সুপর্ণা ভট্টাচার্য
‘জেগে থাকে রাত’। নেতাজীনগর সরস্বতী নাট্যশালার নবতম প্রযোজনা। গত ২৮ মে ২০২৪ মিনার্ভায় অভিনীত হল জয়েশ ল-এর নির্দেশনায় এই নাটক।
নাটককার সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের লেখা এই একাঙ্ক নাটক। সিংহভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারের উচ্চাশা থাকে তাদের সন্তান এদেশে অথবা বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভ করুক। শিক্ষাশেষে বিদেশে বেশ মোটা অঙ্কের মাইনের চাকরি করুক এবং সেখানেই বসবাস করুক। সন্তানদের মনে ছোটো থেকেই সে স্বপ্ন বুনে দেন বাবা অথবা মা, অথবা দুজনেই। সন্তান মেধাবী এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের হলে তো সে স্বপ্ন আরো উজ্জ্বল হয়।
‘জেগে থাকে রাত’ তেমনই আমেরিকা নিবাসী এক সন্তানকে আবর্তিত করে একটি রাতের কথকতা। যে কথকতার কেন্দ্রবিন্দু শ্রী রজত রায় । তিনি এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মার্কেটিং অফিসার। উচ্চাকাঙ্ক্ষী, আমেরিকাকে পৃথিবীর মহানতম দেশ বলে মনে করেন।তিনি গর্বিত পিতা বটে, কিন্তু নাটকের পরতে পরতে উন্মোচিত হয় তাঁর অন্তরের হাহাকার। প্রবাসী সন্তানের সঙ্গে ধীরে ধীরে যে তাঁর দূরত্ব বেড়ে গেছে, অচেনা হয়ে গেছে সন্তানের যাপন তা উপলব্ধি করতে থাকি আমরা । এও বুঝতে পারি, শুধু সন্তান নয়, দূরত্ব তৈরী হয়ে গেছে, স্ত্রীয়ের সঙ্গে।
নাটককার সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় অসম্ভব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তাঁর নাটকে রূপক রূপে রজত রায়ের প্রতিবিম্ব এবং রাত অর্থাৎ রাত্রিকে এনেছেন। ফলে এক ইল্যুশন তৈরি হয়েছে এই নাটকে। অতিরিক্ত মদ্যপ অবস্থায় যাদের সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যান রজত রায়। আমরা মধ্যরাতের এক বিধ্বস্ত মানুষকে আবিষ্কার করি। অবশেষে স্ত্রী এসে আয়না দেখান তাঁকে। তাঁর একাকীত্ব, তাঁর শূন্যতা যে তাঁর নিজের তৈরী, ঠুনকো অহঙ্কার যে বাবা হিসাবে তাঁকে এক অন্তঃসারশূন্য সম্বোধন ব্যতীত আর কিছু দিতে পারেনি, তা বুঝিয়ে দেন। ভেঙে পড়তে পড়তে নিজের প্রতিবিম্ব, যা আসলে তাঁর অন্তরেই বাস করা এক অন্য রজত রায়, তার কাছে স্বীকার করেন, নিজের অক্ষমতার কথা।
পর্দা খুলতেই আমরা মায়াবী এক আলোয় রজত রায় রূপী শ্রী শ্যামল সরকারকে দেখি। যার বেশভূষা দেখে মনেই হয় তিনি বিধ্বস্থ। তাঁর স্বরক্ষেপণ, অভিব্যক্তি বুঝিয়ে দেয় বহুক্ষণ ধরেই তিনি মদ্যপান করছেন। সুন্দর, ঝকঝকে আসবাবপত্র, ঝাড়বাতির আলো রজত রায়ের অর্থনৈতিক অবস্থান বুঝিয়ে দেয় অনায়াসেই। শ্যামল সরকার অভিজ্ঞ অভিনেতা। ঋদ্ধও বটে। মদ্যপ অবস্থায় একটি নাট্যপ্রযোজনার প্রথম থেকে শেষ অবধি অভিনয় করা কঠিন ব্যাপার। সেটি তিনি দক্ষতার সঙ্গে করেছেন। শুধু ভেঙে পড়ায় মুহূর্তটি আরো একটু গভীর হলে ছুঁয়ে যেত দর্শকদের।
রজত রায়ের প্রতিবিম্বর চরিত্রে রূপদান করেছেন দীপঙ্কর ঘোষ। অনন্য চরিত্রায়ন। এই চরিত্রটির কিন্তু কয়েকটি শেড, সেই রজত রায়ের অন্তরাত্মা, ফলে একদম কিছু শারীরিক অভিব্যক্তি দুজনের সমান হতেই হবে। দীপঙ্কর সেটিতে সফল। শ্যামল সরকার এবং দীপঙ্কর ঘোষের এক বিখ্যাত গানের লাইনের সঙ্গে কম্পোজিশন, মনে রাখার মত দৃশ্যায়ন।
রাত্রি, যে রাত্রিকে নির্ঘুম পার করতে যন্ত্রণা দানা বাঁধে, আবার যে রাত্রি মোহময়ী, স্বপ্ন লেখে সেই রূপক রাত্রি চরিত্রে অভিনয় করেছেন, আ্যনি সেন। তাঁর পোশাক, মঞ্চ জুড়ে আবেশ নিয়ে চলন মুগ্ধ করে। শুধু স্বরক্ষেপণ বা আমরা যেটা বলি, ‘নাভি থেকে উচ্চারিত ধ্বনি’ সেটির সামান্য অভাব, যা অচিরেই দূর হবে বলেই বিশ্বাস।
এবার আসি রজত রায়ের স্ত্রীর ভূমিকায় ন্যান্সির কথায়। এতো পরিমিতি বোধ, এতো অভিজ্ঞ অভিব্যক্তি, এতো অতল থেকে সংলাপ প্রক্ষেপণ মুগ্ধ করেছে। বাবা এবং ছেলের সম্পর্কের টানাপোড়েনে সবথেকে অসহায় হন মা। দ্বিধাবিভক্ত হতে থাকেন। কী আশ্চর্যজনক ভাবে তিনি সেটা ওইটুকু সময়ে ফুটিয়ে তুলেছেন! প্রশংসনীয় এবং সাধুবাদ।
সবশেষে আসি রজত রায়ের পুত্রের চরিত্রায়নে আরুষের কথায়। আরুষ সার্থক অভিনেতা রূপে ক্রমশ চর্চিত হচ্ছে, হবে। মায়ের সঙ্গে বন্ধুর মত কথোপকথন সহজ, অনায়াস। শেষ মুহূর্তে অসহায় বাবার কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়ার মুহূর্তটুকুও অনুভবী।
নাটককারের মুন্সীয়ানা হল রাত শেষে ভোরের মহেন্দ্রক্ষণে সব দূরত্ব শেষে একসঙ্গে হেসে ওঠার দৃশ্য রচনা করা। ধন্যবাদ শ্রী সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে এমন এক মনস্তাত্ত্বিক নাটক লেখার জন্য।
মঞ্চ করেছেন আরুষ দত্ত এবং দীপঙ্কর ঘোষ। খুব সুন্দর ভাবনা তাঁদের মঞ্চনির্মাণ। সাধুবাদ প্রাপ্য। বাবলু সরকারের আলোক পরিকল্পনা এবং প্রক্ষেপন দুটিই প্রশংসার দাবী রাখে। অপূর্ব আলোর মায়া সৃষ্টি হয়েছে মঞ্চজুড়ে।
নাট্য প্রযোজনাটির সব থেকে দুর্বল জায়গাটি হল আবহ। শ্যামল সরকার এবং ন্যান্সির গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ চলাকালীন কী উচ্চকিত একটানা আবহ! কেন? আবহর জন্য নাটক তো নয়, নাটকের জন্য আবহ। আবহ সাহায্য করে সংলাপকে সুষমামণ্ডিত করতে। দর্শকদের অনুভূতিতে প্রলেপ লাগাতে। আবহ করেছেন সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়। একটু ভেবে দেখা যেতে পারে।
নির্দশক শ্রী জয়েশ ল এবং সহ নির্দেশক আরুষ দত্ত প্রশংসার দাবী রাখে, এমন একটি বাচিক নির্ভর নাটককে অত্যন্ত দক্ষ ভাবে উপস্থাপিত করার জন্য। এই নাট্য প্রযোজনা দর্শকের মন জয় করে এগিয়ে যাবে এমনটা অনুভব করা গেল দর্শকাসন থেকে। নেতাজীনগর সরস্বতী নাট্যশালার সকল কর্মীবৃন্দের এই প্রয়াস দলকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।