সুব্রত কাঞ্জিলাল
ধারাবাহিক- পর্ব- ২
তাঁর শিল্পে বারে বারে রিজেনারেশন তত্ত্ব উঠে এসেছে। জীবন থেমে থাকে না। বহতা নদীর মত জীবনের গতি সামনের দিকে। সুবর্ণরেখা ছবিতে আমরা দেখতে পাই মামার হাত ধরে নায়কের সন্তান মায়ের কাছে গল্পে শোনা নতুন বাসার দিকে এগিয়ে চলেছে। তিতাস একটি নদীর নাম ছবির শেষ দৃশ্যেও একটি শিশু তিতাসের চর দিয়ে ভেঁপু বাজাতে বাজাতে এগিয়ে চলেছে। মেঘে ঢাকা তারা ছবিতেও দেখা যায় নায়িকা নীতার মৃত্যুর পরেও নবজীবন কলোনিতে আরো একটি লড়াকু মেয়ে জীবন যুদ্ধে এগিয়ে চলেছে। তিনি বলতেন নীতার মৃত্যু আছে।
কিন্তু নীতাদের মৃত্যু নেই। গণনাট্য সংঘের মঞ্চে নাটক করতে গিয়ে তিনি হাজার হাজার দর্শকের সম্মুখীন হয়েছিলেন। দলের মধ্যে বিরোধ বিসংবাদ অসুস্থ মানসিকতা তাকে আহত করেছিল। এই বিষয়টা নিয়ে অনেক পরে তিনি কোমল গান্ধার ছবি করেছিলেন। ছবিটা গণনাট্যের বন্ধুদের ভালো লাগে নি। আজ বুঝতে পারা যায় গণনাট্য কিংবা গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের ভেতরের অসংগতি, নীতিহীনতা, ক্ষমতা দখলের অসুস্থ প্রবণতা কতটা মারাত্মক হতে পারে। তবে এই ছবিতেও কিন্তু তিনি মিলনের গান গেয়েছেন। বঙ্গভঙ্গের যন্ত্রণার হাহাকার বুকের মধ্যে ধারণ করবার পরেও নায়ক ভৃগু নায়িকা উমার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল নতুন জীবনের আস্বাদ। তার ছবিতে গ্রীক ট্রাজেডি এসেছে অপটিমিস্ট ট্রাজেডি হয়ে।
তার মনে হয়েছিল তিনি কিছু বলতে চান। যা থিয়েটারের মধ্যে আটকে থেকে সব সময় বলা যাবে না। আরো অনেক উন্নত শিল্প মাধ্যম দরকার। অনেক বেশি দর্শকের মুখোমুখি হওয়া দরকার। এই মনে হওয়া থেকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের অনেক বড় বড় পরিচালকের আবির্ভাব ঘটেছে। এখানে অন্যায় কোথায়? ভুল কোথায়? তিনিও থিয়েটার থেকে চলে এলেন সিনেমা শিল্প নিয়ে কাজ করতে। প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক বিমল রায় ছিলেন তাদের পারিবারিক বন্ধু। ঋত্বিক বাবুর এক দাদা বিমল রায়ের সঙ্গে কাজ করতেন। এই বিমল রায়ের সাহচার্য্যে এসে তিনি বুঝতে পারলেন সিনেমার অসীম ক্ষমতার রহস্য।
চল্লিশের দশকে হাজরার মোড়ে ছিল একটি চায়ের দোকান নাম প্যারাডাইস কাফে। সেখানে তরুণ সলিল চৌধুরী, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, ঋষিকেশ মুখার্জী, এইসব গণনাট্যের শিল্পীরা একদিকে যেমন ভারতে রাজনৈতিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন, অন্যদিকে বিশ্ব চলচ্চিত্র নিয়ে নিয়মিত আড্ডা হতো। এবং সিনেমা নিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও আলোচনা হতো। ঋষিকেশ সুখার্জি বিমল রায়ের সঙ্গে বম্বে চলে গিয়েছিলেন সিনেমার সম্পাদনার কাজ নিয়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই বিমলদার কাছ থেকে যেমন সলিল চৌধুরী আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন, ঋত্বিক ঘটকও একই ভাবে ডাক পেয়ে বোম্বে চলে গেলেন। শশধর মুখার্জি তখন বোম্বেতে নামকরা প্রোডিউসার ছিলেন। তিনি একটি কোম্পানি তৈরি করেছিলেন। সেই কোম্পানির নাম ছিল ফিল্মালয়। অশোক কুমার ছিলেন শশধর বাবুর শ্যালক। ঋত্বিক ঘটক ঐ কোম্পানিতে গল্প লেখা এবং চিত্রনাট্য লেখার ডিপার্টমেন্টে ঢুকে পড়লেন। নির্মিত হলেও মধুমতি ছায়াছবি। এই ছবির পরিচালক ছিলেন বিমল রায়। সংগীত পরিচালক ছিলেন সলিল চৌধুরী।
ওই একই সময় ওই একই কোম্পানি থেকে আরেকটি ছবি নাগিন তৈরি হয়েছিল। এই ছবির গল্পকার এবং চিত্রনাট্যকার ছিলেন নবান্ন নাটকের সেই প্রখ্যাত বিজন ভট্টাচার্য। হেমন্ত মুখার্জী ছিলেন সংগীত পরিচালক। বোম্বের সেই চাকরি ঋত্বিক বাবুর ভালো লাগছিল না। তিনি তার নিজের মতো করে যেসব গল্প লিখছিলেন সেই সব গল্প মালিকের পছন্দ হচ্ছিল না । বাণিজ্যিক সিনেমার জন্য যে ধরনের গল্প প্রয়োজন হয় শশধর বাবু, সেই সব গল্প লিখতে বলছিলেন। ঋত্বিকের ভেতরে তার শিল্পী সত্তা প্রতিবাদী হয়ে উঠছিল। তিনি তো বাণিজ্যিক সিনেমার গল্প লেখবার জন্য জন্ম নেন নি। তিনি যে গল্প লিখতে চান, যে ছবি সৃষ্টি করতে চান সে সব তো বাণিজ্য নগরী বোম্বেতে বসে হবে না।
এই ধারণা বদ্ধমূল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বম্বে পরিত্যাগ করে চলে এলেন। এরপরেও তিনি আরো অনেকবার বোম্বে থেকে ডাক পেয়েছিলেন। যেমন তার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ঋষিকেশ মুখার্জি তাকে বহুবার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অন্যদিকে আরো অনেক প্রযোজক পরিচালক এবং রাজেশ খান্নার মত অভিনেতা ও ঋত্বিক ঘটককে দিয়ে সিনেমা করবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কোনটাই শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারে নি। বম্বে থেকে ফিরে এসে তিনি নিজে স্বাধীনভাবে সিনেমা তৈরি করবার উদ্যোগ নিলেন। কোঅপারেটিভ সিস্টেমে নাগরিক ছবির শুটিং শুরু হল। গল্প চিত্রনাট্য এবং পরিচালনার ভার তিনি নিজে নিলেন। এই ছবিটির সঙ্গে যুক্ত কেউ পারিশ্রমিক নেন নি। এই ছবিতে যারা কাজ করেছেন তাদের বেশিরভাগ বামপন্থী মানসিকতার লোক।
গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছবির শুটিং শেষ হল। সম্পাদনার কাজটাও শেষ হলো। তবে কিভাবে ছবি সিনেমা হলে দেখানো যায় সেটা নিয়ে সমস্যায় পড়ে যাওয়া হলো। ওখানে যে রয়েছে প্রদর্শকদের এবং পরিবেশকদের অশুভ আতাত। ওদের ডিঙিয়ে কোনভাবে মানুষের কাছে ছবিকে পৌঁছে দেওয়া যাবে না। এদিকে ঋত্বিক বাবু যে ছবি বানিয়েছেন সেই ছবিতে না আছে কোন নাচ গান। না আছে সুদর্শন নায়ক নায়িকা। স্টার কাস্টও নেই। দর্শক কেন আসবে টিকিট কেটে সিনেমা হলে?
এই প্রশ্ন ছিল পরিবেশকদের। এসবের মধ্যেও একজন পরিবেশক জুটে গেল। ঋত্বিক বাবুরা তো মহা খুশি। আনন্দে আত্মহারা। এইবার তাদের ছবি বিভিন্ন হলে মুক্তি পাবে। কিন্তু সিনেমা হলে ছবির মুক্তি পেতে গেলে ছবির প্রডিউসারকে প্রচুর টাকা খরচা করতে হয়। ছবির পরিবেশকরা প্রচুর টাকা নিয়ে থাকে।। অত টাকা কোথায় পাওয়া যাবে? কে দেবে সেই টাকা? কাবলিওয়ালার কাছ থেকে ধার দেনা করেও তো অত টাকা জোগাড় করা যাবে না। অন্যদিকে যদি বা চড়া সুদে ধার পাওয়া যায়, সেই টাকা শোধ করা হবে কিভাবে? কারণ এই নাগরিক ছবিটা তো আর পাঁচটা হুল্লোর বাজি ছবি নয়। যে লোকটা এই ছবির প্রিন্টগুলো নিয়ে নিয়েছিল, আর ভরসা দিয়েছিল যে সময় সুযোগ করে নাগরিক মানুষের জন্য মুক্তি পাবে।
সেই দুর্লভ সময়ের আর খোঁজ পাওয়া গেল না। ছবির প্রিন্টগুলো পরিবেশক নামের অসাধারণ লোকটার শোয়ার ঘরের খাটের নিচে পড়ে রইলো। জীবিত কালে ঘটক বাবু, তার প্রথম ছবির মুক্তি দেখতে পারলেন না। একজন শিল্পীর জীবনে এটা যে কত বড় আঘাত তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। আজকের দিনে হৃদয়হীন, চাটুকার মনবৃত্তির, রাজনৈতিক বেশ্যাগিরীতে অভ্যস্তরা এই কারণেই ঋত্বিক ঘটককে বুঝতে পারেন না।
শোক দুঃখ ভুলে গিয়ে তিনি আবার চেষ্টা করলেন আর একটা ছবি তৈরি করার। অনেক কাঠ খর পোড়ানোর পর তার এক দুঃসম্পর্কের দিদির সুবাদে সামান্য কিছু টাকা পাওয়া গেল। সেই টাকা দিয়ে তৈরি হলো অযান্ত্রিক। আজকের দিনে কেউ ভাবতেই পারবে না যে কতটা কৃচ্ছ্ব সাধন করে সে সময় একটা ছবি তৈরি করা হতো। দুবেলা মাংস ভাত দূরের কথা, অনেক সময় এক বেলা মুড়ি চিবিয়ে কিংবা শুকনো রুটি খেয়ে ,একবেলা নিরামিষ ভাত ইউনিটের সবাই মিলে আনন্দ করে খাওয়া দাওয়া হতো। সব সময় শুটিংয়ের জন্য ট্রলি, ক্রেন ব্যবহার করবার কোন সুযোগ ছিল না। কারণ বাজেট নেই। আউটডোর শুটিংয়ে গিয়ে অত্যন্ত সাধারণ মানের হোটেল কিংবা বাড়ি ভাড়া নিয়ে একটা দুটো ঘরে ইউনিটের সবাই মিলে কুকুর কুন্ডলী হয়ে রাত কাটাতে হতো। ফিল্মের র-স্টক জোগাড় করা ছিল আরো মুশকিল।
এই সময় বিদেশ থেকে এলেন একজন সিনেমা বিশেষজ্ঞ, গবেষক, সাংবাদিক মারি সিটন। অযান্ত্রিক দেখে তিনি চমকে গেলেন। টালিগঞ্জের মত একটি ঝরঝরে প্রাগৈতিহাসিক যুগের যন্ত্রপাতি নিয়ে কিভাবে অযান্ত্রিকের মত ছবি তৈরি হল এটা ভেবে থৈ কুল পাচ্ছিলেন না। এই মহিলা ছবিটাকে ইউরোপে নিয়ে গেলেন। এই মহিলার জন্য ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে ইউরোপের চলচ্চিত্র জগতে পরিচয় ঘটলো। অথচ তখন কলকাতার সিনেমা হলে অযান্ত্রিক মুক্তি পাওয়া সত্ত্বেও কোন দর্শক পাওয়া যাচ্ছিল না। এমনই একদিন হাতিবাগানের সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। একথা সেকথার পর তিনি বললেন, আমি মরলে হয়তো বাঙালি আমার ছবি দেখবার জন্য হলে আসবে।
না। আজও তার ছবি দেখবার জন্য কেউ হল মুখো হয় না। তাছাড়া বাংলার সিনেমা হলে তার মৃত্যুর পর কখনো কোনদিন মর্যাদার সঙ্গে তার ছবি দেখানো হয় নি। কালে ভদ্রে হয়তো কোন ফিল্ম সোসাইটির সদস্যরা কিংবা অন্য কোন সংগঠন তার ছবির রেট্রো স্পেক্টিভ করেছেন। তার বাইরে তেমন কিছু হয়নি।
এখন প্রশ্ন হল, কেন হলো না? পরিবেশক এবং হল মালিকরা বলবেন, ঘটক বাবুর ছবি জনপ্রিয় ছিল না। আজও সাধারণ মানুষের কাছে ওইসব ছবির কোন চাহিদা নেই। কথাটা কিন্তু একেবারে মিথ্যে নয়। অযান্ত্রিক, কোমল গান্ধার, সুবর্ণরেখা , তিতাস একটি নদীর নাম যখন নির্মিত হয়েছিল, ওই ছবিগুলোর ভাষা, বিষয়বস্তুর রস গ্রহণ করবার জন্য বাঙালি দর্শক প্রস্তুত ছিল না। নবারুণ ভট্টাচার্য বলছেন, বাঙালি বুঝতে পারল না যে এই মানুষটা সিনেমার নতুন ব্যাকরণ তৈরি করছেন। পুরনো ব্যাকরণ ভাঙছে ন । ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ বদলে ফেলছেন। এটাই তো একজন সৃষ্টিশীল মানুষের কাজ।
হ্যাঁ। সত্যজিৎ রায় বলছেন, আমি যেমন হলিউডের সিনেমা দেখে প্রভাবিত হয়েছি, ঋত্বিক সেভাবে হলিউডকে গ্রহণ করেন নি। তিনি ছিলেন ইউরোপের চলচ্চিত্রের ভক্ত। অন্যদিকে আমার চেয়ে অনেক বেশি বাঙালি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তার শিল্প রচনায়। এইখানেই তো ঋত্বিক বাবুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। থিয়েটার ও সিনেমার মতো বিদেশি মাধ্যমের মধ্যেও তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ দেশজ ভাবনার শিল্পী। তার সিনেমা এবং থিয়েটারে বারবার আরকিটাইপাল চরিত্র রচিত হয়। তিনি মনে করতেন, শিল্পের বিষয় হবে আন্তর্জাতিক। আঙ্গিক হবে বিশুদ্ধ লোকজ। তাই তার শিল্পে— বাংলার লোকজ শিল্পের ঐতিহ্য ছড়ানো থাকে। গল্পের নায়িকাদের নাম হয় উমা, সীতা, বঙ্গবালা, শকুন্তলা।
তিনি ফেলে আসা ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকেন। ঋত্বিক ঘটকের অন্যতম সহকারী পরিচালক সত্যব্রত চট্টোপাধ্যায়ের মুখে শুনেছি মেঘে ঢাকা তারা ছবির জন্য চিত্রনাট্য লেখার কাজ যেদিন শেষ হয়েছিল, সেদিন নাকি শক্তিপদ রাজগুরুর ওই উপন্যাসটাকে নিতান্ত ফালতু মাল বলে বইটা সরিয়ে রেখেছিলেন। তারপর যখন তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাহলে আপনি এই বইটাকে ছবি করার জন্য বেছে ছিলেন কেন ? তার উত্তরে ঘটকবাবু বলেছিলেন, হাস যেমন
পাকের মধ্য থেকে ক্ষীরটুকু তুলে নেয় আমিও সেইভাবে তুলে নিয়েছি। আমার ছবিটা মুক্তি পাওয়ার পর দেখবি এই ছবিটা দেখার জন্য মানুষ টিকিট কাটবে। তোদের শক্তিপদ রাজগুরুও বইটার পরবর্তী এডিশনে পুরনো নামটা বদলে মেঘে ঢাকা তারা নামটা রাখবে।
হ্যাঁ। ঋত্বিক ঘটকের জীবনে এই একটি মাত্র সিনেমা যা দেখার জন্য আজকের দর্শকও অপেক্ষা করে থাকে। তাহলে দ্বিতীয়বার তিনি এইরকম আর কোন সিনেমা নির্মাণ করার কথা ভাবলেন না কেন? এখানেও একজন শিল্পীর যথার্থ চরিত্র লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। যদিও তিনি সারা জীবন নাটকে এবং সিনেমায় দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে নিজে রক্তাক্ত হয়েছেন আমাদের রক্তাক্ত করেছেন। শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি দুই বাংলার পুনরায় মিলনের স্বপ্ন দেখে গেছেন। একটু গভীর দৃষ্টি নিয়ে তার শিল্পকর্মগুলোকে বোঝার চেষ্টা করলে দেখা যাবে , স্বাধীনতা পরবর্তী নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনের লড়াইয়ের কথাও বলেছেন। প্রথম ছবি নাগরিকের নায়কের ভ্রান্ত ধারণার প্রতি বিদ্রুপ করে বলেছেন , অর্থনৈতিকভাবে তুমি উপরের দিকের শ্রেণীতে উঠে আসবার স্বপ্ন দেখলেও ঐতিহাসিক কারণেই তোমাকে নিচের দিকে নেমে যেতে হবে। কারণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা এলেও দেশের মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসে নি।
বাড়ি থেকে পালিয়ে ছবিতে বাবার হাতে মার খেয়ে কলকাতা শহরে পালিয়ে আসা কিশোরকে একজন ফেরিওয়ালা বলছে, এর নাম কলকাতা। এখানে সবাই লড়াই করে বাঁচতে আসে। তুমি এখনো ছোট আছো। তোমাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। লড়াই করবার রসদ সংগ্রহ করার জন্য। সুবর্ণরেখা ছবিতে আদর্শবাদী নায়ক ঈশ্বর একদিন যে কিশোরটিকে বাগদির ছেলে জানা সত্বেও তাকে আশ্রয় দিয়েছিল, নিজের বোনের সঙ্গে মানুষ করে তুলেছিল। সেই আদর্শবাদী নায়ক কারখানার মালিকের হিন্দুত্ববাদী মনোভাবের পরিচয় পেয়ে সেই বাগদির ছেলেকে বর্জন করতে দ্বিধা করে নি। কারণ হিন্দু মহাসভার অনুগামী অ বাঙালি মালিক যে তাকে দু আনার শেয়ার অফার করেছে।
সুবর্ণরেখা ছবির অন্তিমে দেখা যায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ঈশ্বরের নৈতিক অধঃপতনের চেহারাটা। মূল্যবোধহীন ঈশ্বর কলকাতার বার গুলোতে ঢুকে রাতের পর রাত কাটিয়ে দিচ্ছেন। তারপর একদিন রাতে পতিতালয় যাচ্ছেন। এবং তার নিজের বোনের মুখোমুখি হন। এই ছবিতেই ঋত্বিক বাবু সুবিধাবাদী, ধান্দাবাজ, হৃদয়হীন মধ্যবিত্ত সমাজের পিঠে যেভাবে চাবুক মেরেছেন সেটা আমরা কি সহ্য করতে পেরেছি ? এই কারণেই তো ঋত্বিকের বিরুদ্ধে আমাদের এত উস্মা। ঋত্বিকের বিশৃঙ্খল জীবন নিয়ে এত চেঁচামেচি। মেঘে ঢাকা তারা ছবিতে বিজন ভট্টাচার্যের মুখে সেই সংলাপটা মনে আছে? ছিন্নমূল একটি পরিবারের ভরণপোষণের যাবতীয় দায়িত্ব যে মেয়েটি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। যার প্রেমিক তার সঙ্গে প্রতারণা করলো। সংসারে কেউ তাকে বোঝার চেষ্টা করল না। মুখে রক্ত তুলে লড়াই করতে করতে যে মেয়েটা যক্ষা রোগে আক্রান্ত হল। সেই মেয়েটাকে তার বাবা বলছে, তুই চইলা যা। চইলা যা।
এই সংসারে কেউ তোরে চায় না। শেষ পর্যন্ত মেয়েটা বাঁচার আকুতি নিয়ে আর্তনাদ করে বলে, আমি বাঁচতে চাই দাদা। আমি বাঁচতে চাই। কিন্তু কে বাঁচাবে তাকে? অধঃপতিত, নিষ্ঠুর , ধান্দাবাজ এইসব মধ্যবিত্ত পরিবার ?
সুবর্ণরেখা ছবিতে পতিতা পল্লীর যে দৃশ্য নিয়ে সে সময় পত্র-পত্রিকায় সমালোচনার ঝড় উঠেছিল মনে রাখতে হবে ৭০এর দশকে রাগী বিক্ষুব্ধ সত্যজিৎ রায়ের জন অরণ্য ছবিতেও ঐরকম একটি মেলো ড্রামাটিক বিশ্ব রচনা করেছিলেন বিশ্ব বরেণ্য স্রষ্টা। সীমাবদ্ধ, প্রতিদ্বন্দ্বী, অরণ্যের দিনরাত্রি ছবিগুলোতে সত্যজিৎ রায় একইভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মূল্যবোধ হীনতার ছবি এঁকেছেন সত্যজিৎ রায়। শেষের দিকে শাখা প্রশাখা, আগন্তুক ছবিতেও তিনি অনেক বেশি ঘৃণা প্রকাশ করেছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতি।
এই কারণেই এই শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা সত্যজিৎ বিমুখ হয়ে উঠেছিলেন। অনেকেই ঘোষণা করেছিলেন চারুলতার পর সত্যজিতের মৃত্যু ঘটে গেছে। বিশ্ব সাহিত্যে মোপাশা, চেখভ, ও হেনরির মত আমাদের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পিঠে চাবুক মারতে মারতে এই শ্রেণীর কুৎসিত কঙ্কালের যে ছবি এঁকেছেন তাদের সাহিত্যে —-সেই সাহিত্য কি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়? ইতিহাস তো বারবার দেখিয়ে যায় যে, এইসব মধ্যবিত্ত শ্রেণীগুলো সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখলেও, বিপ্লবের আয়োজন করবার পর প্রতি বিপ্লবীদের মিছিলে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। যেমনটা ঘটেছিল ফরাসি দেশে প্যরি কমিউন এর পতনের সময় থেকে। ঠিক একই কারণে বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে আমরা ক্রুদ্ধ হইতিনি কেন মাতাল , বিশৃঙ্খল, বেহিসেবি মাইকেল মধুসূদনকে অর্থ সাহায্য করতেন। আমাদের কাছে মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য তুচ্ছ হয়ে যায়। শরৎ সাহিত্যেও এই শ্রেণীর বিরুদ্ধে কষাঘাত দেখতে পাওয়া যায়। তিনি লিখছেন, কাঁধে গামছা নিয়ে যখন গ্রামের পর গ্রাম ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে ঘুরে বেড়াতাম তখন যারা আমার পেছনে কুকুর লেলিয়ে দিত তারা সব ভদ্রলোক। আর যারা আমাকে আশ্রয় দিত তারা হল নিচু তলার দুলে বাগদি সম্প্রদায়। হয়তো এই কারণেই শরৎ বাবুকে চরিত্রহীন বলে ভদ্রলোকেরা আত্মপ্রসাদ লাভ করত। আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ক্ষেপে গিয়ে বিদ্যাসাগর মশাই সাঁওতাল পরগনায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের অযান্ত্রিক ছবিতে আমরা দেখি সাঁওতাল ওরাও মুন্ডাদের
জীবনে জীবন যোগ করার লড়াইয়ের ছবি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে বর্ণ প্রথার প্রচারক ব্রাহ্মণদের হাতে চৈতন্যদেবের খুন হবার পেছনেও ছিল এই একই উদ্দেশ্য। চৈতন্যদেবের মিছিলে যারা জড়ো হতো তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল সমাজে অচ্ছূৎ শূদ্র জনগোষ্ঠী।
ঋত্বিক ঘটকের শিল্পকর্ম আমাদের কাছে আয়নার মতো। যে আয়নায় আমাদের ভন্ডামি, বদমাইশি, ধান্দাবাজির ছবি ফুটে ওঠে। ভারতীয় সিনেমার ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর সত্যজিৎ ঋত্বিক মৃণাল সেনকে আমরা কেন যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নষ্ট বিবেক আর অধঃপতনের আয়না বলতে পারি না তার রহস্য এইসব মহান শিল্পীদের সৃষ্টির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে।