Wednesday, November 27, 2024
Wednesday, November 27, 2024
Homeসিনেমাফ্রাঁসোয়াত্রুফো; এক অবিস্মরণীয় প্রস্থান

ফ্রাঁসোয়াত্রুফো; এক অবিস্মরণীয় প্রস্থান

সুব্রত রায়

শুধু সমুদ্রের স্বর;অন্য কোনো শব্দ নেই। শুধু সমুদ্রের গন্ধ;অন্য কোনো স্পর্শ নেই।আমাদের আর্ত দিগন্ত রেখা জুড়ে বেজে ওঠে একটি বালকের হাহাকার ও পদধ্বনি। তারপর চরাচরের মৃদুতম অনুনয়ও থেমে গেলে যখন মোমের মত জ্বলে ওঠে হৃদয়,কবিতা জননের স্বাদ পাওয়া যায়। বাস্তবিক তিনি  আজ যখন মৃত্যুর গ্রীবার আড়ালে ওষ্ঠ রেখে স্বয়ং নির্বাক তখন বলা যায় ত্রুফো ছিলেন আমাদের মলিন সায়ান্যের সবচেয়ে আনন্দময় অতিথি। তাঁর চিত্রনাট্যে ধর্মবিশ্বাসের মতো ইন্দ্রিয়ঘন একটি শুদ্ধতার রং ছিল ও প্যারিস তাঁর প্রিয় শহরের পথে ও উদ্যানে ক্যামেরা সঞ্চালনে সেই আভা যা নিদ্রা ও কুসুমে আকর্ন থাকে।

নবতরঙ্গে তাঁর প্রধান সহযোগী জ্যাঁ লুক গোদারের সঙ্গে যদি তুলনা করি তবে দেখবো গোদারে যেখানে ধ্বংসের যন্ত্রনা ও উৎক্ষেপ, ত্রুফোতে সেখানে শৃঙ্খলা ও রেখার সংহতি। আমৃত্যু আমাদের আলোচ্য শিল্পী জানতেন চলচ্চিত্র নামক শিল্প মাধ্যমটির অস্ত্বিত্ব তাঁকে কৃতকর্মের সূত্রে প্রমান করে যেতে হবে। অন্তর্ঘাতকের ভূমিকা তাঁর নয়।একজন আধুনিক শিল্পী যদি তাঁর প্রকাশ মাধ্যমটিকে অখন্ড মন্ডলাকার নিয়ত সত্য বলে ভেবে থাকেন তবে তা রক্ষণশীল রুচিরই পরিচয় বহন করে। “ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ”ছবিতে অন্ততঃ ত্রুফো সুযোগ পেয়েছিলেন নিজেকে নিজের যাবতীয় দিনলিপিকে অস্ত্রপ্রচার করার। পরিবর্তে পেলাম মুগ্ধতার মায়া আবরণ। বুঝতে পারি সন্দেহের অধিকারকে এই শিল্পী প্রতিস্থাপিত করতে চান আচ্ছন্নতার দ্বারা। এক নিবিড় অস্তিক্যবোধ ত্রুফোর শিল্পকর্মের জরায়ু। অস্তিক্যতাই তাঁকে রক্ষা করে উৎকেন্দ্রিকতা থেকে,তাঁর প্রধান গৌরব এই যে চলতি শতকের দ্বিতীয় ভাগে ইতিবাচনের জন্য যে নৈতিক দর্প প্রয়োজন তা তাঁর ছিল আর আর জয়ের এই শিখর থেকেই ত্রুফোর পরাভব এর সূচনা।

প্রখর অনুশীলনে তিনি যে সৌন্দর্যের জন্ম দেন তা আমাদের ক্লান্ত করে না। সিনেমার খাতায় দুর্বিনীত পুরুষটি যখন সিনেমার পর্দায় নমনীয় হয়ে দেখা দেন তখন ভালো লাগে কিন্তু এত সহজে,এত অনায়াসে ভালো লাগে যে আহত হৃদয়ে মেনে নিতে হয় এ এক বিপর্যয়ের সঞ্চারপথ। অতীতের প্রতি ঈষৎ মনোনিবেশ করলে আমরা সবিস্মযে লক্ষ্য করবো যে “আর্টস” পত্রিকার যে উদ্ধত সমালোচক অবলীলায় বাতিল করে দেন জনৈক প্রাচ্যদেশীয় চলচ্চিত্র স্রষ্টার “পথের পাঁচালী” কিংবা বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে ওঠেন জন ফোর্ডের প্রতি, তিনিই অনাতিকাল পরে পরেই নির্মাণ করেন “ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ” – যা অবিশ্বে অভিনন্দিত, কিন্তু কোনো ক্রমেই প্রচলিত নন্দনত্ত্বতত্ত্বের আততায়ী নয়।

ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো নবতরঙ্গের গুরুত্বপূর্ণন পরিচালকদের একজন। লা পলিতিক দেশ অথর অর্থাৎ লেখক নীতির তত্ত্ব যিনি প্রচার করেছিলেন নিজের অনেক ছবিতেও তা তিনি প্রয়োগ করেছেন। তাঁর সমস্ত ছবির চিত্রনাট্যের লেখক বা সহলেখক তিনি নিজে। কম খরচে ছবি করার স্বপক্ষে অনেক বলেছেন ত্রুফো,যেহেতু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা তাতে কম বিপদজনক। তাঁর প্রথম ছবি  “ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ”(১৯৫৯) মাত্র আড়াই লক্ষ ফ্রাঁতে করা। জ্যাঁ লুক গদারের “ব্রেথলেস” ছবির মূল আইডিয়াটি ত্রুফোর। এছাড়া “ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ” ছবিটির কান এ পুরস্কার প্রাপ্তি ও “জুল এন্ড জিম”(১৯৬১)ছবির সাফল্য নবতরঙ্গকে আন্তর্জাতিক পাদপ্রদীপের সামনে এনেছিল। প্রকৃতপক্ষে ত্রুফোর প্রথম তিনটি ছবি “ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ “(১৯৫৯),”শুট দ্য পিয়ানো প্লেয়ার”(১৯৬০),ও “জুলস এন্ড জিম”(১৯৬২) এর কাহিনী,সম্পাদনা প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিশ্রমী পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ত্রুফোর শ্রেষ্ঠ ছবি বলা যায়।

এই নিবন্ধের উদেশ্য নয় ত্রুফোর অবমূল্যায়ন। তাঁর নির্মাণ সাফল্য নিয়েও আমার কোনো সংশয় নেই,তথাপি হুজুগপরায়ন শোকপ্রস্তাব লিখনেও যেহেতু নিযুক্ত নই,অত্যন্ত বিনয়ের সাথে আমাকে যোগ করতে হবে যে ত্রুফোর শিল্পী জীবনের ইতিহাস মূলত কাইয়ে দু সিনেমার নন্দনতত্ত্ব থেকে এক সফল পশ্চাদপসরনের ধরাবিবরণী।

প্রসঙ্গত “ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ” (১৯৫৯),stolen kisses(1968) ও “বেড এন্ড রোসেস”(১৯৭০)—-এই তিনটি ট্রিলজি বলা যায়। আত্মজীবনীমূলক কাহিনীর নায়ক আতোয়া এবং চরিত্রের রূপকার জ পিয়ের লিউড একই সূত্রে গাঁথা। কাইয়ে দু সিনেমান আর্টস এর পাতায় যে সংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছিল তার প্রত্যক্ষ পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত ঔপন্যাসিক-চলচ্চিত্রকার আস্ট্রুকের একটি প্রবন্ধে। আস্ট্রুকের কামনা ছিল চলচ্চিত্রের একটি সার্বভৌম আখ্যায়। অতঃপর আন্দ্রে বাঁজার মানসপুত্র ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো বিশেষ ভাবে অর্জন করলেন মিজ-অন-সিন এর নৈতিক বাস্তবতা ও ডিপফোকাস তত্ত্বের উত্তরাধিকার।

১৯৫৯ সালে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র প্ৰনতি জানাল ফ্রাঁন্সকে। ত্রুফো কান থেকে গ্রা প্ৰ জয় করলেন। অন্যদিকে এলা ল্যা রেনে ও জ্যাঁ লুক গদার দুই বিপরীতে মুখী প্রতিভা সম্ভব করলেন “হিরোশিমা মন আমুর”ও “ব্রেথলেস”এর মতো স্থায়ী শিল্পের সৃজন। কিন্তু যেভাবে” ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ”ছবিটির বন্দনা গাওয়া হয়েছে আজ পর্যন্ত নানা দিক থেকে,যেভাবে তা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে যে অন্য কোনো স্তব নিরর্থক মনে হয়। সন্দেহ নেই সর্বগুণান্বিত এই ছবি ও তার অবিশ্বাস্য বাণিজ্যিক সাফল্য কাইয়ের তরুণ যোদ্ধাদের সাহস ও মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়। তবে ত্রুফোর বন্ধুরা যাই বলুন না কেন এত বছর পরে একথাও বিতর্কের অতীত নয় যে ছবিটি মোটেই পরীক্ষামূলক বা বেপরোয়া নয়। প্রথার শ্রেষ্ঠ অনুবর্তন মাত্র। কিন্তু কেন এমন হলো?একজন বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী কেন প্রথম আবির্ভাবেই আপোষ রফা করে বসলেন। অথচ প্রায় একই সময়ে বানানো “ব্রেথলেস” বা  “হিরোশিমা মন আমুর” অনেক বেশি উচ্চাশাপরায়ন। গদার তাঁর প্রথম ছবিতেই দেখালেন গল্প বলার নিটোল দায় আর তার নেই,উন্মোচিত হলো জাম্পকাটের রাজসিক মহিমা।

ত্রুফোর বিরুদ্ধে আমার মুখ্য অভিযোগ যে তাঁর ছবিতে কোনো বিকৃতি ও অতিরঞ্জন নেই। প্রায় সর্বত্রই তা বাস্তবের সমানুপাতিক। ফিল্মের বাস্তবতা যে প্রথম পর্যায়ের নয়,বরং দ্বিঘাত,ত্রিঘাত বা আরো উচ্চ পর্যায়ের তা ত্রুফো বুঝতে চান না। “ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ”-এ চরিত্র চিত্রনে অনুপুঙ্খ নিষ্ঠা এবং গীতিকবিতার অসামান্য স্পর্শ দর্শককে বিব্রত বা চিন্তিত করে না, ঝাঁকুনি দেয় না। পরিবর্তে গঠিত হয় এক পেলব আত্মজীবনী। এঁকে দেয় মায়ান্জন।

ত্রুফোর “জুল ও জিম” ছবিতে ছুটির একটি অবারিত নিমন্ত্রণ আছে এখানে প্রকৃতিতে রেখা নেই। রাউল কুতরের ক্যামেরা জীবনের উপরিতল থেকে আলোর চিত্রকল্প উদ্ধার করে আনে। কিন্তু যে আঁধার আলোর অধিক—–ত্রুফো তাঁর খোঁজ পাননা। আর হয়ে ওঠে না বলেই ত্রুফো এই ছবির জন্য সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পান। আবার “ডে ফর নাইট”ছবিতে ত্রুফো বাস্তবের স্বাভাবিক উপস্থিতিরই পক্ষপাতী। এই ছবিতে জনৈক মুখ্য চরিত্র অত্যন্ত জরুরী একটি প্রশ্ন রাখে “Are films more important than life?” যেহেতু রক্তে ও মর্মে তিনি শিল্পী জীবনের প্রথম পর্ব থেকেই ত্রুফো নিজেই নিজেকে প্রশ্নটি করে চলেছিলেন। নিরাবরণ রক্ত পরীক্ষার ইশারায় সাড়া না দিয়ে ত্রুফো যে নান্দনিক নীরবতার আবহ গড়ে তুলেছিলেন তা খুব পলকা নয় অবশ্যই, কিন্তু প্রয়ানের আগেই জেনে গিয়েছিলেন কাইয়ের দলের মুখ্য সেনাপতি পদে তিনি আর বৃত নন। সেই সিংহাসনটি জ লুক গদারের জন্য সংরক্ষিত।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular