সুব্রত কাঞ্জিলাল
চরিত্র: এস্থার/ ব্রুনো/ ডাক্তার/ প্রথম নাজি অফিসার/
দুজন পাহারাদার বা গার্ড (কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পের)/ বিভিন্ন বয়সের কয়েকজন মহিলা যুবক বৃদ্ধ বন্দী।
জার্মান যুদ্ধ কনসার্ট কান ঝালাপালা করে দেওয়া বেশ কিছুক্ষণ বাজবে। পর্দা খুলে গেলে দেখা যাবে বন্দী শিবিরের কয়েকটি অংশ। প্রজেকশন মেশিনে সাদা পর্দায় দেখাতে হবে—হিটলার বাহিনীর মার্চ। হিটলারের বক্তৃতা। নাজিবাহিনীর কর্মকাণ্ড।
আকাশে বোমারু বিমান। স্থলে ট্যাংক বাহিনীর ক্রমাগত গুলি বর্ষ ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতা। ইহুদি নির্যাতনের
দৃশ্য। (ব্যাকগ্রাউন্ডে শব্দের মধ্য দিয়েও এইসব দৃশ্যকে উদ্ভাসিত করা যায়)
অন্ধকার মঞ্চে একজন কথক আসবেন। এই চরিত্রটি কোন বেটে মানুষকে দিয়ে হবে না। কণ্ঠস্বর ভাল হতে হবে। এই অভিনেতা পরে ডাক্তারের ভূমিকায় যেতে পারে।
কথক।। আমরা প্রস্তুত। মঞ্চ প্রস্তুত। দলের অভিনেতারা প্রস্তুত। আপনারাও কনসেনট্রেট করুন। একটা গল্প বলবো। পুরনো গল্প। তবে এ গল্পের মৃত্যু নেই।
(আবহ সঙ্গীত আসবে। জার্মান symphony! কথক স্থান পরিবর্তন করবে)
কথক।। প্রেমের গল্প! যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে এক জার্মান যুবক ও যুবতীর প্রেমের গল্প! এই প্রেম গড়ে উঠেছিল বন্দী শিবিরের অন্ধকারে! (আবার স্থান পরিবর্তন ও সংগীত চলবে)
কথক।। আমরা অনেক রকম প্রেমের গল্প শুনেছি। সিনেমা থিয়েটারে দেখেছি। রোমিও জুলিয়েট, সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্প। আমাদের এই গল্পের পটভূমি জার্মানির ইহুদি নির্যাতন ক্যাম্প। যাকে বলা হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। সময় ১৯৩৭ সাল! জার্মানির ফুয়েরার অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধান হিটলার সমস্ত পৃথিবী দখল করবার উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে। প্রতিদিন ইউরোপ আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হচ্ছে। একটার পর একটা বড় বড় শহর শ্মশানে পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে হিটলারের জার্মানির অধিকৃত কয়েকটি অঞ্চলে বড় বড় কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছে লক্ষ লক্ষ ইহুদী কমিউনিস্ট আর গণতন্ত্রপ্রেমীদের। প্রতিটি কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সঙ্গে রয়েছে বড় বড় গ্যাস চেম্বার। সেই গ্যাস চেম্বারে এইসব বন্দীদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। আমাদের এই গল্পের প্রেমিকা এস্থার । এরকম একজন বন্দী ইহুদি যুবতী। আর তার প্রেমিক ব্রুনো অটো বিখজ এই বন্দী শিবিরের একজন কর্মচারী।
আবার আবহ সংগীত বেজে উঠবে।
দেখা যাবে সেন্ট্রি দুজন বন্দি শিবিরের বন্দীদের চাবুক মারতে মারতে বার করে আনলো। অনাহারে, নানা রকম অত্যাচারে বন্দীরা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। অনেকে জল চাইছে। কেউ কেউ খাবার চাইছে। সেন্ট্রি দুজন তাদের লাইনে সোজা হয়ে দাঁড়াবার জন্য অত্যাচার করে যাচ্ছে। একজন গার্ড বাঁশি বাজিয়ে ওই বন্দী গুলোকে প্যারেড করার জন্য নির্দেশ দিল।
সেন্ট্রি/১।। লাইন লাইন লাইনে দাঁড়াও। সোজা হয়ে-
শুয়োরের বাচ্চা- ইহুদির বাচ্চাগুলোকে ইচ্ছে করছে এইখানে গুলি করে মারি!
সেন্ট্রি/২।। এ গুলো জার্মানির কলঙ্ক। আর্য রক্তের শত্রু।
এদের এত সহজে মরতে দেওয়া যাবে না।
এক নম্বর।। প্যারেড করিয়ে করিয়ে তেল বার করতে হবে। কুইক মার্চ। লেফট রাইট-লেফট রাইট-
বীভৎস ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে। কেউ তাল মিলাতে পারছে না। সেন্ট্রি গুলো গালাগালি করছে। চাবুক চালাচ্ছে। বুড়ো মানুষগুলো হুমরি খেয়ে পড়ছে।
এমন সময় একজন অফিসারের সঙ্গে ডাক্তার আসবে। বন্দী গুলোকে পর্যবেক্ষণ করবে। অফিসার কে অনেকটা হিটলারের মতো দেখতে। উন্মাদের মতো আচরণ করে।
ডাক্তার।। এদের থেকেও রক্ত বার করতে হবে?
অফিসার।। আপনার আপত্তি আছে নাকি?
ডাক্তার।। আমার আপত্তি কে শুনছে। আপনার মতন আমিও একজন জার্মান নাগরিক।
অফিসার।। তার আগে বলুন আমাদের ফুয়েরার এডলফ হিটলারের অনুগত কর্মচারী আমরা।
ডাক্তার।। নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। তবে আমি একজন ডাক্তার। ডাক্তারি পাস করবার পর ওথ নিতে হয়েছিল। বলতে হয়েছিল আমি আর্ত মানুষের জন্য নিবেদিত। আমার দায়বদ্ধতা শুধুমাত্র অসুস্থ মানুষের কাছে।
অফিসার।। আপনি কি এদের মানুষ বলেন? এরা হচ্ছে দেশদ্রোহী। জার্মান জাতির শত্রু। ফুএরার এডলফ হিটলারের চোখে এরা শয়তানের বংশধর। জারজ।
ডাক্তার।। সবই বুঝলাম। বলছিলাম যে, এদের চেহারা দেখে আমি তো বুঝতে পারছি না কিভাবে এদের শরীর থেকে রক্ত টেনে নেব। বরং এদের বাঁচানোর জন্য এদের রক্ত দিতে হবে।
অফিসার।। বাজে কথা না বলে ডু ইওর ডিউটি। আর একটা কথা এদের বাঁচার কোন অধিকার নেই। তাছাড়া কেন বুঝতে পারছেন না যে, আমাদের এই কানন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে গত মাসে যত বোতল রক্ত সাপ্লাই হওয়া র কথা ছিল, সেটা আমরা পারিনি।
অনেকটাই ঘাটতি থেকে গেছে। আগামী সাত দিনের মধ্যে ঘাটতি পূরণ করতে না পারলে আমার চাকরি থাকবে না। আপনারটাও খতম–বুঝলেন ?
ডাক্তার।। একজন ডাক্তার হয়ে আমি যদি বলি, একজন মানুষের শরীর থেকে যতটা পরিমাণ রক্ত বার করা দরকার তার থেকেও বেশি রক্ত আমরা অলরেডি বার করে ফেলেছি। এরপর দেখা যাবে-
অফিসার।। আর কোন দেখাদেখির ব্যাপার নেই। তাছাড়া আপনি কেন হেজিটেট করছেন বলুন তো? এদের হয়তো কাল কিংবা পরশু গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। তার আগে যতটা পারেন ব্লাড টেনে নিন।
ডাক্তার।। ওকে।
অফিসার।। আর দেরি করবেন না। কাজ শুরু করুন।
মঞ্চের একটা বিশেষ জায়গায় সেটা উচুমত হলে ভালো হয়। সেখানে গিয়ে ডাক্তার তার যন্ত্রপাতি নিয়ে বসবে। সেন্ট্রি এক একজন বন্দীকে টেনে হিচরে সেই জায়গায় পাঠিয়ে দেবে। ডাক্তার সেই মানুষটার শরীর থেকে রক্ত বার করতে থাকবে। রক্ত টেনে নেওয়া মানুষগুলোকে সেন্ট্রি টেনে হিঁচড়ে অন্যত্র সরিয়ে দেবে।
ব্রুনো আসবে রক্তের বোতল নিতে।
ব্রণ।। (অফিসার কে হিটলারী কায়দা অভিবাদন করবে) হাইল হিটলার।
অফিসার।। গাড়ি এসে গেছে?
ব্রুনো।। ইয়েস স্যার।
অফিসার।। তোমার ডিউটি কোথায় পড়েছে?
ব্রুনো।। চার নম্বর ক্যাম্পে।
অফিসার।। তোমার এগেনস্টে বেশ কিছু কমপ্লেন এসেছে। তুমি কি জবাব দিতে পারবে?
ব্রুনো।। কি কমপ্লেন স্যার?
অফিসার।। তুমি নাকি এইসব ইহুদির বাচ্চাদের সঙ্গে মেলামেশা করো। সিমপ্যাথি ক্রিয়েট করছ।
ব্রুনো।। কে বলেছে স্যার?
অফিসার।। তোমাদের কলিগ।
ব্রুনো।। বুঝতে পেরেছি। কমপ্লেইনার আমার কাছে আবদার করেছিল, একটা ইহুদি মেয়ে তার চাই। গত সপ্তাহে যে দলটা এসেছে তাদের মধ্যে একটা ষোলো বছরের মেয়ে আছে। সেক্সি। চার্মিং গার্ল। আমি বলেছিলাম, ওটা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া জানাজানি হয়ে গেলে আমার চাকরি যাবে।
অফিসার।। হুম । বি কেয়ারফুল ব্রুনো, এইসব ইহুদিদের প্রতি কোন রকম সহানুভূতি দেখানো যাবে না। আমাদের ফুয়েরার বলেন, ইহুদীরা মানব জাতির শত্রু। আর্য জাতির প্রতিদ্বন্দ্বী। এদের নিকেস করতে না পারলে জার্মানি কলঙ্কমুক্ত হবে না।
ব্রুনো।। এদের নিকেস করতে আর কতদিন লাগবে?
আমি তো শুনেছি প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ ইহুদি কে গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অফিসার।। সংখ্যাটা দিনকে দিন বাড়ছে। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কেউ জানে না। এই যে ডাক্তার কত বোতল হল? ওদিকে যে গাড়ি এসে গেছে।
ব্রুনো।। খুব তাড়া দিচ্ছে।
ডাক্তার।। একটা বোতল নিতে পারলাম কোনরকমে।
অফিসার।। সে কি। আজও ঘাটতি। কম করে ছয় বোতল পাঠাতে না পারলে পর আমার চাকরি থাকবে না।
ডাক্তার।। তাহলে আমার থেকে পূরণ করতে হবে। এই যে দেখছেন আমার সামনে একটা বুড়ো রয়েছে, এর শরীরে ভেন পাওয়া যাচ্ছে না। বারবার ছুচ ফোটাচ্ছি।
যদি ভেন পাওয়া যায়, —
অফিসার।। ইউ আর গুড ফর নাথিং। আপনি নিজের চাকরিটাও খাবেন। একটা কিছু ব্যবস্থা করুন। ছ বোতল আমার চাই।
এমন সময় একজন সুন্দরী যুবতী এস্থার বাইরে থেকে ছুটে এলো।
এস্থার।। ডাক্তার, এই এই বুড়ো মানুষটাকে ছেড়ে দিন। আপনি আমার থেকে রক্ত নিন।
ডাক্তার।। সেকি তুমি তো গত পরশু দিয়েছো। আজ কি করে নেব?
এস্থার।। যেমন করে আখ মারাই কলে ফেলে আখের রস নিংড়ে নেওয়া হয়। সেই ভাবে নেবেন।
ব্রুনো।। না না। এটা সম্ভব না।
অফিসার।। কেন সম্ভব না? ও যখন বলছে-তাছাড়া ওর শরীর তো বেশ সুস্থ। দেখে মনে হচ্ছে রক্তের সমুদ্র বইছে ওর ধমনী তে। আপনি ওই মেয়েটার থেকে রক্ত বার করুন। আজ ছ বোতল আমার চাই।
এস্থার।। হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার কিছু হবে না। বৃদ্ধ মানুষটাকে আরো কিছুদিন বাঁচতে দিন। ও এখনো শ্বাস নিচ্ছে। আর কয়েকটা দিন বাঁচতে দিন।
ডাক্তার।। তুমি কেন বুঝতে পারছ না যে, এটা আমি পারিনা। ডাক্তারি এথিক্স এটা বলে না।
ব্রুনো।। আপনি ঠিক বলেছেন ডাক্তার।
অফিসার।। আই ওয়ান্ট টু নো, আপনি এথিক্স নিয়ে জল খাবেন? চাকরি বাঁচাতে পারবেন?
ডাক্তার।। কিন্তু আমি বলছি-এই মেয়েটার এখনো অনেক দিন বেঁচে থাকা সম্ভব। ওকে এইভাবে আমি মরতে দিতে পারি না।
এস্থার।। আমি বাঁচবো ডাক্তার। আমাকে এখনো অনেক দিন বাঁচতে হবে। আমি এভাবে মরতে পারবো না। আমাকে বাঁচতেই হবে। পৃথিবীর আরো অনেক কিছু দেখার জন্য বাঁচতে হবে।
ব্রুনো।। নিশ্চয়ই। এই বুড়ো লোকগুলো অনেকদিন বেঁচে আছে। এরা মরে গেলে কোন ক্ষতি হবে না। আপনি এই মেয়েটার কথা শুনবেন না।
অফিসার।। তাছাড়া এতদিন আপনি এখানে যা করছেন মানে যদি বলি করতে বাধ্য হচ্ছেন তার মধ্যে এথিক্স কোথায়?
ডাক্তার।। দ্যাটস রাইট। আমাকে বাধ্য করা হয়েছে এখানে ডাক্তারি করতে। ভুল বললাম। আগে ডাক্তারি করতাম। এখানে আমাকে পাঠানো হয়েছে —কসাইগিরি করতে। কসাইয়ের এথিক্স থাকতে পারে না।
অফিসার।। নো আর্গুমেন্ট। ডু ইট নাউ। আপনার কাজ এক্ষুনি শেষ করুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার এখনই ছ’বোতল রক্ত দরকার। ওই শুনুন গাড়িটা হর্ন দিচ্ছে। কেন অযথা বিতর্ক করছেন? হোয়াই? Why? (চিৎকার পাগলামি শুরু করবে)
শেষ পর্যন্ত ডাক্তার বাধ্য হয় মেয়েটার শরীর থেকে রক্ত বার করতে। ব্রুনো সেখান থেকে সরে আসে। সে কিছুতেই মেয়েটাকে আড়াল করতে পারল না। প্রায় অপ্রকৃতস্থ র মতো অফিসার একটা রক্তের বোতল নিয়ে মঞ্চের সামনে চলে আসবে।
অফিসার।। কে বলেছে ওদের শরীরে রক্ত নেই? কে বলেছে এরা রক্তশূন্য? এইতো টকটকে লাল রক্ত! গরম গরম রক্ত! ফুয়েরার বলেন, আমাদের এখন কোটি কোটি বোতল রক্তের দরকার। ওয়ার ফ্রন্টে জার্মান সোলজাররা পৃথিবী দখল করবার জন্য যুদ্ধ করছে। ওদের জন্য দরকার রক্ত। লক্ষ্য লক্ষ্য বোতল রক্ত। আর তাই দেশের শত্রু, দেশদ্রোহী জারজ ইহুদীদের শরীর থেকে রক্ত বার করতে হবে। ওদের রক্ত দিয়ে আমাদের সৈনিকরা বাঁচবে। কিন্তু এই সব ইহুদিদের মেরে ফেলতে হবে।
ব্রুনো।। কিন্তু স্যার, এই রক্ত তো দূষিত। আর্য জার্মান রক্তের মত বিশুদ্ধ নয়। এরা শয়তানের বংশধর।
এদের রক্ত শোষণ করে বীর জার্মান আহত সৈনিকদের বাঁচানো যাবে?
অফিসার।। ইউ স্টপ ইট। যা বোঝনা তা নিয়ে কথা বলছো কেন?
ব্রুনো।। বুঝিনা বলেই তো জানতে চাইছি। প্রশ্ন করছি।
লক্ষ লক্ষ ইহুদী আর কমিউনিস্টদের আমরা বন্দী শিবিরে প্রতিদিন পাঠিয়ে দিচ্ছি। কারণ ওরা জার্মান রাষ্ট্রের কাছে ভয়ংকর বিপদ। ওদের বাঁচার অধিকার নেই।
অফিসার।। ১০০ বার। হাজারবার কথাটা সত্যি।
ব্রুনো।। আমাদের ফুয়েরার এডলফ হিটলার বলেন,আমরা পৃথিবী শাসন করব। সমস্ত অনার্য জনজাতিকে পায়ের নিচে ক্রীতদাসের মতো রাখতে হবে। তবে একটা প্রশ্ন ছিল-
অফিসার।। তোমাকে হাজারবার বলা হয়েছে, প্রশ্ন করবে না। আমাদের ফুয়েরার প্রশ্ন পছন্দ করেন না।
তাইতো তিনি কোন সাংবাদিক সম্মেলন করেন না। তিনি শুধু বলেন। আদেশ করেন। নির্দেশ করেন।
তুমি কি অন্ধ, জার্মানির সমস্ত রকম মিডিয়া নতমস্তকে ফুয়েরার প্রতি অবিচল আস্থা পোষণ করে প্রতিদিন প্রশস্তি প্রকাশ করে যাচ্ছে। কি হলো ডাক্তার? আরতো অপেক্ষা করা যাচ্ছে না।
ডাক্তার।। এই মেয়েটার থেকে পাঁচ বোতল রক্ত বার করা যাবেনা। আমাকে যদি ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করাতে হয় আমি প্রস্তুত। তবুও আমি চাকরি বজায় রাখার জন্য এটা করতে পারবো না।
অফিসারটি উন্মোদের মতো আচরণ করতে থাকে।
অফিসার।। আমার তো এখন সন্দেহ হচ্ছে, আপনিও কি দেশদ্রোহীদের সঙ্গে তলে তলে যোগাযোগ রেখে চলছে ন। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে জানাবো, আপনার বংশ পরিচয় জানতে। আপনিও কি ছদ্দবেশী ইহুদি? (চিৎকার করতে করতে মৃগী রোগীর মত আচরণ করতে করতে মাটিতে গড়িয়ে পড়বে)
আলোর পরিবর্তন ঘটবে। দৃশান্তর।
রাত। ফুটফুটে জোসনা। পাহারাদার রা সেলের বাইরে
পাহারা দিচ্ছে। এস্থারকে দেখা যাবে গড়াদের ভেতরে দাঁড়িয়ে কাউকে যেন খুঁজছে।
প্রহরী।। এই যে মেয়ে, এখনো এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
এস্থার।। আজ বুঝি সারারাত তোমার ডিউটি?
প্রহরী।। হ্যাঁ। তাতে তোমার কি?
এস্থার।। তেমন কিছু না। মানে–
প্রহরী।। বুঝেছি। কারো পথ চেয়ে আছো। কি লাভ বলো তো? ভুল স্বপ্ন দেখা ঠিক না!!!
এস্থার।। যতদিন বাঁচবো ততদিন স্বপ্ন দেখতে দেখতে
বাঁচবো।
প্রহরি।। কি যে ছাই এত স্বপ্ন দেখো। আমি তো কিছুই দেখতে পাই না। চারিদিকে শুধু অন্ধকার। যুদ্ধ গোলা বারুদ এর দমবন্ধ করা অন্ধকার।
এস্থার।। তোমার সংসার নেই? বউ ? ছেলে মেয়ে?
প্রহরী।। সবই ছিল। এখন কেউ নেই।
এস্থার।। কোথায় গেল তারা?
প্রহরী।। তুমি কি আমার চাকরিটা খেতে চাও?
এস্থার।। এতে চাকরি যাবার কি আছে!
প্রহরী।। জার্মানিতে এখন কেউ যেমন স্বপ্ন দেখেনা। প্রশ্ন করাও বারণ। তাছাড়া তোমাদের মত বন্দীদের সঙ্গে কথা বলার আইন নেই। আমাকে বিরক্ত করবে না। (চলে যাবে। একটু দূরে যাবে তার মুখোমুখি হবে আর একজন সেন্ট্রি।)
দ্বিতীয়।। মাগীটার সঙ্গে কি কথা হচ্ছিল?
প্রথম।। তেমন কিছু না।
দ্বিতীয়।। আমি তো শুনলাম
প্রথম।। তাহলে জিজ্ঞেস করছিস কেন?
দ্বিতীয়।। মাঝে মাঝে ফুসুর ফুসুর করিস। আমাদেরকে তো পাত্তা দেয় না মাগীটা।
প্রথম।। কথা বলার চেষ্টা করিস না। কামড়ে দেবে। (এবার
ব্রুনোকে দেখা যাবে এগিয়ে আসতে)
ব্রুন।। ওই সেলের চাবিটা কার কাছে?
দ্বিতীয়।। চাবি? চাবি দিয়ে কি হবে?
ব্রুনো।। প্রশ্ন না করে যাবি টা চাইছি থাকলে দে।
প্রথম।। আমার কাছে রয়েছে। প্রয়োজনটা কি জানতে পারি?
ব্রুনো।। ওই মেয়েটার সঙ্গে শুতে হবে।
দ্বিতীয়।। তুই একা শুবি?
ব্রুনো।। ক্যাম্প কমান্ডার আগে শোবে। কথা না বাড়িএ চাবিটা দে। মেয়েটাকে এক্ষুনি নিয়ে যেতে হবে।
দ্বিতীয়।। কমান্ডার এর কাছে?
ব্রুনো।। দেখতেই পাবি।
দ্বিতীয়।। একটা কথা বলব। আমরা আগে মেয়েটাকে চাটতে পারি না?
ব্রুনো।। ঠিক আছে। কথাটা কমান্ডারকে গিয়ে বলছি-
দ্বিতীয়।। এই না না তুই কি খেপেছিস। এসব কথা কমান্ডার এর কানে তুললে–সর্বনাশ হয়ে যাবে।আমি ইয়ার্কি মারছিলাম! তুই সিরিয়াসলি নিয়ে নিলি! তুই না- (ভয় পালাবে)
প্রথম প্রহরী চাবিটা দেবে ব্রুনোকে
প্রহরী।। এই শেষ বার। আর কোনদিন এভাবে চাবিটা চাইবি না। তুই কি আমাকে-মারতে চাস?
ব্রুনো।। তুই থাকতে আমার কি ভয়! আর আমি যতক্ষণ আছি তোর গায়ে কেউ টাচ করতে পারবেনা!
তবে আমি যতক্ষণ ওদিকে থাকবো, তুই লক্ষ রাখিস।
চাবিটা নিয়ে ব্রুনো সেলের কাছে চলে যাবে। মেয়েটাকে বাইরে নিয়ে আসবে।
প্রহর।। দুটোই মরবে। ঈশ্বর ও বাঁচাতে পারবে না।
এস্থার।। আজকে তোমাকে কি রোমান্টিক লাগছে!
এত দেরি করলে কেন? আমি সেই কখন থেকে তোমার জন্য গড়াদের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছি।
ব্রুনো।। তুমি আবার রক্ত দিতে গেলে কেন?
এস্থার।। নইলে বুড়োটাকে বাঁচানো যেত না।
ব্রুনো।। তোমাকে একটা কথা কিছুতেই বুঝাতে পারছি না এস্থার, আমার জীবন এখন নির্ভর করছে তোমার জীবনের উপর। এভাবে প্রতিদিন তুমি যদি শরীরের সব রক্ত নিঃশেষ করে দাও—
এস্থার।। তখন তুমি তোমার রক্ত দিয়ে আমাকে বাঁচাবে।
ব্রুন।। তুমি যেভাবে এগোচ্ছ মৃত্যুর দিকে, তোমাকে বাঁচাবার কোন সুযোগ আমি পাব না। তাছাড়া আমাদের সম্পর্ক জানাজানি হয়ে গেছে। আমাদের কমান্ডারের কাছেও চলে গেছে। এরপর হয়তো আমাদের আর কোনদিন মুখোমুখি দেখা হবে না।
এস্থার।। তারমানে আজই শেষ রাত।
ব্রুনো।। হয়তো। আমাদের ক্যাম্পের বেশ কিছু স্টাফ কে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কাল-পরশু যদি আমাকেও সরিয়ে দেয়! আশা করছি দু-তিন দিনের মধ্যে নতুন স্টাফ চলে আসবে। তার আগে আমাদের দুজনকে এখান থেকে পালাতে হবে।
এস্থার।। পালাতে হবে?
ব্রুনো।। হ্যাঁ। পালাবো। সব ব্যবস্থা করেছি। এখানকার ডাক্তারবাবু আমাদের পক্ষে রয়েছে। আরো দু একজন আমাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে।
এস্থার।। কোথায় পালাবো? গোটা দেশটাই তো জেলখানা! তাছাড়া এই ক্যাম্পের আমার সহযাত্রী অন্য বন্দীদের ফেলে কিভাবে যাব?
ব্রুনো।। আমরা অন্য দেশে পালিয়ে যাব। যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
এস্থার।। আমরা আবার ধরা পড়ে যাব। গেস্টাপো বাহিনী আমাদের ধরে ফেলবে
ব্রুনো।। তুমি কি মনে কর, আমি সমস্ত রকম খবরাখবর না নিয়ে পালাবার পরিকল্পনা করেছি। শোনো, পৃথিবী জয় করতে নেমে হিটলার ইউরোপের অনেকগুলো দেশ দখল করে নিয়েছে। ইউরোপের অনেকগুলো দেশে ফ্যাসিবাদী সরকার কায়েম হয়েছে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পোল্যান্ড, এমন অসংখ্য দেশের পতন ঘটে গেছে। কিন্তু হিটলার সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করতে গিয়ে এখন বিপদে পড়ে গেছে। আফ্রিকাতে জার্মানির পরাজয় ঘটে গেছে। যুদ্ধের চেহারা চরিত্র বদলে গেছে। আমেরিকা ইংল্যান্ড রাশিয়া আরো অনেকগুলো দেশ মিত্র শক্তি তৈরি করেছে। আমাদের দেশের মধ্যেও এখন বিশৃঙ্খলা চরম আকার নিয়েছে। হিটলারের নাজী বাহিনীর মধ্যে চরম বিরোধ দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। ৩-৪ বার হিটলার কে বিভিন্ন সময় খুন করবার চেষ্টা হয়েছে। ডাক্তারবাবু সেদিন বলছিলেন, জার্মানির পতন অবশ্যম্ভাবী। আমাদের পালাবার পক্ষে অনুকূল সময় এখন।
এস্থার।। এক এক সময় মনে হয় তুমি কি করে এখনো সরকারি চাকরি বজায় রেখেছো। তুমি কি সত্যি সত্যি
হিটলারের সমর্থক নও?
ব্রুনো।। তুমি কি মনে কর নাজি বাহিনীর মধ্যে বা সরকারের পুলিশ গেস্টাপো, গোয়েন্দা মিলিটারি তে যারা চাকরি করে তারা সবাই হিটলারের সমর্থক!
উন্মাদ হিটলারের ইহুদি বিদ্বেষ মেনে নিচ্ছে? একেবারেই না। অনেকের মোহ ভঙ্গ হয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে যতদিন আছে এই দলটা, দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে।
এস্থার।। আমার বাবাও তোমার মত কথা বলতো। একটা মিথ্যাকে বারবার প্রচার করলে মানুষ একটা সময় মনে করে ওটাই বুঝি সত্যি। মিডিয়ার অনবরত মিথ্যা প্রচার জার্মানির সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে দিয়েছিল। তাই তারা বিশ্বাস করেছিল হিটলার কে। কিন্তু একটা মিথ্যাকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা যায় না। আচমকা একদিন আমাদের বাড়িতে গেস্টাপো
বাহিনী ঢুকে পড়েছিল। আমার চোখের সামনে আমার বাবা মাকে গুলি করে মেরেছিল। কেন জানিনা ওরা আমার গায়ে হাত দেয় নি। আমাদের পাড়ার আরো অনেক ইহুদি পরিবারকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে তুলে নিয়ে এসেছিল এখানে। সেই দলটার মধ্যে ইউনিভার্সিটি র নাম করা প্রফেসর ছিল। ডাক্তার ছিল। ইঞ্জিনিয়ার লেখক বুদ্ধিজীবিরাও ছিল। এরা কেউ রাজনীতি করত না। খুব সাধারণ মানুষ।
ব্রুনো।। আমিও রাজনীতি বুঝিনা। আমাদের পরিবারও ছিল ব্যবসায়ী পরিবার। অর্থনৈতিক মন্দার বাজারে পারিবারিক ব্যবসা ফেল করে । আমাদের মতন আরও অনেক যুবককে নাজি বাহিনীতে যুক্ত হতে বাধ্য করা হয়েছিল। এতদিন শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য চাকরিতে টিকে আছি। তোমার সঙ্গে দেখা না হলে হয়তো বাকি জীবনটা এই ভাবেই কেটে যেত।
এস্থার।। তাই যদি হয়, তাহলে এভাবে পাগলামি করছ কেন? পালাবার কথা ভাবছো কেন? ভালোবাসা কখনো পালিয়ে বাঁচতে পারে না!! কোন আগুনের সাধ্য নেই ভালোবাসাকে পোড়াতে পারে! দাউ দাউ আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভালোবাসা শুদ্ধ হয়ে ওঠে! পবিত্র হয়ে ওঠে! ভালোবাসা দুর্যোগকে ভয় পায় না।
ব্রুনো।। তোমার কথা বইয়ে পড়া কথার মত। বাস্তবে তার সঙ্গে কোন মিল নেই। বাস্তবটা বড় কঠিন।
কবিতা আর কল্পনার জগত নিয়ে বাস্তবের মাটিতে বেঁচে থাকা যায় না।
এস্থার।। তাহলে জানতে চাইবো, আমাকে তুমি ভালবাসলে কেন? কি দেখেছো তুমি আমার মধ্যে? একটা সেক্সি শরীর? যে শরীরটাকে বিছানায় ফেলে উল্লাস করা যায়! বিকৃত কাম্ চরিতার্থ করা যায়! যৌন উন্মাদ হয়ে ওঠা যায়? এটাই যদি ভেবে থাকো তাহলে কেন বুঝতে পারছ না, তোমার বাস্তবতা কেন তোমাকে বুঝতে দিতে চাইছে না, আমার শরীরটাকে নিয়ে খেলা করবার কোন সুযোগ তুমি পাবে না। এই যে মানুষ মারবার জন্য কনন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প, গ্যাস চেম্বার এখানে প্রতিদিন মনুষ্যত্বের মৃত্যু ঘটে। বিশ্বাস আর নির্ভরতার গলা টিপে মারা হয়। তুমি নিশ্চয়ই জানো যে গ্যাস চেম্বার ে আমাকেও ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। আমার এই শরীরটা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
ব্রুনো।। এই একই প্রশ্ন আমিও তোমাকে করতে পারি।
কি দেখেছো তুমি আমার মধ্যে? একটা শক্ত সবল পুরুষালী শরীর? মেয়েরা যাকে বলে হ্যান্ডসাম! সেক্সি বডি! অথচ আমি ইহুদী নই! কমিউনিস্ট নই! আসলে আমি একজন হিটলারের নাজি বাহিনীর সদস্য। এই কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পের কর্মচারী। তুমিই বা আমার কাছ থেকে কি প্রত্যাশা করো?
এস্থার।। ভালোবাসা। মনুষ্যত্ব। বিশ্বাসের নির্ভরতা।
ব্রুনো।। এইরকম নরকের অন্ধকারে? (তুমুল হাসি) ভালোবাসা!!! বিশ্বাস!!! মনুষ্যত্ব!!!
এস্থার।। আমার চোখ তোমার মধ্যে আরও অনেক কিছু আবিষ্কার করেছে।
ব্রুনো।। তাই নাকি! তা কি কি আবিষ্কার করলে তুমি?
এস্থার।। তোমাকে বলে লাভ নেই। তুমি বুঝতে পারবে না। তোমার মস্তিষ্কের কল কব্জা গুলো জট পাকিয়ে গেছে।
ব্রুনো।। অস্বীকার করছি না। আমি এখন একটা কথাই শুধু ভাবছি এই নরক থেকে তোমাকে কি করে উদ্ধার করব।
এস্থার।। তোমার ভাবনায় একটু ভুল আছে। আমি একা উদ্ধার পেতে চাই না। এখানে আমি ছাড়াও আরো অনেকগুলো মানুষ রয়েছে। তারাও উদ্ধার পেতে চায়। বাঁচতে চায়। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বুকভরে শ্বাস নিতে চায়।
ব্রুন।। তুমি কেন বুঝতে পারছ না, সেটা এই মুহূর্তে সম্ভব না।
এস্থার।। তাহলে আমাকে সেই চরম মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হবে।
ব্রুনো।। কি বলছো তুমি!!!
এস্থার।। আমাদের দুজনকেই সেই চরম মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হবে ব্রুনো। আমাদের জানতে হবে, আমাদের আবিষ্কার করতে হবে, এই যে আমরা বারবার ভালোবাসার কথা বলছি, এটা কতটা সত্যি। বুঝে নিতে হবে এটা মোহ নাকি বাইরের আকর্ষণ?
ব্রুন চুপ করে থাকে। ভেতরে ভেতরে তার যন্ত্রণা তাকে কুঁড়ে কুরে খাচ্ছে। সে কিছুতেই বুঝাতে পারছে না যে এস্থারকে এই মুহূর্তে বার করে নিয়ে যেতে না পারলে সামনে ভবিষ্যৎ ভয়ংকর।
এস্থারও চুপ করে ব্রুনোকে বোঝার চেষ্টা করে। ব্রুনোর চারিদিকে ঘুরতে থাকে। তারপর হেসে ফেলে। ওদিকে গার্ড একবার এদিকে এসে সংকেত দিয়ে যায়। ব্রুনো উপেক্ষা করবে।
এস্থার।। (খিলখিল হাসি) একেই বলে পূর্ব রাগ! আমি ভারতীয় কবি কালিদাসের কাব্য পড়েছি। মেঘদূতম। সেখান থেকেই জেনেছি পূর্ব রাগের পরে আসে অনুরাগ। আর তারপরেই বিরাগ (হাসি) তোমার এখন যা অবস্থা দেখছি, তুমি পূর্বরাগের আগুনে পুড়ছো।
ব্রুনো।। হ্যাঁ হ্যাঁ আমি পুড়ছি। সর্বাঙ্গে এক ধরনের জ্বালা। এই যন্ত্রণা কাউকে বোঝানো যাবে না।
এস্থার।। তাহলে তুমি ঠিক জায়গাতেই আছো। পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয়ে উঠতে হবে। তারপরেই আসবে ভালোবাসার সিদ্ধি লাভ।
এস্থার এগিয়ে এসে আলতো করে ব্রুনোর কপালে চুম্বন এঁকে দেবে। ব্রুনো চঞ্চল হয়ে উঠবে। এস্থার কে জড়িয়ে ধরবে। আরো কিছু দূর-
এগিয়ে যাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু এস্থার খুব শান্তভাবে নিজেকে সরিয়ে নেবে। হাসতে থাকবে। গান ধরবে। German love song হতে হবে। গানটা ব্যাকগ্রাউন্ডে আসবে। গানের সঙ্গে এস্থার নাচবে।
অন্যদিকে সেই প্রহরী অর্থাৎ গার্ড টর্চএর সিগন্যাল দেখাচ্ছে। দ্রুত মেয়েটাকে সেলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে ব্রুনো তালা ঝুলিয়ে দেবে।
দেখা যাবে ডাক্তারবাবু এগিয়ে আসছেন।
ব্রুনো।। আপনি!! আমি ভাবলাম ক্যাম্প অফিসার!!!
ডাক্তার।। খুব ভয় পেয়েছ মনে হচ্ছে?
ব্রুনো।। বুকে হাত দিয়ে দেখুন, ধরাস ধরাস করছে। হৃদপিণ্ডটা বাইরে বেরিয়ে আসবে মনে হচ্ছে।
ডাক্তার।। ভেরি ব্যাড সিমটম। এ রোগের সাধারণত কোন ওষুধ নেই।
ব্রুনো।। তাহলে উপায়?
ডাক্তার।। মেয়েটা কি বলছে? ও কি রাজি?
ব্রুনো।। মতিগতি বুঝতে পারছি না।
ডাক্তার।। সে আবার কি। কি চাইছে ও?
ব্রুনো।। সেটা জানতেই তো এলাম।
ডাক্তার।। এখনো জানাজানির পর্ব চলছে। আমি তো ভাবলাম অন্য কিছু। সে যাই হোক, এদিকে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। ক্যাম্পে যারা খাবার সাপ্লাই দেয়, আগামী শুক্রবার তাদের গাড়ি যখন ঢুকবে, ওদের কন্টেইনার বক্সের মধ্যে মেয়েটাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। তারপর ক্যাম্পের কাটা তারের বেড়া পার করে ওরা চলে যাবে ওদের গোডাউনে। তোমাকে তার অনেক আগেই গো ডাউনে গিয়ে অপেক্ষা করতে হবে।
আন্ডারস্ট্যান্ড? চুপ করে আছ কেন? ব্যাপারটা বোঝাতে পারলাম? ওই ফুড কোম্পানির গোডাউনে সেদিনের রাতটা তোমাদের থাকার ব্যবস্থা হবে। পরের দিন early মর্নিং আমার পরিচিত একজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ তার গাড়ি করে তোমাদের সীমান্ত পার করে দেবে।
ব্রুনো।। কিন্তু-
ডাক্তার।। এর মধ্যে কোন কিন্তু নেই। পরিকল্পনা খুব আটোসাটো। যুদ্ধের পরিস্থিতি এই সময় জার্মানির অনুকূলে নয়। সবাই বুঝতে পারছে পরাজয় আসন্ন। জার্মানিতে হিটলারের প্রতি আকর্ষণ ক্রমাগত কমছে। গেস্টাপো বাহিনীকে আগের মত আটোসাটো দেখা যাচ্ছে না। এই সুযোগটা তোমরা নিতে পারলে নতুন জীবন ফিরে পাবে।
ব্রুনো।। আপনি যা বলছেন অর্থাৎ হিটলারের পতন হবে?
ডাক্তার।। সেটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। ফ্যাসিস্ট
দলগুলোর এই পরিণতি হয়। নাৎসি বাহিনীর ভয় যারা দম বন্ধ অবস্থায় চুপ করেছিল, এখন তারাও মুখ খুলতে শুরু করেছে। দলের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস খুনোখুনি মারামারি শুরু হয়ে গেছে। মানুষ একদিন হিটলার কে বিশ্বাস করেছিল। জার্মানির উন্নতি হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে যেভাবে জার্মানির অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে আবার এই দেশ মাথা তুলে দাঁড়াবে। আসলে কিছুই হয়নি।
ব্রুনো।। আপনি তাহলে বলছেন, এইটাই মোক্ষম সময়।
ডাক্তার।। আমার তো তাই মনে হয়। কথাটা আমি তোমাকে বলতে এলাম। এখানকার চাকরি আমারও আর ভালো লাগছে না। বিবেকের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে আমি ক্লান্ত। আমি যা করছি এটা তো ডাক্তারের কাজ নয়।
ব্রুনো।। একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছে করে, রোজ রোজ এত রক্ত দিয়ে ওরা কি করে?
ডাক্তার।। মদ বানায়। জেলি বানায়।
ব্রুনো।। মানুষের রক্ত দিয়ে মদ!! জেলি!!!
ডাক্তার।। ওরা বলে ইহুদিদের রক্ত দিয়ে বানানো মদে দারুণ নেশা হয়। শুধু কি রক্ত? ওদের গায়ের চামড়া দিয়ে লেডিস ব্যাগ বানানো হয়! মেয়েদের নানারকম প্রসাধনি আইটেম তৈরি হয় ইহুদিদের হার দিয়ে। আরো যেসব বীভৎস কান্ডকার খানা চলছে, এখানে আর বেশিদিন থাকলে উন্মাদ হয়ে যাব। তুমি ভাবতে পারো, হিটলার সরকারি ফরমান জারি করেছে, যুদ্ধের জন্য তার লক্ষ লক্ষ সৈনিক দরকার। সেই কারণে প্রত্যেক যুবতী জার্মান নাগরিককে প্রতিবছর যেকোনোভাবে গর্ভবতী হতে হবে।
আচমকা সাইরেন বেজে উঠবে। শুরু হয়ে যাবে গার্ডদের দৌড়াদৌড়ি। টাওয়ারের মাথা থেকে সার্চলাইট ঘুরতে থাকবে। ডাক্তার এবং ব্রুনো প্রথমে কিছুই বুঝতে পারবে না। একজন গার্ড ছুটে এসে বলবে—-
গার্ড।। পালান পালান নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিন। শুয়ে পড়ুন শুয়ে পড়ুন। রাশিয়ার এয়ারক্যাপট বোম্বিং করা শুরু করেছে।
আকাশপথে বোমারু বিমান একটার পর একটা উড়ে যাচ্ছে। বিকট আওয়াজ। তারপর বম্বিং শুরু হবে। গার্ডরা কানে হাত দিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছে। ডাক্তার এবং ব্রুনো একই কাজ করবে।
কিছুক্ষণ চলবার পর আবার ক্লিয়ারিং সাইরেন বাজানো হবে। একজন গার্ড ছুটে তে ছুটতে আসবে ডাক্তারের কাছে।
গার্ড।। স্যার পশ্চিম দিকের ক্যাম্প শে ড টা টোটালি উড়ে গেছে।
ডাক্তার।। সেকি!!!
গার্ড।। ওই ক্যাম্পে প্রায় সাড়ে ছ হাজার বন্দী ছিল।
সম্ভবত কেউ বেঁচে নেই।
ডাক্তার।। ও মাই গড!!!
ব্রুনো।। এদিকে র শেডটা কি অক্ষত আছে?
ছুটে যাবে এস্থার যেখানে থাকে সেদিকে।
অফিসার।। (বাইরে থেকে আসবে) ব্রুনো ওভাবে ছুটল কেন?
গার্ড।। এদিকে ক্যাম্পে ওর কয়েকজন পরিচিত বন্দী থাকে।
অফিসার।। পরিচিত!!! স্ট্রেঞ্জ!!!
ডাক্তার।। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই অফিসার। যাদের বন্দি করে নিয়ে আসা হচ্ছে তাদের সঙ্গে আমরা সবাই একটা সময় মিলেমিশে বাস করতাম। তাদের মধ্যে আপনিও খুঁজলে অনেক বন্ধু পেয়ে যাবেন।
অফিসার।। ইহুদি আর কমিউনিস্ট বন্ধু আমার কখনো ছিল না। থাকতে পারে না। ব্রুনোকে দেখে মনে হচ্ছে বোম্বিং এর সময় পশ্চিম দিকের ক্যাম্পে যারা মারা গেল তাদের জন্য একটু বেশি দরদ দেখাচ্ছে।
গার্ড।। আপনি ঠিক বলেছেন স্যার।
অফিসার।। (ডাক্তারকে) ছেলেটা তো আপনার অনুগত। একটু সামলে চলবেন। ওকেও ওয়ার্নিং দেওয়া প্রয়োজন। কি বলেন ডাক্তার বাবু? (কটাক্ষ করে চলে যাবে)
অফিসার এবং গার্ড চলে যাবে। ডাক্তারের মুখ দেখে বোঝা যাবে, সে বেশ বিপন্ন। ব্রুনো এগিয়ে আসবে।
ব্রুনো।। ঈশ্বরের কৃপায় এদিকের ক্যাম্পে কোন ক্ষতি হয়নি। সবাই বেঁচে আছে।
ডাক্তার।। তোমার এস্থার এদিকের ক্যাম্পেই তো থাকে?
ব্রুনো।। ইয়েস স্যার।
ডাক্তার।। পালাবার একটা মহা সুযোগ তোমার হাতছাড়া হয়ে গেল।
ব্রুনো।। এদিকের ক্যাম্পের কারো কিছু কোনরকম ক্ষতি হয়নি। ঈশ্বর সবাইকে রক্ষা করেছেন।
ডাক্তার।। অপেক্ষা কর। আবারও একটা বোম্বিং এর সুযোগ খুঁজতে থাকো। (চলে যাবে)
ব্রুনো যখন ভাবছে কি করবে ঠিক সেই সময় প্রথম প্রহরী বা গার্ড যে চাবি দিয়েছিল ব্রুনো কে সেই লোকটা এগিয়ে আসবে।
গার্ড।। চাবিটা দে।
ব্রুনো।। হ্যাঁ এইতো-
গার্ড।। ঈশ্বর হয়তো এবার অনেককে রক্ষা করবেন। তোমাকেও-
ব্রুনো।। মানে? কি রকম?
গার্ড।। ওই মেয়েটা যে সেলে থাকে তুমি হয়তো লক্ষ্য কর নি ওটার একেবারে শেষ প্রান্তে বোমা পড়ে বিরাট ফাটল ধরেছে। আমি দেখে এলাম ওই দিক দিয়ে বন্দীদের অনেকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। এখানে বোকার মত দাঁড়িয়ে না থেকে ওই মেয়েটাকে নিয়ে ওই দিক দিয়ে কেটে পড়।
ব্রুনো।। সত্যি?
গার্ড।। এখনো আমাদের এই ক্যাম্পের বড় কর্তাদের নজরে আসেনি। তারা নিজেদের বাঁচাবার জন্য ব্যস্ত। আর দেরি করিস না চলে যা। চলে যা বলছি–
ব্রুনো অবাক হয়ে ভাবে গার্ডের মানবিক মুখের কথাগুলো। সে গার্ডকে আন্তরিকভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরবে। তারপর চলে যাবে।
দৃষ্টান্তর।
আলোর পরিবর্তন ঘটতে থাকবে।
হার কাঁপানো আবহাওয়া সংগীত বেজে উঠবে। আমরা দেখব ব্রুনো এবং এস্থার ছুটতে ছুটতে অনেক পথ পেরিয়ে পাহাড়ের গুহার মতন একটা জায়গায় চলে এসেছে। দুজনেই ক্লান্ত। অবসন্ন। দাঁড়াতে পারছে না। জায়গাটাকে ভালো করে দেখে নিয়ে ব্রুনো বোঝার চেষ্টা করবে তারা কোথায় এসেছে।
ব্রুনো।। এটা একটা পাহাড়ের নিচের অংশ। এই গুহাটা তে বন্য জন্তু থাকতে পারে। তবে মনে হচ্ছে জন্তু গুলো এখন পালিয়েছে। এদিকে সেদিকে যেভাবে বোম্বিং হচ্ছে, ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। ওদেরও তো প্রাণের ভয় আছে। ওরাও বাঁচতে চায়। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ দিক থেকে নামলে একটা নদী পাব। এখানে বেশিক্ষণ না থেকে চলো আমরা নদীর দিকে চলে যাই। মনে হচ্ছে ওটা সীমান্ত অঞ্চল।
এস্থার।। আমার আর চলবার ক্ষমতা নেই। আমি পারবো না।
ব্রুনো।। জল খাবে? আমার সঙ্গে খানিকটা আছে। এই নাও–
এস্থার।। (জল খেয়ে) কেন তুমি আমাকে এভাবে নিয়ে এলে? কি লাভ হল?
ব্রুনো।। আমাদের মত ওই ক্যাম্পের আরো অনেকে পালিয়ে গেছে।
এস্থার।। সবাই ধরা পড়ে যাবে।
ব্রুনো।। নরক থেকে পালাবার সময় কেউ ভাবেনা সে আবার ধরা পড়ে যাবে। তার মাথায় তখন একটাই চিন্তা— নরক থেকে মুক্তি! মুক্তি! মুক্তি!
এস্থার।। আমিও মুক্তি চাই, বাঁচতে চাই, জীবনের সমুদ্রে স্নান করতে চাই।।
ব্রুনো।। শোনো এস্থার, সময় বদলাচ্ছে। ক্যাম্পের ডাক্তারবাবু বলছিলেন, দেশের পরিস্থিতি দ্রুত মানুষের অনুকূলে চলে আসছে। সোভিয়েত রাশিয়ার ফাইটারবিমান গুলো জার্মানির সীমান্ত লংঘন করে ঢুকে পড়ছে। বম্বিং এর সময় আমাদের ক্যাম্পের একটা অংশের গোটা বন্দী শিবির ধ্বংস হয়ে গেছে। গার্ড বলছিল কয়েক হাজার বন্দী মারা গেছে। এমনিতেই মারা যেত, আজ কিংবা কাল গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। গার্ড বলল এই তো সুযোগ। তোমাদের সেল এর শেষের প্রান্তে ফাটল ধরেছে। গার্ড আমাকে ইঙ্গিত করতেই আমি আর দেরি করলাম না। যদিও ডাক্তার বাবু আমাদের পালাবার একটা ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
এস্থার।। (এতক্ষণ ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছিল। এবার হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ল। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াবে। এদিকে ওদিকে কিছু খুঁজবে।)
ব্রুনো।। কি হলো কি খুজছো?
এস্থার।। আমি যখন পালাচ্ছিলাম তখন আমাদের সঙ্গে যারা আসছিল তারা কোথায় গেল?
ব্রুনো।। জানিনা-
এস্থার।। বলো কোথায় গেল?
ব্রুনো।। ওইভাবে সবাই দল বেঁধে পালাতে গেলে যেকোনো লোকের সন্দেহ হবে। তাই আমি বলেছিলাম যে যার মত ভিন্ন পথে চলে যাও।
এস্থার।। ওদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ দম্পতি ছিল। দিনের পর দিন অমানুষিক নির্যাতনে ওরা কি করে যে বেঁচে ছিল। আমি ওদের বলেছিলাম, যদি কোনদিন মুক্তি পাই, ওদের আমি বাড়ি পৌঁছে দেব।
ব্রুনো।। আমার মনে হয় ওরা শেষ পর্যন্ত পালাতে পারেনি।
এস্থার।। আমার যে কথার খেলাপ হয়ে গেল। ওদের কাছে আমি মিথ্যেবাদী হয়ে গেলাম।
ব্রুনো।। এক্ষেত্রে তুমি কি করতে পারো? আমরা কে কি করতে পারি? কিছু করার নেই আমাদের। তাছাড়া তোমার নিজের পা যদি মাটিতে না থাকে, শক্ত পায়ে নিজে যদি দাঁড়াতে না পারো তাহলে অন্যকে সাহায্য করবে কিভাবে?
এস্থার।। হ্যাঁ। তোমার কথায় যুক্তি আছে। আমার বাবা ও এইরকম বলতো। তবে ওই মানুষগুলোর সঙ্গে এক মাসের বেশি থেকে ছি, প্রশাসনের পুলিশ গেস্টপ বাহিনী আমাদের গরু ছাগলের মতো মাল গাড়ির ওয়াগানে ভর্তি করে ক্রমাগত এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে গেছে। এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে জীবন্ত লাশের মতো থাকতে হয়েছে।
ব্রুনো।। ওসব কথা এখন অতীত। সামনের দিকে তাকাও। আমাদের বাঁচতে হবে।
এস্থার।। তোমার কথা শুনে এখন আমার মনে হচ্ছে, অনেক মানুষকে বাঁচানোর জন্য আমাদের বাঁচতে হবে। নিজেকে রক্ষা করতে হবে। সময়টাকে বদলানোর জন্য আমাদের অনেক কাজ রয়েছে।
ব্রুনো।। তাহলে চল। পাহাড়ের ওদিকের খারি দিয়ে নদীর কাছে নেমে যাই। তারপর নদীটা পার করে অন্যপ্রান্তে যেতে হবে।
ব্রুনো হাত বাড়িয়ে দিলে এস্থার সেই হাতটা ধরে উঠে দাঁড়াবে। ওরা আবার এগিয়ে যাবার চেষ্টা করবে। কয়েক পা এগিয়ে এস্থার দাঁড়িয়ে পড়বে।
ব্রুনো।। কি হলো, দাঁড়ালে কেন? চলো-
এস্থার।। (ঘুরে দাঁড়িয়ে) আমরা কি তাহলে সত্যি সত্যি মুক্তি পেতে চলেছি?
ব্রুনো।। তোমার অবিশ্বাস হচ্ছে?
এস্থার।। না মানে, আবার রোজ পাহাড়ের কোলে সূর্যোদয় দেখবো? তারপর পশ্চিমের গহন অরণ্যের বুকে সূর্যাস্ত হবে? আবার আমরা সমুদ্র স্নান করতে পারব? বসন্তে যখন টিউলিপ ফুল ফুটবে, আমাদের গ্রাম লালে লাল হয়ে যাবে ফুলে ফুলে তখন আমরা আবার বসন্ত উৎসবে মেতে উঠতে পারব?
ব্রুনো।। হ্যাঁ। আবার গির্জার ঘণ্টার শব্দে ই স্টার কিংবা যীশুর জন্মদিনে র সারারাত আমরা উৎসব করব।
এস্থার।। আমি যখন ধরা পরলাম, তারপরের পরের দিন আমার এক বন্ধুর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। ওয়েডিং গাউন কিনে আমার কাছে এসেছিল। তারপর আমাকে বলেছিল, এই ওয়েডিং গাউন টা আমাকে পরলে কেমন হবে? আমি বলেছিলাম দারুন! সেই গাউন টা আমার বন্ধু কেটি আমাকে পড়তে বলেছিল! আমি কিছুতেই পরতে চাইনি! ও বলল এই গাউনটা তোকে বেশ বানাবে! এমন নাছর বান্দা হয়ে উঠলো যে শেষ পর্যন্ত আমাকে পরতে হয়েছিল। তারপর কি করল জানো? ও আমার সামনে একটা আয়না হয়ে দাঁড়ালো! বলল, এই গাউনটা তোর। তোকে দারুন মানাচ্ছে। ওয়েডিং-এর সময় এটা তুই পড়বি। আমাকে যখন ধরে নিয়ে আসা হলো, তখন আমি একটা শুটকেসের মধ্যে ওই গাউনটা নিয়ে এসেছিলাম।।
ব্রুনো।। তাই নাকি। চমৎকার। তাহলে নদীর ওপারে পৌঁছে গিয়ে আমাদের বিয়ের সময় তুমি ওই ওটা পড়বে।
এস্থার।। আমার এখন পড়তে ইচ্ছে করছে।
ব্রুন।। সে কি! এখন এই সময়!!
এস্থার।। হ্যাঁ। এখন তুমি আমি ছাড়া আর তো এখানে কেউ নেই। আমি তোমার আয়নায় দেখতে চাই নিজেকে।
ব্রুনো।। কিন্তু আমি বলছিলাম যে-
এস্থার।। বড় ভয় হয়। যদি আর কখনো সময় না পাই!!
ব্রুনো।। তোমার মধ্যে খালি হতাশা। আমি তো বলছি দিন বদলাচ্ছে। মানুষের জন্য একটা পৃথিবী আমরা তৈরি করব।
এস্থার।। তবুও আমার পরতে ইচ্ছে করছে। প্লিজ না বলো না। তুমি একটু দাঁড়াও। (আড়ালে চলে যাবে)
ব্রুনো।। এত ছেলেমানুষ! ঠিক আছে তাড়াতাড়ি কর!
কিছুক্ষণের মধ্যে ওয়েডিং গাউন পরে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে এস্থার। চাঁদের আলো য় ঝলমল করে উঠবে তার রূপ। বিস্ময় হতচকিত হয়ে ব্রুনো তাকিয়ে থাকবে।
এস্থার।। কি দেখছ অমন করে?
ব্রুনো।। তোমাকে।
এস্থার।। কেমন লাগছে?
ব্রুনো।। স্বর্গ থেকে এইমাত্র একটা পরী নেমে এলো আমার সামনে।
এস্থার।। পরি যার তার কাছে যায় না। নিজেকে ধরা দেয় না। পরি খুঁজে বেড়ায় মনের মানুষকে। তার দেবদূত কে।
ব্রুনো।। খুঁজে পায়?
এস্থার।। পাবে না কেন? এই তো পেয়েছি! তুমি আমার দেবদূত!!! আমাকে নরকের অন্ধকার থেকে আলোর পৃথিবীতে নিয়ে এসেছ! এখন পরি যদি দেবদূতের কাছে কিছু চায়, সে কি পাবে?
ব্রণ।। কেন পাবে না? পরীকে অদেয়া কিছু তো নেই।
এস্থার।। সত্যি বলছো? প্রমিস?
ব্রুনো।। প্রমিস।
এস্থার।। তাহলে আমাকে সেই জিনিস দাও যা পেলে পরী র জীবন সার্থক হয়ে উঠবে।
ব্রুনো।। কি করে বুঝবো? কোন জিনিসটা সে চাইছে?
এস্থার।। নারীত্বের অহংকার।
ব্রুনো।। বুঝলাম না
এস্থার।। সব মেয়ে যে কারণে জন্মায়। সৃষ্টিশীল হয়ে উঠতে। অহল্যা মাটিকে উর্বরা করতে। মা হতে। গর্ভবতী করো আমাকে। হে পুরুষ, তুমি বীজ বপন করো অহল্যা মাটিতে।
ব্রুনো।। না অসম্ভব। এটা সময় নয়।
এস্থার।। কেন অসম্ভব বলছো? কেন সময় প্রতিকূল বলছো? এইতো খানিকক্ষণ আগে অন্য কথা বলছিলে! নদীর ওপারে জীবন আছে! বসন্ত আছে! সূর্যোদয় আছে! আদিগন্ত শস্যের সমারহে নবান্নের উৎসব আছে।
ব্রুনো।। হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ। এর কোন কথাই মিথ্যে নয়। আর দেরি না করে আমাদের নদীটা পেরি এ ওপারে যেতে হবে।
এস্থার।। আমার এখন খুব নাচতে ইচ্ছে করছে।
ব্রুন।। নাচ!!
এস্থার।। গানও গাইতে ইচ্ছে করছে।
মিউজিকের সঙ্গে এস্থার নাচবে। নাচতে নাচতে ব্রুনো কেও টেনে নেবে। এরকম কিছুক্ষণ চলবার পর হঠাৎ আকাশ পথে বোমারু বিমান উড়ে আসবে। সাইরেন বাজবে। বোমা বর্ষণ হবে। ব্রুনো গুহার মধ্যে এস্থার কে টেনে নেবে। বাইরে আগুনের ঝলকা চলছে। তারপর ওরা যখন নদীর পারে যাওয়ার চেষ্টা করবে ঠিক তখন সামনে এসে দাঁড়াবে নাজি বাহিনীর সৈনিকরা। তাদের মধ্যে আমাদের সেই অফিসার কেও দেখা যাবে। ব্রুনোদের ঘিরে ফেলবে সৈনিকরা।
দৃশ্য পরিবর্তন।
কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প। পলাতক বন্দিদের ধরে আনা হয়েছে। প্রত্যেককে বেঁধে রাখা হয়েছে খুঁটির সঙ্গে। দেখা যাবে আমাদের ব্রুনো কেও একটা উঁচু জায়গায় বেঁধে রাখা হয়েছে। অসম্ভব অত্যাচার করা হয়েছে তার শরীরে। মুখটা বিকৃত হয়ে গেছে। সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত।
অফিসার।। দুই ডজন হিংস্র কুকুর আমরা লেলিয়ে দিয়েছিলাম। মূলত ওই কুকুরগুলো ইহুদি বন্দিদের খুঁজে বার করেছে। তারপর কামড়ে ফালাফালা করে দিয়েছে।
একজন গার্ড।। এগুলো মাথামোটা। ভেবেছিল এখান থেকে পালিয়ে গেলে বেঁচে যাবে।
অফিসার।। ফুয়েরার এডলফ হিটলারের সরকারের পরমায়ু অনন্তকাল। জার্মান জাতীয়তাবাদ কখনো অস্ত যাবে না। তবে ওই ডাক্তারকে এখনো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
একজন গার্ড।। খুঁজে পাওয়া যাবে অফিসার। কোথাও পালাতে পারবেনা। আমাদের গোয়েন্দা দপ্তর নিশ্চয়ই খুঁজে বার করতে পারবে।
অফিসার।। ডাক্তার কে ধরতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমাদের দেশের সরকারের অনেক কিছু গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে।
গার্ড।। অফিসার, এই বন্দী গুলোকে কালকেই গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।
অফিসার।। ওদের সঙ্গে ওই শয়তান ব্রুনো কেও চালান করে দিতে হবে। আমার অনেক আগেই সন্দেহ হয়েছিল। হি ইস দেঞ্জারাস পারসন। একটা কিছু ঘটিয়ে ছাড়বে আন্দাজ করেছিলাম।
গার্ড।। মেয়েটার কি হবে স্যার?
অফিসার।। ভাবতে হবে। দুম করে একটা কিছু করে ফেলা যাবে না। (চিন্তা মগ্ন অবস্থায় পায়চারি করবে! এমন সময় একজন কার্ড একটা অফিসিয়াল চিঠি নিয়ে আসে)
গার্ড।। বার্লিন থেকে একটা মেসেজ এসেছে।
অফিসার।। মেসেজ। (সই করে নেবে! মেসেজটা পড়বে! তারপর হা হা করে হেসে উঠবে)
গার্ড।। আপনি হাসছেন!!!
অফিসার।। হাসির খবর এসেছে তাই তো হাসছি।
মজার খবরও বটে। তবে এই বন্দিদের জন্য এই মেসেজে দারুন সুখবর আছে।
গার্ড।। কিরকম স্যার?
অফিসার।। এদের মুক্তির খবর।
গার্ড।। মুক্তির খবর!!! সেটা কি রকম?
অফিসার।। ফুএরার এডলফ হিটলারের জন্মদিন উপলক্ষে আমাদের দেশের বিভিন্ন কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে অনেক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হবে।
গার্ড।। তাই নাকি!!!! এত অবিশ্বাস্য!!!
বন্দীদের মধ্যে মুক্তির আনন্দ জেগে উঠবে। মৃত্যুপথ যাত্রী, মুমূর্ষ বন্দীদের মধ্যেও আশার আলো জেগে উঠলো।
অফিসার।। তবে শর্ত আছে।
গার্ড।। কিরকম শর্ত?
অফিসার।। খেলা হবে। খেলা হবে। মজার খেলা।
গার্ড।। কিরকম খেলা স্যার?
অফিসার।। মুক্তির জন্য খেলা। জীবনের জন্য খেলা।
গার্ড।। একটু বুঝিয়ে বলবেন?
অফিসার।। আগামী ১৪ তারিখ এখানে যতবন্দী রয়েছে এদের প্রত্যেককে নাচের খেলা তে পার্টিসিপেট করতে হবে। ম্যারাথন ডান্স। দীর্ঘ ৪৮ ঘন্টা যারা ম্যারাথন ডান্সে অংশগ্রহণ করে টিকে থাকবে তাদের মুক্তি দেওয়া হবে।
গার্ড।। যারা টিকে থাকতে পারবে না?
অফিসার।। তাদের জন্য কোন কিছু বলার নেই।
বন্দিরা উল্লাস করে ওঠে। নাচতে থাকে। অফিসারের নির্দেশে ব্রুনোকে শিকল মুক্ত করা হয়।
অফিসার।। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন। আজ তোমাদের জন্য ভালো ভালো খাবার পাঠানো হবে।
গুডবাই। নাচো। আজ থেকে নাচ প্র্যাকটিস করো। আমি প্রত্যাশা করব তোমরা সবাই শেষ পর্যন্ত নাচ কমপ্লিট করতে পারবে। গুডবাই।
অফিসার চলে যাবে।
বন্দীরা মুক্তির আনন্দে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে। নেচে ওঠে। তাদের কাছে খাওয়ার পৌঁছে যায়। ক্ষুধার্ত মানুষগুলো খাবার কেড়ে নেয়।
এস্থার এগিয়ে আসে ব্রুনোর কাছে।
এস্থার।। কিছু বুঝলে তুমি?
ব্রুনো।। না।
এস্থার।। আমরা কি মুক্তি পাব? তুমি কি নাচে অংশগ্রহণ করবে?
ব্রুনো।। কিছুই বুঝতে পারছি না।
এস্থার।। আমি করব। আমরা সবাই নাচবো। মুক্তির জন্য নাচব। জীবনের জন্য নাচব। শেষ পর্যন্ত যা হয় হোক। মরবার আগে কিছুতেই মরবো না।
নাচের বাজনা বেজে ওঠে। সবাই নেচে ওঠে। সে এক অকল্পনীয় দৃশ্য। বৃদ্ধ অ শক্ত মুমূর্ষু সবাই মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে নাচ শুরু করে।
ওদের ওপর আলোর খেলা শুরু হয়।
নাচতে নাচতে ওরা জীবনের শক্তি অর্জন করতে থাকে। ওরা বুঝতে পারে থেমে গেলে চলবে না। পড়ে গেলে চলবে না। শেষ পর্যন্ত নাচতে হবে।
তারপর একটা সময় যখন ৪৮ ঘন্টা পার হয়ে যায়। ওরা সবাই চিৎকার করে বলে—–
সবাই।। আমরা পেরেছি। আমরা ৪৮ ঘন্টা ম্যারাথন নাচ কমপ্লিট করেছি। আমরা কেউ থেমে যায়নি। আমরা কেউ হার পরাজয় স্বীকার করিনি। মরবার আগেই মরিনি। এবার আমাদের মুক্ত করে দাও। বন্দিশালার দরজা খুলে দাও।
ঠিক তখন চারিদিক থেকে মেশিনগানের গুলি গর্জে ওঠে। অন্ধকূপ কুত্তার মত মেশিনগানের গুলিতে প্রতিটি মানুষের মৃত্যু ঘটে। রক্তাক্ত ইতিহাস রচিত হয় জার্মানির বন্দীশালায়।
অফিসার এগিয়ে আসে। উন্মত্ত হাসি তার। হাসতে হাসতে তার মৃগী রোগ আক্রান্ত হয়। কাঁপতে কাঁপতে সে বেরিয়ে যাবে।
এবার দেখা যাবে রক্তাক্ত মৃতদেহর গুলোর মধ্যে থেকে এস্থার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াবে। চারিদিকে নিজেদের দেখে আর্তনাদ করে উঠবে। খুঁজতে থাকবে ব্রুনোকে। তারপর ব্রুনোর মাথাটা নিজের কোলের দিকে নিয়ে বলবে।
এস্থার।। বেচে থেকে তোমার স্বপ্ন তুমি পূরণ করতে পারলে না। হয়তো তার জন্য আমি দায়ী। কিন্তু তোমাকে কথা দিচ্ছি প্রিয়তম, আমি মরবো না। আমাকে বাঁচতে হবে। তোমার প্রতিনিধি আমার গর্ভে বেড়ে উঠছে। তার জন্য আমাকে বাঁচতে হবে। তোমার সন্তানকে আমি বড় করব। সে বড় হয়ে ওঠে অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে আর একটা ন্যায়ের যুদ্ধ শুরু করবে। আমাদের কত ঠাকুর সামনে এসে দাঁড়াবে।
কথক।। এর এক বছরের মধ্যেই সোভিয়েত রাশিয়া জার্মানি দখল করবে। হিটলার তার দলবল নিয়ে আত্মহত্যা করবে। জার্মানির মানুষ ফ্যাসিজমের হাত থেকে মুক্তি পাবে। এস্থার তার সন্তানকে জন্ম দেবে। সন্তান যখন বড় হবে তখন তাকে কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পের গল্প শোনাবে। দস্যু হিটলারের খামখেয়ালিতে সেই সময় কয়েক কোটি মানুষ কে হত্যা করা হয়েছিল।
ধীরে ধীরে পর্দা নেমে আসে।
এই নাটকের সমস্ত আইনগত অধিকার নাট্যকার সুব্রত কাঞ্জিলালের। রচনাকাল: ডিসেম্বর: ২০২২