ্ছে প্রথম প্রশ্ন। কারণ নিজের সম্পর্কে নিজে জাস্টিফাই করাটা ঠিক নয়। আমি যখন ছাত্রাবস্থায় রবিন্দ্রভারতীতে পড়তে আসি থিয়েটার নিয়ে, সেই আসাটাও ক্রাইসিসের মধ্যে থেকে, ক্রাইসিস মিনস- বন্দুরা আমার ওপরে ভরসা করছে, ভালোবেসে। অতএব তারা আমার ওপরে চাপিয়ে দিয়েছে আমাকে ডিরেক্ট করতে হবে। তার একমাত্র কারন আমি বেশী বুঝি এরকমটা নয়। কিন্তু সকলের কথা ধৈর্য সহকারে শোনার একটা অভ্যেস আমার আছে। শোনার একটা অভ্যাস আমার ছোটবেলা থেকেই আছে। সেই জায়গা থেকে ওরা কোথাও আমাকে ট্রাস্ট করেছিল। এই কাজটা ওকে দিলে পারবে, আমার অনুপস্থিতিতেই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই আমার শুরু। তখন আমি সারা কলকাতার ফুটপাতে  ঘুরে বেড়াতাম, কোথায় থিয়েটারের কিছু বই পাওয়া যায় কিনা, তখন আমি এত ছোট, আমাদের রাজধানী হচ্ছে হাবড়া। তা ওই প্ল্যাটফর্মে আমাদের ভরতের নাট্যশাস্ত্র দেখলাম। একটা বই বাড়িতে কিনে নিয়ে গিয়ে  পড়তে গেলাম, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না, পারার কথাও নয় , আমি তখন মাধ্যমিক দিলাম, সেটা এই ৮১ সাল হবে। তখন সবসময় মনে হত, আমাকে নিজেকে ইকুইপ্ট করতে হবে। নিজেকে তৈরি করতে হবে। আমি বি কম অনার্স নিয়ে পাশ করেছি, তখন আমি ঘুরতে ঘুরতে, সেই সময় ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে অ্যাকাউন্টেন্সি নিয়ে ভর্তি হব বলে, আমি কলকাতায় এসে রবীন্দ্রভারতীতে ফর্ম ফিলাপ করে বাড়ি চলে  গেলাম। তারপর রবীন্দ্রভারতী থেকে পাশ করলাম। এবং সেইসময় আমাদের টিচার ছিলেন মনোজ মিত্র, কুমার রায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত ছিলেন। হ্যাঁ তরুন রায় ছিলেন, ঐরকম স্নেহপ্রবন মানুষ টিচার খুব কম পাওয়া যায় আজকের দিনে। কিন্তু আমার সঙ্গে নান্দীকারের একটা আত্মীকতার সম্পর্ক, বহুরূপীর সাথে আত্মীকতার সম্পর্ক, সুন্দরমের সঙ্গে- এদের সঙ্গে মানে একেবারে পারিবারিক সম্পর্কের মত ছিল।

‘‘তখন আমি সারা কলকাতার ফুটপাতে  ঘুরে বেড়াতাম, কোথায় থিয়েটারের কিছু বই পাওয়া যায় কিনা, তখন আমি এত ছোট, আমাদের রাজধানী হচ্ছে হাবড়া।’’

আমি চাইলে এদের যে কোন দলেই আমি কাজ করতে পারতাম। কিন্তু আমি প্রথম থেকেই সেটা চাইনি। কারণ আমার এখনও মনে আছে ৪-১০ এ যদি আমাদের ক্লাস শেষ হয়, আমি পাঁচটা কুড়ির বনগাঁ লোকাল ধরতাম, ধরতাম শিয়ালদহ থেকে, ধরতাম এই কারণই যে ওখানে আমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে, আমি ফিরে গিয়ে আমি আজকে সারাদিন যা শিখলাম সেইটা আমাকে ওদের প্র্যাকটিস করাতে হবে। অতএব আমি ইন্ডিভিজুয়াল জায়গা থেকে কিছু করব এইটা কিন্তু কখন আমি ভাবিনি। সবাই মিলে আমরা যেন সেই চর্চাটা করতে পারি। আমি চাইলে কলকাতায় আমি অনেকদিন আগেই থিয়েটার করতে  পারতাম, আমি সেটা চাইও নি, আমি গোবরডাঙ্গায় আমার জায়গাতেই, আমার নিজের জোড়ে নিজের সংস্কৃতির জোড়েই কাজটা করতে চেয়েছিলাম, এবং অদ্যাবধি সেই জায়গায়ই একদম দৃঢ়প্রতিজ্ঞই আছি, যে কারনেই আমার মনে হয়েছে যে, আঞ্চলিক জায়গায় যদি কিছু তৈরি করা  যায়, আর সে কারণেই আমরা ওখানে একটা সাড়ে সাত কাঠার জায়গা কিনেছি। কিনে সেখানে একটা পারফর্মিং স্পেস তৈরী করেছি, এবং আমাদের ওখানে এটা করার আগে পর্যন্ত, পশ্চিমবঙ্গে এইরকম আর কোন স্পেস হয় নি, এটা হয়েছে ২০১৫-র ৩রা অক্টোবর, বন্ধু ব্রাত্য সেটা  উদ্বোধন করে গেছেন। এবং আজ পর্যন্ত ২০১৫-র পর ২০১৭, এ পর্যন্ত সেন্ট্রাল গভমেন্ট বা  স্টেট গভমেন্টের এক পয়সাও গ্র্যান্ট ছাড়া আমরা ৩৪ লক্ষ টাকা খরচ করেছি। জমিটা কিনেছি আমরা ১০ লক্ষ দিয়ে। তখন দাম কম ছিল, এখন তার কারেন্ট ভ্যালুয়েশন ৪০ লাখ টাকা। আমরা তখন সেই পারফমেন্সের স্পেস্টা তৈরি করতে পেরেছিলাম। তারপরে আমি অলরেডি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একটা গ্র্যান্টের জন্য অ্যাপ্লাই করেছি, তার কিছু মিটিং ফিটিং এখনও  হয় নি। কিন্তু অ্যাপ্লাই করে দিয়ে আমরা কিন্তু আমাদের মত করে কাজ করে যাচ্ছি, কে কবে দেবে তার ওপরে ভরসা করে বসে নেই।

এটা প্রায় ২৬ লক্ষ টাকার একটা প্রোজেক্ট সে কাজ অলরেডি শুরু হয়ে গেছে, আগামী ১০মে তার ছাদ ঢালাই হবে। সেটা প্রায় ১২-১৩ শ স্কোয়ার  ফুট গ্রিনরুম কাম ওয়ার্কশপ স্পেস কাম লাইব্রেরী ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা চাইনি যে এটা নকশা করছে মানে নকশারই ব্যাপারটা। এটা সমস্ত সাংস্কৃতিক কর্মীদের। সারা ভারতবর্ষে সারা পৃথিবীতে যত সাংস্কৃতিক কর্মী আছে, তাদের ব্যাবহারের জন্য। এবং ওখানে আমরা যতদিন ব্যবহার করি তার চেয়ে বেশীদিন বাইরের থিয়েটারের মানুষেরা ব্যবহার করেন। এমনকি বিদেশ থেকে এসেও যেমন লন্ডন থেকে একটি দল এসেও ওখানে কাজ করে গেছে। কিন্তু আমাদের পুরো ইনফ্রাস্ট্রাকচারটা রেডি নেই বলে, এবং গোবরডাঙ্গায় কোন হোটেল গেস্ট হাউজ ইত্যাদি নেই বলে কোন অসুবিধা হচ্ছে না, থিয়েটারের মানুষের এইটেই হচ্ছে একটা আত্মীয়তা,  সেই জায়গা থেকে তাঁরা আমাদের বাড়িতে থেকে গেছেন। আমাদের বিভিন্ন ছেলেমেয়েদের বাড়িতে থেকে, ওখানে কাজ করে গেছে। সাউথ ইন্ডিয়া থেকে চন্দ্র দর্শন এসেছেন, তিনি সাতদিন থেকে গেছেন, বাপি বোস দিল্লী থেকে এসেছেন, তিনি এখানে অনেকদিন ধরে থেকে গেছেন, এইরকমভাবেই কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি থিয়েটারের ফ্র্যাটারনিটির না কোথাও একটা অন্য জোর আছে। সেটা হচ্ছে হৃদয়ের জোর। সে যেখানে যতই প্রফেশনাল থিয়েটার হোক, অর্থনৈতিক জায়গার ওপরে নির্ভর করে হোক, যাই হোক না কেন সব মিলিয়ে কিন্তু থিয়েটার এখনো, সারা পৃথিবীতেই এরকমভাবেই হয়। আমার ওখানে আরো চার পাঁচজন বিদেশী মানুষ  এসেছেন, ড্যানিয়েল এসেছেন ইউএসএ থেকে, সবারটা মনে নেই, তবে সবটাই হৃদয়ের জায়গা।   অতএব হৃদয় ঠিক থাকলে এবং ভালোবাসা দিতে পারলেই হবে। ভালমন্দ খেতে তো ওখানে  কেউ যাবেন না, থিয়েটারের মানুষের সামান্য প্রয়োজনটুকু মিটলেই যাবে। তারা প্রাণের আনন্দে এখনও থিয়েটারটা করে। এই সময় দাঁড়িয়ে।

আচ্ছা একজন অভিনেতার চরিত্র কি হওয়া উচিত বলে মনে হয় আপনার।

আপনি বলছেন একজন অভিনেতার ব্যাক্তিগত জীবন আর মঞ্চের জীবন, এইটা বলছেন তো? শুনুন তাহলে আমি কিন্তু রবিশঙ্করের মিউজিকটাই শুনি, রবিশঙ্কর আর কি ব্যাক্তিগতভাবে কি করছেন না করছেন সেটা আমার জাস্টিফাই করার কোন রাইট নেই। কিন্তু আমি ব্যাক্তিগতভাবে   বিশ্বাস করি, আমি ব্যাক্তিগতভাবে যেটা বিশ্বাস করি না সেটা আমি থিয়েটারেও করি না। আমি নাটকে দেখাচ্ছি যে, মেয়েদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, সেটা খুব খারাপ হচ্ছে, কিন্তু আমি বাড়ি গিয়ে বৌ পেটাচ্ছি। যেটা আমি পছন্দ করি না এবং সেটা কখনও করিও না।  

তাহলে এখানে আপনি বলছেন যিনি তা করেন তার প্রভাব তো নাটকেও পরবে?  

হ্যাঁ সে তো পড়েই। আমরা সবাই জানি ডি এল রায় যখন শাহজাহান লিখছেন তার আগে তার  স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে। যেকারনে ডি এল রায়ের শাজাহানে যতখানি অপত্য স্নেহ ওখানে প্রভাবিত করে, তার টেকস্ট-এ ব্যাপারটা ওইরকম ছিল না, ঐতিহাসিক সত্যতা সেরকম ছিল না।   সেখানে কল্পনার আশ্রয় বেশী, একটা মানুষ যে ক্রিয়েটার তার ব্যক্তিগত জীবনের যে যন্ত্রণা, ধরুন ‘মা’। গোর্কী কোন সময়ে নাটকটা লিখছেন? প্রেক্ষাপট কি? তার সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থানটা কি? এটা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি কেন? সেই মানুষটাকে সেই সময়টাকে জানতে চাই। তা কিভাবে তাকে প্রভাবিত করেছিল। সেই মুহুর্তে তার মানসিকতাটা কি ছিল? কারণ  ধরুন  তৃণমূল গভমেন্ট আসার আগে, বেশ কিছুদিন আগে ব্রাত্য যখন প্রথম থিয়েটার করছে, প্রথম যখন নাটকগুলো লিখছে, তার সেই নাটকগুলো দেখুন, ব্রাত্য নাট্যকার হিসেবে তো তুলনা করা যায় না, অতুলনীয়, প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী সারা ভারতে। তাহলে সেই মানুষটা যখন সেই সময়  নাটক লিখছে, সেই নাটকগুল দেখুন একরকম, আর এই গভমেন্ট চেঞ্জ হবার পর ব্রাত্য যখন একটা সাংস্কৃতিক কর্মী তো বটেই সেই সঙ্গে একটা পলিটিক্যাল পারসন ও তো বটে, একটা পার্টির মানুষ তো বটে, তখন কিন্তু তার নাটকগুল কিন্তু সময়টাকে প্রভাব ফেলছে না,  আগামীদিনে মানে ১০-২০ বছর পর যদি ও রাজনীতিতে না থাকে, তখন আবার পালটে যাবে। একটা মানুষ তার চারপাশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

তাহলে এখানে একটা প্রশ্ন উঠে আসে নাটকে আপনি কোন দর্শনকে গুরুত্ব দেবেন, সামাজিক না  রাজনৈতিক?

না না রাজনীতি ছাড়া থিয়েটার হবে না। কিন্তু তার মানে কিন্তু আমি বলিনি এই কথা যে  আমাকে তৃণমূলের পক্ষে নাটক করতে হবে। বা সিপিএমের পক্ষে নাটক করতে হবে। আমার একটা রাজনৈতিক ফিলজফি আছে। আমি সেই দর্শনে থেকে আমার মত করে থিয়েটারটা করব। সেটা তৃণমূলের পক্ষে যেতে পারে বিপক্ষে যেতে পারে, আমার কিছু… আই ডোন্ট বদার। সেটা যদি পার্টির কোন লাইনের সাথে মিলে যায় যাবে। আপনাকে বলছি- আমরা ‘জীয়ন পালা’ বলে   একটা নাটক করেছিলাম, সেই নাটকটা করার সময় আমি অত কিছু ভাবিনি, কিন্তু করার পর দেখলাম সেইটা সিপিএমের লোকেদের খুব পছন্দ হল, তার কারন কি? ওতে নাকি বিজেপিকে গালাগাল করা হয়েছে। আমি কিন্তু সেরকমভাবে আদৌ করিনি। ওদের মনে হয়েছে। মনে হওয়া  আর না হওয়াতে তো আমার কোন হাত নেই, অতএব তার পছন্দ হয়েছে, আর কারো সেটা পছন্দ নাই হতে পারে। নাটক যখন করে ফেললাম তখন আর আমার থাকে না, তখন   দর্শকের হয়ে যায়। পাঁচ জন দর্শক একটি নাটককে পাঁচ রকম ভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে। সেইখানে আমার তো কোন হাত নেই।

আপনার প্রিয় নির্দেশক কে? বাংলা বা জাতীয় স্তরে বা আন্তর্জাতিক স্তরে?

এইটা একটু বলা কঠিন। আমি বলব যে আমি তো ইনস্টিটিউশনাল থিয়েটার করি, সেখানে যারা ইনস্টিটিউশনাল থিয়েটার করেন, সংগঠনকে বেস করে যারা থিয়েটার করেন তাদের কাজই আমার কাছে সেরা কাজ বলে মনে হয়।এই যে এখন যে থিয়েটারের ট্রেন্ডটা এসেছে সেই ট্রেন্ড আগামীদিনে সংগঠনকে ভেঙ্গে দেবে। বলে আমি বিশ্বাস করি। কোম্পানি থিয়েটার কথাটা ব্রাত্য ব্যবহার করেছে শুনেছি, নতুন একটা কথা এসেছে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি থিয়েটারের পেছনে একটা সংগঠন থাকে। সেটা হচ্ছে অনেকটা ঐ সমুদ্রে যে জাহাজ থাকে না, জলের তলে- দেখা  যায় ওপরে, যে পারফরমেন্স হয় যেটা সকলে দেখতে পায়, সেটা হচ্ছে জাহাজের ওপরের  অংশটা, নীচের অংশটা না থাকলে ওপরের অংশটা হতেই পারে না। সেখানে যে নিচের মানুষগুলো তাদের প্রতিটি তিল তিল শ্রম । তিল তল ডিসিপ্লিন , তিল তিল কর্তব্যবোধ, বন্ধুর প্রতি আত্মীয়তা, বিশ্বাস, এসবের ওপরেই কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে পারফরমেন্সটা। সেখানে কোনোরকম ত্রুটি ঘটলে, সেটা সম্ভব হয় না। অতএব তারা আমাদের থিয়েটারের কিন্তু একেকটা স্তম্ভ। যারা ঐ কাজগুলো করে।

থিয়েটারে সকলেই তো অভিনেতা হতে আসে প্রথমত। তারপর দুটো চারটে নাটক করে ফেলার পরে সে নির্দেশক হয়ে যায়। তো সেই নিয়ে আমি কিছু বলছি না, যারা ইন্সটিউশনাল থিয়েটার করে, আমি কোলকাতায় আমার চোখে যতটুকু দেখা, নান্দীকার বা এখনও বহুরূপী। উষাদির দল ইত্যাদি। অতএব এখানে এক এল,কে গেল, কে থাকল্‌ তাতে কিছু এসে যায় না। থিয়েটারটা হবে। আজকে সাংগঠনিক ক্রাইসিস হতে পারে। তারজন্য  রিফ্লেক্সশান প্রযোজনাতেও পড়তে পারে। কালকে রিকভার হয়ে যাবে। হবেই। কারন এখানে জেনারেশন টু জেনারেশন ট্রেইন্ড হচ্ছে ছেলে-মেয়েরা। আমাদের দলে ধরুন পাঁচ বছর ধরে তার ট্রেনিং হয়। আমরা কুড়ি জন করে করাই, সারাবছর তার ট্রেনিং চলে, এবং সেখানে ফিস দিয়ে ছেলে-মেয়েরা লাইন দিয়ে আসে, সেখানে কুড়ি জনের বেশী নেবার মত আমাদের প্রভিশান নেই। তাতেও দেখা যায় যে অনেক রকম প্রবলেম , তারা পয়সা দিয়ে কাজ করতে চান, এবং সেখানে গোবরডাঙ্গার ছেলে-মেয়ে কম। বাইরের ছেলে মেয়ে বেশী, এমনকি কলকাতার রবীন্দ্রভারতীতে পড়ছে এমন বাচ্চারাও সেখানে কিন্তু গিয়ে ঐ ট্রেনিংটা করে। তাহলে আজকে আমার কাছে এক্স আছে, এক্স নেইতো ওয়াই ওখান থেকে চলে আসছে। সংগঠনের স্ট্রাকচার যদি ঠিক থাকে, আর্টিস্ট সাপ্লাই তো ওখান থেকে হবে। তার থেকেও বড় কথা মফঃস্বল তো সাপ্লায়ার। নানা রকম হাতছানি থাকে। মিডিয়া প্রলোভন থাকে, তাতে কিছু যায় আসে না। ওতে কিছু আটকায় না।

পরিচালক, অভিনেতা না সংগঠক এই তিনের কোন ভূমিকায় কাজ করতে আপনি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন?

আমি আগে সংগঠক। কোন পরিচালককে আগে সংগঠক হতেই হবে। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন আপনি ডিরেক্টর, আপনার প্রডাকশনের খরচ পাঁচ লাখ টাকা। কে এনে দেবে টাকাটা? আমি যখন পাঁচ লাখ টাকা ভাবছি, তখন আর এক আমি, মানে সংগঠক আমি, সে ভাববে আচ্ছা পাঁচ লাখ টাকাটা এরা কোথা থেকে দেবে? তারপর প্রোডাকশনটা যখন নেমে যাচ্ছে, তখন আমাকে ভাবতে হচ্ছে, ঐ পাঁচ লাখ টাকা আমি দলকে কি করে ফেরত দেবো? কারণ দেখুন  আমাদের প্রত্যেকটা মানুষের একটা নির্দিস্ট আয় আছে, কেউ ১০ হাজারে সংসার চালায়, কেউ  ৬ হাজারে, কেউ ৬ লাখ টাকায় সংসার চালাতে পারে না। আমি শুনে অবাক হয়ে যাই, যখন শুনি যে একটা প্রোডাকশন হয়েছে একাডেমিতে, হাউসফুল শো। তাতেও নাকি এত টাকা লস। তাহলে তো আমার মনে হয় থিয়েটারের ইকনোমিকসটাই তারা বোঝে না।

এখন ব্যতিক্রম কিছু  কিছু আছে, কিছু মানুষের ড্রিম প্রোজেক্ট থাকে, আমারও কিছু কিছু ড্রিম প্রোজেক্ট আছে, সেইটা করতে গেলে আমি জানি এত টাকা খরচ লাগবে, তাহলে আমি যদি অধিকাংশ নাটক থেকে টাকা ফেরত দিতে পারি, চারটে নাটক থেকে টাকা ফেরত দিচ্ছি সেই যে টাকাটা এল, সেইটা দিয়ে আমি ড্রিম প্রোজেক্টটা করব। যে আমার টাকা ফেরত দেবে না, দরকারও নেই ফেরত দেবার। কিন্তু আমার যে আহ্লাদ ছিল, আমার যে কুড়ি বছরের স্বপ্ন ছিল আমি লেবেদেফ করব, সেই লেবেদেফ আমি তখন ৪০হাজার টাকা গভমেন্ট স্যাঙ্কসান পেয়ে, ৪লাখ খরচ করতে পারি।  এইটা এভাবেই করতে হয়। আমি একটা জায়গায় থিয়েটার করতে যাব, আমি থিয়েটার করে  পয়সা নিই, সেখানে একটা ক্যন্সার পেসেন্টের সাহায্যের জন্যে, আমি নিজে গাড়ি ভাড়া খরচ  করে, কোন এক পয়সা তাদেরকে দিতে হবে না, আমি সেখানে গিয়ে তাদেরকে নাটক করে দিয়ে  আসব, এবং সেই যে টাকাটা, ওরা পেল সেটা সবটাই ওদের, বরং যে টাকাটা আমাদের  যাতায়াতের জন্য খরচ হল, সেটা আমিই খরচ করব, সেটা আমার কন্ট্রিবিউশন। ঐ ছেলেটার  প্রতি আমাদের দান। তা না হলে আমি করব কোথা থেকে? আমার যদি লস হয়! আমারা  কোন রেট-এ কাজ করি না। আবার আমাদেরকে নিয়ে যখন কেউ ব্যাবসা করছে, তখন আমি তাদের সাথে ব্যবসা করি।

আগামী প্রজন্মের কাছে আপনার বার্তা কি?

বার্তা না। আগামী প্রজন্ম যারা বাচ্চারা কাজ করছে না, সেটা আমার কাছে সাংঘাতিক ইন্সপায়ারিং, ভীষণ ক্রিয়েটিভ ওরা। এবং ওরা এইটা রাখে, যে বড়রা যা করছে তার উল্টো কিছু করবে। প্রচন্ড এক্সপেরিমেন্টাল নেচারের কাজ করছে ওরা। কনভেশনাল কাজ থেকে বাইরে বেড়িয়ে। প্রচুর ছেলে-মেয়ে এরকম জানি। আমি তো রবীন্দ্রভারতীর ছাত্র ছিলাম, ওখানে    আমাকে পরীক্ষা নেবার জন্যে মাঝেমধ্যে ডাকে-টাকে। সেখানে গেলে না আমি বুঝতে পারি এই   ছেলেটা ভবিষ্যতে কি হবে। ঠিক সেরকমই আমি দুচারজনের নাম বললে আপনি তাদের  আইডেন্টিফাই করে ফেলবেন। তূর্ণা, মিসকা হালিম, অনির্বান ভট্টাচার্য, ভাস্কর মুখার্জী, এদের সব্বাইকে আপনি প্রায় চেনেন। এদের সাথে পরীক্ষা সংক্রান্ত কোন খুব বেশী কথা হয় না। ওদের সঙ্গে কথা হয় কোথা থেকে এসেছে, কি করতে ভাল লাগে। এইটা থেকে বুঝে যাই এদের মধ্যে আগুন আছে। এবং সেই আগুন একদিন জ্বালিয়ে দেবে ওরা। কিন্তু সবটা মিলিয়ে, পরিবেশটা ওদের জন্য আর একটু ফেবার হওয়া দরকার ছিল। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সবটাই। আসলে কি বারটল ব্রেখট কে তো ছুটে বেড়াতে হয়েছিল, নিজের দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল, ব্রেখটকে কিন্তু একসময় বার্লিন এন্সেম্বল, ঐ গভমেন্টই করে  দিয়েছিল। গভমেন্টের হয়তো পরিবর্তন হয়েছিল, চেঞ্জ হয়েছিল, সেটা বলছি না আমি, রাষ্ট্রের সাপর্ট ছাড়া সম্ভব না।

এই রাষ্ট্রের প্রশ্নে অনুদানের বিষয়টাও আসছে। শুনছি এখন নাকি প্রতি বছর একটা করে প্রোডাকশন নামাতে হচ্ছে। কেউ কেউ ভাবছেন এতে নাকি প্রযোজনার মান নষ্ট হচ্ছে। বিষয়টা ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।

না না না, একটা থিয়েটারের দল বছরে একটা প্রোডাকশন করবে না, তাহলে কি কাজ করছে? আমাদের দলে ধরুন বছরে মিনিমাম তিনটে প্রোডাকশনের কাজ হয়। আমি তো ফুল টাইম থিয়েটার করি। এর চেয়ে কম কাজ হলে তো আমি পাগল হয়ে যাব। আমার তো অন্য কোন কাজ নেই, এবং চাকরি করে তারপর থিয়েটার করব,এ তো বাবু বিলাসীও নই।

অনেকে বলছেন তাহলে প্রযোজনার মান নাকি নষ্ট হচ্ছে। 

না না না, আমি বিশ্বাস করি না। সে কী সময় দেয় থিয়েটার জন্যে যে তার ওপর ডিপেন্ড করবে। আপনি সারা বছরে তিনটে নাটক যদি করেন, তাহলে একটা নাটক তৈরি করার জন্য তো চার মাস করে সময় পাচ্ছেন। আপনি তো থিয়েটার ছাড়া আর কিছু করেন না, আমি সেই অর্থে ভাবছি। আপনি তো হোলটাইমার। চার মাস আপনার যথেষ্ট সময়। তার মধ্যে আপনার ট্রেনিং প্রসেস, সবকিছু চলবে তাতে প্রবলেম কি? এমন দলও আছে ৪-৫ টা শো করে বছরে।  আমরা ধরুন ১০০ শো করি, আর ১৫০ শো ছেড়ে দি। মানে যতগুল করি তার চেয়ে বেশী ছেড়ে দি। নিজেদের কিছু নির্ধারিত প্রোগ্রাম থাকে বলে।

এরকম একটা ব্যপার গড়ে তুললেন কিভাবে? এর কি কোন ফর্মুলা আছে? সেই যাদুকাঠিটা কি?

এর যাদুকাঠি কিছুই না, বন্ধুত্ব। সম্পর্ক। এই ‘স্বজন’ যখন হয়েছিল, তখন একটা নিয়ম হয়েছিল, স্বজনের বাইরে কাউকে ডাকা যাবে না, এরকমটা হয়েছিল না? তোমাকে ফ্র্যঙ্কলি বলছি আমার একটা শো-ও কাটেনি। আমাকে নিতে পারছে না বলে অনেক ফেস্টিভাল বন্ধ হয়েছে।

তাহলে এই বন্ধুত্ব আর শুধু থিয়েটার?

একদম। শুধু থিয়েটার। কোন ব্যারিয়ার নেই। কে কি বিজেপি করুক, তৃণমূল করুক, সিপিএম করুক, থিয়েটার করে তো, ব্যাস থিয়েটার করে মানে আমার বন্ধু। আমার আত্মীয় সে।

নাটক নিয়ে প্রচার ও প্রসারের স্বার্থে এরকম একটি ব্যবস্থাপনা আপনার কেমন লাগছে? 

এটা খুব ইন্টারেস্টিং একটা ঘটনা, থিয়েটার ফ্র্যাটারনিটিতে এরকম একটা ঘটনা, আমি শুনে- আমার এতটা ভাল লেগেছে, থিয়েটার তো যতলোক করি তত লোক দেখি না, আর থিয়েটারের পত্রিকার ইত্যাদির কাজ করছে যারা, তারা থিয়েটারেরই কাজ  করছে। সে একজন অ্যাক্টরের সমান গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। একজন নির্দেশকের সমান গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। কিন্তু আপনি মনে করে বলুন তো বাংলা থিয়েটারকে কোন পত্রিকার সম্পাদক তার শম্ভু মিত্রর মত নাম হয়েছে। বা অনারড হয়েছে। পায়নি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। ধরুন আমাদের থিয়েটারের টেকনিশিয়ানদের না  আছে এল-আই-সি না আছে কিছু। তার একটা ব্যঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে, আমরা দলগুলো কি  সেভাবে ভেবেছি? যে বাবা তুই আমাদের সাথে মেকাপের কাজ করিস, বা লাইটের কাজ করিস,  ঠিকাছে বছরে তোকে আমি বোনাস দেব পুজার সময়। সেটা ৩৬৫ টাকাই দেব। সেটা দিলে গভমেন্ট থেকে, তোর কিছু অ্যাকসিডেন্ট হলে তুই ১লাখ টাকার একটা বীমা পাবি। আমি ৩৬৫টাকা দিতে রাজী নই। এই বন্ডিংটা হওয়া খুব জরুরী।  

তাহলে প্রেম-ই আপনার মূল মন্ত্র।

একদম প্রেম প্রেম এবং প্রেম।    

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -