নাট্য প্রশিক্ষণ কি আদৌ অভিনয় শেখাতে পারে?  

- Advertisement -

               

দুলাল চক্রবর্ত্তী 

প্রারম্ভিক প্রশ্নের অবতারণার কারণ না জেনেই আলোচনার মধ্যে ঢুকে পড়ে দেখা যাক অভিনয় শিখতে হলে নাট্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে কি না।

বর্তমান সময়ে নাট্য প্রশিক্ষণ ও অভিনয় শিক্ষণের তোড়জোড় অনেক বেড়েছে। এখন নাটকে অভিনয় করতে ইচ্ছুক হলেই তাকে কামারশালায় যেতেই হবে। মন ও শরীরকে পিটিয়ে পুড়িয়ে সাইজ মতো করতে প্রশিক্ষণ প্রকৃত জরুরি। এমনটা দাবি করেন নাট্য পরিচালকদের একটা বিরাট অংশ। তাই  অভিজ্ঞ শিক্ষকদের কথা মতো একজন পরিণত মানুষকেও ছেলে মানুষ হয়ে নিজেকে ভুলে, নিজের বয়স কমিয়ে ছেলে খেলায় মেতে উঠতেই হয়। কারণ বাবা মা এবং সমাজ নির্দেশিত ও নির্ধারিত নিষেধের বলয়ে যে কোনো তরুণ মন বদ্ধ কুঠুরিতে চিলে কোঠার সেপাই হয়ে জড় ভরতের মতো নিস্প্রভ এবং নিস্পৃহ হয়েই থাকে। তাতে রঙ তো থাকে না। ঢং করতে, সং সাজতে মন দেহ প্রস্তুত করতে হয়। কারণ  অনেকেই শুধু প্রথাগত শিক্ষার বাহন মাত্র হয়ে রয়েছে।

এই প্রবন্ধে আলোচ্য বিষয়সূচি

  • অতীতে কি এই কামারশালা বা ওয়ার্কশপ ছিল?
  • শিল্পীর সম্পদ কি?
  • শিল্পীর বংশানুক্রমিক শিল্পের প্রতি অনুরাগ কতটুকু?
  • বাস্তবিক এই নাট্য প্রশিক্ষণ কি নাট্যের চলনে কার্যকরী হচ্ছে?
  • বাংলা নাটকের পরিকাঠামোতে নাট্যশিক্ষা কি মান্যতা পায়?
  • আমার শিল্পী হবার আদৌ প্রয়োজনীয়তা আছে কি?
  • আমাদের নাট্য ইতিহাসের গৌরব
  • গ্রুপ থিয়েটার কনসেপ্টের প্রয়োজনীয়তা
  • ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে
  • শেখার মুল মন্ত্র
  • আত্মপ্রশিক্ষণ নাকি প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ
  • ভাবনায় প্রায়োগিক ত্রুটি
  • নাট্য প্রশিক্ষণ শিবির কি করতে পারে?

অনেক ডিগ্রি হয়তো আছে। কিন্তু মনের অন্দরমহলে ইচ্ছার বাগান শুকিয়ে গেছে। যেহেতু রসকষহীন মরা গাছের শুকনো ডাল দিয়ে কোন কারুকাজ সমন্বিত নির্মাণ সম্ভব নয়। তাই এখনকার এই জেটগতির যুগে পাগলামি করতে না পারলে কোন চ্যালেঞ্জ নেওয়া কঠিন। শিল্পী বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লেগে পড়াও মুস্কিল। মদ না খেয়েও যারা মাতাল, তারাই ব্যতিক্রমী মানুষ।

 বিপ্লব করতেও হুজুগ লাগে। এই উল্টো পথে নেচে চলা কেউ কেউ পারলেও সবাই একেবারেই পারে না। যাই হোক এই নাট্য প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া এইরকম নানা কারণে বাংলা নাটকের চর্চায় প্রভাব ফেলেছে। এবং এই  অবদানের গুরুত্ব তাই স্বীকার করতেও হয়। কারণ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তিত অবস্থা অবশ্যই চোখে পড়েছে। কিছু ছেলে মেয়ে তারুণ্যে আশাবাদী। অভিনেতা অভিনেত্রী হবেই। যেহেতু আশায় বুক বাঁধে চাষা। তাই উদ্যোগ এবং উপযোগ নিয়েই এইসব চেষ্টা চলছে। রমরম করে নাট্য প্রশিক্ষণ শিবিরের অবতারণা হচ্ছে। কিছু মানুষকে শিল্প ধারণা শিখিয়ে পড়িয়ে অনায়াসে শিল্পী হিসাবে গড়ে নিয়ে, নাটকের রেওয়াজ তাল বাদ্যে ভরপুর করে তোলাই এই শিবিরগুলির একমাত্র বাসনা। দলগুলি এই নিয়েই আশাবাদী। 

অতীতে কি এই কামারশালা বা ওয়ার্কশপ ছিল?

কিন্তু এমনটা অনেক অতীতে ছিল না। বাইরের শিক্ষার তাপ চাপ ছাড়াই অভিনয় চলতো। মান নিয়ে সম্মানহানির তেমন সম্ভাবনা ছিল না। যা হোক ভাল মন্দ নাট্যায়ন হলেই বেশ আনন্দ ছড়াতো। আগে ভাবা হতো, মানুষ তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি এবং অনুভূতির পাঠমালা থেকেই কিছুটা অভিনয় উপযোগী চিন্তা ভাবনায় মনকে বেয়ে চলে যেতেই সক্ষম হবে। বাকিটা দলের নির্দেশক ও নাট্য শিক্ষক শিখিয়ে পড়িয়ে নাটক অনুসারে গড়ে নেবেন। নাটক কেমন, চরিত্র কেমন সেই মতোই সব বিবেচনা নির্ভর করত। ঘষা মাজা তার উপরেই দাঁড়িয়ে ছিল। নাটক হিসাবে চরিত্রের প্রয়োজনে অভিনয়ের দাবিতেই অভিনেতার গড়া পিটার মধ্যেই চূড়ান্ত কাজের তাপমাত্রা বাড়তো। আর এই চর্চা ক্রমাগত একজন মানুষের উপর চলতে থাকলে সেই মানুষ নিশ্চিতই অভিনেতা বা অভিনেত্রী পদবাচ্য হয়ে উঠবেন। এটাই মানা হতো। স্বীকার করতে হবেই, অনেক ক্ষেত্রেই এই অনুমানের সার্থক প্রতিফলন নাট্য মহলে যদিও পাওয়া গেছে।

কিন্তু অনেকের শিল্পী বানাবার জন্যে এই চেষ্টা আবার ছাই তে জল ঢালা ব্যাপারও হয়েছে। এর পেছনে অনেক কার্য কারণ সংযুক্ত আছে। যার ব্যাখ্যার প্রসঙ্গ এই লেখা নয়। তাছাড়া কথায় বুঝিয়ে বলাও কঠিন। কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্র এবং পেশাদারী থিয়েটারের ইতিহাসের পাতায় এইভাবে নাট্য শিক্ষন পদ্ধতির বিশেষ উল্লেখ নেই। যা মেলে তা হলো পরিচালকের নিজের হাতে গড়া শিল্পীর চেতনা ও পড়ানো পাঠের বিস্তারিত ইতিবৃত্ত। খুঁজে দেখলে এই তথ্যই নানা ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়। যে নাট্য পরিচালক নিজেই এই শিক্ষা দিতে সক্ষম হতেন। বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া আলাদা অভিনয় শিক্ষক তেমন ছিলেন না। নটী বিনোদিনীকে গিরিশ ঘোষ কিভাবে তৈরি করেছিলেন জানি সবাই। পতিতালয় থেকে উঠে আসা সব অভিনেত্রীদের একইভাবে গড়ে নেওয়া হয়েছিল কাজের ফাঁকে পড়াশোনা থেকে যাবতীয় শেখানো হয়েছিলো। সাহিত্য বোধ গড়ে দিয়ে মন মননের বিকাশ ঘটানো হয়েছিল। বাংলা থিয়েটারের সমস্ত কালেই অভিনেতার প্রস্তুতি পর্বে এই প্রথাই কার্যকরী ছিল। সময় পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে  সেইসব মানুষেরাও সবিনয়ে সে সব ধারণ করেছিলেন। মোটের উপর অভিনয় শিক্ষার বিরাট গুরুত্ব আছে। এই গুরুমুখী বিদ্যায় সর্বকলার সব অনুভুতি ছড়ানো আছেই। কেউই সব জানি না। কিন্তু কিছু কিছু জানি, করে দেখাতে পারি। তাই শিক্ষার গুরুত্ব আছেই। যেমন উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, থেকে সকল অভিনেতা অভিনেত্রীরাই নির্দেশকের হাতে তৈরি হয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায় চরমভাবে একজন সফল শিক্ষক। এমনটাই চলে চলে যা কিছু সৃষ্টি করেছে।

শিল্পীর সম্পদ কি?

শিল্পীর নিজের মন ও চোখের তীক্ষ্ণ নজর সবচেয়ে প্রধান শক্তি। আসলে অভিনয় অন্তর মথিত এক মন ও কল্পনা অনুসৃত মানবিক প্রকাশের প্রচলন। এক্ষেত্রে ইচ্ছা আর অনুশীলনের তাড়না থেকেই শেখা, এবং তা ধরে রাখাও সম্ভব। যদি অনুরাগ থাকে। ধৈর্য থাকে। শিল্পী হবার তিতিক্ষা থাকে। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় করণীয় করতে না পেরে ওঠার ব্যথা থেকে যদি কান্নার মোচড় জমা হয়ে থাকে। তবেই সব চেষ্টা বিফলে যায় না। কিছুটা হলেও হয়। অনেক দিন ধরে লেগে থেকে চেষ্টা করে যাওয়াতেই খোঁজের সৃষ্টি হয়। এইভাবেই কিছুদূর যাওয়া যায়। যাই হয়, তাও শেষ কথা নয়। তবে অনেকটা। এটুকু নিয়েই আরো কি করা যায়, বা যেতে পারতো…  ভাবাই চলে। ক্রমাগত আর নিরন্তর চলা।

শিল্পীর বংশানুক্রমিক শিল্পের প্রতি অনুরাগ কতটুকু?   

শিল্পী হবার জন্যে বংশের শিল্পানুরাগের প্রতি চর্চার ধারাও মস্ত বড় বিষয়। রক্তের মধ্যে এই ইচ্ছামত উড়ে চলার বেহিসেবী লেনদেন স্রোত, নিজের বংশগত জিন থেকেই আসে। নাটক থিয়েটার, এটাও একধরনের খেলা। তাই তো ক্রিকেট ফুটবলের সাথেই এটাও play and play….। নিজেকে আবিস্কার করতে ট্রায়াল এন্ড এরর পদ্ধতিতে খুঁজে চলতেই হয়। এটা ধ্যান জ্ঞান নেশা হলে তবেই শিল্পী হিসাবে পেশাদারিত্ব অর্জন করা যায়। 

কিন্তু এখন এই বিষয় জটিলতাতে ভরেছে। সময়ের চালচিত্রে নাট্য প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে এই প্রশ্নগুলিও উঠতে শুরু করেছে,—এতো যে নাট্য শিক্ষণ শিবির হচ্ছে, সেখানে কি পরিমানের উন্নত মান অভিনেতা অভিনেত্রী পাওয়া যাচ্ছে? কিছু ছেলে মেয়ে জুটিয়ে দলে ভারিক্কি চেহারা দেখানোই কি কিছু নাট্য সংগঠনের উদ্দেশ্য? নাট্য দল বিপুল সংক্ষক স্বপ্নালু তরুণ তরুণীদের প্রকারান্তরে ইউস আন্ড থ্রো ব্যবহার করে ফেলছে না কি?

বাস্তবিক এই নাট্য প্রশিক্ষণ কি নাট্যের চলনে কার্যকরী হচ্ছে?

শিল্পী হিসাবে যারা শিখছেন, তারা সেই অনুসারে ভাল চরিত্রে মনোনীত হচ্ছেন কি? একজন নতুন শিল্পী অভিনয় শিক্ষার প্রয়োগ তার অভিনীতব্য চরিত্রে কতটা করতে পারছেন? যে সব নাটক ভীড় করে নিয়মিত নির্মিত হচ্ছে, তার উপস্থাপনায় অবদানের নিরিখে শিশৃক্ষুদের গড়ে ওঠার কতটা ইতিবাচক চেহারা দেখতে পাওয়া যায়? যারা শিক্ষক হিসাবে নাট্য পাঠ পড়াচ্ছেন, তাঁদের কৃতিত্ব সম্বন্ধে এযাবৎ আমরা কি খতিয়ান পেয়েছি? নাট্য প্রশিক্ষণ দিয়েই কি আদপেই অভিনেতা অভিনেত্রী তৈরি করা সম্ভব? সভা সমিতি করে এসব বিতর্কিত বিষয় আলোচনা না করা হলেও কেউ কি এসবের ফিড ব্যাক নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছেন না? উত্তর খুঁজে না পেলেও এই ব্যাপারটা কিন্তু কাঁধের উপর জিজ্ঞাসা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেই।

বাংলা নাটকের পরিকাঠামোতে নাট্যশিক্ষা কি মান্যতা পায়?

বাস্তবিক বাংলা নাটকের এই পরিকাঠামো হীন অবস্থার মধ্যেই স্বপ্ন দেখা হয়েছে অনেক বেশি। কাজের কাজ তুলনায় কম হয়েছে। না শিল্পের, না শিল্পীর, না দলের, কারোরই প্রাপ্তি তেমন ঘটে নি। কেবলমাত্র কালাতিপাত করেই নাটক নিজের মত করে কুশীলবদের ইচ্ছা গাড়িতে চলে, আশায় ভর দিয়ে শুরু থেকেই সুদিনের অপেক্ষা করছে। কিন্তু অভিনয় জগতের সুদিন দুর্দিন নিয়ে যেমন রাষ্ট্র ব্যবস্থার কোন মাথা ব্যথা নেই। সামাজিক স্বীকৃতিও নেই। বরং নজরদারির বহর লম্বা হয়েছে। সাধুবাদ কম নিন্দা বেশি সঞ্চয় করেছে। অথচ নাটক বা থিয়েটার থেমে নেই। কিছু মানুষের মন গড়া স্বপ্নিল পথে গড়িয়েই চলেছে। কিন্তু কোনভাবেই না ঘরকা না ঘাটকা দশা যাচ্ছে না। বরং আরো রঙিন হয়ে আরো অনেক জটিল পথ পার হয়ে কিছু করে দেখাতে চাইছে। নিশ্চয়ই নাটকের জন্যে আশাবাদী হতে হবে।

কিন্তু কত কষ্টে এতো পথ পার হলাম, কি পেলাম তা নিয়ে কিছু তো ভাবতে হবে? বাস্তবতার এই রূঢ়তার মাঝে, গা এলিয়ে শুধু নাট্য প্রশিক্ষণ দিয়ে কি বুৎপত্তি মিলবে? এই চলাচলের চরম উদাসীনতায়, এতকাল নাটকের ভাঁড়ারে যা মেলে নি। তা কি মিলবে? নতুন আর কতটুকু, কিভাবে আর কিই বা হবে? ভাবনারা এখানেই ঘনিভূত হয়ে আছে। শোনাবে হতাশার মতো।  কিন্তু মানুষ নিজে শক্তিশালী না হলে, মানুষের মূল্যবোধের মান না বাড়লে এই গড্ডালিকা প্রবাহেই নাটক ঘুরপাকই খাবে। সবচেয়ে বড় কথা হৃদয়বৃত্তি, সুকোমলবৃত্তি, আর সুকুমারবৃত্তি দিয়ে শিল্পী মানস পরিবেষ্টিত না হলে দানব মানবে ফারাক থাকে না। যাকে তাকে শিল্প শিক্ষায় সুশিক্ষিত করাও তখন যায় না। নাট্য প্রশিক্ষণ একমাত্র হয়ে কিছুই করতে পারে না। পারে কেবল পথ চেনাতে। অনুশীলনকে অনিবার্য করতে। তিয়াসা বাড়িয়ে ছুটিয়ে নিতে। মাটি যেমন ফলন তেমন হবেই। সারাংশ ইচ্ছা, চেষ্টা, আর একটা ব্যক্তিগত আন্দোলন নিজের সাথেই। নিজেই স্বশিক্ষিত হতেই হবে। কোনো উপায় নেই। 

আমার শিল্পী হবার আদৌ প্রয়োজনীয়তা আছে কি? 

হ্যাঁ আমি কিছু কথা সবসময় ভাবি। এ আমার নিজের সাথে অন্তরঙ্গ   আলাপচারিতা বলতে পারেন। আপনারাও করতে পারেন। কথাটা কি? ‘কেন আমি শিল্পী হবো’। আমার দায়বদ্ধতার লক্ষ্য কি? আমি মানুষটি কেমন? আমার শিল্প বোধ কি? নান্দনিক চিন্তা চেতনায় আমার রসবোধ আছে কি? আমার এই সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা কতটা আছে? আমার শিল্পী হবার জন্যে   মূলধন কি আছে? আমার বংশ পরম্পরায় কি আমি এই কাজ বহন করছি?  আমি কতটা শিল্পে অনুরক্ত? কি কারণে আমি ব্যবসা বাণিজ্য না করে এই খামখেয়ালি জীবনের পথে আছি?

আমার পেটের সংস্থান আগে, না শিল্প চর্চা  আগে, এগুলোর পরিস্কার ধারণা আমার আছে কিনা। আমি সখের শিল্পী কিনা তাও চিন্তা করা দরকার। আমি ফুল, শিশু নারীতে কেমন পুলকিত হই। আমার বিচিত্রিতা মানসে প্রেম যৌনতার রসায়ন কি। সার্বিক আমির চূড়ান্ত প্রকাশ ভাল মন্দ, কুৎসিত সুন্দর সরল জটিল নিয়ে কিভাবে ত্রিমাত্রিক। এখানে আমি কিভাবে তার্কিক আর কিভাবে প্রাকৃতিক। তার বিষদ বিতন্ডা মন গন্ডারের খেলায় কিভাবে পরিস্ফুটিত। সেখানেই আমার হৃদয় মন্দিরে আমারই পূজা চলে। আমি জ্যান্ত জান্তব জীবন আগে। সেখানেই জয়ের কথার ওঠা নামা।

আমাদের নাট্য ইতিহাসের গৌরব      

যেখানে আমাদের থিয়েটার দিন বদলের স্বপ্ন থেকে নব নাট্য আন্দোলনের পথে পা ফেলেছিল। সমাজকে বদলাতে চেয়েছিল। দেশের রাষ্ট্রীক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধতা করতেই জন্মেছিল। সেই নব-গণ-সৎ নাটকের আজ কি কোন অস্তিত্ব আছে? সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজ তান্ত্রিক চেহারা কারা বদলে পুঁজিবাদী এক নায়কতন্ত্রে সমগ্র বিশ্বকে কখন কিভাবে গ্রাস করে ফেললো। কিভাবে বাংলায় বামপন্থার একবগগা মনোভাবে যাবতীয় শ্রদ্ধা সমীহ সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে চলে গেলো। লেনিন মার্ক্স সমস্ত মানুষের মন থেকে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেলো। এগুলো নিয়ে আমার ভাবনা বা অভিমত কি। আমাকেই ভাবতে হবে। কেন মানুষ সুকান্ত ভট্টাচার্যকে ভোলে না। আবার কিভাবে সুকান্ত দর্শণ চেনে না। নজরুল ইসলামকে গানে যতটা  মাথায় রাখে আদর্শে ততটা নয়।

এই যে দেশের ভিতর ধর্মীয় রাজনৈতিক  পরিবেশ সমস্ত মানুষের ভোটের ফলেই আসছে, সেখানে রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর রামমোহন রবীন্দ্রনাথ কোন কাজে লাগছে? এও নাটক শিখতে আমাকেই ভাবতে হবে। এখন কোন আদর্শের কথা কাকে কে শোনাবার অধিকার রাখে। না, আমি জিজ্ঞাসা চিহ্ন দেই নি। প্রশ্ন নয়। চিন্তা শুধু। আর এই চিন্তা থেকেই অনেক উত্তর নিজের জ্ঞানে চলে আসে। তাতে তরল মানসিকতার বোহেমিয়ান চাওয়া বাস্তবায়িত হতে পারে না বলেই যাকে তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নাটকের অভিনেতা করা মুস্কিল।

গ্রুপ থিয়েটার কনসেপ্টের প্রয়োজনীয়তা

মনে রাখা দরকার গ্রুপ থিয়েটার কনসেপ্ট এখন আর নেই। এখন কোন নির্দিষ্ট পথে বা মতে নাটক নেই। খামচে খুমচে বাজার মাৎ করাই নাটকের মরন কামড়ের শেষ কথা। এই হুড়োহুড়ি নাটকের বনেদে স্বপ্নের চেয়ে দখলের অধিকার অনেক আগে আছে। দ্বিমত আছে, বিতর্ক আছে, মতান্তর মনান্তর আছে। থাকবে, থাকুক। কিন্তু আইডল আইডিয়ার জন্যে নিদর্শন তো পাবো? তেমন কই? কি আছে সামনে? কাজেই মন সাম্রাজ্যের অধীশ্বর শুধুই এক ব্যক্তি। আর ব্যক্তিগত অধিকারে তিনিই তার নিজের অধ্যাপক, তিনিই জয়ী হবেন। যার আত্ম মন্থন সমুদ্রের মতো তোলপাড় তোলা। ভীষণ কঠিন এই অসম ও অসমান বাস্তব প্রেক্ষিতে নিজে অবলীলায় স্বাভাবিক থাক। এসব আলোচনা তাই বাতুলতা। তাই সরে যাই অন্য বিষয়ে। আসি আমার জীবন বীক্ষায় কোন দীক্ষা কার্যকরী হয়েছিল। নিজের মত ও পথে বেড়ে ওঠার তরঙ্গে ভেসে চলি। আর তাই বরং বলি। আত্ম প্রচার করা ঠিক কাজ নয়। যেখানে আমিও মহা শূন্য। তবুও আমিও আমার মতো এক পৃথিবী।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে      

নিজে কোন পথে গড়ে উঠেছিলাম। সেখানে অনেক টানা পোড়েন ছিল। ভাল মন্দের মিশেলে। যদি ভুলও থাকে, তা চলে যাবে ব্যক্তি আর ব্যক্তিগত বিভাগে। চাইলেই গা ঢাকা দেওয়া যাবে। আর যদি কীর্তি থাকে সবার পক্ষে, তবে আহ্লাদিত হওয়া যাবে। সেখানে আস্বস্ত হবার ভিত্তি থাকারই কথা। 

যাই হোক, অন্য ভাবে বলি, সাহস আর উত্তেজনার অফুরন্ত ভান্ডার থেকেই এই নিজেকে অন্য মানুষের মঞ্চ অস্তিত্বে নিয়ে যাবার প্রবল উন্মাদনা আসে। বিশেষত এই যে অভিনয় ক্ষেত্রের প্রকাশিত চরিত্রের আবিষ্কার এবং আবির্ভাব ঘটানোর পরম্পরা নাটক সিনেমা বায়স্কোপে যে যে সময়কালে আমরা যেভাবে পেয়েছি। তাতে সেই সেই সময়েরই জীবন থেকে নেওয়া জৈবিক চেতনাই কাজ করেছে। সময় বদলে গেলে তার স্বীকৃতি কমেছে। তথাপি পরবর্তী কালেও অনেককাল আগের কাজও খুবই মূল্যবান হয়ে  সমাদৃত হয়েছে। কারণ কালের পালের হাওয়ায় যে জীবন বোধ থাকে, তাকেই নাড়াচাড়া করেই মনের কল্পনায় নাটকের টেক্সট মঞ্চে জীবন্ত হয়ে ওঠার পথ পায়। কিন্তু দুঃখ সুখের প্রকাশের মাত্রা আজ কাল পরশু চলে গেলেও ফিরে আসা সময়েও একই মাত্রা বহন করবে। করেছেও। কারণ জৈবিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা আমাদের অস্তিত্বের কাছে অবনত। শিল্পে শিল্পী জীবনের জন্য সবটুকুই নিবেদন করে যায়। আমাদের কাব্য সাহিত্য নাটক চর্চার যাবতীয় কাজ সমাজ রাজনৈতিক চেতনার দ্যুতিতেই করে যেতেই আমরা সনাতন জীবন ধারণ পদ্ধতিতে বদ্ধপরিকর ছিলাম এবং আছি। থাকবোও। কারণ এ এক জীবন চর্চার ধারা। মানবিক প্রবৃত্তি থেকেই কাব্য সাহিত্য চিত্রকলা সঙ্গীত নাটকাভিনয় এক সূত্রে গাঁথা আত্ম প্রকাশ।

আমার জীবনের বিচিত্র কিছু অভিজ্ঞতা থেকে নিজের অভিমত বলছি। এখানে দুটি বিষয়। এক আমি কি রকম ও কেমন মানুষ । দুই নাটকের পাঠ কিভাবে পেয়েছি। এই দুটি না মিললে শিল্পীর শিল্প আত্মা বিজড়িত অনুপ্রাণিত লগ্নি হয়তো সম্ভব হয় না। খুব ছোট বেলায় আমি কলিয়ারি থাকতাম। আসানসোল রাণীগঞ্জ এলাকায়। জন্ম সূত্রেই রুক্ষ মাটির রূপ দেখেছিলাম। বাবা এখনকার বাংলাদেশ থেকে এখানে ক্লার্কের চাকরি করতেন। আমরা ৫ ভাই ছিলাম। বোন ছিল না। আমি আমার উপরের ভাই মারা যাওয়ায় কার্যত তৃতীয় সন্তান। খুব ভাব প্রবন। নমনীয়। লাজুক স্বভাবের ছেলে। কিন্তু কিছু উল্টো পাল্টা করার ইচ্ছায় পাগলা থাকতাম। যা দেখতাম। তাই অনুকরণ করার চেষ্টা চালাতাম। প্রাইমারি স্কুলে তখন পন্ডিত মশাই থাকতেন। তিনি বসেই থাকতেন। অন্যের দেখে নিজেকে শিক্ষিত করতে বাধ্য করতেন। সহপাঠীরাই সাহায্য করেছে সব বিষয়ের শিক্ষায়। ছবি আঁকার পাঠ বাউরী বন্ধুদের কাছেই। ওরা সিডিউল কাস্ট। ওদের মাটির বাড়ির দেওয়ালে অজস্র ছবি থাকতো। আমি দেখতাম আর মনের ভেতরে তাই লালন করতাম। ওদের ছেলে মেয়েরা কাগজের পাতায় সেইসবই আঁকতো। আমি গ্রামের স্কুলে পড়লেওয়াল বেয়ে খালি পায়ে আল ভেঙ্গে যেতাম। টিফিন পিরিয়ডে সবাই বাড়ি যেত খেতে। আমি তখন হয়তো কোন দূর্গা মন্ডপে গিয়ে ডাকের সাজের ঠাকুর গড়ার বিভিন্ন পর্যায় দেখে বেড়াতাম। সব কিছুর প্রতি কৌতুহল ছিল। এক সময় নিজেদের কলোনি কোয়ার্টারের গোয়াল ঘরে খড়ের কাঠামো গড়ে ছোট্ট দূর্গা ঠাকুর গড়তেও শুরু করেছিলাম। বাবা একদিন অসম্পূর্ণ মূর্তিটা পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। মন খারাপ তো হয়েছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণ পরিবারের বিশ্বাস ছিল যে কুমোরদের বংশ থাকেনা। তাই না মেনে উপায় কি। এসব শৈশবের আমি, আমার জীবনের কিছু ঘটনা। সেই ১৯৬২/৬৩ সালের কথা। ১৯৬৭ সালে মুর্শিদাবাদ শহরে চলে আসি। শুর হয় অন্য জীবন। 

এখানে তখন কবি সাহিত্যিকদের আড্ডা ছিল গণনির্দেশ পুস্তকালয়ের সামনে, রাস্তার উপর। আমি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের ছাত্র। পড়াতে মন কম। অন্য কিছু খুঁজে চলেছি। অল্প পয়সায় লিটল ম্যাগাজিন কিনতে পাওয়া যেতো। এনারাই গল্প কবিতা লিখতেন। আমি জোগার করে পড়তাম। ছিল স্বপন কুমারের ডিটেকটিভ উপন্যাসের চটি বই। ক্লাসের একজন বন্ধু খুব ভাল গল্প লিখতো। ব্যাস, শুরু হয়ে গেলো লেখালেখি। তখন ১৫ পয়সায় হাফ সাইজ বোর্ড বাইন্ডিং খাতা কিনতে পাওয়া যেতো। বাজারের পয়সা মেরে সেইসব খাতা কিনে গাদা গাদা গল্প লিখতাম। পরিণতি, উত্তরণ, এসব পারতাম না। ১৯৬২ সালে কলিয়ারিতে থাকা কালিন বাবা ফিলিপসের রেডিও কিনে ছিলেন। তাতে প্রতি মাসের শেষ মঙ্গলবার গভীর রাতে বেতার নাটক হতো। মেবার পতন, কপালকুন্ডলা, মহারাজা নন্দকুমার, সিরাজদ্দৌলা, সাজাহান ইত্যাদি। পাক্ষিক বেতার জগৎ নেওয়া হতো। দৈনিক যুগান্তর খবরের কাগজ বাসায় আসতো। শারদীয়া বেতার জগৎ পত্রিকায় প্রচুর গল্প উপন্যাস থাকতো। ছেলেবেলায় সাহিত্যের মুখোমুখি আসায় এই বেতার জগৎ এর মস্ত ভূমিকা ছিল।

মুর্শিদাবাদে লেখালেখির চর্চায় এর স্ফুরণ ঘটার চেষ্টা চলেছিল। তখন বাবার সামান্য বেতন। সংসারে খুব আর্থিক অনটন ছিল। সাদাসিধা জীবন যাপন ছিল। পোশাক পরিচ্ছদ দারিদ্রের ছাপে ভরা। কিন্তু খাওয়াতে আর মন বিলাসে ত্রুটি ছিল না। রেডিও নাটক শোনা, আধুনিক বাংলা গান, পল্লীগীতি, নজরুল, রজনীকান্ত, অতুল প্রসাদ, রবীন্দ্র সঙ্গীতের ধারণা মা বাবাই করে দিয়েছিলেন। এসবের সাথে ছিল যাত্রা পালা দেখার বিরাট অবকাশ। কলিয়ারি বেল্টের রাণীগঞ্জ, শিয়ারসোল (নজরুল ইসলাম এখানকার রাজ হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন), রাণী সায়র, পাঞ্জাবী মোড়, এইসব জায়গায় চিৎপুর কলকাতার বিখ্যাত যাত্রাদল তাদের অফিস করে বসে থাকতো। কলিয়ারি অঞ্চলেই যাত্রার মস্ত বিপনন ছিল। শীতকালে মাসের পর মাস বিভিন্ন কলিয়ারিতে তিন/চারদিন ধরে যাত্রা হতো। বাবা বড় বাবু বলে কম্লিমেন্টারি কার্ড পেতেন সপরিবারে যাত্রা দেখার জন্যে। বাবার কোলে বসে ছোট ফণি,বড় ফণি, স্বপন কুমার প্রমুখদের যাত্রা দেখেছি ছোট বেলায়,১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সময় কালে। পরদিন বন্ধুদের নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে যাত্রা যাত্রা খেলা চলতো, মন থেকে সংলাপ বানিয়ে। এইসব পেয়েছিলাম আগেই। গ্রাম বাংলার ভাদু, টুসু উৎসব, রামায়ণ গান, ম্যাজিক, বহুরূপীদের সাজ এসবই ওই ঢ়াড় বঙ্গের সাথে পাওয়া গেছিলো। প্রচুর প্রচুর অনুভূতি সংগ্রহ করেছিলাম কলিয়ারি অঞ্চলের মানুষের জীবন চর্চা দেখে। আন্তরিকতা দেখে। ভালবাসা পেয়ে। একেবারেই অন্য জগৎ ছিল। এসব নিজের কথা। শুনে কার কি হবে? তবুও অনেক চলাকে যদি প্রভাবিত করে, তাই বলা।

শেখার মুল মন্ত্র     

একটা কথা আমি খুবই ভাবি। ভুল না ঠিক বলতে পারবো না। কথা হলো, নাটক যেহেতু সর্ব শিল্পকলায় সম্পৃক্ত একটি জান্তব প্রকৃয়া, তাই এই কাজের ধারাপাত কি কাউকে শেখানো যায়? এ কী সম্ভব? কে শেখাবে? সে বা তিনি কতটা উপযুক্ত? যে শিখবে সে কেমন করে দেখবে এই শেখাকে? রিসিভ করাও তো একটা ব্যাপার। ভেতরের সাড়া না পেলে এই কাজ কি ধরে বেঁধে কাউকে দিয়ে করিয়ে নেওয়া যায়? নিজের মন, নিজের জীবন, সাথে আসছে চরিত্রের অন্য রকম জীবন।

তাই সেই ভাবনা থেকেই বলতে পারি নাটকের প্রশিক্ষণ প্রকৃয়া, নিশ্চিতভাবে অভিনয় শেখাতে পারে তখনই, যখন দাতা গ্রহীতার দেওয়া নেওয়ায় অনেকগুলো বিষয় একসাথে যুক্ত হয়ে যায়। প্রথমত যথেষ্ট কীর্তিবান ও অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকেরা শিক্ষাদানের কাজে যুক্ত থাকেন। হাতে কলমে মঞ্চকর্মে যাঁরা নিযুক্ত। দ্বিতীয়ত প্রশিক্ষার্থীদের ছাত্র হয়ে পাঠ নেবার আগ্রহ থাকার উপর। শিক্ষার্থীদের শিল্পের প্রতি অনুগত হতে পারাও বিষয়। মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে কিছুই করতে চাওয়ায় আন্তরিকতা থাকা দরকার।

এই শেখার মানসিকতায় প্রশিক্ষকদের সাথে একাত্ব হতে পারায় ভাবের লেনদেন সাবলীল হয়। তৃতীয়ত গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ, শিক্ষাক্রম যথাযথ নির্ধারণ করতে পারা। সিলেবাসে মঞ্চের অভিনয় প্রকৃয়া প্র‍্যাক্টিকাল যতটা হবে, তার চেয়ে বেশি যুক্ত থাকবে ইতিহাস ও ব্যাপক একাডেমিক ঐতিহ্য সম্বলিত ভাবধারার প্রকাশ। ইচ্ছের মূল্য আছেই। তবুও একজন শিশৃক্ষুর বংশগতিতে কোন পূর্বসুরির শিল্পের যে কোন বিভাগের চর্চা ধারায় ঐতিহ্য সম্বলিত হবার অবগতি পেলে, শেখার অনুকূলে যায় নাটকের বাতাস। লাগে পারিবারিক সহোযোগিতা। হতে পারে প্রশিক্ষার্থীর চরিত্র মানসিক ভাবে কিছুটা উন্মনা, কিছুটা অবাস্তব বাস্তবতার মিলমিশ থাকার মেজাজ সম্পন্ন। চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যেই খামখেয়ালী সে।

তবুও আছে যেন মানবিক স্বচ্ছতা। বিশেষ রাজনৈতিক চেতনা। বোধ, বুদ্ধি আবেগের নিয়ন্ত্রিত সহাবস্থান। জীবন সম্বন্ধে আশাবাদী হওয়া। ইচ্ছা আর ধৈর্যের পরিমাপ নিক্তিতে দুই পাল্লায় সমান সেই নাটুকে মানুষ। এই হওয়া না হওয়ার খেলায় নিজেকে আবিষ্কার করার উন্মাদনা থাকা এক বিচিত্রিতা মননেই শিল্পের অধিষ্ঠান থাকে। যার কারণে এসে যায় কিছু করে দেখাবার মতো চ্যালেঞ্জিং শক্তি। চাই সর্বোপরি শেষ দেখে থামার মতো একগুঁয়ে বিশ্বাসে ভর দিতে পারা। এইরকম আরো অনেক সুক্ষ্ম চলাচলে চেতন অবচেতন স্তরে শিক্ষার্থীদের কল্পনার বিস্তারে নিজে এবং নিজের শিল্পে পুলকিত অবস্থায় যেতে পারায় নাটকের যাবতীয় শিক্ষা যুগপৎভাবে এগিয়ে চলে। এগুলিই আমি মানি।

কারণ আমার ১৯৭৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পাওয়া অভিজ্ঞতা আমাকে এভাবেই নাটকে এনেছে। এভাবেই ধরে রেখেছে। আর চলার পথে নাটকের পাঠ নেওয়ার উৎসে এটাই চিনিয়েছে। অভিনয় শেখার নির্ধারিত কোন বয়স যেমন নেই, তেমনি এই শেখার সমাপ্তি বলে চূড়ান্ত কোন মাপকাঠি নেই। চলবে আজীবনকাল। প্রত্যাশা হীনভাবে কাজের আনন্দ পাওয়ায় অন্তরের তৃপ্তির আস্বাদন। এরপর কাজের পরে অনেক কাজ করেই শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে যাওয়া যায়। আর তবেই আসে খ্যাতি এবং হয় উপার্জনের সুরাহা। তাই নাট্য প্রশিক্ষণের মধ্যেই একটা পেশাদারী পথেই চলা শুরু হয়। নিজের দায় দায়িত্ব কাঁধে নেবার সামর্থ্যও পাওয়া যায়। 

আত্মপ্রশিক্ষণ নাকি প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ

আমি নাট্য প্রশিক্ষণের মধ্যেই নিজেকে গড়ে নিয়েছিলাম। চাকরির সাথেই সংসার সামলে নাটক নিয়ে প্রত্যক্ষ কাজে  যুক্ত হয়েছিলাম। নিজের জীবনে নাটকের বোধকে স্বচ্ছন্দ স্বাভাবিক করে তুলতে পেরেছিলাম। তবে সে সব অসম্ভব দামী কিছু ব্যক্তিত্বের সামনাসামনি হতে পারায় সম্ভব হয়েছিল। যাই করতে পেরেছি, সবই তাঁদের সাহচর্য। সেইসব কথাই বলি বরং। 

সেটা ছিল ১৯৮৮ সাল। বহরমপুর রবীন্দ্র সদনে একটা নাটকের প্রশিক্ষণ শিবির হয়েছিল। ৩১শে জুলাই থেকে ৬ই আগষ্ট পর্যন্ত। এটি ছিল পশ্চিমবঙ্গ নাট্য একাডেমি আয়োজিত তৃতীয় নাট্য শিক্ষণ শিবির। ১৯৮৭ সালে বামফ্রন্ট সরকারের তত্ত্বাবধানে ও ভাবনায় গিরিশ মঞ্চ কম্পাউন্ডের ভিতরে একটা ছোট ঘরে প্রথম নাট্য একাডেমির অফিস উদ্বোধন হয়েছিল। নাট্য একাডেমি শুরুতেই নাট্য শিক্ষণীয়তা নিয়ে ভাবিত হয়েছিল। এটা বাম জমানার বিশেষ সাংস্কৃতিক কীর্তি।

তখন নৃপেন্দ্র সাহা গ্রুপ থিয়েটার পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। নাটকের জন্যে সব জেলায় তিনি যাওয়া আসা করতেন। সকল দলের ব্যর্থতা সফলতা চাক্ষুষ করতেন। নিজে নাটক লিখতেন না। পরিচালনা করতেন না। কোনদিন অভিনয়ও করেন নি। কিন্তু নাটকের কেন্দ্রীয় এক ভাবুক ব্যক্তিত্ব। রাজ্যের সর্বত্র রাজনৈতিক থিয়েটারের প্রসারের জন্যে নিবেদিত প্রাণ ছিল তাঁর। তাঁর নেতৃত্বে গ্রুপ থিয়েটার পত্রিকা তখন এমন একটা ছাতা ছিল, যার তলে না দাঁড়ালে নাটকের কাজ করাই অসম্ভব ছিল।

নাটকের প্রতিযোগিতার বাজারে যোগাযোগ, চেনা জানা, সবারই ওই এক মাধ্যমেই হতো। যাই হোক, বাম রাজনৈতিক দলের একজন পার্টি মেম্বার হিসাবে এই মহান মানুষের সাথে যুক্ত ছিলেন তাবড়-তাবড় নাটকের প্রখ্যাত মানুষ। নাটক মানুষের কথা বলবে, মানুষকে শোষণ মুক্ত সমাজ দেবে। এই কথাটা ভিতর থেকে নাড়া দিত। হয়তো সেই নাড়াকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। তাই নাটকের জন্যে বিজ্ঞান ভিত্তিক চর্চায় কুশীলবদের অগ্রসর করতেই নাট্যজনেরা চিন্তিত হয়েছিলেন।

এই জন্যে নাট্য একাডেমি গড়ে উঠেই ১৯৮৭ সালেই এই নাট্য প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করেছিল। ওই বছরই কলকাতায় প্রথম সরকারি অর্থ ব্যয়ে নাট্য শিক্ষণ শিবিরের ব্যবস্থা হয়েছিল। এই শিবির হয়েছিল প্রেসিডেন্সি বিভাগের জেলা গুলির চর্চায় নিযুক্ত নাটকের মানুষদের নিয়ে। শিবির পরিচালক ছিলেন উৎপল দত্ত স্বয়ং। ২য় নাট্য প্রশিক্ষণ শিবির হয়েছিল বর্ধমান বিভাগের নাট্য কর্মীদের জন্যে। চালক ছিলেন জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়। চতুর্থ শিবির হয়ছিল উত্তর বঙ্গের ৫টি জেলার নাট্য মহলের অগ্রগতির জন্যে। এটাও ১৯৮৮ সালের আগষ্টের শেষ সপ্তাহে। 

শিবির চালক নীলকন্ঠ সেনগুপ্ত। আমি নির্বাচিত হয়েছিলাম শ্রদ্ধেয় অরুণ মুখোপাধ্যায় এর কাছে ইন্টারভিউ দিয়ে তাঁরই শিবির পরিচালনায়। তৃতীয় নাট্য শিক্ষণ শিবিরে। তখন মুখোমুখি যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে মালদহ, নদীয়া আর মুর্শিদাবাদের সর্বমোট ৮৫ জন নাট্যকর্মীদের মধ্যে ৩১ জনকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। যে শিক্ষণ শিবিরে শিক্ষক ছিলেন, সর্বশ্রী তাপস সেন, খালেদ চৌধুরী, পবিত্র সরকার, শমীক বন্দোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তী, অসিত মুখোপাধ্যায়, দেবেশ চক্রবর্তী (পি এল টি), রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, নীলকন্ঠ সেনগুপ্ত, অশোক মুখোপাধ্যায়, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, হীরেন ভট্টাচার্য, রঞ্জিত মিত্র(রূপসজ্জাকার), সুরকার দেবাশীষ দাসগুপ্ত, ধ্রুব মিত্র(মাইম), জয় সেন প্রমুখ। অনুজ হিসাবে সহায়তায় ছিলেন গৌতম হালদার, অঞ্জন দেব, দেবশঙ্ক্র হালদার প্রমুখেরা।

সবার পেছনে শিবিরের ছাত্র ছাত্রীদের গোপন নজরে ধরতে নিযুক্ত ছিলেন ইন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়। তিনি গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের কর্তা। নিজে বেশ কিছু নাটক লিখে ফেলে নজর কেড়েছিলেন। খুব ভাল চিত্রকর। যাই হোক ওনার অন্তর্ভুক্ত অবদান এই সব নাট্য শিক্ষণ শিবিরে অন্য মানেতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই শিক্ষণ সিলেবাস অসম্ভবই ভাল এক প্রাপ্তি।

যাবতীয় অবগতি আমাদের ঋদ্ধ করেছিল, ওই দেখে দেখে নাটক করার ইচ্ছের মধ্যে। তখন ওই একই সিলেবাসে সব ওয়ার্কসপ চলেছিল। নাটকের পাঠ্যক্রমে ছিল, শরীর শিক্ষা ও দেহ সঞ্চালন, কন্ঠ ও স্বরক্ষেপন, বাংলা নাটক ও নাট্যমঞ্চের ইতিহাস, মঞ্চসজ্জা, মূকাভিনয়, ইম্প্রোভাইজেশন ও থিয়েটার গেমস, গ্রীক নাটক ও এলিজাবেথীয় থিয়েটার ইতিহাস, পাশ্চাত্য নাট্য দর্শন, আলোক সম্পাত, আবহ এবং নাটকের গান বা সঙ্গীত, রূপসজ্জা ও পোষাক, নাট্য নির্দেশনা, প্রযোজনা, অভিনয়, আর আলাদা করে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের লাঠি নাটকের প্রোডাকশন প্রসেস।

সাথে ছিল নাট্যকারকে রচনার মধ্যে চেনা, প্লে এনালাইসিস, সিনোগ্রাফি, গ্রুপ ডিসকাশন ইত্যাদি অনেক কিছু। এখানেই ব্যক্তিগত ভাবে আমি নাটকের সব কিছুই ধারণা করার শক্তি পেয়েছিলাম। শুধু আমি নই, আরো অনেকেইপেয়েছিলেন। তাই প্রায় ৩০/৩২ বছর ধরে চলে, আজও মঞ্চের উপর সেই শিক্ষা পাথেয় করে চর্চা দক্ষতায় কাটিয়ে দিলেন অনেকে।

যেমন আমার সতীর্থ ছিলেন কৌশিক চট্টোপাধ্যায়, গৌতম মজুমদার, পরিমল ত্রিবেদী, এন এস ডি স্নাতক বিশ্বজিৎ বিশ্বাস, কালীশংকর কর্মকার, পুতুল চক্রবর্তী, লিপিকা দত্ত, বিধান টুডু (প্রয়াত), তুষার মুখোপাধ্যায় (প্রয়াত),কল্যাণী ঋত্বিক সদনের আলোক শিল্পী রবীন কুন্ডু, বিশ্বপ্রিয় মুখার্জী প্রমুখেরা, অনেকেই মঞ্চের কাজে এখনো বর্তমান। তখন এই চারটে নাট্য প্রশিক্ষণ শিবিরে, রাজ্যের প্রায় চারশো আগ্রহী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১২০ এর কাছাকাছি সংখ্যায় নির্বাচিত কর্মীরাই এই পাঠ নেবার সুযোগ পেয়েছিল।

এদের মধ্যে থেকে মাত্র ৩০ জনকে ইন্টার্নালি অব্জার্ভ করে, সে কতটা আগ্রহী যাচাই করে, সরাসরি কলকাতার গিরিশ মঞ্চে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় নাট্য শিক্ষণ শিবিরে আনা হয়েছিল। সমস্ত জেলার বাছাই করা এরাই, পরবর্তীতে অনেক কৃতিত্বে নাট্য দরবার উজ্জ্বল করেছেন। আমি এই শিবিরেও ছিলাম। টানা দশদিন ধরে ১৯৮৯ সালের ১লা থেকে ১০ই মার্চ পর্যন্ত প্রচুর শেখার অবকাশ পেয়েছিলাম।

মনোজ মিত্র, হরিমাধব মুখোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী, মোহন আগাসে, দ্বিজেন বন্দোপাধ্যায়, উষা গাঙ্গুলী, বাদল দাস, পৃথু নন্দন ঘোষ, সলিল বন্দোপাধ্যায়, মেঘনাদ ভট্টাচার্য আরো অনেকেই ক্লাসে শিক্ষক হয়ে এসেছিলেন। একইভাবে ১৯৯২ সালে কাকদ্বীপে গঙ্গা সাগরের মেলা যেখানে হয়, সেখানে গিয়ে নির্জনে আবাসিক ভাবে শিক্ষক ও ছাত্র ছাত্রীদের পাশাপাশি রেখে নাটক লেখার ওয়ার্কসপ করার পরিকল্পনা এবং বাস্তবে তা সংঘটিত করা হয়েছিল।

বিদগ্ধ নাট্যকার হিসাবে মনোজ মিত্র, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, বিষ্ণু বসু(ব্রাত্য বসুর বাবা), চন্দন সেন, রবীন্দ্র ভট্টাচার্য, মামনুর রসিদ প্রমুখেরা হাতে কলমে নাটক লেখার ভাবনা বীজ থেকে কলমের কারুকাজ শিখিয়েছিলেন। এখানেও আমি আমার লেখা হাতিয়ার বদল নাটকের কারণে নির্বাচিত হয়েছিলাম।

প্রচুর শিখেছি তাই। এরপরে ১৯৯৪ সালে গিরিশ মঞ্চে দ্বিজেন বন্দোপাধ্যায় আর বিমল চক্রবর্তীর যৌথ শিবির চালনায় নাট্য পরিচালনা শিবিরে আমি যুক্ত হয়েছিলাম। এখানে দশ দিন ধরে নাটক মঞ্চ অভিনয় আলো আবহ আর সামগ্রিক পরিকল্পনা নিয়ে দুর্দান্ত শিক্ষা পেয়েছিলাম।

বিভাস চক্রবর্তী মুক্তধারা নাটকের প্রডাকশন প্রসেসিং দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কিভাবে নাটক চালনা করতে হয়। আগের সব শিক্ষকেরাই ছিলেন। তবুও ভুলিনি অশোক মুখোপাধ্যায়, অসিত মুখোপাধ্যায়, সলিল বন্দোপাধ্যায়, উষা গাঙ্গুলী, রুদ্র প্রসাদ সেনগুপ্ত, তড়িৎ চৌধুরী, এইসব ব্যক্তিত্বের চিন্তা ভাবনার মুখোমুখি লেনদেনের কথা।

৮ এর দশকের শেষ থেকে ৯ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে অনুষ্ঠিত চারটি নাট্য বিষয়ক শিক্ষণ শিবিরে অনেকেই বারবার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার মধ্যে কটা নাম বলি, যেমন কৌশিক চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল চক্রবর্তী, পার্থ চৌধুরী, দুলাল চক্রবর্ত্তী, উজ্জ্বল হক, সমীর কুন্ডু, পরিমল ত্রিবেদী, কল্যাণ দাস, কিশলয় বসু, পলাশ ভদ্র, লোকনাথ বন্দোপাধ্যায়, অনিল সাহা, দীপায়ন ভট্টাচার্য, কাজল মহান্ত, তপন হাজরা, মেঘ মুখোপাধ্যায়, গৌতম মজুমদার, বিধান টুডু, ইত্যাদিরা এখনো নাটক অন্ত প্রাণ। নিজের মুখে নিজের কথা বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে। কথা কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হচ্ছে। আমি ৩২ দিন নাটকের ক্লাসে গিয়েছিলাম। ছয় বছরের মধ্যে।

রাজ্য সরকার আমাকে বিনা পয়সায়, খাওয়া থাকা যাতায়াত ভাড়া দিয়ে বাড়ি থেকে তুলে এনে নাটকের পাঠ পড়িয়েছিল। এই গুরুত্ব অনুভব করে ফরাক্কা ব্যারেজে ইঞ্জিনিয়ার এর চাকরি করতে করতেই আমি টোটাল থিয়েটারের কাজে যুক্ত ছিলাম। তখন মোবাইলের যুগ ছিল না। পত্রিকা কিনে, পড়ে, তাতে লেখালেখি করে সারা রাজ্যের সাথে যুক্ত থাকতাম। আমি কি বাংলা নাটককে উদ্ধার করে দিয়েছিলাম? না, একেবারেই তা নয়।

এটা ছিল আমার দায়, কর্তব্য। কারণ আমাকে রাজ্য সরকার গণমুখী নাটকের কাজে উদারভাবে, বিনা প্রত্যাশায় নাটকের জন্যে নিজেকে নিমগ্ন করতে সুযোগ দিয়েছিল। আমি যদি থেমে যাই। যেতাম। যেতেই পারতাম। তাহলে কিন্তু সরকারের পরিকল্পনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হতো। কোন একজন নাট্যকর্মী আমি শিবিরে নির্বাচিত হওয়ায়, বাদ পড়ে গেছেন অবশ্যই। কাজেই আমি নাটকের চর্চা না করলে অপরাধ হতো।

ভাবনায় প্রায়োগিক ত্রুটি

হয়তো সেই বাদ পড়ে যাওয়া নাট্যজন আরো বড় কাজ করতেন। কিন্তু সুযোগ পেলেন না। এটা স্বপ্ন ভঙ্গের কারণ হতেও তো পারে। মোট কথা এই সব ভেবে গেছি লেগে থাকার যুক্তি খাড়া করতে। আমার জীবনে ভাল শিক্ষকদের কাছে পাঠ শেখা, নির্ধারিত উপযুক্ত শিক্ষাক্রম একটা বিশাল প্রাপ্তি। পরবর্তীতে নৃপেন্দ্র সাহা আমাকে দিয়ে বহু নাট্যমঞ্চ সংক্রান্ত কাজ করিয়ে নিয়েছিলেন।

নাট্য প্রশিক্ষণ শিবির কি করতে পারে?

নাট্য প্রশিক্ষণ শিবির নাট্যচর্চায় কিছু সূত্র বাতলে দিতে পারে। কিছু হয়ে যাওয়া ইতিহাস বলে দিতে পারে। কিন্তু কোনভাবেই নাট্যজন হিসাবে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে না। এই একজন নাট্য প্রেমী হয়ে ওঠার সবটুকুই ইচ্ছা আর অনুসন্ধান নির্ভর। বাংলা নাটকের এই এগিয়ে আসায়, বিভিন্ন জেলার, বিভিন্ন অঞ্চলের নানান ওঠাপড়া ঘিরেই কিছু মানুষের অবদান রয়েছে। দেখা গেছে সেইসব মানুষ যদি এই ক্ষেত্রে কোন একদিন না এসে দাঁড়াতেন, তবে তা আর অন্য কে করতেন তা অনুমান করা মুস্কিল হতো।

কাজেই আমি মনে করি, এই সমন্বিত শিল্পকলায় একেবারে নবিশ অবস্থায় এসে পড়ে ঠেকে ঠেকে, ধাপে ধাপে শিক্ষা গ্রহণ করাই শ্রেয়তর পথ। এই মর্মে বহু মানুষ শীর্ষস্থানীয় অবস্থান পেয়েছেন ক্রম অধ্যাবসায় দিয়ে। অনেকে দশ বিশ বছরে এতো সমৃদ্ধ কীর্তি রেখে গেছেন, যা বাংলা নাটকের সমাজ ভুলতে পারেনি আজো। এঁদের অনেকেই কিছুই তেমন জানতেন না। করতে করতে হাত পাকিয়েছেন।

উল্লেখযোগ্য যেমন কেয়া চক্রবর্তী। উনি আজও একটা মাইলস্টোন পরিচিতি। আছেন এমন অজস্র প্রেরণার উৎস। আসল কথা নাটকের গভীরে যেতে হলে একটা ভিন্ন মন লাগে। এই মন তৈরির পেছনে, চলচ্চিত্র, চিত্রাঙ্কন আর সাহিত্যের মিশেলে কিছু বিশেষ অনুভূতি থাকলেই নাটকের অস্তিত্বে যাতায়াত করা হয়তো সহজ হয়। নিবেদনের উপর সবই নির্ভরশীল। জীবন চাওয়া সম্বল মাত্র। পাওয়া ঘিরে প্রশান্তি আসুক বা না আসুক। চাওয়াটুকুই থাকুক। নাটকের কাজ তো চরৈবতি পরম্পরা মাত্র। তাই একেবারে চূড়ান্ত শিক্ষণীয়তা পেতে জীবনের শেষ দিনের অভিজ্ঞতার জন্যে অপেক্ষমাণ থাকতেই হবে।

ট্রায়াল অ্যান্ড এর পদ্ধতিতে বদলে, শুধরে, পালটে চলাই সমাজ সময় এবং জীবন দর্শনের আধার। চিন্তারও আধুনিকতা। জ্ঞান থেকে বিজ্ঞান বেয়ে, মন ছেয়ে আসা মেঘেদের ঘনঘটা ঘিরেই শিল্পের ফড়িং উড়ে এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। খোলা জানলায় মুক্ত মনে বসে থেকে আকাশটাই চেনা, সেই যখন দেখার বিচিত্র জগৎ হবে, আলো ঠিক আসবে। আসবেই আসবে আশাবাদ। 

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -