দুলাল চক্রবর্ত্তী, ফরাক্কা
বিশিষ্ট নাট্যকার শান্তনু মজুমদার লিখেছেন ‘শুনো রে নন্দরাণী’ নাটক। আমরা দুজনেই পাশাপাশি বসে, গত ১৬ জানুয়ারি, মালদহ দূর্গা কিঙ্কর সদনে এই নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন দেখলাম। নিজের লেখা নাটক দেখে শান্তনু মজুমদার নিজেও সেদিন অভিভূত হয়েছিলেন। এর প্রধান কারণ এই জটিল নাটক মঞ্চায়নে দলের কব্জির জোরের নিপুণ প্রকাশ। স্কুলিং অফ এ্যাক্টিং, অ্যান্ড প্রোডাকশন প্রসেসিং অফ টেক্সট দুরন্ত। নাট্যকারের চিন্তায় রচিত আখ্যানটি ধারালো প্রক্ষেপণে উদ্ভাসিত হতে পেরেছে। মফস্বল বাংলার তথা উত্তর বঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল সহ মুর্শিদাবাদের গর্বিত অনেক নাট্যদলের চর্চায় এই স্কুল অফ আ্যক্টিং কমই দেখেছি। যত গুণপনা আছে, সবই অভিনয়ে কেন্দ্রীভূত। অনুভব অনুভূতিকে মান্যতা দিয়ে চরিত্র অনুযায়ী, পরিস্থিতির গুরুত্বে অভিনেতাদের স্বরের অতি স্বাভাবিক লেনদেন নজর কেড়েছে। বাহ্যরূপের চেয়ে অন্তর্ভুক্ত অন্তর আর্তিই মেলোড্রামা না হয়ে মূর্ত মুহূর্ত হতে পেরেছে। কাজেই নাট্য বিষয়কে যথাযথ দৃশ্যমান করতে পারার ক্ষমতায় মালদহ থিয়েটার প্লাটফর্মের শুনো রে নন্দরাণী নাটক খুব পোক্ত একটি নির্মাণ হতে পেরেছে। উৎকট সংঘাতের একটা রাজনৈতিক কোন্দল কেন্দ্রিক চেনা গল্পের নাট্যায়নে আসর মাতিয়েছে। প্রেক্ষাগৃহে ভীড় করে আসা দর্শকদের আনন্দিত করেছে।
নাটকের প্রতিপাদ্য বক্তব্য শক্তিতে শুনো রে নন্দরাণী নাটক, সংসার সমাজে এবং রাজনৈতিক দলের আভ্যন্তরীণ ক্ষমতার অন্তর্গত এবং অন্তর্গূঢ় সংঘাত দেখিয়েছে। দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণে কাহিনি সফল। দুই অস্তিত্বের প্রতীকী ব্যাঞ্জনায়। রাজনীতিতে আর সংসারে। রাজনৈতিক মর্মে একের পর এক দৃশ্যের চলমানতায়, নাটক দেখিয়েছে ক্রম ধাবমান অনাচারে, রাজনৈতিক ক্ষমতার উত্থান-পতন আর নির্নিমেষ হত্যায় দলের নৈতিক প্রজ্ঞার স্খলন। আবার গল্প বৃত্তান্ত জানিয়েছে, কীভাবে এক অশিক্ষিত উদবাস্তু মহিলা কালক্রমে মহা ক্ষমতার অধীশ্বরী হতে পারে। রাজনৈতিক দলে এবং নিজের দখলে থাকা পরগাছা সংসারে। যে কর্তৃত্বে মহীয়সী হয়েছে, অন্য কোন পরাশ্রিত পরিবারে এবং চূড়ান্তে ভোট ও গদি সর্বস্ব রাজনৈতিক দলে। বর্তমান ও অতীতে রাজনীতিতে যা চলে আসছেই। তা খুব চেনা। সবাই জানেন। কেননা স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনৈতিক কোন্দল থেকে ক্ষয় নাশ উপেক্ষা করেই অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাবান দল নিজের শীর্ষ স্থানের বিচ্যুতি সইতে পারেনি। ভোট তার কাছে জনগণের স্বীকার। আর রাজনৈতিক দলে চলেছে সেই অহংকার। অবস্থাটা এমন, যেন দখল তার, জোর যার। এতে বাম ডান রাম মিলিতভাবেই ভোটের রাজনীতিতে উদ্ভ্রান্ত ছিল, আছে। সংসারের ঘেরাটোপেও ক্ষমার সক্ষম অধিকারের চলছে। যে কোন উপায়ে ক্ষমতা ধর হয়ে অন্যের ভাঙা ভিটেতে শেয়াল হয়ে ঢুকতে হবেই। এই মর্মেই ভোগ দখলের সুচতুর খেলায়, কেবলই লীলাময় রাজনৈতিক খেলা চলছে। জন সাধারণকে ছলনায় ফেলে তাই রাজনৈতিক নেতা, চেলা চামুন্ডাদের নিয়ে কেবলই ক্ষমতাকে পুজো করেই আসছে সংবিধানের সব বিধান। এই মর্মেই শুনো রে নন্দরাণী নাটক বুঝিয়েছে সত্যিই নেতা নেতৃরা (বাম ডান বা রাম) কেউ-ই মানুষের বন্ধু নয়। বন্ধু ছিল না। হতে পারেনি। এখানে আছে স্তাবকতার বুলির প্রলাপ। তাই রাজনীতিতে কিছু আলটপকা প্রগতিশীল বুলি আউড়ে অন্তে সবাই আত্ম স্বার্থ চরিতার্থ করে চলেছে। এটা হয়েই চলেছে। সাধারণ মানুষের মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে ব্যাপারটা। আর সেই তালে তালি বাজিয়ে মুনাফা বাজ সমাজ-সংস্কৃতি স্বার্থপরতা নির্ভর হয়ে দলবদল করেই ছোট বৃত্তের ক্ষমতায় পড়ে থাকা ক্ষুদ্রতরকে হাঙর-প্রতাপ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। এই ধরনের বক্তব্যই আছে, নাটকের গল্পের খাঁজ আর বাঁকে। দুর্নীতি গ্রস্থ একরাশ মানুষের আত্মকেন্দ্রিক চালচিত্রে চলচ্চিত্রের মত পরপর দৃশ্যে লাল সবুজ গেরুয়া রঙের ক্রমিক উত্থান খেলাই দেখা গেছে। তাই সময়ের ভাষায় শুনো রে নন্দরাণী অসাধারণ একটি নাটক। গঠন শৈলীতে অন্যন্য সাধারণ একটি টেক্সট। অনবদ্য যার মঞ্চ পরিকল্পিত রূপায়ণ পদ্ধতি। কিন্তু সংবিধানিক রাজনীতির বাইরে এই নাটকের আরেক স্বর আছে। যেখানে নন্দরাণী নিজের টিকে থাকার রাজনীতি চমৎকার ধরা পড়ে যায়। সেখানে সে নির্লজ্জ নিন্দাপঙ্কের মধ্যমণি।
কেননা এই গল্পে নন্দরাণী, নিজে জীবনের ছন্দে নন্দিত হতে গিয়ে, নিজের শরীরকে সুবলের কাছে বিক্রিত পণ্য করেই অন্য এক সুক্ষ্ম রাজনীতি চালায়। তা হলো সংসার রাজনীতি। সংসারের চার দেওয়ালে ঢাকা অন্ধকার গুহায়,সহায়তা প্রত্যাশার আকারে প্রকারে বিভৎস, তবুও সহায়ক এক মোহময় চারিত্রিক প্রকাশে নন্দরাণী এসেছে। নিজেকে সুরক্ষিত করতে। পেটের জন্যেই কীভাবে আত্ম বিলোপের ভিন্নতর পথে সে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পেরেছে। অন্য উত্থানে যা সমৃদ্ধি পেয়েছে। তাই, নাট্য সাহিত্যের সাম্প্রতিক অনেক চরিত্রের মধ্যে নন্দরাণী একেবারে অন্য আস্বাদের উপস্থিতি।
সুবলকে আনন্দিত করেই সে পথ খুঁজেছে নিজের খাদ্য বস্ত্র আর মাথার উপরের সুখের নিরাপত্তা-ছাদ। তাই ভিন দেশ থেকে এসে দখল করেছে নিজের সপক্ষে অর্জিত প্রতিষ্ঠার প্রতিটি ক্ষেত্র। কাজের মেয়ে হয়ে যে সুবলের ঘরে এসেছিল। সুবল বামপন্থী রাজনীতির পক্ষেই আমৃত্যু ছিল। সেই রাজনীতির পাঠ সে তার কাছেই শিখেছে। বস্তুত কাজের মেয়ে থেকে ছাত্রী, দেহসঙ্গীনী থেকে কমরেড বা সাথী—- এক রঙিন আসমানী কবুতর হয়ে ঢুকে ক্রমে সে সুবলের সংসারে আস্তানা গেড়েছে ছানাপোনা সহ। হায়না হয়ে নয়। মমতাময়ী মায়ের স্বত্ত্বায়। এখানে সে টেনে এনেছে, নিজের আগের পক্ষের মেয়ে বেলাকেও। সর্বক্ষণ মাতৃ বিদ্বেষী ছেলে কার্তিকও আছে তার সম্পর্কের গন্ডিতে। বলা যেতে পারে পরিস্থিতির শিকার হয়ে এক অসত জীবন বোধ নিয়েই বাঁচার জন্য ক্রমান্বয়ে সে সক্ষম এক মমতাময়ী নারী হয়েছে। ক্রমে সুবলকে জানিয়েই তৃণমূলে গিয়ে যোগ দিয়েছে। হয়েছে সর্বময় কর্তৃ, ভিন্ন পরিবারের চালনা শক্তি, তারই অন্তর তন্ত্রে-মন্ত্রের অন্যতম মানবিক শক্তিতে দাসে পরিণত হয়েছে এক গ্রামীণ পরিবার। বোঝাপড়ায় দিব্যি মাতৃত্ব দান করেছে, এ কুলে ও কুলে।
তা হয়েছে বলেই ভাবতে বাধ্য হই, জনগণের মধ্যেকার ভীড়ে তলিয়ে থাকা এক অর্ধ, কিম্বা অশিক্ষিতা এক নারীর এই জয়, কেবলই তার আত্ম প্রতিষ্ঠার পক্ষেই আলোকিত হচ্ছে। যা পরিণতিতে সুবলের সংসারের আপাত সুখ থেকে ক্রমে অসুখ হয়েও দুর্যোগ দেখা দিয়েছে। সবই যে রাজনৈতিক দাবার গুটির চালে। কিন্তু সে নিজের সামর্থ্য সম্পদকে এই সংসারের কল্যাণে যেন এক মুঠি ভিক্ষা, লক্ষ্মীর ভান্ডারের মত সামান্য ভিক্ষা দিয়েই সে পরিস্থিতি সামলে চলেছে। দিয়ে চলেছে পারিবারিক সুস্থ রাজনৈতিক ভাবাদর্শ যাপন মহার্ঘতা। আজকের রাজনীতির পরিস্কার চেহারার নন্দরাণী তাই দানেই উজ্জ্বল। চিরদিনই যে নিন্দনীয় অসুখে অসুখী রাজনৈতিক মহল। যে আত্ম আবিস্কারে উন্মত্ত রাজনৈতিক দরবার। নন্দরাণী সেভাবেই আবার অনৈতিক পথে স্বচ্ছন্দ। যেহেতু রাজনীতি সামগ্রিক মানুষের কল্যাণে নেই। অতএব, নন্দরাণী কোনভাবেই মানুষের জয়ের বিষয় হয়ে উঠতে পারে না। আর ওঠেনি বলেই নন্দরাণীকে মুখ মিষ্টি ক্যামোফ্লেজ বা ছদ্মবেশও মনে হয়। যদিও তাও নয়। তবে কী, কে সে? কেন সে কারোরই বন্ধু নয়? ভাবায় এ-সব এই নাটকের গল্প শক্তিতে। কোন যাদু বলে সে তবে এক অনিবার্য ভবিতব্য হয়েছে? নিজের সংসারে এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে? কি আছে এই সক্ষমতায়? প্রশ্ন ওঠে। কেননা সে যা করেছে বা করতে পেরেছে, আর পাঁচজন তা পারে না। এখানে কিছু দেওয়ারই রীতিতে কি ভিন্ন একটা নীতিমালা এসেছে? দেওয়াই যার শেষ কথা। অর্থাৎ কিনা দিয়ে তবে কিছু নাও। এই দেওয়াই একটা কিছু পাওয়ার কৌশলগত দাওয়াই যেন। দিতে নিতে গিয়ে যে পাল্লা মেপে চলতে হয়, বুদ্ধি কষে কাজ করতে হয়। তার অপরূপ ব্যখ্যান নন্দরাণী নিজে। তার অস্তিত্ব সংবাদ অশুদ্ধ পাঁকের পদ্ম বলেই, এমনভাবে অসহায় এক দাম্পত্য জীবনের অন্তর দ্বন্দ্বে সূচ হয়ে ঢুকে, সে ফাল হয়ে বেড়িয়েছে। অবশ্যই হৃদয়হীন সে নয়। মন বলে সুন্দর এক অন্তর অন্তত তার ছিল। তাই সুবলের বাড়িতে সাম্রাজ্য গড়ে, নারী সান্নিধ্য কামুনায় দুর্বল, কিন্তু অঞ্চলের বরেণ্য নেতা সুবলের স্নিগ্ধ অন্তর নিংড়েই, সে অবস্থার প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। সে জানে, মহৎ উদ্দেশ্যে বিনিময়ে প্রাপ্তি সুযোগ দিয়ে পরবর্তীতে কীভাবে কুড়িয়ে নিতে হয়।
যখন চারিদিকে গড়পড়তা জীবন শুধুই দিতে দিতেই বঞ্চিত হয়ে যায়। কম বেশি সকলকেই প্রতারিত হতে হয়। সবাইকে হেরে ভুত হতে হয়। তার মধ্যেই নন্দরাণী খুবই পটু খেলোয়াড়। সুবল মন্ডলের সর্বাঙ্গীণ বন্ধু সে। সুবলের বিপন্নতার বিশেষ সাথী। সংসারে যেমন তেমনই পার্টিতে। যার বিবৃতিতে পাশেপাশে চলেছে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। চল্লিশ বছরের রাজনৈতিক চেহারা দর্শিয়ে যা ইতিহাস হয়ে আছে। সেখানে সিপিএম তৃণমূল একই কথা। সংসদীয় গণতন্ত্রের মারপ্যাচে সবাই অভিন্ন। তাই, এ এমন এক যুগ, যেখানে কিছু দেয় দিয়ে, পরে কায়দা করে আবার দামী অবস্থান আদায় করে নিতেও হয়। নাটকে রাজনীতির চরিত্র তাই বলে।এখানেই নিজের মর্যাদার অধিকার কি করে কায়েমি স্বার্থে ফলবতী গাছ হতে পারে। তা আছে। এসব তো যুগের চলন থেকেই শিখতে হবে। নন্দরাণীতে সেই চলমান যুগ ধর্মের পাঠমালা আছে। শুনো রে নন্দরাণী তে সেই শোনার কথাও আছে। যেখানে চাপিয়ে দেওয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবী দশায় চলেছে স্বার্থ ভিত্তিক দেয়া নেয়ার নিরন্তর পরম্পরা। এ নাটকে সবই স্বার্থের জন্যে দুরন্ত গতিতে চলন্ত তাই। ক্ষয় নাশ, উল্লাস, কান্না সবই পরিস্থিতির যান্ত্রিকতায় ধাবমান সুচতুর এক প্রকৃয়া মাত্র।
সবাই জানি, আদিম যুগ থেকেই মানুষ নিজের প্রতিষ্ঠাকে একমাত্র বলে ভেবেছে। তাই যে শুধুমাত্র অন্নদাস। যে অর্ডার পালন করবে। সে কি করে আদেশের আদর্শিক পথে যায়। ভাবনার তরঙ্গ সেখানেই পাক খাচ্ছে। নাহলে একটি চরম তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভরা জীবন পর্যায় টপকে কীভাবে নন্দরাণী প্রকৃত প্রাপ্তি পথে অগ্রসর হতে চায় এবং পেরেও ওঠে। হতে পারে কি? এতই কি সহজ? না, কঠিন। কঠিন চারিত্রিক বিশেষত্বে মানুষের এই অসম্ভব হয়ে ওঠাই জ্যান্ত নাটকের স্বর। কারণ নন্দরাণী শুধু ক্ষমতার দাসত্ব করতে মরিয়া লড়াই চালায়। অন্ততঃ শুনো রে নন্দরাণী নাটক তাই-ই শেখালো। কারণ বহু মুহুর্তের অভিব্যক্তিতেই নন্দরাণীর স্থীর প্রজ্ঞায় হাহাকার হীন, (সুবল ও কার্তিকের মৃত্যু) দু দুটি জীবন ক্ষয় সয়েই রাজনীতিতে জয়ের জন্যেই দাঁড়িয়ে কত গাঢ় হতে পারে, তাও দেখা গেলো। সবই করেছে সে তার ইন্সটিন্ক্ট চরিত্রের স্বাভাবিক দাবিতে। এ হেন নন্দরাণীর পুরো পরিবার দখল করার নিচু স্বরের তীব্র আবেদন ভোটের জন্যেই প্রতীকী লাগে। তাই একটা উটকো জঞ্জাল কাজের মেয়ে হয়ে এসে, নিপুন বোঝাপড়ায় একসময় পুরো পরিবার, একটা দলবদ্ধ গোষ্ঠীর প্রশান্ত প্রশংসা সে কেড়ে নেয়, নিতে পারে। তাও জানায় এই নাটক। যেখানে অহরহ চলছে কব্জির লড়াই। মৃত্যু হত্যা আর লুটপাট।
শুনো রে নন্দরাণী নাটক তাই এক ত্রিমাত্রিক টেক্সট। সবই ঘটছে যুক্তিযুক্ত পথে, চমৎকার ভাবে, যেমন রিয়েলস্টিক, তেমনই আবার প্রতীকী ব্যঞ্জনায়। শৈলজার কোলে আদর খায় স্বামীর অবৈধ সন্তান। শৈলজা জানে তার স্বামী কাজের মেয়ে নন্দরাণীর সাথে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত। আর তাই শৈলজা-সুবল সংসার বৃত্তে অনায়াসে আটকে পড়ে নন্দরাণী নন্দিনী মুর্তিতে। সে তিল তিল করে অর্জিত জীবন গল্পের সার দেওয়া নেওয়ার কথা বলেছে। শীর্ষ নেতৃত্ব রাজনীতিতে সে যে, এমন বুদ্ধিমান হবে, এ কী কেউ কখনো ভেবেছে? নাহলে একজন কাজের মেয়ে গৃহকর্তাকে দৈহিক সুখ দিয়ে নিজেও আয়েস পেয়ে মদমত্ত হাতির মতো কত অনায়াসে তিল থেকে তাল হয়ে যায়? যাকে ঘরের পক্ষাঘাত গ্রস্ত বউ নির্বিদ্বিধায় মেনে নেয়? মেনে নেয় অকপটে, সহ্য করে স্বামীর সেই গোপন লীলাময় ব্যভিচার? এমন ঘটনা কী অসাধারণ এক লুট নয়? তবে তো মানতেই হয় নন্দরাণী ডেঞ্জারাস চরিত্র। তবেই তো সে তিল থেকে তিলোত্তমা হয়ে একটা কলুষিত রাজনৈতিক বাতাবরণে সপ্রতিভ শক্তি হতে পারে। আবার সংসারের কর্ত্রীর বিরুদ্ধে বরণীয় সতীন। সে নিজের সন্তানকে লক্ষ্মীর ভান্ডারের ভিক্ষা স্বরূপ শৈলজার কোলে দিয়ে আদরণীয় প্রতিপক্ষকে বশ করে না কী? সিপিএম তৃণমূল বা বিজেপির গোপন আঁতাত বলতে এছাড়া আমরা আর কি বুঝি? বামফ্রন্টে সাত দলের মধ্যে আর আস পি, ফরোয়ার্ড ব্লক, ইত্যাদিদের সামান্য মন্ত্রীত্ব দানের এই জাতীয় ভিক্ষা দিয়েই তো বাম বিরুদ্ধ ক্ষোভকে ম্যানেজ করা হতো। শুনো রে নন্দরাণী নাটক দেখে মনে আসে না এইসব ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক দুর্গতির সরাসরি চালচিত্র?
এ-সব সুক্ষ বিচার করেই নিশ্চিতই মালদহ থিয়েটার প্লাটফর্ম এই নাটক কে মঞ্চে এনেছে। সফল সম্ভাবনা সূচীতও করেছে। প্রযোজনা আগামী ঘষামাজার চলনে, আলাপে আলোচনায় আরো ধারালো হবে। সুচারু হবে। আশা তাই, আগামীতে আমার মতো চোখে দেখেই মনে চলে আসবে সার্বিক নাট্য উপলব্ধির সংসার বিজড়িত রাজনীতির শব্দ ধ্বনি। কেননা নাটকের সব পরত ও তরঙ্গগুলি খুবই সংযত ও নান্দনিক করে গড়েছেন নির্দেশক সুব্রত পাল। মননশীল একটি প্রযোজনা। যার মঞ্চ ভাবনায় আছেন নীল কৌশিক। যে মঞ্চের অপরূপ ভাবাশ্রয়ী চেহারা নির্মাণ করেছেন অরিজিৎ দাস ও সুরজিৎ হালদার। রঙ তুলির অঙ্গ-রূপ-সজ্জায় কলকাতার বিধাতৃ দেব সরকার যুক্ত হয়েছেন। আলোর দ্যোতনায় বিবিধ মাত্রা যুক্ত করেছেন সাধন পারুই। আবহে নাটকের টেম্পোকে ধরেছেন সার্থক সেন ও সুব্রত পালের একান্তের চিন্তায়। চারিত্রিক বিভিন্ন বিক্ষেপে সফল পোশাক চয়নে আছেন কৌশল গোস্বামী। বাদ বাকি মঞ্চ সামগ্রীতে পৌলমী প্রামাণিক ও সঞ্চিতা রায় গোস্বামী। এদিন আবহ প্রক্ষেপণ করেছেন অর্কসমা প্রামাণিক। মোটামুটি আঙ্গিক গত পরিশ্রমে শুনো রে নন্দরাণী নাটকে এঁদের সবারই একত্রিত অবদান আছে। নাটক এবং চালনায় নজরে পড়েছে সকলের হয়ে ওঠার সংকল্পে গড়ে তোলা অভিনয় প্রসঙ্গটি।
সাফল্য অনেকটাই শান্তনু মজুমদারের। কিন্তু কে এই শান্তনু মজুমদার? আমি ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে ওনাকে জানি। প্রতিযোগিতা মঞ্চেই ওনার লেখা নাটকের জয়জয়কার দেখেছি। জীবনের প্রথম নাটক লিখেই যিনি চমকে দিয়েছিলেন। মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক চেতনায় উনি হাতে কলমে পাঠ নেওয়া একজন মানুষ। যিনি রাজনীতির বাইরে গিয়ে খুঁজেছেন মানুষের বোবাকান্নার স্বর-তরঙ্গ। সত্যি মিথ্যে জীবন গতিপথের মোচড়ে মুচড়ে পড়া মানুষের হাল হকিকত, তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। উপলব্ধি করেছেন। একজন মঞ্চ শিল্পীর দায় থেকেই নাটকের পাগলামি। রিয়েলিটি বা ম্যাজিক রিয়েলিটি নাটকে এসেছে গড়গড়িয়ে ঝরঝরে সংলাপ মুখে দেওয়া চরিত্র মহিমায়। কিন্তু কোনভাবেই প্রথাগত প্রতিবাদ করা মঞ্চ দিখাওয়া সর্বস্য নাটক তিনি লেখেন নি। ওনার নাটকে চরিত্রের ব্যঞ্জনার স্তর ভেদ থাকে। উত্তরণ আসে ঘটনার ভেতরের অন্তর আর্তনাদে। উনি এমন এক নাট্যকার, যাঁর মনে অদ্ভুত এক সাহিত্য বোধ আছে। তার অতলে তলিয়ে আছে আবার বিচিত্র জীবন বোধ। তাই নাটকে বর্ণিত চরিত্রগুলো এমন মানুষ,.. যার জন্ম হয় নাট্যকারের নিজের মনের অলিন্দে। কিন্তু অন্ধকারে পথ হাতড়াতে গিয়ে কার্যকারণ সূত্রে উঠে আসে রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি। এর মধ্যেই সে সব মানুষের চরিত্রের ত্রিমাত্রিক বিশ্লেষণ থাকে সময়ের জেহাদি সংবাদে। দেখা যায় মানুষের হয়ে ওঠার আর বেঁচে থাকার মরিয়া চেষ্টা। সবই কাল্পনিক। কিন্তু কল্পনার আলপনা আমাদের সবার পাশের উঠোনে আঁকা থাকে। শুনো রে নন্দরাণী নাটকের সব চরিত্রই তাই খুব চেনা। এরা ইতিহাস থেকে ঝরে পড়েছে, একটা সহজ সরল গল্পের আদলে।
নাটকের প্রয়োগে কিছু বাড়তি চাওয়া আছে। যা প্রযুক্ত হয় নি। উদ্ভাবনের পথও ভেবে ওঠা যায় নি। তবে কাঙ্ক্ষিত। এই মর্মে দুটি বাইক দুর্ঘটনাকে আলাদা করতে হতে পারে। শব্দ আলোর বিচিত্র বিভৎসতা মঞ্চ টিকে টালমাটাল করলেই বা মন্দ কি। স্ট্রাকচার ভেঙে পড়লে আরো ভাল হয়। প্রতিটি দৃশ্যের শুরুতেই আরো ভিন্ন বৈচিত্র্য সংযুক্ত হতে পারে। অভিনয়েও কিছু দূর্বলতা দেখেছি। মহলাই যার উদ্ধার প্রকৃয়ায় সামর্থ্যের হাতিয়ার। নাটকের শেষে সুবল আর কার্ত্তিকের মৃত্যু দুটি স্বতন্ত্রতা পায় নি। পাওয়া দরকার ছিল। নাটকের একটি পর্ব এডিট হয়ে গোলমালের সৃষ্টি লরেছে নাকি তলিয়ে দেখা দরকার। নন্দরাণীর দুই শোকের দুটি তরঙ্গ দেখার ইচ্ছা হয়। শৈলজা চরিত্রে অসুখ ও সুখের প্রকাশ দৃশ্যগত ভাবে পেছনে থাকায় পরিস্কার ধরা যায় না। রত্নাশ্রী দেবের পোশাকের রঙ কিম্বা গড়নের আকার তার পঙ্গুত্বের অন্তরায় হচ্ছে হয়তো। অভিনয়ে আরো জটিলতার দ্যোতনা দরকার আছে। একই কথা মণি কমরেড চরিত্রের সঞ্জীব দাস সম্পর্কে বলা যেতে পারে। কূটনৈতিক এই চরিত্রের ওজন অন্য সাধারণের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। জোরালো ব্যক্তিত্বের চরিত্র এটি। বি এস এফ কর্ণেল রঞ্জন কুমার গুপ্তের প্রতিহিংসায় সম্রাট বন্দোপাধ্যায়ের মজবুত প্রাণশক্তি যুক্ত হলে ভাল মুহুর্তের মধ্যে যাবে নাটকের আরেক স্বর। তার হিংস্রতম রুচি প্রকাশে সম্রাট বন্দোপাধ্যায়ের উত্তপ্ত পরিস্থিতি, মণি কমরেডের চক্রান্তে জোড়ালো হবেই। আর সেটা হলেই নাট্যের পরিণতি চমৎকার পথ পাবে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে নন্দরাণী চরিত্রে মাসুমা পারভিনের সার্বিক অভিনয়। তিনি এই নাটকের মস্ত শক্তি বটেই। মালদহের ভিন্ন নাট্য প্রতিভা আবিস্কার। বিভিন্ন মুডের বিবিধ স্বরক্ষেপনের চমৎকার মাত্রার তিনি অভিনন্দিত একটি চরিত্রায়নের সাক্ষর রাখলেন। পাশাপাশি নেতা সুবল মন্ডলের ভূমকায় সুব্রত পালও এই নাটকের শ্রেষ্ঠ ডান হাত। তাই বলে অন্য কেউই মন্দ নন। সবাই সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ চরিত্রে দায়িত্বশীল ভাবেই মঞ্চে এসেছেন। তাই সকলের গ্রুপ এ্যাক্টিং সুন্দর। চরিত্রের পারস্পরিক সমঝোতায় উল্লেখযোগ্য হয়েছে নাটক।
তবে মূল নাটকের টেক্সট ঠিকঠাক লেখা হলেও, নন্দরাণী আর সুবলের পর্ব কিছুটা বেশি মনে হয়। রাজনৈতিক চাপান উতরের সিপিএম তৃণমূল কন্দোল ভাগে কম পড়েছে। বিজেপির গৈরিক মেরুকরণের মেরুদন্ডটি জিজ্ঞাসা হয়েই থেকেছে।। বামপন্থীদের নৈরাজ্য দেখাবার পর্বে নন্দরাণীর গল্প এসে রাজনৈতিক কূটনৈতিক ও কপটীয় বঞ্চনা কম এসেছে। তখনকার ক্ষমতায় থাকা ধরাকে সরা জ্ঞান করা সিপিএম কমরেডদের দুর্দান্ত প্রতাপ, প্রতারণা, দুর্বলের উপর অন্যায় অত্যাচার করার অপচেষ্টা, আমি চাকরি জীবনে খুব কাছ থেকে দেখেছি। ভোটের রাজনীতিতে ভুঁইফোর মস্তানী আগ্রাসন আমার জীবন অভিজ্ঞতায় সংগ্রীহিত আছে। কেননা প্রায় বোবা করে ছায়া যুদ্ধের সংগ্রামের অবতারণা ছিল তথাকথিত ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে। সেই আছিলায় লুটতরাজে ভোট পেয়ে জেতাও দেখেছিলাম। এই পরিবর্তন কীভাবে কি হলো, কেন হলো সে সব অনেক এই অতিবাম, অ-বাম, প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক উল্লাসের উল্ফনই তার জন্য দায়ী। সেখানে তখন ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের আভ্যন্তরীণ গোপন কোন্দল এবং লুকানো সমঝোতা আমি দেখেছি। যারা সবাই নেতা, কিন্তু চাকরিতে কাম্য ডিউটি করতেন না অনেকেই। বেতন নিতেন গুনে গুনে। ঘটনার সেই বৃত্তে এই শুনো রে নন্দরাণী নাটকই ছিল। যার মূল কথা ক্ষমতার হস্তান্তর এবং ক্ষমতায় বলীয়ান হওয়ার কৌশল রপ্ত করার পন্থার খোঁজ। নন্দরাণীর মতোই। এই নারী চরিত্রটি মার্ক্সবাদ পড়েনি। তখনকার কমরেড ক’জন পড়েছিলেন? নন্দরাণীর সবই দেখে শেখা মাত্র। সে দেখেছে পরাজয়ের বিভিন্ন স্তর। দেশ ভাগের জ্বালা-দুঃখ নিয়ে তবুও সে কাঁদে না। সে জীবনকে মাতৃত্ব আর পুরুষের ভোগে বিলিয়েই মনুষ্যত্ব বিকাশের সুযোগ্যা করে আপন সজাগ সিদ্ধান্তে নিজেকে এই কলুষিত পথে টেনে এনেছে। সে জানে পেটের অবৈধ সন্তানকে শৈলজার রক্ষণাবেক্ষণের কেন্দ্রে এনেই, একসময় পুরো পরিবার সহ অঞ্চলের রাজনীতিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে প্রতিক্রিয়ায় মগ্ন হতে পারা যাবে। অনৈতিক অন্তর দ্বন্দ্বের সেই আলোকেই আলোকিত পাপে কমিউনিজমের প্রসারিত পথ সেদিন অবরুদ্ধ হয়েছিল। সব দেখাল, এই নাটক। তাই আমি আমার তরফ থেকে মালদহ থিয়েটার প্লাটফর্ম দলকে এমন উপস্থাপনা করার জন্যে অভিনন্দন জানাচ্ছি। জয় হোক নাটকের।