উঠোন আয়োজিত মানিক নাট্যমেলায় কাঁচরাপাড়া কৃষ্টির নাটক রক্ত নোনতা

- Advertisement -

দুলাল চক্রবর্ত্তী  

কাঁচরাপাড়া কৃষ্টি নাট্য সংস্থা, উঠোন ( কিছু নাট্যদলের সম্মিলিত ফোরাম ) আয়োজিত মানিক নাট্যমেলায়, তাদের রক্ত নোনতা শীর্ষক নাটকটির অভিনয় করেছিল। সম্প্রতি নৈহাটি ঐকতান মঞ্চে, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের গল্প আশ্রিত, সর্বমোট ৯টি নাটকের ক্রমিক মঞ্চায়নের মধ্যে, এটি ষষ্ঠ প্রদর্শনের উপস্থাপনা ছিল। রক্ত নোনতা নাটকের অতি সংক্ষিপ্ত পরিসর এবং সকল চরিত্রের চমৎকার অভিনয় দীপ্তি আনন্দিত করেছিল।

বাস্তবিকপক্ষে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা এই গল্পের মধ্যে তেমন নাটকীয়তা নেই। আছে বর্ণনা আর অবস্থার আলোকপাত। তবুও নাটকে কিছু বাড়তি কল্পনা যুক্ত করে, বিবিধ চরিত্রের মনভূমে জেগে ওঠা বক্তব্যের অরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে, শোষিত সমাজের, এই সময়ে ঘুমিয়ে পড়া অস্তিত্বের গালে থাপ্পড় মেরে জাগিয়ে উঠিয়ে কোন রাজনীতি কার এবং কেন আজ প্রয়োজন, তাই বুঝিয়ে দেবার জন্যে, রক্ত নোনতা নাটক, সুভাবিত একটি ডাইরেক্টরিয়াল স্ক্রিপ্ট থেকে হয়ে ওঠা একটি সৃজনশীল প্রযোজনা। প্রায় অনু নাটক পরিসরের ব্যাপ্তি গভীরতা এখনো মনে দাগ কেটে রয়েছে।

ভোলা যাচ্ছে না, নাটকের বক্তব্য কথার তেজ-ঝাঁজ-ভাঁজ, আর নির্মাণের সময়োপযোগী অনুপম ব্যাখ্যা। মূল গল্পের নাট্যরূপের চেহারাটা চয়ন করেছেন বারাকপুরের সাবিক পন্ডিত। অভিনয় ও নাট্য ক্রিয়ায় সমগ্র হয়ে ওঠার নাট্য ভাবনায় ছিলেন নির্দেশক সুদীপ্ত দত্ত। মূল গল্পের ঈঙ্গিতময় সাহিত্যের অনুভূতি গুলিকে তিনি, (সম্ভবত নাট্যরূপ কার সাবিক পন্ডিত সহ) এই সময়ের বিপ্লবী জেহাদের আস্বাদে, বৈচিত্রে, অপূর্ব বিন্যাস ভাবনায় ধরেছেন। নাটকের নামে সংযুক্ত রক্ত কী, আর নোন্তাই বা কেন, তার প্রকৃতি সুপ্ত স্তর থেকে চারিত্রিক অনুভূতির প্রকাশে তিনি বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন। ব্যবহৃত নাটকের অতি সাধারণ মঞ্চ সংস্থাপনে খন্ডিত আলোক মূর্ছনায় আকাশ প্রসাদ এখানেও উজ্জ্বল এক নাম। সামগ্রিক পরিকল্পনা ও নির্মাণ তদারকিতে ছিলেন গৌতম ঘোষ ও মনোজ প্রসাদ।

সময় আসন্ন সন্ধ্যা। ডাক্তার দাসের চেম্বারের বাইরে ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ চলছে। চলছে পুলিশের সাথে বিপ্লব বিদ্রোহে যোগদানকারী তরুণ তরুণীদের সংঘাত। চেম্বারে তাই অসুস্থ রোগী আসতে পারছে না। বসে থেকে ক্লান্ত নবীন কম্পাউন্ডার চলে যেতে উদ্যোগ নিচ্ছে। এই গোলমালে ডাক্তার দাস কিন্তু বাইরে যেতে চান না। নবীনকে আজ রাতে বাড়ি না ফেরার সংবাদ স্ত্রীর কাছে জানাতে বলেই ক্ষান্ত হন তিনি। তিনি যে একজন আত্ম সর্বস্ব মানুষ। তা বোঝা যায়। মিছিল মিটিং ইত্যাদির বিতন্ডা বিবাদে তিনি থাকতে চান না। ইতিমধ্যেই রাত ঘনায়। শিবশঙ্কর বাবু বোমা ইত্যাদিতে রক্তাক্ত একটি ছেলেকে চিকিৎসার জন্যে আনে। দেখা যায় ছেলেটি ডাক্তারের নিজের। মৃত প্রায় দশা। এখন শুধু উপলব্ধি। রক্ত পাতের ভয়ের পাশে আসে রক্তাক্ত আত্মজের অন্তিম কাল।

এখানেই রয়েছে গল্পের উপমা ব্যঞ্জনা। ডাক্তারি চিকিৎসায় রক্তের কাঁটাছেঁড়া প্রচুর করেছেন ডাক্তার দাস। সেই রক্তের স্বাদের থেকে বিপ্লবে আহতদের রক্তের স্বাদে কত কান্নার লবণ জমে আছে। তা যেন জিভে চেটেই সন্তান হারা বাবা বুঝতে পারছেন। এই যে রক্ত নোনতা লাগে তখন, যখন শোষণ পীড়িত বিপ্লবের রক্তাক্ত কান্না ক্রমে আস্বাদিত হয়, এটা বোঝাতেই এই গল্প মানিক বন্দোপাধ্যায় লিখেছিলেন।

এখানে নাট্যকার ও নির্দেশক অনেকখানি সাব টেক্সট রচনা করে গল্পের বাস্তবতা এবং ঘটনা পরম্পরাগত পরিস্থিতির অনুমান দিয়েছেন। যা উলম্ব কিম্বা প্রলম্বিত আরোপ নয়। ছেলের নাম হয়েছে অজয়। ছেলেটির প্রেমিকা এসেছে। তার নাম এষণা। ডাক্তার দাসের স্ত্রীকেও নাটকে ফ্লাসব্যাকে আনা হয়েছে। আসিফ নামে ছেলের কলেজ বন্ধু এসেছে। ধর্মীয় মৌলবাদে হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার চক্রান্তে, এইসময়ের এন আর সি অথবা সি এ প্রয়োগের বিরুদ্ধে কলেজ ছাত্র ছাত্রীদের অবরোধ আন্দোলনকে যুক্ত করা হয়েছে। আপোষকামি বাবা, ডাক্তার সেন মুখ বুঝে থাকাই শ্রেয় মনে করেন। তাই পড়াশোনা নিয়ে ছেলেকে ঘরের কোণঠাসা জীবনে ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর তিনি। ছেলে অজয় বাবার বিরুদ্ধে গোপনে মায়ের প্রশ্রয়ে এই বিপ্লবী চক্রে জড়িয়েছে। এই সক্রিয় রাজনৈতিক অংশ দানে এষণা’র অত্মিক সাড়ায় অজয় অজস্রের অংশ হতে চায়। নবীন কম্পাউন্ডার অবসরে এই চেম্বারেই ফেস্টুন লেখে। লুকিয়ে রাখে মিছিলের হাতিয়ার করে। এসব ডাক্তার দাসের নজরে এসে দ্বান্দ্বিক নজির নমুনার বিরক্তিতে, নেগেটিভ আ্যপ্রোচ সৃষ্টি করে। ছেলে অজয়ে’র প্রেমিকা এষণা’র প্রত্যয়িত আর্তনাদ বিরুদ্ধতায় এসব জানা যায়। শেষে এই আহত পরিনাম। কি চেয়ে কী পাওয়া। তা থেকেই রক্ত নোনতা নাটকের ভিন্নতা, পরিচ্ছন্নতা, অনুভব করে মুগ্ধ হতে হয়েছিল। মাত্র সতেরো মিনিট সময়কালে এমন কিছু নাট্য মুহূর্তে মুখোমুখি কবে হয়েছি, জানি না। গল্পের কিনারা কার্নিশ ধরে ঝুলে থাকা সম্ভাবনাব গুলি থেকেই এতো জল্পনা কল্পনা এসে, আমাদের ঋদ্ধ করেছিল। যা গল্পে একেবারেই নেই।

বাবা ডাক্তার দাসের একবগগা দাপুটে চরিত্রে দুরন্ত অভিনয় করেছিলেন উত্তম ঘোষ। অনেকটা সময় মনোলগে একাই তিনি বিশেষ স্টেজ পার্সোনালিটি হয়েছিলেন। তেমনই প্রেমিকা কলেজ পড়ুয়া এষণা চরিত্রের তীব্র যন্ত্রণা দগ্ধ অনুভব চমকে দিয়েছিল। এই চরিত্রে, দেহের ও মনের ভাষার সু প্রকাশে ঋদ্ধিমা দে যে একজন উঁচু দরের অভিনেত্রী। তা মেনে নিতে হয়। প্রেমিকার পাশে মন্দ নয় বাবার দুর্বিনীত সন্তান এবং প্রেমিক অজয় চরিত্রের সৌরভ সাহার অভিনয়। নবীন কম্পাউন্ডার ও আসিফ চরিত্রে আকাশ ভৌমিক মানানসই। তুলনায় শিবশঙ্কর বাবু চরিত্রে সুখেন সিনহা অনেকটা দায়সারা লাগে। সহজ সরল মায়ের গৃহিণী রূপে স্বাতী প্রসাদ যে মনোজ প্রসাদের উপযুক্ত স্ত্রী, তা মেনে নিয়েই আনন্দ পেলাম। তাই রচিত এক পরতের গল্পের মধ্যে বৈপরীত্যের বিলম্বিত অনুভব সুক্ষ্মভাবে ঢুকিয়ে এই রক্ত নোনতা অতি অবশ্যই  একটি ক্ষুরধার উপস্থাপনা হয়েছে। প্রোডাকশন প্রসেস এবং অভিনয় স্কুলিং এখানে বক্তব্যের সাথে যুত বদ্ধ শক্তিতে প্রথিত হয়েছে। সব মিলিয়ে উঠোন আয়োজিত মানিক নাট্যমেলায় কাঁচরাপাড়া কৃষ্টি দলের এই নাটকের মঞ্চায়ন বিশেষ সম্মান।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -