প্রেক্ষা প্রযোজিত ‘মর্মকথা’ পারস্পরিক সম্পর্কের দলিল  

- Advertisement -

শুভশ্রী দত্ত

সম্প্রতি প্রেক্ষা নাট্যদল প্রযোজিত নাটক ‘মর্মকথা’ মঞ্চস্থ হয়ে গেল মধুসূদন মঞ্চে। ১৯২০ সালে সমারসেট মম্ এর লেখা নাটক ‘দি স্যাক্রেট ফ্লেম’ নাটকটির ভাবানুবাদ করেছেন পরিচালক চন্দ্রশেখর আচার্য্য।

মূল নাটকের পরিণতি পবিত্র অগ্নিশিখার মত সম্পর্কের সৌন্দর্য্যকে যেরকম তুলে ধরা হয়েছে , সেরকম অনুবাদ গল্প ‘মর্মকথা’-য় প্রতিটি সম্পর্কের অন্তরের অনুভূতিরই প্রকাশ ঘটেছে ৷ প্রত্যেকের সাথে, প্রত্যেকের মনের সু্ন্দর সম্পর্কের ভিন্ন ভিন্ন দিক নিয়েই এগিয়ে চলেছে গল্পের পথ ৷ 

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, মা- ছেলের সম্পর্ক থেকে শুরু করে, প্রেমের সম্পর্ক, রোগী-সেবিকার মধ্যে অন্তরের অনুভূতির পর্যবেক্ষণ, বিপদে পাশে থাকা পারিবারিক বন্ধুর সাথে বাড়ির কর্তৃর সম্পর্ক, এমনকি ডাক্তার-রোগীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক৷ প্রতিটি সম্পর্কের সুন্দর রূপকল্প গল্পে বেঁধে রাখতে সহায়তা করেছে৷ 

গল্পের শুরুতেই শূণ্য হুইল চেয়ারের উপস্হিতি অসুস্হতার নিদর্শন বহন করল৷ সম্পূর্ণ গল্পে, শরীরের নিম্নাঙ্গ পুরোপুরি অকেজো থাকে বাড়ির বড়ো ছেলে  ভীষ্মের, এই হুইল চেয়ারই তার চলার একমাত্র মাধ্যম ৷নব দম্পতি লহরী-ভীষ্মের বৈবাহিক জীবন ছারখার করে দেয় ভীষ্মের জীবনে উড়োজাহাজের দূর্ঘটনা৷ কিন্তু উভয়ের প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ব, শ্রদ্ধা এতটুকুও কমেনি৷ স্বামীর প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও, বিদেশ ফেরৎ দেওর অর্কের যৌবনে আকৃষ্ট হয়ে শরীরের মোহে ভেসে যায় লহরী এবং অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পরে৷ দাদা ভীষ্মের প্রতি অর্কের শ্রদ্ধা থাকলেও, লহরীকে বৌদির সম্মানে সেও জায়গা দিতে পারে নি৷ লহরীর ভাগ্যের পরিস্থিতিকে অর্ক বারংবার সম্মান দিয়েছে৷ ওর পাশে থেকেছে, হবু সন্তানের বাবা হিসেবেও সকলের সামনে স্বীকৃতি দিয়েছে ৷ ভীষ্ম তার স্ত্রীর ভাগ্যের পরিণতিকে, সহ্য করতে পারে না৷ ওর অকেজো শরীরকে, স্ত্রী ও মায়ের মনে প্রতি মূহুর্তে দুঃখের অনুভূতি বহন করাতে চায় নি৷ সেইজন্য লহরী চাওয়া সত্ত্বেও, জাহ্নবী নামে এক সেবিকা তার যত্নের দায়িত্ব ভার বহন করে৷ রোগীর শারীরিক অক্ষমতা, মনের উপর কতখানি প্রভাব বিস্তার করে, সেটা সেবিকা পেশার সঙ্গে যুক্ত হবার সাথে, নিকট বন্ধুই তা অনুভব করতে পারে৷ এমনকি সেবিকা জাহ্নবী, ভীষ্মের সাথে তার স্ত্রীর সম্পর্কের দূরত্বই যেন তৈরী হয়, সেরকমই চেষ্টা সে করে ৷

ডাক্তার, রোগীর শারীরিক অবস্থার খবরাখবর নেবার সাথে, রোগীর সঙ্গে দাবা খেলতেও মেতে থাকেন৷ ভীষ্মের এই দূর্ঘটনা ঘটার পর, পারিবারিক বন্ধু, প্রাক্তন পুলিশ অফিসার বাল্মিকী জেঠুও ভীষ্ম-অর্কের বিধবা মা শালিনীর পাশে কাছের বন্ধু হয়েই সঙ্গে ছিলেন ৷সম্পর্কের বাঁধন এতটাই মজবুত ছিল যে ,ভীষ্মের ওষুধের জায়গায় কয়টা অতিরিক্ত ওষুধ ছিল, তা শালিনীর নখদর্পণে ৷ জীবনের প্রতি নিরাশা তৈরী হলে, যদি রোগী তা খেয়ে ফেলে, তাই সেবিকা তা রোগীর নাগালের বাইরে রাখে৷ এমনকি,  ভীষ্মের মৃত্যুকে শালিনী খুন বলেই বারংবার জাহির করে৷ মধ্যরাতে, ভীষ্মের মৃত্যু রহস্যের কিনারা খুঁজতে গল্পের রহস্য বোঝাতে, আবহ সঙ্গীতের পরিবেশনে পাশ্চাত্যের মিশ্র সুরের ব্যবহার ঘটে৷ বাড়ির লোকজনেরা সেই রাতে, গোপনে এদিক ওদিক ছুটোছুটির প্রমান দেয়, বোবা চাকর পবিত্র৷ ভীষ্ম মৃত্যুর আগে, স্ত্রী, ভায়ের সাথে সেবিকা ও চাকরকেও তার সম্পত্তির অংশ দিয়ে গিয়েছিল ৷রহস্যের উৎঘাটন হল, অসুস্থ  অপারগ মানসিক যন্ত্রণায় কাতর ভীষ্মের নামের মধ্য দিয়েই ৷ মহাভারতে, ভীষ্মের যেরকম ইচ্ছামৃত্যু ঘটেছিল৷ সেই ভাবেই ‘মর্মকথা’ নাটকের গল্পের রহস্যের সমাধান ঘটাল এই নামটাই৷ দূর্ঘটনার পরে মায়ের কাছে ভীষ্ম ,আবদার রেখেছিল – যদি কখনো সে জীবন ত্যাগ করার সিন্ধান্ত নে, সেদিন সে তার মায়ের সাহায্য পাবে কিনা! সেদিন শালিনী দেব, ছেলেকে কথা দেয়, এবং সেই কথা রাখতেই, ছেলের হাতে তুলে দেয়- অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ৷

মূল ইংরেজী গল্পের কিছু কথা, code and code হয়ে, নাটকের বাংলা সংলাপের সাথে, মিশে যায়৷ প্রতিটি শিল্পী, নিজস্ব চরিত্রে স্বাতন্ততা বজায় রেখে, সাবলিল ভাবে গল্পটিকে জীবন্ত করে তোলে৷

ভীষ্মের চরিত্রে প্রলয় কুমার ঘোষ তার চরিত্রের পরিস্থিতি মোকাবিলার অস্থিরতা বেশ সাবলিল করে তুলেছেন৷ স্ত্রীর সাথে রোম্যান্টিক বাক্যালাভেও প্রেমের প্রকাশের সাথে, শারীরিক  অক্ষমতার অপরাধবোধ  চরিত্রে স্বাভাবিক ভাবে ফুটে উঠেছে৷ লহরী চরিত্রে সুব্রতা সাহা পুরো গল্পে প্রতিটি অবস্থায় চরিত্রের স্বাভাবিক প্রকাশের নিখুঁত অভিনয় দক্ষতা দিয়ে জীবন্ত করে তুলেছেন৷  অর্কের ভূমিকায়, কুমার সঞ্জয় সম্পর্কের টানাপোরেনে, আলাদাভাবে সাবলিল প্রকাশ ঘটিয়েছে৷ সঙ্গে, নিজ কন্ঠে গান গল্পের পরিস্থিতিকে আরও সুন্দর রূপ দেয়৷ শালিনী, বুলবুল বসাক মায়ের স্নেহ এবং পরিস্থিকে সামলাতে দৃঢ়তার প্রকাশ, দুয়ের মেলবন্ধন স্বাভাবিক প্রকাশ ঘটায়৷ মহুয়া ব্যানার্জী, জাহ্নবীর চরিত্রে সেবিকার চরিত্রকে উপস্থাপন করার সাথে, ভীষ্মের একনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে, চরিত্রে দৃঢ়তার প্রকাশ বেশ বলিষ্ঠ৷ বাল্মিকী চরিত্রে মানস চক্রবর্তী পারিবারিক প্রকৃত বন্ধু হিসেবে সেই চরিত্রের বিন্যাস আকর্ষণীয়৷ ডাক্তার রুপে প্রশান্ত দত্তের চরিত্রের দৃঢ়তা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে৷ সৌমেন্দ্র দাস এক বোবা পরিচারকের ভূমিকায় পবিত্রের অভিনয় বেশ সাবলীল৷ এই নাটকের আলো করেছেন সৈকত মান্না যা নাটকের গুণমান উন্নীত করেছে। আবহে রাজা ব্যানার্জী কাজ নাটকের ছন্দ ঠিক রেখেছে। মঞ্চ সজ্জায় অজিত রায়ও যথাযথ। সব মিলিয়ে এই নাটক বর্তমান বাংলা নাট্য চর্চায় দর্শক মনে রেখাপাত করেছে।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -