ব্যারাকপুর সাঁকো সংস্থার নাটক পরশমণি

- Advertisement -

দুলাল চক্রবর্ত্তী, ফরাক্কা 

অতি সম্প্রতি ব্যারাকপুর সাঁকো সংস্থা নির্মাণ করেছে নাটক পরশমণি। নাটকটির রচনা শ্যামাকান্ত দাস। নির্দেশনা কাঁচরাপাড়ার প্রবীণ নাট্যশিল্পী সুকান্ত কর্মকার। সত্তর দশকের শেষ ভাগে লেখা এই হাস্যরসে ভরা গভীর রাজনৈতিক বক্তব্যের সিরিও কমিক নাটকটি, যে আজও কতটা প্রাসঙ্গিক। তা-ই বুঝিয়ে দিল সাঁকো সংস্থার সমস্ত কর্মী বৃন্দ, তাঁদের আন্তরিক প্রচেষ্টায়।এই নাটকে কোথাও কোন প্রক্ষিপ্ত বক্তব্যের উত্থাপনীয় প্রয়াস নেই, শুধু একটা গল্পের ঘটনা ক্রমে উৎপন্ন নান্দনিক চলনে, উপস্থাপনার আভ্যন্তরীণ মোচড় ও খুটিনাটি চারিত্রিক রহস্যে জড়িয়ে থাকা অজস্র ব্যাপ্তিতে নাটকটি পরিবেশিত হয়েছে। তাই সামগ্রিক অভিনয়ের কিছুটা জড়তা-সংকোচ, গল্পের মজায় এবং পরিবেশন গুণে দর্শক মনকে ভাললাগায় গুঞ্জরিত করলো। যখন চলমান অসংখ্য ছোট নাটকের যান্ত্রিক চলনে এবং প্রবন্ধের ছদ্মবেশে লিখিত কেবলই আলোচনা মূলক নাটকের ভীড়ের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে দর্শক মন। ঠিক তখনই গল্পের আরাম দর্শকদের মনে চিন্তার সূত্রে ও আনন্দে কিছুটা স্বস্তি দিলো। নাটকের গঠনশৈলী বিচিত্র ঘটনা পরম্পরায় ঘটে চলা মানবিক প্রবৃত্তিতে কিছু বড়ো কাজ করার পক্ষেই মানুষের নিজের রাজনীতিকে জাগায়। প্রভাবিত করে। সেই অর্থে নিছক হাসির মধ্যেও পরশমণি নাটক নিজের ভেতরের প্রতিধ্বনিতে কি হলো, কেন হলো, কিভাবে সম্ভব ইত্যাদির কিছু আভাস আলোকিত হল। চিত্তেরও প্রশান্তি মিলল। যদিও অন্তিমে মৃত্যু বিঘ্নিত স্থিতিতে সাময়িক ভাবেই চঞ্চল করলো। এখানেই আছে গল্পের অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রান্তিক জটিলতা। 

যাই হোক নৈহাটি ঐকতানে অভিনয় চলাকালীন সময়ে মুহুর্মুহু করতালিতে মানুষের সামগ্রিক ভাল লাগা পাওয়া গেলো। মঞ্চ আলো এবং সাজ পোশাক সহ আবহ ভাবনা — আধুনিক নাট্য প্রকরণের ষোলআনা কড়ায়গণ্ডায় হিসাব কষেই, রীতিমতো বড় দলের শক্তি সামর্থ্যের সাড়ায় খুঁজে পাওয়া গেল। যদিও   একেবারেই নতুন সংস্থা ব্যারাকপুরের এই সাঁকো নাট্যদল। কিন্তু এগারোটি চরিত্রের জন্য উপযুক্ত এবং মানানসই ভূমিকায় চরিত্র উপযোগী নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। সকল কুশীলবদের অভিনীতব্য চরিত্রের জ্ঞান চমকে দিল। সকলেই চরিত্রানুগ অভিনয় করেছেন। তাই আরো মঞ্চায়ন পেলে এই পরশমণি নাটক এই সময়ের মফস্বল বাংলার অন্যতম বিশিষ্ট একটি পূর্ণাঙ্গ নাটকের উপস্থাপন হতে পারে। তবে অবশ্যই কিছু সংশোধন এবং পরিমার্জনা দরকার। 

নাটকের স্বত্বাগত বৈশিষ্টে যুক্ত আছে কিছুটা মেলোড্রামা, ফেলে আসা সময়ের সাথে যদিও সে-ই রীতি জড়িত, সিরিও কমিক ঝড়ের দাপটও কাঙ্ক্ষিতভাবেই সংযুক্ত, আর তার অতলে সমাজের মধ্যেকার লুম্পেন বা একেবারেই ঘৃণায় তলিয়ে থাকা মানুষের ক্রমে পাতি বুর্জেয়াদের গা ঘেঁষে চলে আসার চেষ্টায় তীব্র কোলাহলের ঝনঝনানি সৃষ্টি হয়েছে। যাতে আছে প্রলেতারিয়ানদের সংস্রবে আসা সেই নিচুতলার মানুষের কান্না হাহাকার আর সভ্য সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে মিশে ভিন্ন গোত্রের অভিযানভিত্তিক যাত্রাপথের সংঘর্ষ জনিত এক কলরব। যা আত্ম প্রতিষ্ঠায় সোচ্চারিত মিশ্র কালচারের দ্বন্দ্ব। তাই এই পরশমণি নাটক গঠনেই সচকিত সম্ভাবনার এক অলীক কল্পনায় বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতার নমুনা। এখানে গল্পের পথেই আছে মানুষের মানুষ হবার কাঙ্ক্ষিত কলরব। যা উচ্চকিত স্বপ্নের অধিকার অর্জন মাত্র।

তাই সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার ওই ঠক জোচ্চোর কালীচরণ, বেশ্যা ডুগডুগি ও ছিচকে চোর চারুলতা এবং এক নিরাশ্রয় মধ্যবিত্ত যুবক কল্যাণের আশ্রয় আবাস পাবার সাথেই নিজেকে হরিবাবুর বাড়ির ভাড়াটে করে নিয়ে যে অন্তর্ভুক্ত অন্তর দ্বন্দে দোদুল্যমান হয়েছে। তা ৪০ বছর আগের একটি রাজনৈতিক ব্যাখ্যার সাথে যুক্ত। একেবারেই সৌখিন থিয়েটারের গা ঘেঁষে এই গল্প মজার মোড়কে ভরে দেওয়া, মানুষের বিশেষ আত্ম প্রতিষ্ঠায় প্রণতিরত ইচ্ছাপূরণ। শুধু রণদেবের সাথে খন্ড যুদ্ধে কালিচরণের মারা যাওয়া অবাস্তব অবিশ্বাস্য একটা নাটকীয় ঘটনা। যা গল্পের ভিতরে মেলোড্রামাকে জোর করে বসিয়ে দিয়ে নাটক শেষ করার পরিনতি দেখায়। গল্পের জয় কিছুটা অর্থহীন লাগে। এটি কিন্তু অতি অবশ্যই কষ্ট কল্পিত সমাপ্তি। 

সে সব যাই হোক পরশমণি নাটকে প্রায় সকলেই যথাযথ অভিনয় করেছেন। খুব ভাল মিষ্টি মুখর, নান্দনিক, এবং মিলনের প্রতীক চরিত্রায়নে নীতা সেনের ঝুমকি চরিত্র। এই নাটকের তিনিই সাঁকো, ঘর ও পথের, সুখ ও দুঃখের এবং জীবন ও মরনের কেন্দ্রে। এছাড়াও খুব দ্বান্দ্বিকতার চরিত্রায়ন ডুগডুগি/ প্রিয়াঙ্কা সরকার এবং চারুলতা/ সুচরিতা দত্ত। তিন নারী চরিত্রই চমৎকার। যথেষ্ট পরিশ্রমী এবং নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রের সামগ্রিক ব্যঞ্জনা ব্যক্ত করে, একেবারেই যুক্তিযুক্ত ভাবে কালীচরণ চরিত্রে সুকান্ত কর্মকার প্রযোজনার বিশেষ শক্তি হয়ে উঠেছেন। তিনি কাঁচরাপাড়া হংসমিথুন সংস্থার তিন দশক আগের নাট্য শিল্পী। কাজেই নিজে নির্দেশকের ভূমিকায় থেকে সব দায়িত্বে তিনি পারঙ্গম যখন, তখন এ আর বেশি কথা কী? খুব ভাল সাথ দিয়েছেন ভাড়া বাড়ির মালিক হরিবাবু চরিত্রে প্রসুন গাঙ্গুলী। এছাড়াও কল্যাণ /প্রবীর কুমার চাকলাদার, চঞ্চল / কৌশিক মন্ডল, রণদেব / যোগাশীষ বন্দোপাধ্যায় তাদের নিজস্বতায় বেশ মানিয়ে গেছেন নাটকের নানা মুহুর্তের নানা তরঙ্গে। বিচিত্র ভূমিকায় হাস্যরসের উদ্রেককারী চরিত্রে গর্জন সিংয়ের চরিত্রে গোপাল বিশ্বাস, অবাস্তব যদিও, তবুও রিলিফ ক্যারেক্টর হিসাবে বেশ মজার। তবে এই চরিত্রের পোশাক নাটকের ঐতিহাসিক সত্যে যুক্ত নয়। এখানে ভাবতে হবে কিনা তা-ই প্রশ্ন। ছোট্ট কিন্তু দুরন্ত মুহূর্তের নকশালপন্থী আন্দোলনের আভাসে ভাই চয়ন/ আকাশ চাকলাদার, ও ছোট ডুগডুগি/ অদিতি সাহা রায় সুন্দর যোগদান। শঙ্কর দেবনাথের আলো, কৌশিক মন্ডলের মঞ্চ, কৌশিক সজ্জনের আবহ একেবারে ফেলনা নয়। তবে ভাবনায় আরো বলিষ্ঠ হবার অপেক্ষা আছে। সব মিলিয়ে প্রথম মঞ্চায়নে সাঁকো প্রযোজিত পরশমণি নাটক,– নাটক করার জন্যেই কেবল নয়। সময়ের কথা বলার দ্বায়িত্বেই রইলো। বহুল মঞ্চায়নে যার সাফল্য সম্ভব।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -