বি-থিয়েটারের প্রথম বর্ষপূর্তি- এক অনবদ্য নাট্যসন্ধ্যা  

- Advertisement -

সুস্মিতা পোড়েল

গত ২৮ শে মে সন্ধ্যায় বি-থিয়েটার আয়োজিত “কাঁচের ছাদ ভেঙে”-র প্রথম বর্ষপূর্তি উদযাপিত হল তপন থিয়েটারে। তৎসহ ছিল কিছু গুণী মানুষকে সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান। এটি তাঁদের প্রথম পর্যায়ের আয়োজন। এইদিন বিনোদিনী সন্মাননা প্রদান করা হয় অভিনেত্রী সীমা গঙ্গোপাধ্যায় ও রঞ্জন বোস কে। এক সন্ধ্যায় ছিল তিনটি ভিন্ন ধরনের নাটক। সামগ্রিক অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সুচরিতা বড়ুয়া চট্টোপাধ্যায় ও আলোকপর্ণা গুহ।

প্রথম নাটক –

আমতা পরিচয় প্রযোজিত ‘হ্যাপী প্রিন্স’। রাজু খাঁ-র ভাবনায় ও ঋতুপর্ণা বিশ্বাসের নাট্যরূপ নিয়ে এই নাটক নির্মাণ করেছেন শুভেন্দু ভাণ্ডারী।

আচ্ছা ধরুন হঠাৎ আপনার মুঠো ফোনটি যদি হারিয়ে যায়। তাহলে কী হবে? গোটা দুনিয়ার খবরাখবর থেকে আপনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পরবেন তো? সেটাই স্বাভাবিক। আজ এমনি এক সন্ধিক্ষণে এসে পড়েছি যেখানে এই মুঠোফোন ছাড়া আমাদের জীবন অচল। যার অপব্যবহার আমাদের সাধারন চিন্তা ভাবনায় ব্যঘাত ঘটাচ্ছে।  ক্রমে আমরা এই মোবাইল ফোনের দ্বারা ক্রীতদাসে পরিনত   হচ্ছি। আর একদল সুবিধাবাদী স্মার্টফোন অপারেট করছে মুনাফার লোভে। সেই সাথে কেড়ে নিচ্ছে এক একটা তাজা ফুলের মতো জীবনকে। এমনি এক বৃত্তান্ত নিয়ে নির্মিত এই নাটক। এ নাটকে দুই বন্ধু প্রিন্স আর প্রকৃতির প্রানখোলা  বন্ধুত্ব যা নাটককে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। একদিকে মানুষে মানুষে বিভেদ আর অপর দিকে পাল্টা বন্ধুত্বের প্রাণময় উচ্ছাস। প্রিন্স চরিত্রে রাজু  খাঁ ও প্রকৃতি চরিত্রে ঋতুপর্ণা দুজনেই মঞ্চে দক্ষ দুই অভিনেতা। যারা মঞ্চের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে দাপিয়ে   বেড়িয়েছেন তাঁদের সাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে। সেই সাথে ঋতুপর্ণার স্বকণ্ঠে গাওয়া গান অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে নাটকটিকে।

সাথে দেবলীনা সরকারের আলো, সব মিলিয়ে বেশ ভালো এই নাটক। এই নাটক বর্তমান প্রজন্মের সকলের দেখা উচিত বলে মনে হয়েছে। প্রতিটি স্কুল কলেজে পড়া ছেলেমেয়েদের কাছে এই নাটকটি নিয়ে যাওয়া উচিৎ। একটি সামাজিক বার্তা বহন করে এই নাটক।   

দ্বিতীয় নাটক-   

নান্দীমুখ প্রযোজিত নাটক “ভ্রুণ হত্যা এবং”। নাট্যবস্তু সংগৃহীত হয়েছে জার্মান কবি ও নাট্যকার বার্টল্ড ব্রেখট-এর একটি কবিতার বঙ্গানুবাদ “মারী ফরারের ভ্রূণ হত্যা সম্পর্কে” থেকে –  যার বঙ্গানুবাদ করেছিলেন অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তী ও অজিতেশ  বন্দ্যোপাধ্যায়। “ভ্রুন হত্যা এবং ” নাট্যরূপ ও পরিচালনা করেছেন সোনালি।   

আজ এই সময়ে দাঁড়িয়ে একটি অতি প্রাসঙ্গিক ঘটনার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে এই নাট্য কাহিনী। প্রতিটি মেয়ের কাছে মা  হওয়া, যা তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর একটি  অধ্যায়। এক  দারুন একটা অনুভূতির ব্যাপার। মা হয়ে ওঠার জন্য প্রতিটি মেয়ে হাজার যন্ত্রণাকেও হাসি মুখে সহ্য করে যেতে পারে। তবে কখনও কখনও এই আশির্বাদ কারো কারো জীবনে অভিশাপ হয়ে নেমে আসে। বিভিন্ন অযাচিত ও অনৈতিক সম্পর্ক বা অবৈধ্য সম্পর্কের কারণবশতঃ কিছু সন্তান তার অস্তিত্ব জানান দেয় মাতৃগর্ভে।   তখন আর সেই অনুভূতিটা আনন্দের থাকে না। সামাজ যাকে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দেয় না। পাপ বলে দাগীয়ে দেয়। মা তখন চায় না সেই সন্তান এই পৃথিবীর আলো দেখুক। তাই মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অবস্থাতেই অনেকভাবে চেষ্টা করে সেই গর্ভস্থ সন্তানটাকে বা ভ্রুনটাকে হত্যা করার। তবু সেই সন্তানগুলো বেড়ে ওঠে মাতৃগর্ভে। একসময় জন্মও নেয় সেই সন্তান। মা তার জন্ম দেওয়া সন্তানকে জন্মানোর পরের মুহূর্তেই নিজের হাতে হত্যা করে। কারন সেই মায়েদের অন্তঃদহন শোনার মতো কেউ নেই। কেউ তাই এই অপরাধের বিচার করার যোগ্যতা রাখে না। না আমাদের দেশের আইন আর না এই সমাজের মানুষ। কারন “যে জন্মাচ্ছে সে জন্মাতে সাহায্য চেয়েছিল।” এই ছিল নাটকের মূল বিষয়।

প্রত্যকের অভিনয় অসাধারণ লেগেছে। অভিনয়ে গার্গী, তনয়া ও সোনালি দক্ষতার সাথে বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা করেছেন। সেই সাথে চন্দন দাসের আলোও বেশ ভালো। সব মিলিয়ে একটা দুর্দান্ত নাটক মঞ্চস্থ হল। এ নাটক যেমন চিরকালীন তেমনি    সমসময়ে দাঁড়িয়ে নিঃসন্দেহে এক সাহসী পদক্ষেপ যার কৃতিত্বের দাবী রাখে সমগ্র নাট্যদলটি।

এই নাটক বহু অভিনয় হওয়া উচিত। আজ এই ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়েও আমরা এরকম একটি সামাজিক সমস্যাকে কাটিয়ে উঠতে পারিনি। অন্তত এই সচেতনতার নিরিখে এই নাটক দেখা উচিত।  

তৃতীয় নাটক-

তিলজলা কল্পন প্রযোজিত দেবেশ ঠাকুর রচিত কবিতা বেহুলা আজ অবলম্বনে “বেহুলা আজও…”। পরিচালনা করেছেন কল্পনা বরুয়া। 

এই নাটকের বিষয় ছিল আমার আপনার সকলের সেই চিরপরিচিত মা মনসার পূজা পাওয়া নিয়ে চাঁদ সওদাগরের সংঘাত, যা চিরকালীন।  

আমরা সবাই জানি মা মনসা একে একে কেড়ে নেয় চাঁদ সওদাগরের সকল সন্তানকে। সব শেষে লক্ষীন্দরকেও। অপর দিকে বেহুলা তার স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে যায় স্বর্গে দেবতাদের  কাছে। স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য। সেখানেও তাকে দিতে হয় পরীক্ষা। সতীত্বের পরীক্ষা। তাকে কাঁচের উপর দিয়ে নৃত্য  পরিবেশন করতে হয় তার সতিত্ব প্রমাণ করার জন্য। একদিকে মা মনসার জেদ অন্যদিকে শ্বশুরের তাকে পূজো না দেওয়া। এইসবের মাঝে সব দিক দিয়েই ক্ষতবিক্ষত হতে হয় বার বার সেই বেহুলাকেই। তবু সে লড়াই করে ও জয়লাভ করে। নানা  ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে। এমনি আমাদের সমাজের প্রতিটি মেয়ের মধ্যে আছে এক একটি বেহুলা। এই ছিলো এই নাটকের মূল বিষয়। প্রত্যেকের অভিনয় অসাধারন। গোটা নাটক একটা টিম ওয়ার্ক। সেই সাথে কোরাসের পালা কীর্তন গান ও সাবলীল নাচ নাটকটিকে অন্য উচ্চমাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। আলাদা করে কাউকে বলার নেই, সকলেরই অভিনয় সাবলীল। এঁরা হলেন- অনুপম পাল, মনীষা পাত্র, সঙ্গীতা রায়,পাপড়ি দাস রয়, বাবেতী  বক্সি, লাবনী মন্ডল, সৌরভ মিস্ত্রি, মানস প্রধান, সায়ন্তন জানা, চন্দ্রানী নন্দী, পিয়াশ্রী বোস, সুমনা সোম, জুহিতা সাধুখাঁ, অরিন্দম অধিকারী, কমলিকা রায়।

সাথে দেবলীনা সরকারের আলো আবারও অনবদ্য। সব মিলিয়ে দারুণ লাগলো নাটকটি।

তবে প্রতিটি নাটকের ক্ষেত্রেই সময়সীমা একটু বেশি লেগেছে। নাটকের বিষয়বস্তু অনুযায়ী আরো বাঁধা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে নাটকের মান আরো বারবে বই কমবে না বলেই মনে হয়। সর্বোপরি আয়োজক বি-থিয়েটার কৃতিত্বের দাবী রাখে এরকম একটি নাট্য সন্ধ্যা উপহার দেওয়ার জন্য।

এই পর্যায়ের পর দ্বিতীয় পর্যায় অনুষ্ঠিত হবে এই একই মঞ্চ অর্থাৎ তপন থিয়েটারে আগামী জুলাই মাসে ২২ তারিখ। সেখানে থাকবে দুটি নাটক। এক মাচার মানুষ প্রযোজিত ‘মৃত্যদেশ’ আর থিয়েটার পুষ্পক প্রযোজিত ‘যাঃ সব ভণ্ডুল’।   

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -