সুব্রত কাঞ্জিলাল
পর্ব- ১
চরিত্র: সাগর (৩২)/ অনিমা (দিদি।৪০)/ শুভঙ্কর (জামাইবাবু ৫০)/ মিঠু (ছোট ভাই সাগরের থেকে দু বছরের ছোট)/ মামা/ মার্গারেট (বাঙালি ক্রিশ্চান। বয়স ২০)
তখন সকাল ন’টা। অনিমা বাড়ির বিভিন্ন ঘরে সাগরের নাম করে খোঁজাখুঁজি করতে করতে বাইরের লনে আসবে।
অনিমা।। সাগর, এই সাগর, কোথায় গেলি তুই? সাড়া দিচ্ছিস না কেন? কি হলো– কোথায় তুই?
বাইরে থেকে মিঠু আসবে। সে টিউশন পড়াতে গিয়েছিল।
অনিমা।। তুই চলে এলি যে মিঠু? আচ্ছা তুই যখন সকালে টিউশন পড়াতে গেলি, তখন কি সাগরকে ঘরে দেখেছিলি?
মিঠু।। না। আমার তো সাড়ে ছটার মধ্যে বেরিয়ে যাবার কথা। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছিল। তাই হুর মুর করে বেরিয়ে গিয়েছিলাম।
অনিমা।। তখন তো সাগর বাগানে বসে থাকে। কি সব মেডিটেশন করে।দেখতে পেলি না কেন?
মিঠু।। সাগরদা তখন বাগানে ঘুরে বেড়ায়। মেডিটেশন করে। । পাখিদের খাবার দেয়। কোন কোন দিন আমাকে বাইকে চাপিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসে। কিন্তু আজকে ছিল না-
অনিমা।। আজ তাহলে কি হলো? কোথায় গেল ছেলেটা? সকাল দশটা বেজে গেছে—বাড়ি ফিরছে না কেন? তুই ওরকম হাপাচ্ছিস কেন? কি হয়েছে তোর?
মিঠু।। আমি তো তখন একটা রিকশা ধরে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। সাগর দার বাইকটা ঘরেই ছিল। তবে চাবিটা খুঁজে পাইনি। স্টেশনের লেভেল ক্রসিং এর কাছাকাছি আমাদের মুকুল দা-র সঙ্গে দেখা । সাইকেল করে বাজারে যাচ্ছিল হয়তো। আমার রিক্সাটা থামিয়ে আমার কাছে এসে বলল, মিঠু, তোর দাদা সাগরকে দেখলাম রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যেন যাচ্ছে। আমি অনেক ডাকাডাকি করলাম। আমার কথা শুনতে পেল না হয়তো।
অনিমা।। সে কি কথা!! কি বলছিস তুই?
মিঠু।। আমি রিকশা থেকে নেমে লেভেল ক্রসিংয়ের ওদিকে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করলাম। দেখতে পেলাম না । তারপর যখন আবার রিকশায় চেপে আমাদের বোসদার বাড়ির সামনে নামলাম, তখন আমাদের এক বন্ধু অতনু আমাকে দেখে বলল, সাগরকে নাকি গঙ্গার ঘাটে বসে থাকতে দেখেছিল।
অনিমা।। গঙ্গার ঘাটে? কখন গেল?
মিঠু।। অতনু রোজ ভোরবেলা গঙ্গার ঘাটে যায় চান করতে। সাগরকে দেখে জানতে চেয়েছিল, অত ভোরে ওখানে ও কি করছে? সাগর নাকি বলেছে, কখনো তো গঙ্গায় চান করে নি, তাই চান করতে এসেছি।
অনিমা।। সর্বনাশ। এসব কি বলছিস তুই!!! একা একা গেছে, গঙ্গায় চান করতে। ও তো সাঁতারও জানে না!! একটা কিছু হয়ে গেলে (কেঁদে ফেলবে) বেশ কয়েকদিন ধরে এরকম করছে। মাথায় যে কি ভুত চেপেছে। আমাকে না বলে বেরিয়ে যায়।
মিঠু।। আমি সঙ্গে সঙ্গে রিকশা নিয়ে গঙ্গার ঘাটে ছুটে ছিলাম। তন্ন তন্ন করে সাগরদাকে খুঁজেও পেলাম না। টিউশন পড়ান মাথায় উঠল। যে ছেলেটা বাইরে যায় না। রাস্তাঘাট চেনে না। সে কখন বেরিয়ে এলো? কেনই বা বেরিয়ে এলো? দিদি, তোর সঙ্গে কিছু হয়েছে? নইলে কদিন ধরে এরকম করছে কেন?
অনিমা।। কি যা তা বলছিস। আমার সঙ্গে আবার কি হতে যাবে? আমি কি কখনো ওকে বকাঝকা করি? ওর সঙ্গে— রাগারাগি করি?
মিঠু।। তাহলে কি জামাইবাবুর সঙ্গে—-?
এই সময় ওদের মামা রবিন বাবুকে বাজারের থলি হাতে নিয়ে আসতে দেখা যাবে।
অনিমা।। মামা তুমি, এই সময়?
মামা।। বাজার করে বাড়ি ফিরছি। সাগরের কি হয়েছে রে? ওকে একবার ডেকে দে তো–। ওর মাথায় কি আবার পোকা নড়েছে– হা করে কি দেখছিস ডেকে দে ছেলেটাকে। দুটো কথা বলেই চলে যাব। বাজার নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। আজ আমার অফিস রয়েছে—-তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে!
অনিমা।। সাগর তো বাড়িতে নেই—
মিঠু।। সেই যে কখন কোন ভোরে বেরিয়ে গেছে। আমরা কেউ কিছু জানি না।
মামা।। বেরিয়ে গেছে মানে? গতকাল অবশ্য আমার কাছে গেছিল সকালের দিকে। ওর মামী বলল, পায়েশ রান্না করেছে, খেয়ে যেতে। আর তোদের জন্য নিয়ে আসতে। বোম্বে থেকে তোর বরদা তোদের তিন ভাই বোনের জন্য কি সব নিয়ে এসেছে। সেগুলোও নিয়ে যেতে।সাগর বলল, ও নাকি চাকরি খুঁজতে বেরিয়েছে। বাড়ি ফিরতে রাত হবে।খিদে নেই কিছুই খাবে না। দুম করে বেরিয়ে গেল —
মিঠু।। চাকরি খুঁজতে তোমার কাছে গিয়ে ছিল মামা!
অনিমা।। তোমার কাছে যে গিয়েছিল আমাকে তো বলে নি!
মামা।। আমি বললাম তুই চাকরি করবি মানে? যদি বা করিস তাহলে আমার কাছে এসেছিস কেন? তোর জামাইবাবুকে বললেই তো—-। তাছাড়া তোর চাকরি করার দরকারটা কি? তখন বলল, দরকার আছে মামা। নিজের পা য়ে দাঁড়াতে চাই। হ্যাঁরে, আমাকে বলল—– আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।
মিঠু।। আরে ঠিক এইরকম কথা গতকাল আমাকেও বলেছে। ওকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তার জন্য একটা চাকরির দরকার।
অনিমা।। গতকাল রাতে আমাকেও বলছিল।
মিঠু।। আমি ওকে বলেছিলাম, তোর কি এই বাড়িতে খাওয়া পড়ার অভাব ঘটেছে? তাছাড়া তুই তো কখনো টাকা পয়সা দিদি জামাইবাবুর কাছে চাইলে পাবি না এমন তো নয়। ওরা তোকে যে টাকা দেয়, সে সবতো তুই খরচা করিস না। ও তখন বলল, আমার নিজের জন্য না। আমি টাকা রোজগার করতে চাই, দিদিকে, তোকে, জামাইবাবুকে আমার তো কিছু দিতে ইচ্ছে করে। তোরা সবাই আমার জন্য অনেক করিস। আমি যে কিছুই করতে পারি না। তাছাড়া আমার আরো অনেক কাজ আছে।
মামা।। এই একই কথা আমাকেও বলেছে। বড় হয়েছি আমি। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে না? দিদি জামাইবাবুরা আমার জন্য এত করছে। ওদের টাকা দিয়ে ওদের জন্য কিছু কিনব, এতে মন সায় দেয় না। মামা আমি তোমাকেও তো কিছু দিতে চাই। মামিকে দিতে চাই। বড়দাকে দিতে চাই। বৌদিকে দিতে চাই। সেটা— নিজের রোজগারের টাকা দিয়ে দিতে হবে তো।
অনিমা।। ওর মাথায় চাকরির ভূত কে ঢুকালো মামা?
মামা।। সেটা তো আমারও প্রশ্ন।
মিঠু।। আমি ওকে বলেছিলাম, সাগরদা, তোকে কে চাকরি দেবে? আর কি কাজই বা তুই করবি? লাখ লাখ লেখাপড়া জানা ছেলে মেয়েরা বি এ এম এ পাস করে বেকার বসে আছে। ও তখন বলল, আমি কোন পাস টাস করি নি ঠিক । কিন্তু আমি তো অনেক বইটই পড়েছি। তাছাড়া বাইক চালাতে জানি। ডেলিভারি বয়দের কাজটা তো করতে পারি। কাজের আবার ছোট বড় কি? ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকাটা ঠিক না। অলস হয়ে যাচ্ছি। টিভিতে মোবাইলে পৃথিবীর কত কিছু দেখায়। অথচ এখন পর্যন্ত আমি কিছুই দেখে উঠতে পারলাম না। মেজদি, এবার আমাকে জগৎটাকে দেখতে হবে। গৌতম বুদ্ধের মত। অতীশ দীপঙ্করের মতো। রবীন্দ্রনাথের মতো। চার্লি চ্যাপলিনের মতো।
মামা।। এইসব কথা আমাকেও বলেছে। আমি যখন বললাম, তোর দিদিকে বল, তোকে নিয়ে ওয়ার্ল্ড টুর করে আসবে। তখন বলে, জামাইবাবু কত কষ্ট করে টাকা রোজগার করে। কষ্টের টাকা আমি ওইভাবে নষ্ট করতে যাব কেন?
অনিমা।। আমার তো মাথায় কিছু আসছে না মামা। এভাবে কোনদিন তো আমাকে না বলে কোথাও যায় না। আমার বাঁ চোখ নাচছে। কি যে হবে——!
মামা।। বেরিয়েছে তো কি হয়েছে? বয়স হয়েছে। এখনো কি তোর আচল ধরা হয়ে বাড়িতে বসে থাকবে?
অনিমা।। তুমি বুঝতে পারছ না মামা। রাস্তাঘাট কিছুই চেনে না। পথ ভুল করে যদি হারিয়ে যায়? সেবারের কথা মনে নেই? পুলিশ খবর দিতে হয়েছিল। ভাগ্যিস ওর জামাইবাবুর এক বন্ধুর চোখে ধরা পড়ে গেল।
মামা।। ভুল করতে করতে ই মানুষ পথ চিনতে শেখে। এত চিন্তা করে মাথা খারাপ করিস না। ঠিক ফিরে আসবে। আমি চলি। বাজারটা দিয়ে আমাকে আবার বের হতে হবে। বাড়ি ফিরে এলে আমাকে একটা ফোন করিস। (চলে যাবে)
অনিমা।। মামা তো বলেই খালাস। আমার দুশ্চিন্তা যে কেন কাউকে বোঝাবার নয়। হঠাৎ করে ওর মধ্যে এরকম পরিবর্তন এল কি ভাবে? ও যে ওর নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নেই, এই কথাটাই ওকে কে বলেছে? আর কেনই বা বলল? আমার বাবা আমাদের তিন ভাই বোনের জন্য যা রেখে গেছে, — তারপর চাকরি করার কি দরকার? মিঠু, তোর কি মনে হয় বাইরের কেউ ওর কানে মন্ত্র দিচ্ছে?
মিঠু।। বাইরের কে ওকে এইসব বলবে? সাগরদা তো তেমন কারো সঙ্গে মেলামেশা করে না।
অনিমা।। তাহলে কি তোর জামাইবাবু—! না না তাই বা কি করে হবে। সাগরকে সে তো নিজের ছেলের মত ভালোবাসে। সাগরের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনবরত চিন্তা করে। কদিন আগেও বলছিল, আমাদের অফিসে ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। কাজ শেখাতে হবে। সাগর খুব মেধাবী। একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন না থাকলেও, সাগরদার অনেক বুদ্ধি। নানা ধরনের বই পড়াশোনা করে। আমি তখন বাধা দিয়ে বলেছিলাম, অফিসের কাজের চাপ ও নিতে পারবে না। শুভঙ্কর অফিস যাওয়ার জন্য বেরিয়েছে।
অনিমা।। এরই মধ্যে বেরিয়ে পড়লে? খেয়ে যাবে না?
শুভঙ্কর।। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আজ অফিসে জরুরি মিটিং আছে। আরো আগে যাওয়া উচিত ছিল।
অনিমা।। আমাকে তো ডাকতে পারতে। ডাইনিং টেবিলে চা রেখে এসেছি। জলখাবার ও তৈরি। প্লিজ একটু বসো।
মিঠু।। জামাইবাবু, সাগরদাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
শুভঙ্কর।। মানে?
অনিমা।। ভোরবেলা কখন যে বেরিয়ে গেছে আমরা কেউ কিচ্ছু জানি না। সেজন্যই তো তোমার খাবার দিতে দেরি হয়ে গেল। প্লিজ একটু বসে যাও। (ভেতরে যাবে)
মিঠু।। হ্যাঁ হ্যাঁ জামাইবাবু। আপনি অফিসে ফোন করে বলে দিন আপনার দেরি হবে। সাগরদা ফিরে না আসা পর্যন্ত দিদিকে সামলানো যাবে না। আপনি তো জানেন দিদির কাছে সাগরদা কতটা—
শুভঙ্কর।। জানি বলেই সাগরকে বলেছিলাম নিজের পায়ে দাঁড়াতে।
মিঠু।। আপনি বলেছিলেন!
শুভঙ্কর।। হ্যাঁ। আমি বলেছিলাম। কথাটা তোমার দিদির বলা উচিত। কিন্তু ও কখনো বলবে না। ওই যে একটা কথা আছে না, সপ্তকোটি সন্তানেরে রেখেছ বাঙালি করে মানুষ কর নি। তোমার দিদি হচ্ছে সে যুগের মায়েদের মত। পেটের ছেলে বড় হয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে, তবুও মায়েদের আবদার তাকে আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখবে। এসব নিয়ে তোমার দিদির সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে। তাকে আমি বোঝাতে পারিনি, সে কিভাবে সাগরের সর্বনাশ করছে। এই যে তুই টিউশন পড়াতে যাস। আমি তো আপত্তি করি না।
মিঠু।। কিন্তু জামাইবাবু—-ডাক্তারবাবুরা যে অন্য কথা বলে! আপনি তো জানেন জন্মের পর থেকে প্রায় পাঁচ বছর কথা বলতে পারত না। বোকার মত তাকিয়ে থাকতো। সবাই তো ভেবে ছিল যে —-
শুভঙ্কর।। যে কোন ডাক্তারকে আমি বিশ্বাস করি না। ওরা পে-শেন্টকে, পেশেন্ট পার্টিকে ভয় পাইয়ে দিয়ে ওষুধের ব্যবসা করে। তোকে বলা হয়নি। সাগরের কেশ হিস্ট্রি নিয়ে একজন ভারত বিখ্যাত ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। একদিন তার কাছে সাগরকে নিয়েও গিয়েছিলাম। সব জানে তোর দিদি।ডাক্তারবাবু খুব ভালোভাবে সাগরকে আবজারভ করে পরিষ্কার বলেছিলেন, ওকে আর পাঁচজন স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচতে দিন। ওর মনের মধ্যে কখনো এ কথাটা ঢোকানো যাবে না যে, ও সবার মত স্বাভাবিক নয়। তাছাড়া আমরা যাকে স্বাভাবিক বলি, সেটাইতো অস্বাভাবিক। আসলে সাগর খুব কল্পনা প্রবন ছেলে। সাধারণ ঘটনা তে ও রিয়াক্ট করে- (ভেতর থেকে অনিমা আসবে)
অনিমা।। এত কথা না বলে, ছেলেটা কোথায় গেল খুঁজবে তো নাকি?
শুভঙ্কর।। ফুটপাতে জন্মানো শিশুদের দেখেছো? কুকুর বিড়ালের মতন জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত হয়! তারপরেও লড়াই করে! একটা সময় পর্যন্ত তাদের মায়েরা পাশে থাকে। তারপর নিজের খাবার নিজেকেই জুটিয়ে নিতে হয়। এটাই হলো জীবনের লক্ষণ।
অনিমা।। (খাবার নিয়ে আসতে আসতে) তার মানে তুমি ওকে বলেছ, একটা চাকরি খুঁজে নিতে! নিজের পায়ে দাঁড়াতে?
শুভঙ্কর।। হ্যাঁ বলেছি। ওর ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভেবেই বলেছি।
অনিমা।। ওর ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভেবে আমার বাবা সব ব্যবস্থা করে গেছে। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ের শর্তের মধ্যে যেটা ছিল, তুমি ওদের গার্জেন হয়ে আজীবন ওদেরকে রক্ষা করবে।
শুভঙ্কর।। তাইতো করছি অনিমা। তোমার বাবা যে বিপুল অংকের টাকা এবং একটা ফ্যাক্টরি রক্ষণাবেক্ষণ করবার সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের তিন ভাই বোনকেও প্রতিপালন করবার দায়িত্ব আমাকে দিয়ে গেছে। সেখান থেকে আমি বিচ্যুত হইনি। আমি মনে করি, আমি তোমাদের বাড়ি, ফ্যাক্টরী আর তোমাদের কেয়ারটেকার।
মিঠু।। ছি ছি জামাই বাবু এসব আপনি কি বলছেন।বাবা আপনাকে নিজের ছেলের মত দেখতো। সম্ভবত বাবা বুঝতে পেরেছিলেন, আমাদের তিন ভাই বোনের দায়িত্ব বলুন, বোঝা বলুন, এমনকি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আপনার হাতে তুলে দেওয়া যায়, এটা ভেবেই তিনি যা কিছু করেছেন। (শুভঙ্কর ফোন করতে থাকে)
শুভঙ্কর।। সেসব আমি জানি। এবং জানি বলেই তোমার বাবা আমাকে বলেছিলেন সম্পত্তির অর্ধাংশ আমার নামে লিখে দেবে ন। আমি রাজি হই নি।
অনিমা।। তোমার বোঝা উচিত, আমাদের যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন মিঠু আর সাগরের বয়স ১০-১২ বছর ছিল। ওরা দুজনই পিঠ পিঠি । আমি ওদের নিজের সন্তানের মত বড় করেছি। নিজে আমি মা হতে চাই নি।
মিঠু।। দিদি, তোর এখানে একটু বাড়াবাড়ি হয়েছে। আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে, তুই মা হতে চাসনি। তবে জামাইবাবুর কথাটাও তোর মাথায় রাখা উচিত ছিল।
শুভঙ্কর।। এ ব্যাপারে আমি তো অনিমাকে কখনো জোর করিনি। স্বামীর অধিকার ফলাতেও চাইনি।
মিঠু।। আপনার প্রতি আমাদের পরিপূর্ণ আস্থা ভরসা রয়েছে। সাগরদা সেও আপনাকে দাদার মতোই ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে।
শুভঙ্কর।। সেটাই তো আমার ভাবনা। আমারও তো শরীর ভালো যাচ্ছে না। হঠাৎ যদি আমার কিছু হয়ে যায়! কে দেখবে তোমাদের? তাছাড়া সাগরের অনন্ত জীবন পড়ে রয়েছে সামনে। তোমার দিদি যেভাবে ওকে বুকের মধ্যে আগলে রেখেছে তাতে করে ছেলেটার ক্ষতি হচ্ছে। (আবার ফোন রিং করবে) শোনো, আমার আজকে যেতে দেরি হবে—–
অনিমা।। তোমরা কি খালি কথা কাটাকাটি করবে? থানায় গিয়ে একটা মিসিং ডায়েরি কর। আমি পরিষ্কার বলে দিচ্ছি, সাগর ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি জলস্পর্শ করবো না।
মিঠু।। মিসিং ডাইরি? তুই এভাবে ভাবছিস কেন দিদি-
অনিমা।। তাহলে কি তোমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে?
শুভঙ্কর।। আমি তো কয়েকটা জায়গায় ফোন করলাম। যেখানে যেখানে ও যেতে পারে—–একটু ধৈর্য ধরতে হবে তো!
মামাকে আসতে দেখা যাবে। হাতে সেই বাজারের থলে।
মামা।। পাওয়া গেছে পাওয়া গেছে। সাগরকে পাওয়া গেছে রে, অনিমা, মিঠু। এই যে শুভঙ্কর, পাওয়া গেছে।
অনিমা।। পাওয়া গেছে? কোথায় মামা? কোথায় পাওয়া গেল? কোথায় আছে সে? তুমি ধরে আনলে না কেন?
মিঠু।। তুমি নিজে তাকে দেখেছ মামা? নাকি অন্যের মুখে শুনেছ?
মামা।। নিজের চোখেই তো দেখে এলাম। দেখে আশ্চর্য হয়ে গেছি। একেবারে অন্যরকম মূর্তি!!!
অনিমা।। কোথায় দেখে এলে বলছো না কেন মামা? কি করছে সেখানে? আমাকে নিয়ে যেতে পারবে?
মিঠু।। তোকে যেতে হবে না দিদি। তুই এদিকটা দেখ। জামাইবাবু কে অফিসের খাবারটা —-
মামা।। তোদের কাউকে যেতে হবে না। ও নিজেই আসবে। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে।
অনিমা।। কি এমন রাজকার্যটা করছে সেখানে? একবারও ভাবছে না যে বাড়ি থেকে না বলে কয়ে বেরিয়ে গিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
শুভঙ্কর।। নিজেকে আপনি আশ্চর্য হয়ে গেছেন মামা? অন্যরকম মূর্তি— বলছেন কেন?
মামা।। আমাদের বাড়িতে যাবার গলির মুখটাতে ভিড় দেখে কেন জানিনা আমিও এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আমাদের সাগর একটা উঁচু টুলে বসে গান গাইছে। আর সেই গান শুনবার জন্য কি ভিড় কি ভিড়।
অনিমা।। কি বললে, সাগর রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান গাইছে? মানে ভিক্ষে করছে?
মামা।। যে সে গান না রে। খোদ হেমন্ত মুখার্জীর গান। সেই যে উত্তম সুচিত্রার সিনেমা শাপমোচন, সেই ছবির গান। শোন বন্ধু শোনো, প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা। গান শুনতে শুনতে আমিও না নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। তারপর ওর সঙ্গে কথা বলে ছুটতে ছুটতে আবার চলে এলাম। ও ফিরে এলে রাগারাগি করিস না। ও নিজেই হয়তো সব বলে দেবে। আমি চললাম। আজ আমার অফিস যাওয়া আর হবে না। ছেলেটা ভালো গান গায় জানি। তাই বলে এতো ভালো!!! তাছাড়া অন্যরকম চেহারা নিয়ে—–
মিঠু ।। সাগরদার গান আমরাও শুনেছি। কিন্তু অন্যরকম চেহারা মানে কি?
মামা।। সাগর বাড়ি ফিরলে তোরা ও বুঝতে পারবি। আমার সময় নেই। পরে আমি আসবো আবার। ওর গান শুনতে আসবো। (চলে যাবে) সাগরের এইরকম চেহারা দেখেই হয়তো রাস্তায় লোক জড়ো হয়ে গেছে—-
অনিমা।। শেষ পর্যন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান গেয়ে—
মিঠু।। ভিক্ষে করছে?
শুভঙ্কর।। ওটাকে ভিক্ষে করা বলছ কেন? গান শুনিয়ে শ্রোতার মনোরঞ্জন করছে ভাবতে পারছ না কেন?-
অনিমা।। তুমি থামবে। ছি ছি ছি ছি ছি শেষে তোকে টাকার জন্য ——
মিঠু।। ছি ছি করছিস কেন? গান গেয়ে কেউ রোজগার করে না বুঝি? রেকর্ডিং সিনেমা ফাংশনে যারা গান গায়—তাহলে তারাও তো এক অর্থে ভিকি রি–
অনিমা।। তুইও দেখছি তোর জামাইবাবুর মতন কুযুক্তি খাড়া করছিস। ওতো আমাদের বংশের মান মর্যাদা ডুবিয়ে দিচ্ছে। সমাজে মুখ দেখাবো কিভাবে!!! সবাই যখন বলবে তোমরা কি ছোট ভাইটাকে খেতে পড়তে দাও না—-! ছি ছি ছি ছি! এ তুই কি করছিস সাগর?
শুভঙ্কর।। আমার তো মনে হয় নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। গুড সাইন। ডাক্তার মুখার্জি এটাই চাই ছিলেন। নিজের পায়ে দাঁড়াবার কথাটা ও যেদিন বুঝতে পারবে—-
অনিমা।। তাহলে তোমার কাছ থেকেই আশকারা পেয়ে—-
শুভঙ্কর।। আসকারা নয়। বলো প্রেরণা। আমি চললাম। (ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে। তারপর বাইরে সাগরের সঙ্গে মুখোমুখি হবে। এবং আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকবে। কারণ সাগর নয়, তার সামনে এখন চার্লি চ্যাপলিন দাঁড়িয়ে আছে) কে আপনি? (চ্যাপলিন গান গেয়ে উঠবে।
গান।।
আওয়ারা হু আওয়ারা হু —–সাগর ভি হু —!
চ্যাপলিন নানা রকম মুকাভিনয় করবে। শুভঙ্কর তারপর চিনতে পারবে ।
শুভঙ্কর।। বাড়িতে কাউকে না বলে বেরিয়ে গেলি কেনো? জানিস না সবাই দুশ্ চিন্তা করে।
যা ভেতরে যা। তোর তোর নাটকটা র দফারফা করে ছারবে। তবে তুই জানো বাড়াবাড়ি করিস না।
সাগর।। তুমি কোথায় যাচ্ছ জামাইবাবু? তুমি থাকলে ভালো হতো। মানে নাটকটা জমে যেত-
শুভঙ্কর।। অফিস—- তোকেও আমার সঙ্গে কাল থেকে বেরোতে হবে।
সাগর।। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে কিন্তু। অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে। নিজের পায়ে দাঁড়াবার একটা উপায় বার করে ফেলেছি। অনিমা এবং মিঠুও সাগরের গলা শুনে বেরিয়ে আসবে। অনিমা এগিয়ে গিয়ে সাগরকে ঠাস করে চর মারবে। সাগর সঙ্গে সঙ্গে দিদিকে প্রণাম করবে। মিঠু হাসতে থাকবে।
সাগর।। বিশ্বাস করো দিদি বেরিয়ে যাবার সময় তোমাকে প্রণাম করা হয়নি। তখন তুমি ঘুমাচ্ছি লে। তোমার ঘুম ভাঙাতে চাই নি। কত রাত পর্যন্ত তুমি জেগে থাকো।
অনিমা।। তাই বলে আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়ে কাঁদাবি! (ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে) কিন্তু এসব কি? তুই বহুরূপী সেজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করছিস?
মিঠু।। আমাকে তো বলে যেতে পারতিস—-দাদা।
সাগর।। তুইও তখন ঘুমোচ্ছিলি। রাত জেগে পরীক্ষার পড়া করিস। এমবিএ করছিস। কত কত বই তোকে পড়তে হয়।তাই ভাবলাম—
অনিমা।। সং সেজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান গেয়ে ভিক্ষে করবি?
সাগর।। ভিক্ষা করবো কেন! আসলে আমি তো ক’দিন ধরে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। লেখাপড়া জানিনা কে দেবে চাকরি। একদিন মামার বড় ছেলে আমাকে বলল, তোর তো খুব ভালো গলা। তুই চাকরি করবি কেন? যারা গান গায় তাদের অনেক পয়সা! কথাটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টা করে দেখলাম। (গান গাওয়া শুরু করবে।)(গান।। শোনো বন্ধু শোনো এই শহরের ইতিকথা—-ইটেরও পাজায়, লোহার খাঁচায় দারুণ মর্ম ব্যথা!) বিশ্বাস করো দিদি। তিন দিন বেশ কয়েকটা জায়গায় গান গাইলাম। আমার সামনে টাকার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।অনেকগুলো টাকা পেয়ে গেছি দিদি! এই দেখো–
অনিমার চোখে জল নেমে আসে।
সাগর ।। তুমি জানো না দিদি, ষাট সত্তর বছর আগে দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, সলিল চৌধুরী, নির্মলেন্দু চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস আরো কত কত বড় বড় মানুষ কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে বেড়াতে ন। আমি বইতে পড়েছি পল রবসান ও আমেরিকার বিভিন্ন শহরে গান গাইতেন। সেই যে বিখ্যাত গানটা মনে আছে? (গান গাইবে।) (গান।। বিস্তীর্ণ দুপারে অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনি নিঃশব্দে নিরবে ও গঙ্গা তুমি বইছো কেন?)
অনিমা।। এসব আমার জানার দরকার নেই। আমার ভাই হয়ে তুই রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান গাইবি না বুঝতে পারলি। এতটা বেলা হল পেটে তো কিছু পড়েনি। সংয়ের পোশাকটা খুলে বাথরুম থেকে পরিষ্কার হয়ে আয়। খাবার আনছি। চুপ করে এখানে বস । (রান্নাঘরে যাবে)
সাগর।। শোনো দিদি, মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর থেকে কলকাতায় এসে শরৎ পন্ডিত দাদাঠাকুর ও কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে নিজের বই বিক্রি করতেন। (গান।। এই কলকাতা আজব ভুলে ভরা। হেথায় বুদ্ধিমানের চুরি করে বোকায় পড়ে ধরা।)
মিঠু।। তুই কোন যুগে পড়ে আছিস রে সাগরদা। গঙ্গা নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। যুগটাই যে অন্যরকম হয়ে গেছে। সবকিছু পাল্টে গেছে। এসব গান কাদের শোনাচ্ছিস? এগুলো আজকাল আর কেউ শুনতে চায় না! তাছাড়া অনেক রকম বহুরূপীর পোশাক থাকতে এটা কেন?
সাগর।। মিরাকেল হয়ে গেল যে।
মিঠু।। মিরাকেল মানে? ব্যাপারটা খুলে বলবি?
(সাগর এবার চাপলিনের মুখোশ খুলে ফেলে। গায়ের কোটও খোলে।)
সাগর।। ক’দিন ধরে এই মানুষটার অনেকগুলো সিনেমা দেখে ফেলেছি। দেখতে দেখতে এই মানুষটা যেন আমার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠলো। আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। গতকাল রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বারান্দায় পায়চারি করছিলাম। তারপর চলে গেলাম বাগানে। চমকে উঠলাম। পশ্চিম দিকে যে বেদিটা আছে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে —
আলোর পরিবর্তন। বেদির ওপরে চার্লি চ্যাপলিন নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করছে। আমাদের সাগর দূর থেকে চ্যাপলিন কে দেখতে পেয়ে বলে উঠবে—-
সাগর।। তুমি?
চ্যাপলিন।। ইয়েস। আইএম—চার্লি চ্যাপলিন ইন ক্যালকাটা ।
সাগর।। হোয়াট?
চ্যাপলিন।। ওই নামে একটা ছবি করবো ঠিক করে ফেলেছিলাম। চিত্রনাট্যের খসড়াও তৈরি হয়েছিল। যুদ্ধ বেধে গেল। ভয়ংকর বিশ্বযুদ্ধ। ভারতবর্ষে আর যাওয়া হলো না। যুদ্ধের পরেও অনেক চেষ্টা করেছিলাম—-রবীন্দ্রনাথের দেশে একবার ঘুরে আসব। ওই মানুষটার সঙ্গে ইংল্যান্ডে আমার দেখা হয়েছিল। তিনিও আমাকে শান্তিনিকেতনে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
সাগর।। are you alive?
চ্যাপলিন।। হোয়াই নট? শরীরটা আমার কবরের মাটিতে শুয়ে আছে। তবে মানুষটা আমি এখনো বিশ্ব পথিক। এবার ভাবছি ছবিটা কোরবো।
সাগর।। সে কি!!! আপনি তো—-
চ্যাপলিন।। কবরখানায় শুয়ে আছি? তাতে কি হল? কলকাতায় যখন আসতে পেরেছি, ছবিটা করে ফেলব। তবে নিজের চরিত্রে আমি তো আর অভিনয় করতে পারব না। তোমার মত একজনকে খুঁজছি। বেশ কিছুদিন ধরে তোমাকে ফলো করছি। তুমি পারবে।
সাগর।। কি যে বলেন না। আমি অভিনয়ের কিছুই জানিনা—-
চ্যাপলিন।। আমিও জানতাম না। মাত্র ছয় বছর বয়সে stag এ চলে এসেছিলাম। অভিনয় শিখতে হয় না। জীবন বোধ থাকলে হয়ে যায়। আমরা সবাই সারাদিন ওটা করছি।
সাগর।। কিন্তু বিষয়টা কি? গল্পই বা কি রকম?
চ্যাপলিন।। তোমাদের বাঙ্গালীদের বিষয়। ধরো তোমাকে নিয়ে যদি গল্প তৈরি হয়?
সাগর।। আমাকে নিয়ে গল্প মানে? আমার মধ্যে গল্প কোথায়?
চ্যাপলিন।। তোমার মধ্যে সংকট নেই? যন্ত্রণা নেই? তুমি কি জীবন যুদ্ধের ময়দানে দাড়িয়ে নেই ?
সাগর।। হ্যাঁ। তাতো আছি—
চাপলিন।। ব্যাস। আর কি চাই? তোমাকে ফলো করতে করতে তোমার গল্পটা ধরতে পেরেছি।
সাগর।। কি রকম?
চ্যাপলিন।। তুমি পথ খুঁজে পাচ্ছো না। ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছ না। এক কথায় জীবনের অর্থটা তোমার কাছে বারবার গুলিয়ে যাচ্ছে। তাইতো?
সাগর ।। একদম ঠিক বলেছেন।
চাপলিন।। তাহলে আর কি। আমার সেই ট্রাম্পের পোশাকটা পরে ফেলো। তাহলেই দেখবে তুমি যা সব খুঁজে পাচ্ছিলে না —-প্রতিদিন যেসব সংকটের মধ্যে ঝামেলার মধ্যে পড়ে যাচ্ছো, সেখান থেকে বেরিয়ে আসবার একটা ঠিকানা খুঁজে পাবে—-
চ্যাপলিন এবার সাগরকে একটা কোট, একটা টুপি, হাতের ছড়ি ছুড়ে দেবে। মন্ত্রমুগ্ধের মত সাগর সেগুলো পরে নেবে। তারপর মুখে বসিয়ে নেবে চ্যাপলিনের সেই বিখ্যাত মুখটা। শুরু হয়ে যাবে রাতের কুয়াশার মধ্যে বেদীতে দাঁড়িয়ে থাকা চ্যাপলিন আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সাগরের নানা রকম মুকাভিননয় ।
আবার আলোর পরিবর্তন।
হো হো করে হাসতে থাকে মিঠু। অনিতা খাবার নিয়ে এলো।
মিঠু।। বানিয়ে বানিয়ে আজকাল দেখছি, গল্প বলতে ও পারিস। চ্যাপলিন ইন ক্যালকাটা। আর সেই ছবির নায়ক তুই!!! মিরাকেল মিরাকেল। ফাটাফাটি স্টোরি। তাহলে আমাকেও নাটকটা লিখতে হবে। নাটকের বাজারে খরা চলছে। এই সাবজেক্টটা জমে যাবে।
হাসতে হাসতে বাথরুমের থেকে চলে যাবে মিঠু।
অনিতা।। কি হলো খাবিনা?
মিঠু।। সাগরদার গল্প শুনে পেট ভরে গেছে। আমাকে এক্ষুনি স্নান করে বেরুতে হবে। ক্লাস কামাই করা যাবে না। (আবার হাসি) চ্যাপলিন ইন ক্যালকাটা। সেই ছবির নায়ক আমাদের সাগর বাবু! সেই সিনেমার আমার একটা চান্স হবে? হলিউডের সিনেমা। ভালো পেমেন্ট দেয়। একবার নাম করতে পারলে, চাকরি করে কোন শালা।
অনিতা।। কি বলছিস বলতো—-
মিঠু।। আমি কিছুই বলছি না দিদি । তোমার ভাই বলছে। চ্যাপলিন ইন ক্যালকাটা। (হাসি)
ওকে জিজ্ঞেস করে দেখো না—–
সাগর এবার উঠে দাঁড়াবে। তারপর চ্যাপলিনের পোশাক পরিহিত অবস্থায় বলে উঠবে—
সাগর ।। ইয়েস ইয়েস। নাউ আই এম হিরো অফ চ্যাপলিন ইন ক্যালকাটা।
আবহ সংগীত বেজে উঠবে।
আলোর পরিবর্তন ঘটবে। আবার সেই বাগান। বে দী তে চ্যাপলিন কে দেখা যাচ্ছে। একটু দূরে সাগর।
সাগর।। তোমার খোলসের মধ্যে ঢুকে আম পাবলিক – কে জয় করে নিলাম। অথচ আমার বাড়ির লোকেরা আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না কেন বলতো?
চ্যাপলিন।। কেন দেবে, ওরা তোমার কাছের লোক। ওখানে ফাঁকিবাজী চলবে না বাবা। বিশ্বাসযোগ্যতা চাই। সে টাতো বাইরের পোশাক দিয়ে হয় না ।
সাগর।। তাহলে কি করতে হবে?
চ্যাপলিন।। অনেক বড় বড় অভিনেতাকে দেখেছি রাজার মেকাপে বেশ নিখুঁত। কিন্তু অভিনয়ের সময় রাজা হয়ে উঠতে পারে না।
সাগর।। তাহলে আমাকে কি করতে হবে?
চ্যাপলিন।। চার্লি চ্যাপলিনের পোশাক পরে হেমন্ত মুখার্জীর গান শুনিয়ে তুমি পাবলিক কে মজা দিতে পেরেছ। ভোটের সময় ভোটবাবুরা এইভাবেই পাবলিকের নজর ঘুরিয়ে দেয়। পাবলিক এর ভোট লুট করে।
সাগর।। হ্যাঁ। তাইতো শুনেছি। তাহলে আমাকে কি করতে হবে?
চ্যাপলিন।। একবার কি হয়েছিল জানো? তখন আমার খুব নাম ডাক। লন্ডনে যেমন খুশি সাজো প্রতিযোগিতায় সবাই আমার পোশাক পরে চ্যাপলিন সেজেছিল। আমিও সেই প্রতিযোগিতায় ঢুকে পড়েছিলাম। অথচ প্রতিযোগিতায় আমি লাস্ট হয়ে গেলাম। কেন জানো?
সাগর।। না তো —-!
চ্যাপলিন।। আমার অভিনয় ছিল নির্ভেজাল। সেই সঙ্গে একরকম অহংকার আমার মধ্যে ছিল। আমার বিশ্বাস ছিল আমি ফাস্ট হব। কিন্তু আমার শিল্পে আমার সিনেমায় আমার মধ্যে কোন অহংকার ছিল না। ভেজাল আর নির্ভেজালের দ্বন্দ্ব ছিল না। পৃথিবীর মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছিলাম। সাধারণ মানুষ আমাকে তাদের একজন বলে গ্রহন করতে পেরেছিল। কারণ আমি সাধারন মানুষের মত বারবার মার খেয়েছি। খিদের জ্বালায় ছটফট করেছি। বারবার জেলে যেতে হয়েছে। বাঘ সিংহের খাঁচার মধ্যে পড়তে হয়েছে। চূড়ান্ত অপদস্ত হতে হতে, আছাড় খেতে খেতে বারবার আমি উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছি।
সাগর।। তাই তো। আমি কি বোকা! আমি তো একজন বড়লোক বাবার আদুরে ন্যাকা ছেলে। এতটা বয়স হল অথচ এখনো দিদির আঁচলের তলায় নিরাপদ আশ্রয়ে জীবনের অমূল্য সময় কাটিয়ে দিচ্ছি।
চ্যাপলিন।। আমার সিনেমার যে নায়কের ভূমিকায়তোমাকে অভিনয় করতে হবে, সে কিন্তু একটা কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে। কেন বেঁচে আছি? বেচে থেকে কি লাভ? কিছু একটা তো করতে হবে এই জীবনটাকে নিয়ে।
সাগর।। ঠিক এইরকম একটা কথা আমার জামাইবাবু আমাকে বলেছিল। নিজের পায়ে দাঁড়াও। নিজেকে চিনতে শেখো। নিজেকে খুঁজে নাও——-
বিচিত্র আলোর ঝলকানির মধ্যে সাগরের কতগুলো চারিদিক থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে।
সাগর।। নিজের পায়ে দাঁড়াও! নিজেকে চিনতে শেখো! নিজেকে খুঁজে নাও—–
বিচিত্র আবহ সংগীতের সঙ্গে আবার দৃশ্য পরিবর্তন ঘটবে।
খাবার টেবিলে মিঠু আর সাগর বসে আছে। খাবার পরিবেশন করতে করতে অনিতা বলবে।
অনিতা।। আমি কিন্তু তোকে স্পষ্ট কথা বলছি সাগর, ছোটবেলা থেকে তুই আমাকে অনেক জ্বালিয়েছিস। এত বড় হয়েছিস, এখনো জ্বালাচ্ছিস। নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্য তোকে সং সেজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করতে হবে না।
মিঠু।। কে শুনছে তোমার কথা দিদি। তোমার ভাই এখন লায়েক হয়ে গেছে। সেই সাগর দা আর নেই।
সাগর।। আমাকে তো কেউ বলল না ভিখারি। আমি তো দেখলাম আমার গান শুনবার জন্য তোদের মত মেয়েরাও ভিড় করেছিল। কয়েক জায়গায় ওরা আমার নাম জানতে চাইলো। আমার ঠিকানা জানতে চাইলো। ফোন নাম্বারটা চাইলো। আমি কেন সিনেমায় গান গাই না সেটাও জানতে চাইলো। এইতো গত রবিবার একটা টিভি চ্যানেলের লোক আমার ছবি তুললো। ইউটিউবে দেবে বলে কেউ কেউ ভিডিও করল।
মিঠু।। মেয়েরা তোর কাছে যখন তোর ফোন নাম্বার চাইলো তুই দিলি?
সাগর।। কি করে দেব। আমি তো মোবাইল ব্যবহার করি না। বললাম আমার কোন ফোন নাম্বার নেই। টিভি চ্যানেলের লোকগুলোকেও বললাম, আমার তো কোন ঠিকানা নেই।
মিঠু।। তোর ঠিকানা নেই মানে? তাহলে থাকিস কোথায়? এটা কার বাড়ি?
সাগর।। এটাতো দিদির বাড়ি। তোদের বাড়ি। আমার তো কোন বাড়ি-ঘর নেই। (এই সময় অনিতা আবার রান্নাঘরে গিয়েছিল।)
মিঠু।। এটা শুধু আমাদের বাড়ি? দিদি শুনলে দুঃখ পাবে। অনায়াসে এসব কথা বলতে পারলি। তুই তাহলে আমাদের কেউ না?
সাগর।। আমি তোদের ভাই। এক মায়ের পেটের ভাই। তাই বলে এটা আমার ঠিকানা কি করে হতে যাবে?
মিঠু।। এসব কি যা তা বলছিস তুই?
সাগর।। আমি বলতে যাব কেন। শাক্য মুনির বংশধর
সিদ্ধারথ গৌতমি এই ভাবেই তো বলে গেলে ন। মানুষের ঠিকানা কখনো একটা বাড়ি হতে পারে না। বিশেষ কোনো শহর বা দেশ হতে পারে না। তাইতো রাজপ্রাসাদ, সুন্দরী বউ, ফুটফুটে একটা বাচ্চা কে ফেলে এসে মাটির পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন সিদ্ধার্থ মানুষের ঠিকানার সন্ধান করতে।
মিঠু।। তাহলে তুইও কি আমাদের ছেড়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াবি? সাগর।। এখনো কিছু জানিনা। কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু জানি, আমাকে আমার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অন্যের পায় যারা দাঁড়ায় তাদের বলে প্যারাসাইট। শোষক। পর নির্ভরশীল।
খাবার নিয়ে ফিরে আসে অনিতা।
চলবে—
বিঃদ্রঃ – এই নাটকের সব রকম আইনি অধিকার নাট্যকারের কাছে থাকবে। নাট্যকারের লিখিত অনুমতি ছাড়া অভিনয় করা যাবেনা।