Tuesday, July 8, 2025
Tuesday, July 8, 2025
Homeসিনেমামূল ধারার বাংলা সিনেমা ও তরুণ মজুমদার

মূল ধারার বাংলা সিনেমা ও তরুণ মজুমদার

সুব্রত রায়

মূল ধারার বাংলা সিনেমাকে যাঁরা সর্বতো ভাবে পুস্ট করেছিলেন তরুণ মজুমদার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তরুণ মজুমদার তেমনই এক যোদ্ধা। তাঁর সিনেমায় আবেগের আতিশয্যই তাঁর সবচেয়ে বড়ো পরিচিতি। যে আবেগের কাছে শিল্পীর সংযম ভেঙে যায়। ফিরে আসি ‘পথভোলা’ সিনেমাটির কথায়। রবি, সুমন, গুপি কীভাবে সেই পাথুরে গ্রামে গিয়ে পৌঁছাল, তার ব্যাখ্যা না-হয় চাইলাম না। কিন্তু তারপরেও বলতেই হয়, শুধু গায়ের এবং মনের জোরেই তো পাথুরে মাটিতে ধান ফলানো যায় না। যায়, যদি এই কাহিনি এক রূপকথার কাহিনি হয়। আসলে যুক্তি এমনই এক জিনিস, যার পিছনে প্রশ্ন থাকাটা খুব প্রয়োজন। সূর্যের আপাত বার্ষিক গতির কারণ সম্বন্ধে প্রশ্ন না জাগলে কোনোদিন জানাই যেত না যে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। কিন্তু ‘শহর থেকে দূরে, বহুদূরে’ যে দর্শকরা তরুণ মজুমদারের সিনেমার জন্য অপেক্ষা করে থাকছিলেন, তাঁরা কি এইসব প্রশ্নে কাহিনিকে জর্জরিত করতে চাইছিলেন? নাকি বদলে যাওয়া সময়ের সামনে দাঁড়িয়ে একটু আশায় বুক বাঁধতে চাইছিলেন?

সেই সময়ের বাস্তবতাকে আজ খুঁজতে গেলে একটু থমকে যেতেই হয়। কারণ সে এক যুগসন্ধিক্ষণ। আজকের তরুণ প্রজন্মের পর্দার নায়ক যদি তাঁর নতুন প্রেমিকাকে বলেন, “আপনাকে দেখলে আমার খিদে পায়”, তাহলে শহর-মফস্বল-গ্রাম নির্বিশেষে প্রতিটি দর্শকের হাসি পাবে সন্দেহ নেই। অথবা এক মুদি দোকানদার যদি বলেন, “গীতায় বলেছে পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”! এগুলো কোনোটাই হয়তো ঠিক ব্যক্তি তরুণ মজুমদারের কথা নয়। এ এক সময়ের কথা। এক নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে একটি সমাজের কাতর আর্তনাদ। সে যুগের অবসান ঘটেছে। যুগান্তে বিদায় নিলেন তরুণ মজুমদারও। তরুণ মজুমদারের সিনেমার নায়কদের মতো সেই নির্মল হাসি, আজ আশেপাশে একটি ছেলের মুখেও নেই। একটি মেয়েও আর সরল প্রেমের টানে মুখ নামিয়ে নিতে পারে না। একটা গোটা প্রজন্ম হতাশায়, রিক্ততায় মুঠো শক্ত করে নিয়েছে। শুধু ‘কাঁচের স্বর্গ’-র সঞ্জয় চৌধুরী বোধহয় এখনও প্রাসঙ্গিক। যারা আঙুল উঁচু করে শুধু বলে যেতে চায় – আমার এই পরিণতির জন্য এরা সবাই দায়ী। যারা ভিতরে ভিতরে চরম অপরাধী হয়ে উঠতে চায়। তবু অপরাধ করে ফেলতে পারে না, কারণ তারা তো আরও অন্য অন্য সঞ্জয় চৌধুরীদের বাঁচাতেও চায়।

এই গল্প কিন্তু প্রান্তিক মানুষের নয়, সেও এক মধ্যবিত্ত জীবনের গল্প। আজকের মধ্যবিত্ত যাপনের মতোই তার ভিতরেও ঘুণপোকার অভাব ছিল না। পিতৃতন্ত্রের নির্লজ্জতাও ছিল। আবার প্রেমের ফল্গুধারাও ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চার পশ্চাদপদতাও ছিল। আবার মানবিকতার দুর্বার জেদও ছিল। শুধু সেই জীবনের সঙ্গে আজকের মধ্যবিত্ত জীবনের একটাই পার্থক্য। সেদিনের সেই জীবন ছিল কয়েকশো বছরের বিবর্তনের ভিতর দিয়ে বেড়ে ওঠা একটা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর জীবন। আর আজকের এই মধ্যবিত্ত জীবনের ভিতরে আছে শুধু যান্ত্রিকতার ক্লেদ। অবসাদ। তবু এর মধ্যেও মানুষেরই বাস, মানুষেরই বেঁচে থাকা। এই ক্লেদ যেমন শেষ সত্য নয়, তেমনই এই জীবন মহানও নয়। এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই মানুষের বেঁচে থাকা। ভাবতে অবাক লাগে, তরুণ মজুমদার কিন্তু কোনোকিছুকে আড়াল করেননি। আবার পশ্চাদপদতাকে মহান করেও তোলেননি।

‘ভালবাসা ভালবাসা’ ছবিটির কথাই ধরা যাক। স্বনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী প্রতিমা দেবী মৃত্যুশয্যায় অপেক্ষা করছেন তাঁর প্রতারক স্বামীর জন্য। পিতৃতন্ত্রের এর চেয়ে নির্লজ্জ প্রকাশ আর কীই বা হতে পারে? তবু তো সেটা এক সামাজিক সত্য। তাকে আড়াল করলে সময়ের সঙ্গে মিথ্যাচার করা হয়। আবার সিনেমার কাহিনিতে এ-অপেক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটু উপাদান হওয়া সত্ত্বেও তাকে খুব বেশি জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়নি। কারণ অপেক্ষা কোনো মহান মানবিক অনুভূতি নয়। তা সামাজিক সত্যমাত্র। যে সময়ে তরুণ মজুমদার শিল্পীর সংযম হারিয়ে আবেগকেই সিনেমার মূল উপাদান করে তুলছেন, তখনও কিন্তু এইসব খুঁটিনাটি বিষয় তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে না।

সিনেমা জীবনের প্রথম অধ্যায়ে যেমন বহু ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রের জন্ম দিয়েছেন তরুণ মজুমদার, তেমনই আবেগের আতিশয্যে তাঁর শেষদিকের সিনেমা ভেসে গিয়েছে। বক্স অফিসে একসময় যে তরুণ মজুমদার নামটাই শেষ কথা ছিল, তাঁর সিনেমাও শেষদিকে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তবু এইসব সাফল্য ও ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে তিনি আসলে এক ইতিহাসের দলিল তৈরি করে গিয়েছেন। সেটাই হয়তো তাঁর সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব। তিনি কয়েকশো বছরের বিবর্তনের ভিতর দিয়ে বেড়ে ওঠা এক সমাজের মৃত্যুকালীন আর্তনাদ শুনিয়েছেন। তারপর উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া এক যান্ত্রিক সমাজ এসে সমস্ত প্রাণশক্তি শুষে নিয়েছে। তাকে বাঁচানো যায়নি, অথবা বাঁচাতে চাওয়া হয়নি। তবে এর মধ্যেও এক রাজনীতিরই নির্মাণ এবং পরিণতি দেখিয়ে গিয়েছেন তিনি। সময় ফুরিয়ে যায় এভাবেই। শুধু কিছু কথা পড়ে থাকে। কিছু কথা বলা হয়ে যায়। কিছু কথা হয়তো কোনোদিনই বলা হবে না। কারণ সব কথা বলা হয়ে গেলে এই পৃথিবীতে আর কিছুই শোনা যাবে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular