ভাটপাড়া আরণ্যক থিয়েটারের ‘কুহক তন্ত্র’

- Advertisement -

দেবা রায়  

গত ২২ শে মে তপন থিয়েটারে অনীক আয়োজিত ‘সদরে মফঃস্বল’ শীর্ষক প্রজেক্টে অভিনীত হল ভাটপাড়া আরণ্যক প্রযোজিত নাটক ‘কুহক তন্ত্র’। কুহক শব্দের আক্ষরিক অর্থ ধরে এগোলেই বোঝা যাবে বিষয় বস্তুর দিকটি। ছলনা, প্রতারণার তন্ত্র যা সামাজিকভাবে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সংস্কার যার পশ্চাতে  আছে এই প্রতারণার মায়াজাল। অর্থাৎ ডাইনী প্রথা। এই নাটকের নাট্যকার ও পরিচালক সঞ্জয় আচার্য আদিবাসী অঞ্চলে গিয়ে তাঁদের সাথে থেকে নানান অভিজ্ঞতার সঞ্চয় করে নির্মাণ  করেছেন ‘কুহক তন্ত্র’। যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।   

এই নাটক নির্মাণের মধ্য দিয়ে পরিচালক শ্রী আচার্য ও নাট্যদল ভাটপাড়া আরণ্যক অবশ্যই সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করেছেন। মানুষের দরবারে এই প্রথার উপস্থাপন ও অন্যায় মায়াজালের চক্রান্তের কাহিনী অনবদ্য রীতিতে বুনেছেন। সরল সাদাসিদে গ্রামবাসীর ভেতরে শহুরে কর্পোরেট জমি দখল ও উন্নয়নের নামে ভিটেমাটি উচ্ছেদ করার সাথে সাথে কীভাবে রুখে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে চক্রান্তের জালে ফেলে খুন করা হয় তারই জলন্ত নাট্য আখ্যান মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন টীম আরণ্যক।    

কুহক তন্ত্র-র নাট্য মুহুর্তগুলি শহুরে নাট্য দর্শকের চোখের সামনে তুলে ধরে এক অজানা তথ্য ও সত্যের মুখোমুখি করেছেন তাঁদের। অরণ্যের জমি আগলে পড়ে থাকা ফুলমতির জীবনে ঘনিয়ে এল ঘন অন্ধকার। ওরই জমির ওপর নজর পড়ল  কর্পোরেটের। থাবা বসালো তাকে উচ্ছেদ করে সেখানে নির্মাণ  হবে রেসর্ট। উন্নয়নের পতাকা পত পত করে উড়বে সেই টিলার ওপর। শহুরে বাবুদের আমোদে প্রমোদে নষ্ট হবে অরণ্যের শান্তি ও স্তব্ধতা এবং সেই অবশ্যই জনজীবনের মধুরতম ছন্দ। ফুলমতি যখন রুখে দাঁড়ায় তখন নির্মানকারী সংস্থা আঞ্চলিক মোড়লের  সাহায্যে সেই ফুলমতির জমি থেকে উচ্ছেদের চক্রান্তে লিপ্ত হয়। স্বজাতির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে ফুলমতির নিয়তি বা ভবিষ্যৎ। ডাক পরে জানগুরুর। বিধান হয়- ফুলমতি ডাইনী। ফুলমতিকে পুড়িয়ে মারতে হবে। ফুলমতি সেই তীব্র আর্তনাদ শহুরে জনজীবনে কোনদিন পৌঁছবে না। কিন্তু সেই অরণ্যেই এক স্কুলের দিদিমনি ফুলমতিকে উদ্ধারের স্বার্থে সমস্ত চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে  প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে উদ্ধার কার্যে এগিয়ে আসে। মৃত্যুর মুখ থেকে তীব্র যন্ত্রনা নিয়ে মুক্তি পায় কি ডাইনী ফুলমতি? এমনি এক প্রশ্নচিহ্নের মধ্যেই সমাপ্ত হয় নাটক।  

ফুলমতির ভূমিকায় কেয়া ঘোষের অভিনয় বেশ বলিষ্ঠ। সংলাপ এবং ছন্দ কোনোভাবেই তাল কাটেনি। বাচিক ও কায়িক অভিনয় অনেক পেশাদার অভিনেতাকে চ্যালেঞ্জ দেবে। এই নাটকের আলাদা করে কাউকেই বলা সম্ভব নয়, কারণ নাটকটা সম্পুর্ণ টীমওয়ার্ক। সকলের একাগ্রতা ও যুথবদ্ধতায় ধীরে নাটকটি   অসাধারণ বুনেছেন অভিনেতারা। তাঁরা হলেন দেবজিত দাস, জাহিদ শাহ, সুশীল বণিক, পুলকেশ ভট্টাচার্য, সায়নী চক্রবর্তী, সঞ্জয় আচার্য, লোহিত দাস ও অন্যান্যরা।

মঞ্চ ভাবনায় সুশীল ও শুভাশিস বেশ ভালো। তবে মঞ্চে চাকার ব্যবহারটা ভালো, কিন্তু সাইকেলের চাকাটা কোথায় যেন নগর সভ্যতার নির্দেশ দেয়, যা বেমানান। আলোয় লোহিত দাস বেশ ভালো। আবহে জাহিদ ও দেবজিত যথাযথ। 

নাটকটির গতি ভীষণ সুন্দর ভাবে ক্লাইমেক্সে পৌঁছেছে কিন্তু শেষ দৃশ্যের প্রেত ভাবনার প্রয়োগ বিষয়টিকে কোথায় যেন নাটকের বিষয়বস্তু ও বক্তব্যকে খর্ব করে দেয়। আমরা কি কোনভাবেই তাদের সেই অন্ধ কুসংসারকে স্বীকার করি? এটা নিয়ে ভাবার  অবকাশ আছে। আবারও বলি এই প্রযোজনা চিরকালীন হয়ে থাকবে। ডাইনীতন্ত্রের বিরুদ্ধে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে এই প্রযোজনা। আর এই ব্যাপারে পরিচালক সঞ্জয় আচার্যের গবেষণায় উঠে আসুক আরও অজানার কাহিনীর আরও নানান ভাবনার কথা। যা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। মেরুদণ্ড সোজা করে বসতে সাহায্য করবে।   

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -