দুলাল চক্রবর্ত্তী
অতি সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে ব্যান্ডেল আরোহীর নাটক “ধনপতির চর”। মূল উপন্যাস অমর মিত্র। গল্পটার কেন্দ্রে আছে, সংস্থা লিখিত ফোল্ডার কথায়–“ঘোড়াদল থেকে ছয় লীগ (মাইল) দূরে সেই চরখানি। কালনাগিনী এঁকেবেঁকে পাক খেয়ে তার জলরাশি নিয়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বড় গাঙে। দিকহীন অসীম আকুল পাথারি সেই গাঙে কাছিমের পীঠের মতো, উবু হয়ে ভেসে আছে, ধনপতির চর। প্রতি বছর আশ্বিন পড়লে, বড় পুজো সাঙ্গ হলে, উত্তরের হাওয়া রুক্ষ গায়ে শিরশিরানি তুললে, দল বেঁধে মাছ মারার জেলেনীরা, ব্যাপারিরা, ঘোড়াদলের ঘাট থেকে নৌকায় চেপে এই চরে আসে। আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত চলে মাছ ধরা। বেচা কেনা সংসার করা নিয়ে পরিব্যাপ্ত থাকে চরের জীবন।
এই চরের কর্তা বুড়ো ধনপতি। ধনপতি ব’লে, সে হার্মাদ পেড্রুর বংশধর। জলদস্যুর জাহাজ ভাসিয়ে ফিরিঙ্গি হার্মাদ পেড্রু এসেছিল কোন এককালে। তার ঘর ছিল, সেই সুদুর লিসবোয়ায়। মাছ মারাদের সাথে জেলেনীরাও এই ছয় মাস ধরে উদয়াস্ত ঘাটে মাছ ধরে, বাছে, কাটে, শুকোয়, আর জেলেদের সাথে মিলে গড়ে তোলে ভালবাসার অস্থায়ী সংসার। এই ছয় মাস, জেলেরা তাদের ঘোড়াদলের ডাঙ্গায় ফেলে আসা মাগ-ছা এর কথা ভাবে না। এই ছ’মাস তাদের সংসার এই চরে। যে পুরুষের, যে জেলেনি জোটে, তার সাথে বেড়া খড়ের ঘর তুলে, সংসার করে। মাছমারারা সারারাত গাঙে গিয়ে মাছ ধরে। শুক্লপক্ষে গাঙে চাঁদের আলো পড়লে, চিকচিক করে। জেলেনীদের কথা মনে পড়ে। আর জেলেনীরা ঘরের কাজ সেরে নির্ঘুম রাত কাটায়। জেলেদের কথা ভেবে ভেবে। প্রতি বছরের মতো, বাতাসী, যমুনা, সাবিত্রী, কুন্তি এবারেও এসেছে জেলেদের সাথে। এই ছয়মাসের সংসার তাদের বড় ভরসা। বাকি ছ’মাস এখানে ওখানে পড়ে থাকতে হয়। পুরষেরা লোভের হাত বাড়ায়। খাবার জোটে না দুবেলা। এই চরে তারা ছয়মাসের বিবি। ঘোড়াদলের ঘাটে যে পুরুষ পছন্দ করে নেয়, তার সাথেই সংসার পাতে।কাজ করে। কাছিমের পুজো করে। প্রাণ ভরে রমণও করে।…….”

এই উপন্যাস থেকে মঞ্চের উপর দেখাবার এবং কিছু চিরকালীন অবদমন এবং শোষণ বার্তা দর্শকদের অনুভূতিতে পৌঁছে দেবার জন্যে, সমৃদ্ধ আঙ্গিকের উপকরণ অবলম্বনে, কল্পনা থেকে টেনে এনে, মঞ্চ দৃশ্য কাব্যের চেহারায় নিজে নাটকীয় টেক্সট লিখে, একটি ডাইরেক্টরিয়াল নাটক খাড়া করেছেন, আরোহীর অভিজ্ঞ নির্দেশক, অভিনেতা রঞ্জন রায়। তিনি অসহায় অবস্থায়, সাধারণ মানুষের, ক্ষমতার নাগপাশে পিষ্ট হতে থাকা, যাপন দশা দেখিয়ে, সমকালীন নাট্যচর্চায় নিজের এবং দলের উপযুক্ত, বলার কথা নির্ণয় করেছেন। ধনপতির চর নাটকে, আদিকালের এক লোকায়ত সংস্কৃতির মধ্যে, বেঁচে মরে থাকা সঙ্ঘবদ্ধ এক রাশ দীন দরিদ্র জেলেদের চলমান জীবনের সাথে, নদীর বহমান ধারাকে মিশিয়ে, তাপিত জীবন যুদ্ধকে আলোকিত করা হয়েছে।, মানুষের জৈবিক তাড়নাকে, চাঁদ সূর্য তারার স্বপ্নকল্পে, প্রাকৃতিক উপজীব্য প্রসঙ্গের মধ্যে উত্থাপিত করে এবং কাহিনী প্রস্তাবকে কাব্যিক মহিমায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই নাটকে বহু ছোট্ট ছোট্ট সমবেত শক্তিকে একত্রিত করে রাজনৈতিক উত্তাপকেও জীবন্ত রূপ দিয়ে, কহতব্য বলতে পেরেছে নাটকের সামগ্রিক কর্মকান্ড। অনেক বড় উপন্যাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকা জীবন বোধ, প্রতিবাদ, সংঘাত, পরিত্রাণের উপায় খুঁজে চলা আদ্দি কালের এক বিচিত্র জীবন ধারাকে এই বাজার ব্যবস্থার চাপে, মুখ থুবড়ে পড়া সার্বিক মানুষের কিংকর্তব্যবিমুঢ় হওয়া হতোদ্যম দশাকে, সচেতনে আলোকপাত না করেও, বিষয়কে আলোকের ঝর্না ধারায় উদ্ভাসিত করে দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছে। প্রযোজনা নিযুক্ত অনেক তুচ্ছাতিতুচ্ছ মুহুর্তকে অনবদ্য ভাবে জীবনের স্বপক্ষে, বর্তমান সময়ের অস্থির সময়ের টালমাটাল মেজাজের সাথে মিলিয়ে মিশিয়ে এক সমসত্ত্ব নাটক উপহার দিয়েছেন, আরোহী শিল্পীরা। ভাবনার কেন্দ্রে সামগ্রিক পরিকল্পনা নিশ্চিতই রঞ্জন রায়ের। কারণ তিনি নিজেই উপন্যাস থেকে ছেঁকে, কীভাবে কেন কি করা হবে… ইত্যাদি ভেবেছেন। তারপর এতো গুণী অনুশীলন ইচ্ছুক শিল্পীদের সমাবিষ্ট করে, তাদের সবাইকে ভাবিয়ে নাড়িয়ে এমন একটি দুর্দান্ত নাটকে হেরো দের ক্রমে জিরো হওয়াকে দর্শীয়েছেন। বড় স্প্যানের এই নির্মাণের মঞ্চ আলো আবহ, সঙ্গীত বাদ্য সব দিয়ে একটি মুহ্যমান অন্তর চেতনাকে মূর্ত করেছেন। মুলত রঞ্জন রায় এবং আরোহীর, সকল শিল্পী কুশীলব সমন্বিত শক্তিতে মানুষের অসহায়তাকে পথ খুঁজে দেবার শপথে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। এ নাটকে প্রতিটি চরিত্রের অভিনেতা অভিনেত্রীরা কেউ-ই নিষ্ঠায় ফেলনা নয়। সকলের অবদান পরিচ্ছন্ন। ধনপতির চর নাটকের মঞ্চ ভাবনায় দেবব্রত মাইতি, মঞ্চ নির্মাণে মদন হালদার, আলোক চিন্তনে সমর পাড়ুই, তার সাথে আলোক সহযোগি ছিলেন রাজেশ এবং ক্ষীরমল। নাটকের আবহ চিন্তার বহু মাত্রা চয়ন করেছেন রাজকুমার এবং আবহ প্রক্ষেপন করেছেন শুভেন্দু চ্যাটার্জি। অপরূপ রূপসজ্জায় অলোক দেবনাথের কৃতিত্ব স্বীকার করতেই হয়। নাটকের নামঙ্কন সবুজ পাল, এবং মঞ্চ সহযোগী ছিলেন সুব্রত, পরীক্ষিত, রাজা, রাজু, তৃষা, দেবাঞ্জনা, দেবিকা, প্রমুখেরা। এই নাটকের সহকারী পরিচালক ছিলেন সুমিত কুন্ডু।
নাটকের কিছু বাছাই চরিত্র, যারা মঞ্চে ছিলেন জ্যান্ত ও জীবন্ত, সারা নাটকের প্রকাশের বহুমুখী আবেগ ও উত্তেজনা বা স্বীকারের উগ্র উদ্দীপক কৃতিত্বের দাবিদার—সেই চরিত্রগুলি, ধনপতি বুড়ো, কুন্তি, বাতাসী, যমুনা, মঙ্গল পুলিশ, ব্যাপারী এবং মালাকার।
বৃদ্ধ ধনপতির ভুমিকায় রঞ্জন রায় বার্ধক্য, শারীরিক অক্ষমতা এবং গৌরব গর্বের বুদ্ধিদীপ্ততায় নিজেকে দক্ষতায় প্রকাশ করেছেন। বাতাসী চরিত্রে বর্ণালী চ্যাটার্জী অত্যন্ত সাবলীল এবং উজ্জ্বল অনুভূতিতে নাটকের কেন্দ্রীয় দ্বান্দ্বিকতায় মুর্ত হয়েছেন। একইভাবে যমুনা চরিত্রে সুস্মিতা ভট্টাচার্য বিভিন্ন আবেগের একটি সৎ নারীর ভুমিকা। দুর্ধর্ষ নেগেটিভ আ্যপ্রোচে মঙ্গল পুলিশ চরিত্রে অভিজিৎ ঘোষ এক সংযত চরিত্রে নিজেক ধরেছেন। ব্যাপারী চরিত্রে জগন্নাথ চক্রবর্তী এই নাটকের অন্যতম শক্তিশালী অভিনয়ের দাবিদার। বিরতির আগেই এই গল্পের মূল শক্তি নিঃশেষিত হয়ে যায়। এরপরের অংশের কেন্দ্রীয় চরিত্র মালাকার চরিত্রের প্রাণবন্ত অভিনয়ে সাত্যকী ভট্টাচার্য একাই একশো বনে যান। চমৎকার মিষ্টি নির্বিবাদী গায়ক মাঝি চরিত্রে সুব্রত রায়, ধনপতির চর নাটকের হৃদয় হয়েছেন বলেই অনুমান। এছাড়া গনেশ / সুমিত কুন্ডু, গুলাব / অদ্রিজ দাস, পীতম্বর / অভিজিত রায়, আরমান / সুব্রত রায়, এবং জেলেনীদের ভীড়ে অঞ্জনা, তৃষা, দেবাঞ্জনা, দেবিকা, বর্ষা প্রমুখেরা সমবেত কলতানে ধনপতির চর নাটককে মুখরিত করেছেন।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে কাছিমের পুজো করে মানুষ। ছয় মাস এই চরেই মুক্ত জীবন মাছ ধরে। মাছ শুকায়। মজুরি পায়। ব্যাপারী আসে বাণিজ্য চলে। পুলিশ আসে লুটপাট করে, নারী আর টাকা অবোধ মানুষ ভয়ে আর ভীতিতে, বাঁচতে চেয়ে এই জালে মাছের মতোই আটকে আছে। কাছিমের মতো পড়ে থাকা এই চর নদীর বুকের উপর যে জনগোষ্ঠীর আলেখ্য আলোচিত করেছে নাটক। দুর্বিপাকে দিশেহারা দুর্বলদের উপর যে দুর্বিনীত অত্যাচারের অমিমাংসিত পর্যায় তুলে এনেছে। বিশ্ব রাজনীতির ছায়ায় দেশের আভ্যন্তরীণ ভেঙে পড়া কাঠামোতে হয়তো আমরা সবাই অনিশ্চয়তার মধ্যেই কোন দিক থেকে কোন থাবায় ক্ষতবিক্ষত হবো, ধনপতির চর দেখতে বসে সেই উত্তাপ উত্তেজনা কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। তবে দীর্ঘক্ষণ ছেলে ঘুম পাড়ানী গানের পর্ব ক্লান্ত করে। জেলে জেলেনীদের জীবন যাপন কথনেই এসেছে। নাটকে নেই। তাদের যাপন নমুনার প্রেম ভালবাসার মাধুরী যুক্ত হলে ব্যঞ্জনা বাড়বে কি না ভাবা দরকার।