মঞ্চে ইবসেনের ‘নোরা’ চরিত্রে নায়িকা জেসিকা চ্যাস্টেন

- Advertisement -

নৈতিক রায়

ব্রডওয়ে থিয়েটারে এবার প্রযোজিত হল ইবসেনের রচনায় ‘ডলস হাউস’। যা একটি ক্লাসিক নাটকের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ। ‘নোরা’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন আমেরিকার প্রখ্যাত ব্যাস্ততম নায়িকা জেসিকা চ্যাস্টেন (Jessica Chastain) ।  

ইবসেনের এই নাটকটি মঞ্চস্থ করতে একটা বড় সেট-ক্যানভাস নির্মাণ করা জরুরি। সেট প্রপস থেকে রিকুইজিশন সবই অনেকটা বড় আয়তনে ধরতে হয়। কিন্তু এই নির্মাণ অদ্ভুতভাবে সাজানো হয়েছে। যেখানে রয়েছে একটি পিয়ানো, বেশ কয়েকটি চেয়ার, সোফা, একটি সিরামিক স্টোভ, একটি রকিং চেয়ার, দেওয়ালে তামার প্লেটে খোদাই করা প্রপার্টিস। বলতেই হয় মঞ্চ নির্মাণের মুন্সিয়ানায় বেশ আধুনিকতা আছে।

নোরার স্বামী টোরভাল্ড-এর অফিস অফস্টেজে রয়েছে। যা ডাউন স্টেজে নোরার কাছে অজানা। এবং এখানে ইবসেনের গল্পের গভীরতাকে অসাধারন ভাবে তুলে ধরেছেন ব্রিটিশ পরিচালক জেমি লয়েড। নোরা যেন সোনার খাচায় বন্দী হয়ে সেই বহির্জগতে থাকা স্বামীকে টুইট করে যাচ্ছে।     

নরওয়েজিয়ান নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের লেখা এই তিন অঙ্কের নাটক ‘এ ডলস হাউস’। বই আকারে নাটকটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭৯ সালের ডিসেম্বরে। সেই মাসেরই ২১ তারিখ ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনের রয়েল থিয়েটারে বড়দিন উপলক্ষে নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর বিয়ে-সংসার ব্যবস্থা ও সামাজিক নিয়মকানুনের গতানুগতিক অভ্যাসগুলিকে সমালোচনা করার কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে ইবসেনের এই নাটক। সেই সময়ের সামাজিক অবস্থানে থেকে এই ধরনের নাটককে মঞ্চস্থ করে নাট্যকারকে কম বিতর্কের মুখোমুখি হতে হয়নি। নাটকের মূল চরিত্র নোরা। নিজেকে নতুন করে চেনার ও জানার আগ্রহ তৈরি হয় নোরার মধ্যে। আর সেই আগ্রহ থেকে একসময় স্বামী, সংসার আর সন্তানের দায়িত্ব ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে চায় সে। 

নাট্যকার ইবসেন এই নাটক লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন এই ধারণা থেকে, যে ‘একজন নারী আধুনিক সমাজে কখনোই নিজের মতো করে বসবাস করতে পারে না।’ কারণ, এটি একটি পুরুষশাসিত সমাজ। এই সমাজের আইন তৈরি করে পুরুষরা। আইন প্রয়োগ ও বিচার প্রক্রিয়াও পুরুষদের হাতে। সে কারণেই তাঁরা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নারীদের বিষয়গুলো নির্ধারণ করেন।

১৮৯৮ সালে ‘নরওয়েজিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর ওমেন্স রাইটস’-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইবসেন বেশ জোর দিয়েই বলেছিলেন, তিনি সচেতনভাবেই নারী অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে কাজ করেছেন। তবে কোনও প্রপাগান্ডার অংশ হিসেবে তিনি ‘এ ডলস হাউস’ লেখেননি বলেও দাবি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তাঁর কাজ ছিল মানবতাকে বর্ণনা করা।

স্বামীর অসুস্থতার সময় নোরা হেলমার অনেক টাকা স্বামীকে লুকিয়ে ধার করেছিলেন। স্বামীকে কোনভাবেই সেকথা জানতে দেননি তিনি। এবং সেই ঋণের কিস্তি একাই শোধ করে যাচ্ছিলেন। এদিকে নোরার স্বামী টোরভাল্ড মনে করেন, নোরা এখনো বয়সে অনেক ছোট বা ইমম্যাচিওর। আর সে কারণেই নোরাকে ‘ডল’ বা পুতুল বলে ডাকেন টোরভাল্ড।

এরই মধ্যে টোরভাল্ড ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে কাজ পান। দায়িত্ব পেয়েই ব্যাংকের এক কর্মী নিলস ক্রোগস্তাদকে চাকরিচ্যুত করার উদ্যোগ নেন তিনি। অভিযোগ, স্বাক্ষর জাল করে টাকা তুলেছিলেন নেলস। ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতে দেখা যায় এই নিলসের থেকেই টাকা ধার করেছিলেন নোরা। গল্পের বাঁক ঘুরে যায়। এরপরেই জানা যায়, আসলে নিজের বাবার স্বাক্ষর জাল করে নোরাই টাকাটা তুলেছিল স্বামীকে সুস্থ করার জন্য। এবার নিলস নোরাকে হুমকি দেয় – হয় নোরা তাকে বাঁচাবে, নয়তো সে নোরার স্বামীর কাছে সব ঘটনা বলে দেবে।     

তবে টোরভাল্ডকে নোরা বোঝাতে পারে না। কারণ নোরার স্বামী মনে করেন, নোরা ব্যবসার এইসব জটিলতা কিছুই বুঝতে পারে না। কিন্তু একদিন সব কথা জানার বা বোঝার পর বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয় টোরভাল্ড। যদিও সে তখনও জানে না যে তাকেই সুস্থ করে তুলতেই নোরা এ কাজ করেছিল। নোরার সামনে টোরভাল্ডকে বোঝার সুযোগ এলো এবং নোরা খুব সহজেই তার পথ আলাদা করে নিল। এমনি একটি ঘাত প্রতিঘাতে নির্মিত চরিত্র চরিত্রায়নে জেসিকা চ্যাস্টেন মননশীল অভিনয় করেছেন, মঞ্চে একটি চরিত্র নির্মাণে তাঁকে যথেষ্ট মহড়া দিতে হয়েছে। নিজের ব্যস্ত সিডিউল থেকে সময় বাঁচিয়ে নিয়মিত রিহার্সাল করে গেছেন তিনি।

সম্প্রতি A Doll’s House-এর এই নতুন প্রযোজনা মঞ্চস্থ হল হাডসন থিয়েটারে। যার মুখ্য চরিত্রে জেসিকা চ্যাস্টেইন প্রায় সমস্ত বস্তুগত প্রতীক থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে। কোনও পর্দা  নেই, কোনও প্রেক্ষাপট নেই, সত্যকে দেখানোর মতো কিছুই নেই যে নাটকটি এমন একটি বিভাগে উন্মোচিত হতে চলেছে যেখানে নোরা তাদের বস্তুগত আরামের মধ্যে তার স্বামীর কাছ থেকে তার ঋণ লুকিয়ে রেখেছে। যেন সৃজনশীল কাজগুলির সাথে তার ছায়াময় আচরণকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এটি Chastain এর একটি এপিক পারফরম্যান্স, যার কাজ শুরু হয় নাটকটি শুরু হওয়ার আগে থেকেই। তিনি মঞ্চে একটি কাঠের চেয়ারে বসে আছেন যখন শ্রোতারা তাদের আসন এসে বসছেন, একটি শিশুর রেসট্র্যাকে একটি ধীর গতিতে চলা উইন্ডআপ গাড়ির মতো চারপাশে শাটল করে যাচ্ছে।     
এই নাটকে একটি বোধ কাজ করেছে যে নোরা তার নিজের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। তাহলে তা কি নিয়তির হাতে ছিল? পুতুলের মতো ঘরে বন্দী হয়ে থাকা আসলে মহিলাদের উপর আরোপিত সীমাবদ্ধতা তৈরি করে। যা ইবসেনের পাঠ্যের একটি গুরুত্বপুর্ণ দিক, যা প্রমাণ করে নারীবাদী প্রশ্নগুলি আসলে বস্তুবাদীদের মতোই প্রাসঙ্গিক। ব্রিটিশ পরিচালক জেমি লয়েড (Jamie Lloyd) দ্বারা পরিচালিত  এবং অ্যামি হারজগ দ্বারা সম্পাদিত এই প্রযোজনাটি নাটকের সময়কালের জন্য ন্যূনতম নিয়ম মেনে নির্মাণ করা হয়েছে।

যখন নাটকটি শুরু হয় এবং অন্যান্য চরিত্রগুলি তার চারপাশে ঘোরাফেরা করে, নোরা সবেমাত্র উঠে আসে। টরভাল্ড (উত্তরাধিকার থেকে সকলের প্রিয় অ্যাক্টিভিস্ট বিনিয়োগকারী আরিয়ান মোয়ায়েদ-এর ভিন্ন স্বাদের অভিনয় ) তার স্ত্রীকে ঘিরে রেখেছেন, তার স্ট্রাইং, তার স্থবিরতার উপর জোর দিচ্ছে। যখন সে ক্রোগস্ট্যাডের মুখোমুখি হয় (ওকিরিয়েট ওনাওডোওয়ান-এর সংযমের অভিব্যক্তি), যে লোকটি তাকে গোপন ঋণ দিয়েছে, সে তার সাথে পিছনে বসে, তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে দৃশ্যান্তর যেন স্থির, ভোঁতা এবং অচল। নাটকের এগোনোর সাথে সাথে, নোরা চরিত্র সবকিছুকে ছাপিয়ে চ্যাস্টেইনের কণ্ঠে ঘটতে থাকে সেই সংলাপ মুর্ছনা। এটি খুব সহজ কাজ নয়, Chastain এর প্রতিশ্রুতি এবং সহনশীলতার  অভিনয় চিত্তাকর্ষক হয়ে ওঠে দর্শকের কাছে।

নাট্য প্রয়োগে লয়েড মিনিম্যালিজমকে দারুণভাবে ব্যবহার করেছেন। নিরপেক্ষ সেটটি চরিত্রগুলির সাথে ঘাত প্রতিঘাতের সাথে তাদের শব্দ দ্যোতনা যা কৃত্রিমতাকে ছিনিয়ে নিয়ে নাটকটির প্রভাবকে বাড়িয়ে তোলে। হয়তো এটি এতটাই  অপ্রতিরোধ্য যে এটি বিভ্রান্তি তৈরি করে। স্লেট ধূসর সেটের আধিপত্য, গাঢ় পোশাক এবং ফ্লুরোসেন্ট স্ট্রিপ লাইটিং এমন একটি উপস্থাপনা যা একজনকে রঙের স্প্ল্যাশ, একটি পোশাক, একটি পিয়ানোর জন্য আকুল করে তোলে। এই ন্যূনতমতা একটি হাতিয়ারের মতো কাজ করতে শুরু করে এবং এমন একটি প্রযোজনার জন্য স্বার্থক নির্মাণে সাহায্য করে।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -