বাংলা ভাষা ও বাংলা থিয়েটার

- Advertisement -

সুব্রত কাঞ্জিলাল

সম্প্রতি নাটকের কাজ নিয়ে শিলচর গিয়েছিলাম। বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এখানকার বাঙালিরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন। ষাট সালের ভাষা আন্দোলনের সময় এই অঞ্চলের প্রায় এক ডজন বাংলাভাষী মানুষ বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। প্রশাসনের সঙ্গে তাদের যে লড়াই চলছে আজও তা থেমে নেই। আমি যেমন বাংলাদেশে গিয়ে ঢাকা শহরে শহীদ মিনারের সামনে গিয়ে মাথা নত করি। ঠিক একইভাবে এই অঞ্চলে এলে আমার তীর্থ দর্শন হয়ে যায়।  

আমি কলকাতা শহরে জন্মেছি। সে সময় আপার সার্কুলার রোড এই শহরের ভিআইপি রোড ছিল। দমদম বিমানবন্দর থেকে দেশ-বিদেশের ভিআইপি’রা যশোর রোড হয়ে এই রাস্তা দিয়েই রাজভবনে প্রবেশ করতেন। এই রাস্তার ওপর একটি চারতলা বাড়িতে আমার জন্ম হয়েছিল। পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে সত্তরের দশকের অন্তিম পর্যন্ত এই বাড়িতে থেকে কলকাতাকে বদলে যেতে দেখেছি। বাংলা ভাগের পরবর্তী সময় শিয়ালদা স্টেশন, মির্জাপুর স্ট্রিট, হারিসেন রোড তথা কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ফুটপাতে হাজার হাজার উদ্বাস্তু মানুষের জীবন্ত লাশ ঠেলে , সে সময় হাঁটতে হতো আমাদের। মায়ের গর্ভে থেকে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং তথা দাঙ্গা দেখেছি। তারপর দেখেছি খাদ্য আন্দোলন, ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ভিয়েতনাম যুদ্ধসহ অসংখ্য সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের ছবি আজও আমার চোখে স্পষ্ট। ষাটের দশকের অন্তিমে তিন তিনবার এখানের রাষ্ট্রপতি শাসন হয়েছিল। সিদ্ধার্থ শংকর এর সরকার গণতান্ত্রিক মানুষের টুটি টিপে

ধরে কলকাতার ওলিতে গলিতে নবযৌবনের যে রক্তপাত ঘটিয়ে গেছে সেসব ইতিহাসেরও সাক্ষী আমি। গণনাট্য সংঘ থেকে গ্রুপ থিয়েটারের আন্দোলনের সুবিশাল ঐতিহ্যের ইতিহাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উপভোগ করেছি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে যাবার সুবিশাল ঐতিহ্যেরও প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছে আমার দেহ মন।

একটা সময় পাঁচজন বাঙালি যুবক এক জায়গায় হলে তারা একটা লিলট ম্যাগাজিন কিংবা গ্রুপ থিয়েটারের দল শুরু করে দিত। এপার বাংলার বাঙালির এইসব ইতিহাস ঐতিহ্য ৯ এর দশক থেকে হারিয়ে যাওয়া শুরু করল। ঠিক যখন থেকে খোলাবাজার অর্থনীতির হিরোশিমা বাতাসের মতো বাংলার আকাশ ঢেকে দিতে শুরু করলো। তবে ওই দশকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমূখ আজকাল পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা চর্চার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার, রাজ্যের সমস্ত দোকান অফিস কাছারিতে সাইনবোর্ডে বাংলা ভাষা ব্যবহার , আরো সব অনেক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। পরিতাপের কথা এই যে এই আন্দোলন শুধুমাত্র কলকাতা কেন্দ্রিক ছিল। অধিকাংশ বাঙ্গালী এই আন্দোলনের ব্যাপারে উৎসাহ প্রদর্শন করে নি।

এই পারের বাঙালিরা একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আদিখ্যেতা করে। একুশে ফেব্রুয়ারির উত্তাপ, তাজা রক্তের স্বাদ কোনদিন অনুভব করেনি। ২০০০ সালের পরবর্তী বাঙালি আর বাঙালি নেই। আজকের বাঙালি ব-কচ্ছপ রুপ ধারণ করেছে।

শিলচরে দেখে এলাম রাজ্যটা অসম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও রাস্তার দোকানে দোকানে অফিসে কাছারিতে প্রতিটি সাইনবোর্ড বাংলা ভাষায় লেখা। সরকারি কাজ বাংলা ভাষায় চালানোর দাবি নিয়ে আজও আন্দোলন অব্যাহত। বাংলা ভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব এখানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এক ডজনেরও বেশি নাটকের দল নিয়মিত চর্চা করে চলেছে। প্রতিবেশী ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে বাংলা সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারার আদান প্রদান প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে অব্যাহত গতিতে চলমান। এখানকার সুবিশাল বঙ্গভবনের সুবিস্তৃত কাজ চমকে দেওয়ার মতো। বাংলা সংস্কৃতির সুপ্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে এই ভবনে রয়েছে আর্কাইভ। রয়েছে লাইব্রেরী, সেমিনার হল, প্রকাশনা সংস্থা, একটি উৎকৃষ্ট রঙ্গমঞ্চ। এই রঙ্গমঞ্চে নিয়মিত ভাবে বাংলা থিয়েটার সঙ্গীত নৃত্য পরিবেশিত হয়। বঙ্গভবনের বর্তমান সভাপতি সঞ্জীব দেবল লস্কর বহু বছর ধরে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে নিরলস গবেষণা করে চলেছেন। শান্তনু সেনগুপ্তর মত আরো অসংখ্য যুবক যুবতী প্রবীণ মানুষদের কাজ প্রত্যক্ষ করার পর আমি অভিভূত, আনন্দিত। সঞ্জীব বাবুর একটা বই আজ থেকে দশ বছর আগে আমার হাতে এসেছিল। সেই বইটার থেকে আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল শিলচর।

বরাক উপত্যকা বাঙ্গালীদের ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য আন্দোলন। পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলা  সংস্কৃতির উষা কাল, স্বর্ণযুগ , বাঙালির উদ্ভব বাংলা ভাষার ইতিহাস এইসব বিষয় নিয়ে বড় বড় পন্ডিতরা অনেক গবেষণা লব্ধ বই লিখেছেন। বাংলা ভাষার জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় এর লড়াইও নিরামিষ লড়াই ছিল না। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র হয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত যে সাহিত্য গড়ে উঠেছিল তা এভারেস্টের শীর্ষ চূড়া স্পর্শ করেছে। এইসব সাহিত্য ছিল আন্তর্জাতিক মানের। তারপর সত্যজিৎ মৃণাল ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এরা ও দিগন্ত সৃষ্টি করলেন। উৎপল দত্ত ,শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা থিয়েটারকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দিলেন। যদুভট্ট থেকে শুরু করে লালন ফকির, রবীন্দ্রনাথ হয়ে হেমন্ত সলিল চৌধুরী পর্যন্ত বাংলা গানের যা কিছু সমৃদ্ধি ঘটেছিল।

আজ তা ধ্বংসের পথে। তাই বারবার প্রশ্ন উঠে যায়, বাংলা ভাষায় নাটক সিনেমা সাহিত্য সংগীত কাব্য চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে বটে, সেগুলো কি বাংলা সংস্কৃতির ৫০০০ বছরের ফসল? বাংলার মাটি, বাংলার জলবায়ু থেকে উৎসারিত?

বাংলা থিয়েটারের কথায় যদি আসা যায়, আমরা বিদেশী থিয়েটারের আদল, কঙ্কালটাকে গ্রহণ করেছি। এই আদলটাকেই মনে হয়েছে উৎকৃষ্ট মাধ্যম। তবে পৃথিবীর থিয়েটারের কথা যারা জানে তারা বলবেন চীন জাপান ভিয়েতনাম মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রসেনিয়াম থিয়েটারকে তাদের একমাত্র আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন নি। প্রত্যেক জাতি গোষ্ঠীর নিজস্ব যে নাট্য মঞ্চ সেইটাকে তারা প্রাধান্য  দিয়েছেন। এরা কেউ কোট প্যান্ট পড়ে ইংরেজ হতে চায় নি। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলেও সেই অঞ্চলের আঞ্চলিক নাট্যধারা অনেক বেশি গুরুত্ব পায়। সিনেমা মাধ্যমটাও ইউরোপ থেকে এসেছে। ঋত্বিক ঘটক কিন্তু এই ইউরোপীয় মাধ্যমটাকে বাংলার মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন বাঙালিয়ানা করে। এই কারণেই সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ঋত্বিক বাবু আমার থেকে অনেক বেশি বাঙালি।

মনে রাখতে হবে বিদেশি থিয়েটারকে রবীন্দ্রনাথও গ্রহণ করেন নি। উৎপল দত্তের থিয়েটারে ছিল ইউরোপ ও বাংলার যাত্রার অপূর্ব মিশ্রিত একটি থিয়েটার। উৎপল বাবুকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি যাত্রার মত করে নাটক লেখেন কেন? জবাবে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথও তো যাত্রার মত করে নাটক লিখে গেছেন। শেক্সপিয়ারের নাটকও তো যাত্রার মত করে লেখা। তিনি একথাও বলতেন থিয়েটার ও সিনেমার বিষয় হবে আন্তর্জাতিক। আঙ্গিক হবে দেশজ। এটাই তো কাম্য।

ভারতীয় গণনাট্য সংঘ দেশীয় থিয়েটারের চর্চা শুরু করে যাত্রা করেছিল। স্বাধীনতার পরবর্তী ভারতবর্ষে আমরা পথভ্রষ্ট হয়ে পড়লাম। ২০০ বছরের দাসত্ব আমাদের প্রকৃত অর্থে মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছিল।

ব্রিটিশ সংস্কৃতির উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞান সংস্কৃতি ইতিহাস যতটা গ্রহণ করবার প্রয়োজন ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি শাদা চামড়ার অন্ধকার দিকগুলোকে অনেক বেশি করে গ্রহণ করে ফেলেছি। আমরা কালা সাহেব হয়ে উঠতে চেয়েছি। এসবের মধ্যে কাল সর্পের মত দিল্লির শাসকদের হিন্দি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে। বিশেষ করে হিন্দি সিনেমার আফিম গুলোকে আমরা আমাদের সংস্কৃতিতে আসন পেতে দিয়েছি।

পশ্চিমবাংলার বাংলা সংস্কৃতি তাই জারজ সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৯ শে মে এই তারিখগুলো আমাদেরকে অন্তর থেকে স্পর্শ করে না। বাংলা থিয়েটার আজ তাই বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে অন্তর্লিন হতে পারে না। বাংলা ভাষার নাটক এই কারণে বাংলা নাটক নয়। এই কথাটা পঞ্চাশ বছর আগে নবান্নের নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসংখ্য বার উচ্চারণ করে গেছেন । শম্ভু মিত্র মশাই ও একটা জাতীয় থিয়েটারের কথা বারবার বলে গেছেন। এই একই আর্তনাদ , আত্ম বিক্ষেপ করে গেছেন শিশির ভাদুড়ী। এপার ওপার বঙ্গভূমির বিভিন্ন জেলায় জেলায় যেসব শক্তিশালী লোকনাট্য সেদিন পর্যন্ত বাঙালির আত্মপরিচয়ের সাক্ষ্য বহন করতো আজ সেসব ধ্বংসের পথে। মানবতার সব থেকে বড় শত্রু পুঁজিবাদ, ফ্যাসিবাদ, বাজার অর্থনীতির গোলক ধাঁধায় শ্রমজীবী মানুষকে ঠেলে দিয়েছে। শহরের মস্তিষ্ক জীবীদের কৃতদাস করে ফেলেছে। এই কারণেই এখন আর লালন ফকির, মুকুন্দ দাস রা জন্মায় না।

মাঝে মাঝেই বিদ্যাসাগরকে মাঝরাতে আমার বাড়ির ছাদে দেখতে পাই। তার সঙ্গে অনেক কথা হয়। তিনিও আক্ষেপ করে বলেন, বাঙালির বর্ণপরিচয় ঘটে নি। বিজন ভট্টাচার্য মহাশয়ের সঙ্গে ৭১ সালে তার সম্পাদিত নীলদর্পণ নাটকের প্রযোজনায় সহকারি হিসেবে কাজ করেছিলাম। সেই বিজনদা স্বপ্নের মধ্যে দেখা দেন। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ঋত্বিক খাইলো মদ। নেশা হইল বাঙালির। এই বাঙালি অধঃপতনের সিঁড়িতে খাড়াইয়া পড়ছে।

শিলচরে এসে কেন জানি না মনে হয়, এইখানে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। পাশেই তো রয়েছে শ্রীহট্ট। বাংলার প্রথম বিপ্লবী, মশাল হাতে সশস্ত্র মিছিল করা নিমাই পন্ডিত এই শ্রীহট্টে এসেছিলেন জীবিকার সন্ধানে। রয়েছে ত্রিপুরা। জাতি উপজাতি অধ্যুষিত বাঙ্গালীদের আরো একটি শক্ত মাটি। বহু সংগ্রামের ঘাঁটি। কলকাতার মতো ওখানে সবদিক থেকে পচন ধরে নি। ওখানকার বাংলা থিয়েটার ঐতিহ্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে পড়ে নি। আমার বিশ্বাস এই শিলচর থেকে শুরু হবে খাঁটি বাংলা থিয়েটারের জয়যাত্রা।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -