হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্রের অনুসন্ধানে “ভেমুলার রামায়ণ”

- Advertisement -

দুলাল চক্রবর্ত্তী

৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায়, মিনার্ভা মঞ্চে ভেমুলার রামায়ণ নাটক দেখলাম। প্রযোজনা অশোকনগর নাট্য মুখ নাট্যদল। দলিত যুবক রোহিত ভেমুলারের আত্মহত্যার প্রেক্ষিত অনুসন্ধানের নাটক এটি। নাটকের আকারে রামায়ণের শম্বুক উপাখ্যানকে, এই সময়ের রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠা সংকল্প-উদ্যোগে সামিল করেছেন বর্ধমানের লেখক অধ্যাপক অংশুমান কর। নির্দেশনা ও আঙ্গিক রূপায়ণে অভি চক্রবর্তী।

সরাসরি সময়ের দাবিতে উঠে আসা রাজনৈতিক নাটক এটি। তাই শুধু খুঁজে ফেরা এক মৃত্যু পেছনের শুকনো কান্নার দাগ, কোথায় কতটুকু লেগে আছে। কারণ, রোহিত ভেমুলার ছিল দলিত যুব সমাজের একটা প্রতিবাদ, একটা দেশের সার্বভৌমত্বে ভালবাসার প্রতীক। যে নিজে হেরে গেছিলেন। সমষ্টিগত মানুষকে পাশে না পেয়ে। এ পরাজয় শুধুই নিজের নয়, অন্যেরও, হয়তো সব ভারতীয়দের। আগামী সময় বলবে, কার ঘরে কোন সন্তান কীভাবে খোয়া যাবে, তা কে জানে? তাই এই দলিত সন্তান, রোহিত এক ধ্রুবতারা, জেগে থাকা জাগিয়ে রাখা প্রতিটি পরিবারের আত্মা-সম্পদ।

কিন্তু উপলব্ধি হীন এক দুঃসময়ে আছি। কেমন করে যে রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের মধ্যে চলে এসেছি। জানি না। যেন বুঝতেই পারিনি। তাই তাকে এবং তার প্রতিবাদ প্রতিক্রিয়াও ঠিক  চিনে নিতে পারিনি, পারছি না। পারছি না বুঝতে, আগামীকালের জন্যে কোন কান্নার ফুল বুকের ভিতরে কুঁড়ি হয়ে আছে ফোটার অপেক্ষায়। তাই রোহিত কথায় আলেখ্য এই এক জাগিয়ে তোলার নাটক হয়েছে ভেমুলার রামায়ণ। কেননা সে তো আজ অতীত, কিন্তু সময় বর্তমান। রোহিত ভেমুলার হতে পারে এইসময়ে মানুষের জন্যে রুখে দাঁড়ানো এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। কিন্তু আমরা বুঝতে দেরি করে ফেলি। কোন তারা কি করে মেঘে লুকিয়ে লুক্রেতিউস বনে যায়, কে তার খবর রাখে। চোখ থাকতেও অন্ধ আছি তো। নাকি অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেছি? বা দেখতে চাই না ভবিতব্য ভবিষ্যৎ, অথবা দেখি, কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে আনন্দ দেখি। বিনোদে বিনোদনে হাসি আর এই দেখে না দেখার ভান করে নিজের টুকু বুকে আঁকড়িয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়াতেই নিজেকে ধন্য ধনী করে তুলি। চারপাশের দুর্যোগে তাই ভেমুলার অবগতির পরম্পরায় এক ভিন্ন পাঠ আসন্ন হয়েই যায়।

সেই কারণে এদিন মিনার্ভা মঞ্চে নাটক শুরুর আগে অশোকনগর নাট্য মুখ দলের ২৫ বছর পূর্তি প্রারম্ভের সূচনা ঘিরেই বসেছিল ভেমুলার রামায়ণ ঘিরে সব নাটকের জন্যে সেমিনার। আলোচক অভি চক্রবর্তী (নির্দেশক, অভিনেতা), অনির্বাণ ভট্টাচার্য (লেখক অভিনেতা), অংশুমান কর( লেখক অধ্যাপক) ও সঞ্চালক সায়ন ভট্টাচার্য (প্রাবন্ধিক, কবি)। এঁরা সবাই নিজেকে ভালবেসে, সবাইকে ভালবাসার গল্প বলতেই ত্রিশ চল্লিশ মিনিটের সময়কালে, সাহিত্য-সময়-থিয়েটার নিয়ে এক অনিবার্য এই মৃত্যু না হত্যার গল্প বললেন। সেই রেশেই, এই দেশে কে কোথায় কীভাবে আছে, সাথে থিয়েটারের যাপন বিলাস কোন তরঙ্গে বইছে তা-ই ভাবছি। না, সেখানে সেসব কথা হয় নি।

অনেক জানা হলো। চলুক সময়, সেই ফেলে দিয়ে চাপা পড়া মানুষের কান্না-গল্প করেই, এখন পথ চলি। কেননা কেউ মরে যেতে চায় না। তাই এইমর্মে, অশোকনগর নাট্য মুখ দল শুভ নাট্যেই আছে। কিছু তো করেই এতো গুরুত্বে এলো। এই সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাটক নির্বাচন আগুনে হাত ঢুকিয়ে কতটা পুড়ছে, তাই বোঝা। আর চিৎকার করা। যেমন ওই যুবক বুঝেছিল। গলায় ফাঁস এটে বসতেই তো বাঁচা কি চরম চাওয়া বোঝা যায়। যেমনটা ঘটেছিল, যখন পরিস্থিতির চাপে রোহিত ভেমুলারকে মৃত্যু সিদ্ধান্ত নিতেই হয়েছিল। মৃত্যুকে সামনে বসিয়েই তাকে এক পত্র সাহিত্য লিখে শেষ নিঃস্বাস ফেলতে হয়েছিল। অঢেল জ্ঞান, অনেক সামর্থ্য, প্রচুর আশার স্বেচ্ছা-বিনাশ, কি মর্মান্তিক। ভাবা কী যায়? শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। সময়ের উদাসীনতায়, নৈরাজ্যের বিরুদ্ধ-অভিমানেই তার আকাশের নক্ষত্র হয়ে চলে যাওয়া। পৃথিবীর ক্ষতি। আকস্মিকভাবে নিজেই নিজেকে নাশ করার পরিকল্পনা করা। যা রাষ্ট্র বিরোধিতা করার পরিণামগত ফল। বেঁচে মরে থাকার চেয়ে মরে বেঁচে যাওয়া আর চিরস্থায়ী হওয়ার অনুপম উদাহরণ। উদ্যমী এক মহার্ঘ্য প্রস্থান সিদ্ধান্ত। রামায়ণকে সাক্ষী রেখে, রামকে তিরস্কার করে, অযোধ্যা রাম মন্দিরকে অর্থহীন করতে এই ভেমুলার রামায়ণ সময়ের নাটক। তবে এই প্রযোজনা বড়ই সরব, অনেকই আছে রামায়ণে, অনেক্ক্ষণ ইতিবৃত্তে।ভেমুলারে কম। কিছুটা কী নিস্তব্ধ হতে পারে? একেবারেই চুপচাপ কান্না…তার বোধ নিয়েই বাঁচার জন্য ক্রমান্বয়ে সক্ষম লড়াই কী শুরু হতে পারবে? কেউ জানি না…. ভাবনা মাত্র, মনের দুশ্চিন্তা।

এই নাটকের সফল মঞ্চ ও আলোক ভাবনায় অভি চক্রবর্তী, আবহের বিচিত্রিতায় তমাল মুখোপাধ্যায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সাথে পোশাক অলঙ্করণে রিক্তা চক্রবর্তী আরেক সুন্দর সংযোজন। অভিনয়ে রাজু বেরা (শম্বুক), বারুনী (সঙ্গীতা চক্রবর্তী), সতর্ক (অসীম দাস), ত্রিশিরা (অরূপ গোস্বামী), সাংবাদিক (দেবাদ্রিতা ভট্টাচার্য), রিয়াজ (উদ্দালক ভট্টাচার্য), খর(সৌমেন্দু হালদার) নজর কেড়েছেন। গান ও কন্ঠদানে অর্ক দেব এবং শ্রেয়া সরকারের প্রসংশা করতেই হয়। এই নাটকে মিত্রার ভূমিকায় অর্পিতা পাল চমৎকার নান্দনিক একটি চরিত্র। অপূর্ব তাঁর অবদান। সমগ্র নাটকের অনুভূতি অনুভবে এঁদের আন্তরিক তাগিদ সংযুক্ত আছে।

সব মিলিয়ে অভি চক্রবর্তী নিজের নাট্য জ্ঞান অভিজ্ঞতায় সার্থক চালনা করেছেন। কিন্তু রোহিত ভেমুলার যেমন নিরবচ্ছিন্ন নিরবতা, রামায়ণের সবটুকুই কিন্তু তেমনই অত্যন্ত সরব সরবরাহ। তাল বাদ্যে কোথায় যেন কান্নার অবকাশ নেই। নিশ্চিতই তুলনামূলক প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের প্রস্তাব হলেও ভেমুলার যে নেই, শূন্যের সমুদ্রে শুধুই ঢেউ, এই মর্মে কিছুটা প্রথাগত নাট্যায়নের অন্তর্ভুক্ত আর্তনাদ যুক্ত হলে, কি ঘটে তা দেখার ইচ্ছা রইলো।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -