Tuesday, July 8, 2025
Tuesday, July 8, 2025
Homeআলোচনাবিভাব নাট্য একাডেমির ‘অন্য সম্রাট’ 

বিভাব নাট্য একাডেমির ‘অন্য সম্রাট’ 

দুলাল চক্রবর্ত্তী

বিভাব নাট্য একাডেমি, নিজেদের দ্বিতীয় পর্যায়ের নাটকের উৎসবের সমাপ্তি দিবসে, ১৬জুন তপন থিয়েটারে, এক রাশ দর্শকদের সামনে অভিনীত করেছিল সংস্থার নিজস্ব প্রযোজনা “অন্য সম্রাট”। খুব সংক্ষিপ্ত সংলাপে, ছোট অনেকগুলো মুহূর্তকে প্রাণবন্ত করেছে এই নাটকের উপস্থাপনা। তাই ছোট নাটকের স্বার্থে অসাধারণ নির্দেশনা। নাটকের খাঁজ ভাঁজে অল্প সামান্য সাজেশন দিয়ে দৃশ্য দেখাবার চেষ্টা ও পরিমিতি বোধ খুব প্রশংসার বিষয়। আলোক চিন্তায় দেবাশীষ চক্রবর্তীর এবং আলোক প্রক্ষেপণে রাজপুত সেনগুপ্ত, দুজনেই নাটকের সঞ্চালন তাল বোধে, এ নাটকের সম্পদ। আবহ প্রক্ষেপণ করেছেন দেবাশীষ দে। তিনিও ভাল। তবে এতটা উচ্চকিত আবহ প্রক্ষেপণ নাটকের আন্তরিকতা নষ্ট করছে বলেই মনে হয়েছে। এখানে যে যাত্রার কনসার্টের ইতস্তত ছড়িয়ে আসা স্মৃতি মেদুর ধ্বনি শোনা যায়, তা তো নিশ্বাসের মধ্যেই ম্রিয়মাণ অস্পষ্ট অতীত সাক্ষ্য কিছু কথা ও শব্দের অনুপ্রাস মাত্র। তাই সারা নাটকের স্তরেই এর প্রবাহিত তরঙ্গ। তাই প্রক্ষিপ্ত লেভেল অভিনয়ের সাথে মেশানো দরকার। এর সাথে নির্মল মৃধার মঞ্চ ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বাড়ি বা শানের যৎকিঞ্চিত টুকরো আভাসগুলো খুবই সার্থক। স্থান কাল সময়কে চিহ্নিত করা এবং কুমার সুদর্শন এর ঘরের বিন্যাসও চমৎকার ছিল। আবহে নিরাময় চক্রবর্তী নির্বাচিত আবেগের তাড়নায় তাড়িত শব্দ ধ্বনি সঙ্গীত মন কেড়েছিল।  প্রয়োগ সামান্য উচ্চকিত ছিল বলে মনের অনুরণন প্রসঙ্গে একাত্মতা কম মনে হয়েছে। শুধু দৃশ্য ধরতাই হয়েছে। এই নাটকে খুব ভাল কিছু মুহুর্তের চয়ন করেছেন নাটককার মুদাসসার হোসেন ছোট্টু। যার ব্যাপ্তি অতি দ্রুত থাকায় চরিত্রের অনুভবে কিছুটা যান্ত্রিকতা এনেছে বলেই মনে হয়েছে। নাটকটিকে এক্সপ্রেস গতিতে ছুটিয়ে নিয়ে যে ভাল কাজটি এই প্রযোজনা চালক করেছেন। তা গতিশীলতার জন্যে চমৎকার। কিন্তু এতে আবেগ ও বাস্তব দুই-ই সমসত্ত্ব মিশ্রনের দাবি রাখে। এখানে নাটকীয়তার স্বার্থ, ঘটনা প্রবাহের এই সময়ে দ্বান্দ্বিক মন মেজাজ প্রোথিত আছেই। তবুও কোথাও এমন কোনো মুহূর্তকথা “অ চিৎকৃত” হলে দর্শকদের মনে সুপর্না, জয়িতা এবং বৃদ্ধ যাত্রা শিল্পী কুমার সুদর্শনের সঙ্কটের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা বাড়তে পারে। হঠাৎ শুধু মনোকষ্টের কারণে, পরিবারে বউ সুপর্নার দুর্ব্যবহারে ও  মেয়ের গঞ্জনা তিরস্কারে তার মৃত্যু হচ্ছে। এই অনুমানের পুর্ব লক্ষণের অভিঘাত নাটক কিছুটা সময় চাইছে বলেই অনুমান হলো। সংসারের তীব্র আর্থিক কষ্টের জ্বালায় খেটে মরে জ্বলে পুড়ে বউ কেবল এক বাক্সে লুকানো আছে। তা-ই খুলে দেখে পেতে চায়। প্রশ্ন জাগে, বাক্সে কি আছে এতদিন তার সাথে ঘর করে সে জানে না? কেন জানে নি? মধ্যবিত্ত গায়ে গতরে খাটা, হাহাকার করে কপাল চাপড়ানো স্ত্রীর স্বামীর প্রতি আস্থা কি একেবারেই শূন্য হয়ে যায়? এখানে দ্বান্দ্বিকতায় মমতাও থাকা উচিত কিনা ভাবার দরকার আছে। অন্য সম্রাট প্রযোজনায় এই রকম কিছু বিষয়ের পুনর্বিচার ও পুনর্বিবেচনা করে নিলে ভাল হবে। তথাপি সাফল্যের সাথে নাটকটির এযাবৎ প্রায় ২৭/২৮ টি মঞ্চায়ন হয়ে গেছে। দর্শকদের ভাল লাগাতে পারায়, যথেষ্ট ভাল উপস্থাপনা। কিছুটা উচ্চকিত সংলাপ কমিয়ে আত্মগত অনুশোচনা সংলাপে আসে, তবে মাত্রা বাড়বে বই কমবে না। কারণ সব কথা বোঝা (অন্তত এদিন) যাচ্ছে না।

অতীতের যাত্রা শিল্পের সুষমা মন্ডিত নস্টালজিক স্মৃতি মেদুরতা ভরা হারিয়ে ফেলা হাহাকারের সাথে, এই সময়ের রিলে আক্রান্ত অযোগ্য অপটু শিল্পীর সিরিয়াল অভিনেত্রী হবার উচ্চাকাঙ্খা কীভাবে সময়ের ব্যভিচারে পদপিষ্ট হয়। এই নাটক তা দেখিয়েছে। সেটাই নাটকের কেন্দ্রীয় প্রেডিক্ট। যেখানে অসুস্থ, মনোবিকারে কাতর কুমার সুদর্শনের সমসাময়িক কাজের অবমূল্যায়ন এক সত্য সততায় অতীত শিল্পীকে নিজের সত্য সততায় দাঁড় করাতে চেয়েছে। পারিপার্শ্বিক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে চলা অনাচারের বিরুদ্ধে। যা নানা দ্যোতানায় বিভ্রান্ত, বিব্রত, বিপর্যস্ত এই পরিবারে আর্থিক সঙ্কট থেকে মুক্তি পাবার বাস্তবতাকে সুন্দর ভাবে প্রকাশিত করেছে। জয়িতা চরিত্রে প্রলিপ্তা মুখার্জীর প্রতিটি মুহুর্ত এই সংবাদে উদ্ভাসিত ছিল। সুপর্ণার সাথে ভালবেসে বিয়ের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসার মুহুর্ত বাদে অনুসূয়া পালের অভিনয়ও সঙ্গত ও স্বাভাবিক। তবে এই চরিত্র একবগগা বিরক্তি উগড়ে না দিয়ে মমতা মিশ্রিত এবং দারিদ্রের ভারে অতিষ্ঠ আর্তনাদ হলে ভাল হয়। নাটকে উচ্চতর উচ্চারণ এসেছে দুই ঘরে চরিত্রে সাথে কথোপকথন প্রকৃয়া নির্ধারিত গিভন সারকামস্ট্যান্সেস চলে আসায়। তা মানতে হবেই। তাই কথাও নেই। বন্ধু অনাদি নেই। সে মারা গেছে। আর আত্মাকে কুমার সুদর্শন দেখতে পায়। অনাদি স্মৃতি বাহিত হ’য়ে নাটকে আসে। কিন্তু একেবারে কাঁধে হাত রেখে সুদর্শনের মহাপ্রস্থান দৃশ্যটি চরমভাবেই সিলিউট (ভিন্নভাবে আবেগ ইলিউশনে) এলে ভাল হতো। বাস্তবতায় কটকট করে এই স্মৃতি মেদুর মৃত্যু দেখা আর তা অনুভব করার পর্যাপ্ততা নাটকের সামর্থ্যে থাকতে হবে। নির্মাণ সৌকর্য মাফিক আলো আর আবহের ম্লান আভাসে। মানসিক মৃত্যু, ভেতর থেকে আস্তে আস্তে মরে যাওয়ার পর্যায়ক্রমিক পরিস্থিতি উচ্চকিত অভিনয়ের কারণে ব্যক্ত হয়নি। কুমার সুদর্শন চরিত্রে গুঞ্জন প্রসাদ গাঙ্গুলী দক্ষ অভিনেতা। উনি সবই পারবেন। নান্টু পালের অভিনয় ও গলার গানে তার না থাকা অস্তিত্বের হাহাকার আবেদন নাটকে উঠে এসেছে চমৎকার ভাবে। নাটকের ভিতরের অন্তর্লীন সংবাদ এই অবলা কথার স্তরের আর্দ্রতায়, সুন্দর ভাবেই এসেছে। সুপ্রিয় নামে প্রতারক সিরিয়াল কর্তার ভূমিকায় সঞ্জয় সেনগুপ্ত সুন্দর মানানসই চরিত্রায়ন। সব মিলিয়ে কিছু সুক্ষ্মতা, কিছু একাকী একাধিক হবার মর্ম বেদনা যুক্ত হলেই অন্য সম্রাট কেন অন্য, কীভাবে অন্য, কি তার বক্তব্য, এসব প্রাঞ্জলতা পাবে। কিছু দুর্বোধ্যতা আছে। কারণ ভাবার কথা একটাই,—বিশ্বের সবাই একদিন সব হারিয়ে বার্ধক্য জীবন পায়। কুমার সুদর্শন কেন এতো উচাটন? সে পাগল হয়ে গেছে মেনে নিলে সংসার তবুও নিষ্ঠুর হয় না। তাই নাটকের জন্যে নাটক হতে হবে এমনতর যুক্তিতে উন্নত, যাতে সুদর্শন এর মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারার অসুস্থতা চিকিৎসা না করেই কি তার মৃত্যু হচ্ছে? নাটকে এই মর্মে কি প্রকাশিত হচ্ছে? যাই হোক প্রযোজনা দেখে প্রশ্নগুলো জন্মেছে। হয়তো সবই ঠিক আছে, এতোটা উচ্চকিত উচ্চারণের ক্লান্তি কষ্ট ডিপ স্টেজে থাকায় পরিচ্ছন্ন ভাবে উপলব্ধ হচ্ছে না। গুঞ্জন প্রসাদ গাঙ্গুলীর এই চরিত্রের অভিনয়, ভেঙ্গে পড়া শারীরিক অক্ষমতা আছে। থাকলেও আরো ভঙ্গুরতা প্রাপ্ত হলে যুক্তি যুক্ত হবে। তবে বড় মাপের নাট্য বোধ সম্পন্ন তিনি। তাঁকে সম্মান জানিয়েই আমার প্রত্যাশা তুলে ধরলাম।

অন্য সম্রাট এমনিতে এই সময়ে, ছোট নাটকের সমাজে অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা ও নির্দেশনার নিদর্শন হয়েছে। যেহেতু নির্মাণের চকচকে ব্যাখার আঙ্গিক চয়ন, গল্প এবং গ্রুপ এ্যাক্টিং ব্যালেন্সড। এক মুছে যাওয়া যাত্রাপালা শিল্পীর অন্তর বেদনাকে নাটকে, বর্তমান আর্থ সামাজিক প্রেক্ষিতে উল্লেখিত করতে চাওয়ায়, টেক্সটও জরুরি এবং তাৎপর্য পূর্ণ।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular