সুব্রত রায়
মৃনাল সেনের প্রয়াণের মধ্য দিয়ে ভারতীয় চলচিত্রের একটি বিশেষ যুগের অবসান হলো। আমাদের চলচ্চিত্রে যাঁরা আভিজাত্যের মাত্রা যুক্ত করেছিলেন সত্যজিৎ ও ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে তাঁর অন্যতম স্থপতি তিনি। কিন্তু চিন্তা করলে দেখা যাবে যে সত্যজিৎ যখন ঊনিশ শতকীয় মানবতাবাদ কে চলচিত্রীয় বাস্তবে রূপান্তরিত করার চেষ্টায় রত এবং যখন তিনি চলচিত্রকে নৈঃশব্দের মাত্রা দিচ্ছেন বা ঋত্বিক যখন ইতিহাসের উপাদানগুলিকে পৌরাণিক লোককথার সঙ্গে জুড়ে একধরনের বিস্ফোরক বাস্তবতা তৈরী করছেন, মৃনাল তখন বেছে নিয়েছেন মধ্যবিত্তের ও নাগরিকতার পৃথিবী, যার ফলে আমাদের ছায়াছবির ইতিহাসে তৈরী হচ্ছে “বাইশে শ্রাবণ”, “ভুবন সোম”, “আকালের সন্ধানে”। এত স্ববিরোধ কোনো চলচিত্রকারের নেই।কিন্তু এক নিঃশ্বাসে নিজেকে পাল্টে নেওয়ার এত অনিঃশেষ আবেগ কি অন্য কোনো চলচিত্রকারের ছিল? মৃনাল সেন কতটা প্রতিভা তারা খেয়াল করেন না যে গতানুগতিক চলচিত্রকার হওয়া যাঁর স্বাভাবিক ছিল,তিনি কোন প্রাণালিবদ্ধ সাধনায় বিশিষ্ট হয়ে উঠলেন?
মৃনাল সেনের চলচিত্র পরিচালক হিসাবে হাতেখড়ি হয় “রাতভোর” চলচিত্রের মধ্যে দিয়ে।স্বরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় এর কাহিনীতে এই চলচ্চিত্রের প্রযোজনা করেছিলেন এস.ভি.প্রডাকশন।মজার কথা হলো এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণে আর্থিক ভাবে কোনো বেগ পেতে হয়নি মৃনাল সেনকে।চলচ্চিত্রের আগে গণনাট্য সংঘ,স্টুডিওতে ট্রেড ইউনিয়ন ইত্যাদির সঙ্গে জড়িয়েও মৃনাল সেন লেখালেখির কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
১৯৫৫ সালের ২১শে অক্টোবর পেল মৃনাল সেনের প্রথম পরিচালিত ছবি”রাতভোর”। উত্তমকুমার ও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় জুটি বেঁধে অভিনয় করেছিলেন এই চলচিত্রে। ছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা ছবি বিশ্বাসও। যদিও এই চলচ্চিত্রটি তেমনএকটা সাফল্য পায়নি।এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে বেশ হতাশই ছিলেন তিনি।
মৃনাল সেনের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র”নীল আকাশের নিচে”মুক্তি পায় আরো তিন বছর পরে। “নীল আকাশের নীচে” চলচ্চিত্রটি মোটামুটি সাড়া ফেলেছিল। এই চলচিত্রে মূল চরিত্রে অভিনয় করেন বিখ্যাত অভিনেতা কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। এই চলচ্চিত্রে ব্রিটিশ ভারতের শেষ দিককার পটভূমিকায় কলকাতার সমাজের নানা স্তরের মানুষের জীবন তুলে ধরা হয়েছিল। যেখানে এক চীনা ফেরিওয়ালা ও বাসন্তী নামের এক নারীর মধ্যেকার প্রেম চিত্রায়িত করা হয়েছে। এই চলচ্চিত্রে ওপর ভারতবর্ষের সেন্সার কর্তৃপক্ষ প্রথমে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।এটিই ছিল ভারতের প্রথম নিষেধাজ্ঞা পাওয়া চলচ্চিত্র। যদিও দুমাস পরে এই চলচিত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল।
মৃনাল সেনের তৃতীয় চলচ্চিত্র মুক্তি “বাইশে স্রাবন” মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬০ সালে। এই বছরই মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায়ের “দেবী”, ও ঋত্বিক কুমার ঘটকের”মেঘে ঢাকা তারা”। “বাইশে শ্রাবন”ই আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিত করে তোলে মৃনাল সেনকে। এই চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে ভীষন তৃপ্তি পেয়েছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন”আমার তৃতীয় ছবি বাইশ শ্রাবন “আমাকে তৃপ্তি দেয়।অসাধারণ কিছু নয় কিন্তু এই ছবি আমার একান্ত আপন। দুর্ভিক্ষের করাল প্রভাবে কিভাবে মানুষের সুকুমার প্রবৃত্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, সেটা তুলে ধরাই ছিল আমার উদেশ্য। এটা এক দুর্বিষহ সময়ের নিষ্ঠুর ছবি। স্বভাবিক ভাবেই এই ছবি বাণিজ্যিক সাফল্যের মুখ দেখেনি। তা সত্বেও “বাইশে শ্রাবন” এর এক অন্তর্লীন জোরের শক্তি আমার ভবিষ্যত চলচ্চিতের প্রেরণা। আমি নিয়মিত ছবি করা শুরু করলাম”।
বাইশে শ্রাবন চলচ্চিত্রে উঠে এসেছিল প্রত্যন্ত এক গ্রামের অজস্র সমস্যার কথা। যেখানে এসেছি তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ, অভাবের গল্প। এটা ছবির মেটা ডিসকোর্স। কিন্তু সিঙ্গাড়ার পুরের মতো ছিল প্রিয়নাথ ও তাঁর স্ত্রীর প্রণয়উপাখ্যান।যেখানেই অভাব,অবিশ্বাস ও সন্দেহ মিলেমিশে একাকার। আর যে কারনে এই ছবি বাংলা চলচিত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো বাইশে শ্রাবন বাঙালির মননে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়ান দিবস হিসাবেই বেশি স্মরণীয়। কিন্তু ছবিতে এই তারিখটি প্রিয়নাথ ও তার স্ত্রীর বিবাহের তারিখ। তাদের কাছে এটি তাদের বিবাহের তারিখ হিসাবেই বেশী স্মরণীয়।ইতিহাসকে মৃনাল সেন মধ্যবিত্ত জীবন ধারার মধ্যে নিয়ে এলেন।
আর একটা কথা বলতে পারি বাইশে শ্রাবন ছবিটি কোনোমতেই মাধবী—-জ্ঞানেশ এর প্রণয় উপাখ্যানটিকে স্মরণচিহ্ন মনে হত না, যদি এ মৃনাল সেন ইতিহাসের অমঙ্গলকে পারিবারিক বিস্তারের মধ্যে উৎকীর্ণ করে না দিতে পারতেন। স্পেক্টটাকেলের বিরুদ্ধে দৈনন্দিনতা —আধুনিক চলচ্চিত্রে তাত্বিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন প্রসঙ্গ। একটি তুচ্ছ দম্পতির তুচ্ছতর মিলনরজনী কীভাবে পরিবার, প্রেম বা দাম্পত্য জাতীয় ধারনাগুলিকে আপেক্ষিক প্রমান করল, তার অন্যতম নিদর্শন এই ছবি।