বিনোদিনী ও তাঁর বিধৃত সাহিত্যকীর্তির আংশিক মূল্যায়নের চেষ্টা

- Advertisement -

অরুন কুমার চৌধুরী

(অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও নাট্যকর্মী)

‘মনের ব্যথা জানাইবার লোক জগতে নাই’- বিনোদিনী দাসী 

সে যুগে নারীদের, সমাজে কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সে সময়ে নিজের প্রতিভার জোরে নিজেকে স্বসম্মানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অভিনয় জগতে, আবার অভিনয় জগত থেকে বিদায় নেবার পর নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন সাহিত্য সাধনায়। তিনি হলেন উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের সর্বশ্রেষ্ঠা অভিনেত্রী নটী বিনোদিনী। বাংলা রঙ্গ মঞ্চে তাঁর অবস্থান মাত্র ১২ বছর, কিন্তু সাহিত্য অঙ্গনে তাঁর বিচরণ প্রায় চল্লিশ বছর।  

১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে ‘ভারতবাসী’ পত্রিকায় রঙ্গমঞ্চ সম্পর্কীয় পত্রাবলীতে শুরু এবং ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘রূপ ও রঙ্গ’ সাপ্তাহিক পত্রিকায় স্মৃতিকথা কথা দিয়ে শেষ। যদিও দীর্ঘ চল্লিশ বছরে তিনি মাত্র দুটি কাব্য ও দুটি আত্মজীবনী লিখেছিলেন। তা সংখ্যার নিরিখে স্বল্প হলেও সাহিত্যের দিক থেকে এক উচ্চমানের সাহিত্য প্রতিভার নিদর্শন রেখে গিয়েছেন।

গিরিশ ঘোষের অনুপ্রেরণায় যে তাঁর সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তৈরি হয়েছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। নিজ চেষ্টায় ইংরাজী শিখে গিরিশ ঘোষের সংগ্রহ থেকে বিভিন্ন বিষয়ের বই নিয়ে এসে পড়াশুনা করতেন। এছাড়া তিনি গিরিশ ঘোষের সাথে নিয়মিত বিভিন্ন পন্ডিত মানুষদের আলোচনা সভায় উপস্থিত হয়ে ইংরেজ, গ্রীক, ফরাসী, জার্মান প্রভৃতি সাহিত্যের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে ‘ভারতবাসী’ সাপ্তাহিক পত্রিকায় ধারাভিকভাবে প্রকাশিত ’বঙ্গরঙ্গমঞ্চ’ বিষয়ক পত্রাবলীর মাধ্যমে তাঁর সাহিত্য জগতে পদার্পণ। প্রথম লেখাতেই পাঠক সমাজকে চমকে দিয়েছিলেন। এই পত্রাবলীর মাধ্যমে সেই সময়ের রঙ্গমঞ্চের বিভিন্ন বিষয় খুব সহজ সরলভাবে তুলে ধরেছিলেন। লেখাটা প্রকাশিত হবার পর  বিদগ্ধ পাঠকেরা সেটা গিরিশ ঘোষের নিজের লেখা বিনোদিনীর নামে প্রকাশ করেছিলেন বলে সাব্যস্ত করেছিলেন। এরপর টানা দশ বছর নিভৃতে সাহিত্য সাধনা করে গিয়েছেন তিনি। ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দে গিরীশ ঘোষ  সম্পাদিত অমরেন্দ্রনাথ দত্তের সৌরভ পত্রিকায় দুটি সংখ্যায় ‘হৃদয়রত্ন’ ও ‘অবসাদ’ নামে দুটি কবিতা এবং ২০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ কাব্য কাহিনী প্রকাশিত হয়।

বিনোদিনীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বাসনা’ ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে মা’কে উৎসর্গ করে প্রকাশিত করেছিলেন। এই কাব্য গ্রন্থে ৪০টি কবিতা এবং একটি আখ্যায়িকা কাব্য সংকলিত হয়েছে। তাঁর অভিনয় প্রতিভার আড়ালে যে এক কবি প্রতিভা লুক্কায়িত ছিল, তা তাঁর কবিতাগুলোতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন তিনি তাঁর থিয়েটার জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও স্বার্থত্যাগের সঠিক মূল্য না পাওয়ার যন্ত্রণার স্মৃতি তাঁর মনে যেমন দুঃখের অবতারণা করতো আবার অন্যদিকে সংসারের সবকিছুই অনিত্য সেটাও উপলব্ধি করতো, সেটি তার কাব্যগ্রন্থের স্মৃতি কবিতায় সুন্দরভাবে ব্যক্ত করছেন।

‘স্মৃতিলো বিষের জ্বালা দিয়ো নাকো আর,

এ সংসারে চিরদিন কিছুই না রয়।

তবে কেন দুঃখ তুমি দাও অনিবার,

তুমি মনেপ্রাণে জ্বালা অতিশয়।।

অস্থায়ী সংসারে কিছু চিরস্থায়ী নয়,

সুখ দুঃখ চিরদিন ঘোরে সমভাবে;

কালের কবলে সবে হয়ে যাবে লয়,

অনন্ত নিদ্রার কালে নিশ্চিন্তে ঘুমাবে’।

তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, সেকালের মহিলা কবিদের তুলনায় তাঁর কবিতাগুলি অপাঙতেয় নয়।

এ প্রসঙ্গে ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূল্যায়নটি খুবই প্রণিধানযোগ্য। ‘এই বাস্তব বিস্মৃত কল্পচারী বিষণ্ণ রোমান্টিকতা গীতি কবিতার বহু পরিচিত মোটিফ, অবশ্য এতে এখনও পরিপূর্ণ শিল্প রূপটি বিকশিত হতে না পারলেও উনিশ শতকের অনেক মহিলা কবির রচনার চেয়ে বিনোদিনীর কয়েকটি কবিতা স্পৃহণীয় তাতে সন্দেহ নেই।

বিনোদিনীর দ্বিতীয় ও শেষ কাব্য গ্রন্থ ‘কনক ও নলিনী’ প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে। ১৯০৪ সালে কন্যা শকুন্তলারা মৃত্যু হয়, তাই তিনি এই কাব্যগ্রন্থটি কন্যার স্মৃতিতে তার নামে উৎসর্গ করেছিলেন। ‘কনক ও নলিনী’ একটি কিশোর কিশোরীর বিয়োগান্তক প্রেম কাহিনী। স্বাভাবিক বেদনা বোধ, ভাবুকতা ও রোম্যান্টিকটা এই কাব্যগ্রন্থটির কবিতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে।

এই কাব্য সম্পর্কে কোনও একজন সমালোচক লিখেছিলেন, ‘এই প্যাসটরাল প্রেমগাথাটি গাথা হিসেবে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু সেকালের অনেক মহিলা কবির পুরুষালী ঢঙের কৃত্তিম রচনার চেয়ে বিনোদিনীর ক্ষুদ্র গাথা কাব্যটি স্বচ্ছতার স্মরণীয়’।  

রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করার প্রায় ২৩ বছর পর তিনি তাঁর স্মৃতিকথা লিখতে শুরু করেন। বিনোদিনীর স্মৃতিকথা ১৯১০ সালে সংক্ষিপ্ত আকারে অমরেন্দ্রনাথ দত্তের সম্পাদনায় ‘নাট্য মন্দির’ মাসিক  পত্রিকায় প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সেসময় এর নাম ছিল  ‘অভিনেত্রীর আত্মকথা’। দুটি সংখ্যায় প্রকাশের পর কোনও এক অজানা কারণে অসস্মূর্ন অবস্থাতেই প্রকাশিত হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৯১২ সালে ‘আমার কথা’ নামে গ্রন্থাকারে প্রথমখণ্ড প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় খণ্ড লেখার ইচ্ছা থাকলেও তা অপূর্ণ থেকে গেছে। বিনোদিনীর ‘আমার কথা’ একটি আগাগোড়া পত্রাকারে লেখা আত্মজীবনী যা তিনি তাঁর নাট্যগুরু গিরিশ ঘোষকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন। তারপর প্রায় একযুগ পর পুনরায় স্মৃতিকথা রচনা আরম্ভ করেন। ‘রূপ ও রঙ্গ’ পত্রিকায় ১৯২৪ সালের মাঘ মাস থেকে এগেরোটি কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল, তাঁর দ্বিতীয় স্মৃতিকথা ‘আমার অভিনেত্রী জীবন’। তবে এটিও অজ্ঞাত কারণে অসম্পূর্ণ থেকেই যায়। এবং এই স্মৃতিকথাই তাঁর শেষ রচনা।   

‘আমার কথা’ ও ‘আমার অভিনেত্রী জীবন’ কেবলমাত্র স্মৃতিকথা মনে করলে সঠিক মূল্যায়ন হবে না। বইদুটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চারও উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। ‘আমার কথা’য় তিনি বিবৃত করেছেন তৎকালীন বাঙালী সমাজের কথা, বাংলা থিয়েটারের কথা। অভিনেতা অভিনেত্রীদের সাথে রঙ্গমঞ্চের অনেক বিষয় তিনি তাঁর লেখাতে তুলে ধরেছেন। তাঁর এই আত্মজীবনীমূলক লেখাকে এককথায় বলা যায় থিয়েটারের ঐতিহাসিক দলিল।  

তিনি কতটুকুইবা পড়াশুনা করেছিলেন কিন্তু তাঁর লেখা ছিল সহজসরল এবং ভাষা শৈলী ও মাধুর্যে পরিপূর্ণ। এছাড়া তিনি তার আত্মজীবনী ‘আমার কথা’র ভূমিকাতে স্পষ্ট করেছেন কেন তিনি আত্মকথা লিখতে শুরু করলেন। তিনি লিখেছেন, ‘মনের ব্যাথা জানাইবার লোকজগত নাই… কেননা আমি সমাজ পতিতা, ঘৃণিতা বারনারী! লোকে কেন আমায় দয়া করিবে? কাহার নিকটেই বা প্রাণের কথা জানাইব? তাই কালিকলমে আঁকিতে চেষ্টা করিতেছি।’ 

‘আমার অভিনেত্রী জীবন’ লেখাতে আত্মস্মৃতির কথাগুলি অন্যভাবে তুলে ধরলেন। তখন লেখা থেকে দুঃখের সুর চরে গিয়ে জায়গা করে নিয়েছিল হাস্যরস। ‘আমার কথা’ লিখেছিলেন সাধু ভাষাতে। এখানে তার পরিবর্তে চলতি গদ্য রীতিতে লিখলেন।

আগের লেখা থেকে এই লেখা হয়ে উঠলো আরও আধুনিক এবং তা বোঝা যাবে লাইনকটি থেকে। …’কোনও কিছু বলতে গেলে তাই আগে মনে পড়ে সেই কথা, যা আমার কাছে এখনও সুখ-স্বপ্নের মতো মধুর, যার মাদকতার আবেশ ও আবেগ এখনও আমি ভুলতে পারিনি। … আর যা বোধ হয় আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সঙ্গের সাথী হয়েই থাকবে। তাই বোধ হয় আমার এই অভিনেত্রী জীবনের কথা বলবার সাধ।’ 

ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় তাই লিখেছিলেন- ‘এই চলতি ভাষায় লেখা দ্বিতীয় স্মৃতিকাহিনীটি সেকালের থিয়েটারের গল্প হিসেবে স্মৃতি-কথা, সাহিত্য হিসাবে স্থায়ী স্থান পেতে পারে।’ 

তাই সবশেষে যেটা বলার বিষয় বিনোদিনীর সাহিত্যের যথাযথ মূল্যায়ন করা দরকার। কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাসে বিনোদিনীর নাম সচরাচর দেখা যায় না। এমনকি তাঁর লেখা কবিতাগুলিও তৎকালীন মহিলা কবিদের সাথে এক সারিতে উচ্চারিত হয় না। বিনোদিনী বারাঙ্গনা ছিলেন বলেই কি তথাকথিত ভদ্রলোকের সাহিত্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন?

ঋণস্বীকারঃ-
১- আমার কথা ও অন্যান্য রচনা- বিনোদিনী দাসী।
২- তিনকড়ি, বিনোদিনী ও তারাসুন্দরী- উপেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষন।
৩- রঙ্গালয়ে রঙ্গনটী- অমিত মৈত্র
- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -