নৈতিক রায়
সম্প্রতি তপন থিয়েটারে অভিনীত হল কাঁচরাপাড়া ফিনিক প্রযোজিত নাটক “বার বার ফিরে আসি”। এক অনিবার্য রাজনৈতিক মঞ্চপ্রকাশ। এই সন্ধ্যার আয়োজক গোষ্ঠী ছিল বিভাব নাট্য একাডেমী। তাদেরই প্রতিষ্ঠা দিবসে আমন্ত্রিত ছিল ফিনিক নাট্যদলের এই নাটকটি।
নাটকটির মঞ্চ নির্মানে টাইম এন্ড স্পেসের এক দ্যোতনাকে খুব সুন্দরভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। নাট্য রচনার এক জটিল আবর্তে ঘুরপাক খাচ্চেন নাট্যকার চরিত্র তন্ময় দত্ত। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সত্যের মুখোমুখি হয়ে কখনও পিছিয়েছেন, কখনও এগোনোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অতীত তাঁকে বারাবার টেনে নিয়ে ফেলেছে সেই সত্যের অন্বেষণেই। “বার বার ফিরে আসি” এই নাটকের নাট্যকার শান্তনু মজুমদার এই সময়ের এক বলিষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে সুপরিচিত। তাঁর বলিষ্ঠ লেখনী শক্তির, সংলাপ বয়ান ও দৃশ্য নির্মানের ক্ষমতা নাটকটিকে অন্যমাত্রা দান করেছে। চরিত্র নাট্যকার তন্ময় দত্ত যেন এই নাটকের মেরুদন্ড যা সটান থেকে, মঞ্চে ঘটিয়ে চলে অনবদ্য সব নাট্য মুহুর্ত। পলিটিক্যাল এথিক্স-কে মর্যাদা দিয়ে, বর্তমান রাজনৈতিক লুম্ফেন কালচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সপাটে চড় মেরেছেন চরিত্র রনা বারুইকে। এক সময়ের ভুল বা অন্যায় যার অপরাধবোধ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে ক্লাইল্যাক্স নির্মানের পথে। একসময় কলম থমকে গেছে। কিন্তু ঘটনার আবর্তে পাক খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত রুখে দাঁড়িয়েছেন সিনা টান করে। অভিন্ন হৃদয় বন্ধুর মৃত্যুর বীভৎসতায় নিজেকে সরিয়ে রেখে, এক কদর্য আপোষের কর্দমাক্ত পথে পিছলে পড়েও নিজেকে তুলে এনেছেন সর্বসমক্ষে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিকে রুখে দিয়েছেন।
এ নাটক এক রাজনৈতিক বীক্ষা দিয়ে যায় মঞ্চ পরিসরে। যার জন্য অন্য এক সকাল অপেক্ষা করেছিলই, হয়তো অনিবার্যভাবেই। মিঠু আর শান্তার মঞ্চ উপস্থিতি যেন নাটকের গর্ভে গড়ে তোলে সুতীব্র সুনামি। যা নিমেষে আছড়ে পড়ে মঞ্চের ওপর। প্রজন্মের রূপক হয়ে মিঠু পিস্তল হাতে রুখে দাঁড়ায় রনার পাঠানো গুন্ডা জুয়েল ডায়মণ্ডের বিরুদ্ধে। আর রুখে দেওয়া মুহুর্ত নির্মান যেন এক আবেদন সৃষ্টি করে, যা সেই কল্পিত বা অঙ্কিত দরজা দিয়ে জনস্রোত এসে হুঁশিয়ারির উচিত শিক্ষা দিয়ে যাবে রাজনৈতিক লুম্ফেনদের। যা আবহের অনিবার্যতার অপেক্ষা করছিল। আর সেখানেই পরিসমাপ্তি হলে নাটকের ছন্দ মাত্রা উন্নীত হত হয়তো অনেক বেশী। নতুন ভোরের আলোর অপেক্ষায় বাড়তি চিরায়ত দৃশ্য সংযোজন না হলেও নাট্যের কোনও ক্ষতি হোত না বলেই মনে হয়।

নাট্যকার হিসেবে সফল শান্তনু মজুমদার। আর এই নাটকের নির্দেশক কাবেরী মুখার্জীও সমান ভাবে সফল। নির্দেশনা ও লেখনীর তাল লয় ছন্দে ছিল বলেই নাটকটি দর্শক মনে টিকে থাকবে। এরপর এই নাটকের অভিনয়। এই নাটকের সামগ্রিক পরিকল্পনায় যার নাম, দলেরই প্রাণপুরুষ কনক মুখার্জী নিজে অভিনয় করেছেন তন্ময়ের ভূমিকায়। এরকম একটি চরিত্র মঞ্চে দক্ষতার সাথে সচল করেছেন। বাচিক ও কায়িক অভিনয়ের ছন্দ পতন হতে দেননি কোনওভাবেই। বন্ধু অম্লান রায় চরিত্রে অবতীর্ন হয়ে প্রশান্ত কুমার দে বেশ সাবলীল থেকেছেন। তাঁরই হাত ধরে সঞ্চালক প্রশান্ত আর অভিনেতার প্রশান্তর টাইম এন্ড স্পেসের খেলাটা সম্পন্ন হয়েছে বেশ দক্ষতার সাথেই। নেগেটিভ ক্যারেক্টার হিসেবে রনা বারুই চরিত্রে মহাদেব সেনের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। শান্তা ও মিঠু চরিত্রে যথাক্রমে মৌলি সেন ও অমিতা সেন বেশ সবল, ও মঞ্চে সাবলীল। গুণ্ডার ভূমিকায় জুয়েল ও ডায়মন্ড চরিত্রে অভিনয় করেছেন যথাক্রমে পল্লব দাস ও গৌতম ঘোষ।
নাটকের কারিগরি দিকে আলো এই নাটকের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়েছে। যা নির্মান করেছেন বাপ্পা সেন। নাট্য আবহ সৃষ্টি করেছেন সুজয় সেনগুপ্ত। দুজনের কাজই নাটককে উন্নীত করেছে।