পুতুলনাটক – একটি হারিয়ে যাওয়া শিল্পকলা

- Advertisement -

ডঃ নিবেদিতা বিশ্বাস

(অধ্যাপিকা, গোবরডাঙা হিন্দু কলেজ, বাংলা বিভাগ)

গত ১০ ডিসেম্বর বিকেল ৫টায় শিল্পাঞ্জলির নিজস্ব সভাগৃহে মঞ্চস্থ হল দুটি পুতুলনাটক ‘দ্যা পোট্রেট অফ অ্যান ওল্ড ম্যান’ এবং ‘ভারতপথিক’। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে EPTA (Experimental Puppet Theatre Arena)-র উদ্বোধন এই অনুষ্ঠানকে স্মরণীয় করে রাখবে। 

 পুতুলনাচ ভারতের প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা। বর্তমানে যা পাপেট থিয়েটার বা পুতুলনাটক নামে পরিচিত। একটা সময় গ্রামেগঞ্জে বিভিন্ন পালা-পার্বণ, উৎসব অনুষ্ঠানে পুতুলনাচ ছিল মানুষের অন্যতম আকর্ষণের জায়গা। তখন মঙ্গলকাব্য, রামায়ণ, মহাভারতের টুকরো টুকরো পালা পুতুলনাচের মাধ্যমে পরিবেশিত হতো। কিন্তু কালচক্রে এই শিল্প আজ মৃতপ্রায়। পশ্চিমবঙ্গের যে গুটিকয়েক জেলায় এখনও এই ধারা বেঁচে আছে তার মধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদীয়া এবং উত্তর ২৪ পরগনা উল্লেখযোগ্য।  আর ভীষণ গৌরবের বিষয় এই যে, উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙায় এই শিল্প এখনও বেঁচে আছে। শুধু  তাই নয়, অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে দেশের নানান জায়গায় প্রদর্শনী করে চলেছেন তাঁরা। এত কথা বলার কারণ,  একুশ শতকে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্য, শিল্পকলা যখন একে একে মৃতপ্রায় সেই সময়ে, তখন সেরকমই একটা বিস্মৃতপ্রায় শিল্পকলাকে বাঁচিয়ে রাখছেন শিল্পাঞ্জলির কর্ণধার এবং কলাকুশলীরা। 

 প্রথমেই বলি ‘দ্যা পোট্রেট অফ অ্যান ওল্ড ম্যান’-এর কথা। পুতুলনাটকের মাধ্যমে বর্তমান সময়ের একটা জ্বলন্ত সমস্যাকে যে এতটা প্রাণবন্ত করে মঞ্চস্থ করা যায় তার দৃষ্টান্ত এটি। উচ্চশিক্ষা, বিদেশযাত্রা কীভাবে ছেলেমেয়েদের বৃদ্ধ মা-বাবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়,  বার্ধক্যে একজন মানুষ কতটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন  তাকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন এই নাটকে। মানুষ তার ছাপ রেখে যেতে চান সন্তানের মধ্যে।  কিন্তু সেই সন্তান যখন সব শিকড় উপড়ে ফেলে বিদেশে কখনও কর্মসূত্রে, কখনও পরিস্থিতির চাপে, কখনও বা স্বেচ্ছায় চলে যান তখন তার পাঠানো অর্থ মা-বাবাকে শান্তি দিতে পারে না। এরকমই এক বৃদ্ধ নিঃসঙ্গ বাবার কোনোরকমে দিনগুজরানের মর্মস্পর্শী চিত্র  ‘শিল্পাঞ্জলি’ তার পুতুল এবং তাদের শব্দ-সংলাপের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলে দর্শককে মুগ্ধ করেছে। বর্তমান সমাজের এক জ্বলন্ত সত্যকে চোখের সামনে তুলে ধরে কখনও আমাদের অস্বস্তিতে ফেলেছে, আবার কখনও স্তব্ধ করে দিয়েছে।

এরপর আসি ‘ভারতপথিক’ নাটকের প্রসঙ্গে। ইতিহাসকে এতটা জীবন্ত করে যে পুতুলনাটকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা যায় তাও দেখলাম এই পুতুলনাটকে। রাজা রামমোহন রায়ের প্রগতিশীল চিন্তা, অনঢ়-অটল ব্যক্তিত্ব পুতুলের মাধ্যমে এবং নেপথ্যের সুদৃঢ় কন্ঠস্বর দর্শককে মুহূর্তের জন্য অন্য জগতে নিয়ে গিয়েছিল যেন! একই সঙ্গে মঞ্চসজ্জা এবং অপূর্ব আলোকসজ্জা মস্তিষ্ককে সজাগ রেখেছে সারাক্ষণ।

 অন্যের সম্পদ দখল করতে চাওয়ার লোভ মানুষের চিরকালের। তবে কখনও কখনও তার ধরণ এবং পথ বদলেছে। কখনও রাজনৈতিক শক্তি, কখনও ছলনার আশ্রয়ে মানুষ একে অন্যের সম্পদ দখল করেছে। তবে ধর্মের আশ্রয় নিলে সেই খেলা অনেকবেশি সহজ হয়। এমনই বহু কুসংস্কারকে ধর্মীয় আচার-আচরণে বেঁধে একদল মানুষ একে অন্যকে ঠকিয়েছে বহুকাল ধরে। তেমনিই এক ভয়ংকর কুপ্রথা  সতীদাহ প্রথা। যার ভয়াবহ আগুন দেশের বহু মেয়েকে অকালে শেষ করে দিয়েছে। স্বামীর সম্পত্তির অধিকার থেকে বিধবা নারীকে বঞ্চিত করার এ এক পৈশাচিক প্রথা। যে প্রথা রদ করেছিলেন ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায়। আর এই মহৎ কাজ করতে গিয়ে পরিবার, পরিজন, সমাজ, এমনকি  মা তারিণী দেবীও তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন।সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বহিষ্কার করতে চেয়েছিলেন রামমোহনকে। তবুও তিনি থেমে থাকেননি। শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছেন, মায়ের বিরুদ্ধে কোর্টে দাঁড়িয়ে মায়ের ধর্মীয় গোঁড়ামিকে ভুল প্রমাণ করেছেন। মা-ছেলের এই দ্বন্দ্ব নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে এই পুতুলনাটকে। শব্দ এবং শরীরের প্রতিটা অঙ্গের এমন নিখুঁত সঞ্চালন  পুতুলের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেছে যেন। যারা পাপেট নিয়ে কাজ করেছেন তাদের প্রশংসা করতেই হয়। আর কন্ঠ, সংলাপ যার কারণে পুরো নাটকটি হয়ে উঠেছিল সহজ, প্রাঞ্জল  তার নেপথ্যে থাকা নামগুলোও সকলের জানা উচিত। রামমোহন রায়ের মতো সুদৃঢ় ব্যক্তিত্বকে সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন সুমন মুখোপাধ্যায়, মায়ের কন্ঠে গীতশ্রী চক্রবর্তী, ১ম ব্যক্তি আর পুরোহিতের কণ্ঠে শঙ্খব্রত বিশ্বাস, দ্বিতীয় ব্যক্তির কন্ঠে জীবন অধিকারী, সতী আর মা এর কন্ঠে সোমা মজুমদার, তারা চাঁদ এর কন্ঠে শান্তনু বসু, মীর আলির কন্ঠে সুশান্ত বিশ্বাস। প্রত্যেকে নিজের জায়গায় এতটা গুণী যে এই পুতুলনাটক অন্য এক মাত্রায় পৌঁছেছিলো।

সবশেষে বলতে হয় সম্পাদক মলয় বিশ্বাসের কথা। ৩৭ বছর ধরে নিরলস সাধনার মাধ্যমে যিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন এই শিল্পকলাকে। আর তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী দুজনের মধ্যে একজন তাঁর পুত্র শঙ্খব্রত বিশ্বাস আর একজন পুত্রবধু সোমা মজুমদার। নাটকের রচনা এবং গবেষণা করেছেন সোমা মজুমদার। তাঁর জন্য  আলাদা করে বললে, বলতে হয় একটা হারিয়ে যাওয়া শিল্পকে এভাবে বাঁচিয়ে রেখে দেশ জুড়ে কাজ করার এই প্রচেষ্টার জন্য তাঁকে কুর্নিশ। নাটকটির পরিচালক শঙ্খব্রত বিশ্বাস এবং সোমা মজুমদার। তাঁদের যৌথ পরিচালনায় নাটকটি দর্শকের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে নিশ্চিত বলা যায়। সবশেষে পাপেট অর্থাৎ পুতুলগুলোর কথা বলতে হয়। যেগুলির সবকটিই শিল্পাঞ্জলির নিজের ঘরে তৈরি করা। এইভাবেই তাঁদের এই প্রয়াস এগিয়ে চলবে, আর পুতুল নাট্যের প্রসার ঘটবে।  

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -