রচনাঃ অনুপ চক্রবর্তী
চরিত্রঃ বিদ্যাসাগর
বিদ্যাসাগরঃ হ্যাঁরে বুধুয়া। মনটা আমার আজ বড়ই খারাপ রে। কেন জানিস বুধুয়া।দেখলাম এক মেয়েকে নিদারুণ ভাবে অত্যাচার করে পথের ধারে ফেলে রেখেছে। মেয়েটা মনে হয় বেঁচে নেই।রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কি করব বল বুধুয়া। আমি কি করতে পারি। তুই বা কি করবি। আমরাতো দুজনেই বেঁচে নেই রে।কতকাল আগে মারা গেছি আমরা। কতদিন হয়ে গেল। এই কার্মাটারে থাকতাম। এই লাল পলাশের দেশে।তোদের রোগে ভোগে হোমিওপ্যাথি করে তোদের একটু আধটু সেবা করার চেষ্টা করতাম। কেননা বড়োই ভালবাসতাম তোদের। জীবনের প্রান্তে পৌছে তোদের সঙ্গে মিশে বুঝেছি তোরাই প্রকৃত মানুষ। তোরা। এই দেশের আদিবাসী মানুষেরা। এই লাল মাটি আর জঙ্গলের সঙ্গে নাড়ীর বাঁধন তোদের। ঐ অরণ্যের মতো, এই আকাশের মতোই সরল মন তোদের। ভয়ানক গরীব হয়েও, আধপেটা খেয়েও তোরা মানুষকে ঠকাস না, মিথ্যেকথা বলিস না,পীড়ন করিস না। শহরের বাবুদের মতো তোরা মিথ্যেবাদী নয়, লোভী নয়, হৃদয়হীন নয়, নীচ নয়। মনে আছে কলেরায় ভুগছিলিস তুই আর তোর বউ। মনে আছে আমাকেই পরিষ্কার করতে হয়েছিল তোদের ঘরদোর। কেউ যে ছিল না।হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিয়েছিলাম তোদের। বাঁচাতে পারিনি। কিন্তু চেষ্টা করেছিলাম বাঁচাতে তোদের। বড়োই ভালবাসতাম তোদের সবাইকে। তাইতো মরণের পরেও এ কার্মাটার ছেড়ে আমি চলে যেতে পারিনি। জীবনের শেষবেলায় এই কার্মাটারে চলে এসেছিলাম মনেতে বড় দুঃখ নিয়ে।কেননা যা ভেবেছিলাম করব বলে,যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম, তা সম্পূর্ণ করতে পারিনি। পারিনি সম্পূর্ণ করতে আমার দেশের নারীদের পূর্ণ মুক্তি ঘটাতে। আমার দেশের মানুষদের অসহযোগিতার জন্যে। মন আমার দুমড়ে-মুচড়ে যেত অসহায় বিধবাদের, বাল বিধবাদের কান্নায়,দুঃখে,অসহায়তায়, তাদের নিরম্বু একাদশীর উপবাসের যন্ত্রণায়, তাদের শিক্ষালাভের সুযোগ না পাওয়ায়। আমারই দেশের মেয়েরা, মায়েরা কত অসহায় নির্যাতিতা।আমি মেনে নিতে পারিনি তাদের এই দুঃখ কান্না। তাইতো পরাশর সংহিতা খুঁজে বার করলাম বিধবা বিবাহের সমর্থনে সেই শ্লোক সমাজপতিদের বিরোধিতার জবাব দিতে।। ‘নষ্টে মৃতে প্রবজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।পঞ্চস্বানৎসু নারীনাং পতিরন্যো বিধীয়তে।।’ বিবাহিতা নারীর স্বামী সন্ন্যাস বা নিরুদ্দেশ-নিখোঁজ হয়ে গেলে পতিত কিংবা মৃত হলে সুনারীর পক্ষে অন্য স্বামী গ্রহণ করা বিধিসম্মত । আইন পাস হলো বিধবা বিবাহের সমর্থনে। মনে আছে প্রথম বিধবা বিবাহের সেই রাত।কালীপ্রসন্ন তার জমিদারির লেঠেলদের দাঁড় করিয়ে রেখেছিল ব্রাহ্মণদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে প্রথম বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠান। রুখতে আমাকে হত্যা করার চেষ্টা। মেয়েদের একটু শিক্ষার আলো দেওয়ার জন্যে ইংরেজ সরকার সহযোগিতা করল না।তাই আমার সামান্য সঞ্চয় দিয়ে লড়াই চালিয়ে ছিলাম মেয়েদের শিক্ষার বিস্তার করতে। স্বখরচে মেয়েদের জন্যে জেলায় জেলায় স্কুল চালাতে। কিন্তু পারিনি সম্পূর্ণ করতে আমার স্বপ্ন। আরব্ধ হয়নি আমার লক্ষ্য, আমার সার্বিক পরিকল্পনা,আমার কাজ। একাকী কত লড়াই করব রে বুধুয়া। তারপর কতকাল চলে গেছে।আগেও দেখছি নারীরা বিপন্ন,অসহায়,আক্রান্ত। আজো তাই। আমি এখন কীকরে কীই বা করব। আজো অন্ধকার একবিংশ শতাব্দীর এই দেশে আমি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে আজ বিদেহী চেতনা মাত্র।আমি তো পারব না ঝাঁপিয়ে পড়তে নারীদের রক্ষা করতে। পারবো না কলম ধরতে তাদের জন্যে। তাহলে বুধুয়া শুধু কি দেখে যাব। কিছু বল বুধুয়া। আমার মতো তুইও বিদেহী আদিবাসী । দেখছি তোদের জঙ্গল কেটে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তোদের জমি থেকে উৎখাত করছে। তোদের জাতভাইদের হত্যা করছে প্রতিবাদ করার জন্যে।তোদেরকে বাস্তুচ্যুত করছে।তোদের ঘরের মেয়ে বৌদের ওপর অত্যাচার করছে।তুইও নিরুপায় আমারই মত বুধুয়া। একবার যদি ফিরে পাই আমার দেহ, আমার সেই শক্তি, ফিরে পাই কলম ধরার সেই হাত আর তুইও যদি ফিরে পাস তোর লোহার মতো সেই শরীর, যদি কুড়ুল আর তীরধনুক তুলে ধরতে পারিস, তাহলে তুই আর আমি মিলে আবার ঝাঁপিয়ে পড়তাম লড়াইয়ে। রক্ষা করতে আমাদের এই হতভাগ্য গরীব দেশকে, এই মাটিকে, এই অরণ্যকে। তাহলে রক্ষা করতে পারতাম আজো হতভাগ্য আমার এই দেশের অসহায় নারীদের অসম্মান থেকে ,অত্যাচার থেকে, নিগ্রহ থেকে, অশিক্ষা থেকে। তুইও পারতিস রক্ষা করতে তোদের জাত ভাইদেরকে,তোদের জলজঙ্গল জমিকে।
একি! একিরে বুধুয়া। এ কী দেখছি। একটা প্রচণ্ড ভীতচকিত মেয়ে ভয়ংকরভাবে আর্ত চিৎকার করতে করতে দৌড়চ্ছে। ওকে ধাওয়া করছে কয়েকজন হিংস্র,কামার্ত পুরুষ। ওঃ ওরা মেয়েটাকে মাটিতে ফেলে ধর্ষণ করছে। ওঃ আমি কিছু করতে পারছি না। পারছি না বাঁচাতে ওকে। তোদেরই জাতের এক মেয়ে। তুইওতো নিষ্ফল ক্রোধে ফেটে পড়ছিস। কিন্তু বাঁচাতে পারছিস না ওকে। আমরা বাঁচাতে পারছি না মেয়েটাকে। আমরা যে বিদেহী। মা। মাগো। মাগো। মাগো।পারলাম না তোমার ইজ্জত বাঁচাতে। বুধুয়ারে ,ওরা মেয়েটাকে ধর্ষণ করে, তারপর আগুনে পুড়িয়ে মারছে। আঃ আঃ আঃ আমি সহ্য করতে পারছিনা। পারছি না। পারছি না। হে ঈশ্বর, যদি সত্যিই তোমার কোন অস্তিত্ব থেকে থাকে, তাহলে আর একবার ফিরে আসতে দাও এই বিদেহী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। আমার লক্ষ্য সম্পূর্ণ করতে। অসহায়া নারীদের মুক্তির লক্ষ্য পূরণ করতে। আবার যদি ফিরতে পারি, এবার তাহলে ফিরব শুধু কলম হাতে নিয়ে নয়। ফিরব হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে।
।।সমাপ্ত।।